গোরা ০১

শ্রাবণ মাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মল রৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই, ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে, যাহারা আপিসে কালেজে আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায় বাসায় মাছ-তরকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁওয়া উঠিয়াছে–কিন্তু তবু এত বড়ো এই-যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শত শত রাস্তা এবং গলির ভিতরে সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে।

এমন দিনে বিনা-কাজের অবকাশে বিনয়ভূষণ তাহার বাসার দোতলার বারান্দায় একলা দাঁড়াইয়া রাস্তায় জনতার চলাচল দেখিতেছিল। কালেজের পড়াও অনেক দিন চুকিয়া গেছে, অথচ সংসারের মধ্যেও প্রবেশ করে নাই, বিনয়ের অবস্থাটা এইরূপ। সভাসমিতি চালানো এবং খবরের কাগজ লেখায় মন দিয়াছে– কিন্তু তাহাতে সব মনটা ভরিয়া উঠে নাই। অন্তত আজ সকালবেলায় কী করিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। পাশের বাড়ির ছাতের উপরে গোটা-তিনেক কাক কী লইয়া ডাকাডাকি করিতেছিল এবং চড়ুই-দম্পতি তাহার বারান্দার এক কোণে বাসা-নির্মাণ-ব্যাপারে পরস্পরকে কিচিমিচি শব্দে উৎসাহ দিতেছিল– সেই সমস্ত অব্যক্ত কাকলি বিনয়ের মনের মধ্যে একটা কোন্‌ অস্পষ্ট ভাবাবেগকে জাগাইয়া তুলিতেছিল।

আলখাল্লা-পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল–

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়

বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল বাউলকে ডাকিয়া এই অচিন পাখির গানটা লিখিয়া লয়, কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত-শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ঐ অচেনা পাখির সুরটা মনের মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ করিতে লাগিল।

এমন সময় ঠিক তাহার বাসার সামনেই একটা ঠিকাগাড়ির উপরে একটা মস্ত জুড়িগাড়ি আসিয়া পড়িল এবং ঠিকাগাড়ির একটা চাকা ভাঙিয়া দিয়া দৃকপাত না করিয়া বেগে চলিয়া গেল। ঠিকাগাড়িটা সম্পূর্ণ উল্‌টাইয়া না পড়িয়া এক পাশে কাত হইয়া পড়িল।

বিনয় তাড়াতাড়ি রাস্তায় বাহির হইয়া দেখিল গাড়ি হইতে একটি সতেরো-আঠারো বৎসরের মেয়ে নামিয়া পড়িয়াছে, এবং ভিতর হইতে একজন বৃদ্ধগোছের ভদ্রলোক নামিবার উপক্রম করিতেছেন।

বিনয় তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া নামাইয়া দিল, এবং তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেছে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার লাগে নি তো?”

তিনি “না, কিছু হয় নি” বলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিলেন, সে হাসি তখনই মিলাইয়া গেল এবং তিনি মূর্ছিত হইয়া পড়িবার উপক্রম করিলেন। বিনয় তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল ও উৎকণ্ঠিত মেয়েটিকে কহিল, “এই সামনেই আমার বাড়ি; ভিতরে চলুন।”

বৃদ্ধকে বিছানায় শোওয়ানো হইলে মেয়েটি চারি দিকে তাকাইয়া দেখিল ঘরের কোণে একটি জলের কুঁজা আছে। তখনই সেই কুঁজার জল গেলাসে করিয়া লইয়া বৃদ্ধের মুখে ছিটা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল এবং বিনয়কে কহিল, “একজন ডাক্তার ডাকলে হয় না?”

বাড়ির কাছেই ডাক্তার ছিল। বিনয় তাঁহাকে ডাকিয়া আনিতে বেহারা পাঠাইয়া দিল।

ঘরের এক পাশে টেবিলের উপরে একটা আয়না, তেলের শিশি ও চুল আঁচড়াইবার সরঞ্জাম ছিল। বিনয় সেই মেয়েটির পিছনে দাঁড়াইয়া সেই আয়নার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

বিনয় ছেলেবেলা হইতেই কলিকাতার বাসায় থাকিয়া পড়াশুনা করিয়াছে। সংসারের সঙ্গে তাহার যাহা-কিছু পরিচয় সে-সমস্তই বইয়ের ভিতর দিয়া। নিঃসম্পর্কীয়া ভদ্রস্ত্রীলোকের সঙ্গে তাহার কোনোদিন কোনো পরিচয় হয় নাই।

