স্যান্ডউইচ ছাড়া—আর যাই পাওয়া যায় তাই খাব।
রুম সার্ভিসকে জিজ্ঞেস করে দেখি।
আমেরিকায় এখন কটা বাজে বাবা?
ঠিক বলতে পারছি না—সকাল আটটা-নটা হবে। মার সঙ্গে কি কথা বলতে ইচ্ছা করছে?
পলিন হ্যাঁ না কিছুই বলল না। মির্জা সাহেব বললেন, দাঁড়াও একটু খোঁজ করছি, ডিরেক্ট ডায়ালিং কি-না তাও তো জানি না।
জানা গেল ডিরেক্ট ডায়ালিং। দ্বিতীয় বার ডায়াল ঘুরাবামাত্র পাওয়া গেল। মির্জা সাহেব মেয়েকে কথা বলার সুযোগ দেবার জন্যে বাইরে চলে গেলেন। বলে গেলেন, সিগারেট শেষ হয়ে গেছে মা, সিগারেট কেনার জন্যে যাচ্ছি।
পলিন কোমল গলায় বলল, কেমন আছ মা?
পলিনের মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমি কেমন আছি তা মমাটেই জরুরি নয়। তুমি কেমন আছ?
ভালো।
ভালো থাকার তো কথা না। নিশ্চয়ই শরীর খারাপ করেছে। ঘর থেকে বেরুলেই তোমার শরীর খারাপ করে। সব জেনে শুনেও তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এত দূরে গিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখি মানুষটা মূর্খ হচ্ছে।
আমি ভালো আছি মা।
বাজে কথা বলবে না। আমি তোমার গলা শুনেই বুঝতে পারছি। তোমার শরীর বল সত্যি করে-জ্বর আসে নি?
এসেছিল। এখন ভালো। তুমি ফিরে আসা মাত্র আমি যা করব তা হচ্ছে তোমাকে আমার কাস্টডিতে নিয়ে আসা। পিটার খুবই বদমেজাজী কিন্তু সে তোমার বাবার মতো অবিবেচক নয়। অভিভাবক হিসেবে তোমার বাবার চেয়ে সে ভালো হবে।
আমি বাবার সঙ্গেই ভালো আছি।
তুমি মোটেও ভালো নেই। এই তো কাশির শব্দ শুনছি। তোমার কি কাশিও হয়েছে?
মির্জা সাহেব সিগারেটের জন্যে যান নি। দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হোটেলটার একুয়াষ্টিকস ভালো। দরজা সামান্য খোলা তবুও কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তিনি হোটেলের লবিতে নেমে এলেন।
পকেটে সিগারেট নেই। এক প্যাকেট সিগারেট পেলে ভালো হত। এখানে ভেন্ডিং মেশিন জাতীয় কিছু নেই। বারে নিশ্চয়ই সিগারেট পাওয়া যাবে। বার কোথায় কে জানে? কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না।
লবি থেকে সদর দরজা ঠেলে তিনি হোটেলের বাইরে পা রাখলেন। দারোয়ান যথারীতি স্যালুট দিল।
আশে পাশে ছোটখাটো দোকানপাট আছে? যেখানে পান সিগারেট বিক্রি হয়।
সিগারেট হোটেলে পাবেন স্যার।
পান? পান নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না?