আয়নার দিকে চাহিয়া দেখিল, যে মুখের ছায়া পড়িয়াছে সে কী সুন্দর মুখ! মুখের প্রত্যেক রেখা আলাদা করিয়া দেখিবার মতো তাহার চোখের অভিজ্ঞতা ছিল না। কেবল সেই উদ্‌বিগ্ন স্নেহে আনত তরুণ মুখের কোমলতামণ্ডিত উজ্জ্বলতা বিনয়ের চোখে সৃষ্টির সদ্যঃপ্রকাশিত একটি নূতন বিস্ময়ের মতো ঠেকিল।

একটু পরে বৃদ্ধ অল্পে অল্পে চক্ষু মেলিয়া “মা” বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। মেয়েটি তখন দুই চক্ষু ছলছল করিয়া বৃদ্ধের মুখের কাছে মুখ নিচু করিয়া আর্দ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তোমার কোথায় লেগেছে?”

“এ আমি কোথায় এসেছি” বলিয়া বৃদ্ধ উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিতেই বিনয় সম্মুখে আসিয়া কহিল, “উঠবেন না– একটু বিশ্রাম করুন, ডাক্তার আসছে।”

তখন তাঁহার সব কথা মনে পড়িল ও তিনি কহিলেন, “মাথার এইখানটায় একটু বেদনা বোধ হচ্ছে, কিন্তু গুরুতর কিছুই নয়।”

সেই মুহূর্তেই ডাক্তার জুতা মচ্‌ মচ্‌ করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তিনিও বলিলেন, “বিশেষ কিছুই নয়।” একটু গরম দুধ দিয়া অল্প ব্রাণ্ডি খাইবার ব্যবস্থা করিয়া ডাক্তার চলিয়া যাইতেই বৃদ্ধ অত্যন্ত সংকুচিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার মেয়ে তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “বাবা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ডাক্তারের ভিজিট ও ওষুধের দাম বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেব।”

বলিয়া সে বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল।

সে কী আশ্চর্য চক্ষু! সে চক্ষু বড়ো কি ছোটো, কালো কি কটা সে তর্ক মনেই আসে না– প্রথম নজরেই মনে হয়, এই দৃষ্টির একটা অসন্দিগ্ধ প্রভাব আছে। তাহাতে সংকোচ নাই, দ্বিধা নাই, তাহা একটা স্থির শক্তিতে পূর্ণ।

বিনয় বলিতে চেষ্টা করিল, “ভিজিট অতি সামান্য, সেজন্যে– সে আপনারা– সে আমি–”

মেয়েটি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকাতে কথাটা ঠিকমত শেষ করিতেই পারিল না। কিন্তু ভিজিটের টাকাটা যে তাহাকে লইতেই হইবে সে সম্বন্ধে কোনো সংশয় রহিল না।

বৃদ্ধ কহিলেন, “দেখুন, আমার জন্যে ব্রাণ্ডির দরকার নেই–”

কন্যা তাঁহাকে বাধা দিয়া কহিল, “কেন বাবা, ডাক্তারবাবু যে বলে গেলেন।”

বৃদ্ধ কহিলেন, “ডাক্তাররা অমন বলে থাকে, ওটা ওদের একটা কুসংস্কার। আমার যেটুকু দুর্বলতা আছে একটু গরম দুধ খেলেই যাবে।”

দুধ খাইয়া বল পাইলে বৃদ্ধ বিনয়কে কহিলেন, “এবারে আমরা যাই। আপনাকে বড়ো কষ্ট দিলুম।”

মেয়েটি বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “একটা গাড়ি–”

বৃদ্ধ সংকুচিত হইয়া কহিলেন, “আবার কেন ওঁকে ব্যস্ত করা? আমাদের বাসা তো কাছেই, এটুকু হেঁটেই যাব।”

মেয়েটি বলিল, “না বাবা, সে হতে পারে না।”

বৃদ্ধ ইহার উপর কোনো কথা কহিলেন না এবং বিনয় নিজে গিয়া গাড়ি ডাকিয়া আনিল। গাড়িতে উঠিবার পূর্বে বৃদ্ধ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার নামটি কী?”