জ্বি না।
দেখি কিছু পাওয়া যায় কি-না।
ট্যাক্সি ডেকে দিব।
না, ট্যাক্সি লাগবে না।
সন্ধ্যায় যে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। ভেজা রাস্তার এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। পানিতে চাঁদের ছবি। চমৎকার দৃশ্য। তাঁর মনে হল, এক শহরের চাঁদের সঙ্গে অন্য শহরের চাঁদের কিছু মিল নেই।
হাঁটতে চমৎকার লাগছে। রাস্তা ফাঁকা। মাঝেমাঝে দ্রুত গতিতে কিছু গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। রাত বারটা এখনো বাজে নি। ঝড়-বৃষ্টি হবার কারণেই হয়ত রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। রাস্তাঘাট একই সঙ্গে পরিচিত এবং অপরিচিত লাগছে। একবার মনে হচ্ছে তিনি নিতান্তই অচেনা একটা শহরে আছেন। পরমুহূর্তেই মনে হল তাঁর সারাজীবন এই শহরেই কেটেছে।
তিনি গুনগুন করে গানের কিছু কলি বলছেন। যার প্রথম লাইন–প্রজাপতি প্রজাপতি রে।…
স্টেডিয়ামের রেস্টুরেন্ট
স্টেডিয়ামের যে রেস্টুরেন্টে আলম এবং মজিদ বসে আছে সেখানেও আলো নেই। ক্যাশিয়ারের টেবিলে একটি মাত্র ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলছে। আর একটি মামবাতি জ্বলছে হাত দেয়ার জায়গায়। বাইরের ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলেও ইলেকট্রিসিটি এখনো আসে নি। রেস্টুরেন্টের সামান্য আলোতেও খাওয়া-দাওয়া চলছে। মজিদ দু প্লেট বিরিয়ানি এবং ঠাণ্ডা পেপসির অর্ডার দিয়েছে। আলম বলল, টাকা কোথায় পেলি?
মজিদ গম্ভীর গলায় বলল, রিচু করেছি।
রিচু করেছিস মানে?
চুরি করেছি। ফুপার একটা আটার বস্তা বেচে দিয়েছি।
বলিস কি।
চিনির বস্তা মনে করে ঝেড়ে দিয়েছিলাম, অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারি নি। শেষে দেখি শালা আটার বস্তা। গ্রেট লস।
ধরতে পারে নি।
পারবে না কেন? ধরেছে।
আলম চিন্তিত মুখে বলল, তোকে কিছু বলল না?
না। কোলে নিয়ে আদর করেছে। গালে চুমু খেয়েছে।
তাদের খাওয়া শেষ হবার আগেই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। মজিদ বিরিয়ানির সঙ্গে রেজালার অর্ডার দিল।
আলম বলল, তোর পায়ের ব্যথাটা কি কমেছে।
মজিদ বলল, ছেমেক, ছেমেক।
আবার উল্টো করে বলছিস, শালা চড় খাবি কিন্ত।
মজিদ ভুরু কুঁচকে ফেলেছে হঠাৎ চিন-চিনে ব্যথা হচ্ছে।
আলম বলল, এই এরকম করছিস কেন?
কী রকম করছি?
মুখ-টুখ কুঁচকে বসে আছিস। ব্যথা হচ্ছে?
হুঁ।
ডাক্তার-টাক্তার দেখানো দরকার। সেপটিক-ফেপটিক হয়ে গেছে কি-না কে জানে।
মজিদ বিরক্ত স্বরে বলল, খাওয়া শুরু কর। বিরিয়ানি খেতে হয় গরম গরম। এই যে ভাইয়া, ঝাল দেখে কাঁচা মরিচ দিতে পারেন? কী কাঁচা মরিচ দিয়েছেন খেতে মিষ্টি আলুর মতো লাগছে।
তারা সেক্রেটারিয়েটের সামনে দিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে এগুচ্ছে। দুজনের হাতে দুটা সিগারেট। মজিদ সিগারেট খায় না। একেকটা টান দিচ্ছে আর খুক-খুক করছে। প্রোটিন হাউজ পার হয়ে তারা চায়নিজ রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি চলে এল। আর তখন আলম খুশি খুশি গলায় বলল, মাহিন শালাকে পাওয়া গেছে। শালার কারবারটা দেখ না।
মাহিন অদ্ভুত কিছুই করছে না। একটা সেলুনে চুল কাটাচ্ছে। চুল কাটানো হয়ে গেছে। নাপিত এখন মাথা মালিশ করছে। আরামে মাহিনের চোখ বন্ধ হয়ে আছে।