বিনয়। আমার নাম বিনয়ভূষণ চট্টোপাধ্যায়।

বৃদ্ধ কহিলেন, “আমার নাম পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। নিকটেই ৭৮ নম্বর বাড়িতে থাকি। কখনো অবকাশমত যদি আমাদের ওখানে যান তো বড়ো খুশি হব।”

মেয়েটি বিনয়ের মুখের দিকে দুই চোখ তুলিয়া নীরবে এই অনুরোধের সমর্থন করিল। বিনয় তখনই সেই গাড়িতে উঠিয়া তাঁহাদের বাড়িতে যাইতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সেটা ঠিক শিষ্টাচার হইবে কি না ভাবিয়া না পাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। গাড়ি ছাড়িবার সময় মেয়েটি বিনয়কে ছোটো একটি নমস্কার করিল। এই নমস্কারের জন্য বিনয় একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, এইজন্য হতবুদ্ধি হইয়া সে প্রতিনমস্কার করিতে পারিল না। এইটুকু ত্রুটি লইয়া বাড়িতে ফিরিয়া সে নিজেকে বার বার ধিক্‌কার দিতে লাগিল। ইঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতে বিদায় হওয়া পর্যন্ত নিজের আচরণ সমস্তটা আলোচনা করিয়া দেখিল; মনে হইল, আগাগোড়া তাহার সমস্ত ব্যবহারেই অসভ্যতা প্রকাশ পাইয়াছে। কোন্‌ কোন্‌ সময়ে কী করা উচিত ছিল, কী বলা উচিত ছিল, তাহা লইয়া মনে মনে কেবলই বৃথা আন্দোলন করিতে লাগিল। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, যে রুমাল দিয়া মেয়েটি তাহার বাপের মুখ মুছাইয়া দিয়াছিল সেই রুমালটি বিছানার উপর পড়িয়া আছে– সেটা তাড়াতাড়ি তুলিয়া লইল। তাহার মনের মধ্যে বাউলের সুরে ঐ গানটা বাজিতে লাগিল–

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।

বেলা বাড়িয়া চলিল, বর্ষার রৌদ্র প্রখর হইয়া উঠিল, গাড়ির স্রোত আপিসের দিকে বেগে ছুটিতে লাগিল, বিনয় তাহার দিনের কোনো কাজেই মন দিতে পারিল না। এমন অপূর্ব আনন্দের সঙ্গে এমন নিবিড় বেদনা তাহার বয়সে কখনো সে ভোগ করে নাই। তাহার এই ক্ষুদ্র বাসা এবং চারি দিকের কুৎসিত কলিকাতা মায়াপুরীর মতো হইয়া উঠিল; যে রাজ্যে অসম্ভব সম্ভব হয়, অসাধ্য সিদ্ধ হয় এবং অপরূপ রূপ লইয়া দেখা দেয়, বিনয় যেন সেই নিয়ম-ছাড়া রাজ্যে ফিরিতেছে। এই বর্ষাপ্রভাতের রৌদ্রের দীপ্ত আভা তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হইল, তাহার অন্তঃকরণের সম্মুখে একটা জ্যোতির্ময় যবনিকার মতো পড়িয়া প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত তুচ্ছতাকে একেবারে আড়াল করিয়া দিল। বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল নিজের পরিপূর্ণতাকে আশ্চর্যরূপে প্রকাশ করিয়া দেয়, কিন্তু তাহার কোনো উপায় না পাইয়া তাহার চিত্ত পীড়িত হইতে লাগিল। অত্যন্ত সামান্য লোকের মতোই সে আপনার পরিচয় দিয়াছে– তাহার বাসাটা অত্যন্ত তুচ্ছ, জিনিসপত্র নিতান্ত এলোমেলো, বিছানাটা পরিষ্কার নয়, কোনো-কোনো দিন তাহার ঘরে সে ফুলের তোড়া সাজাইয়া রাখে, কিন্তু এমনি দুর্ভাগ্য– সেদিন তাহার ঘরে একটা ফুলের পাপড়িও ছিল না। সকলেই বলে বিনয় সভাস্থলে মুখে মুখে যেরূপ সুন্দর বক্তৃতা করিতে পারে কালে সে একজন মস্ত বক্তা হইয়া উঠিবে, কিন্তু সেদিন সে এমন একটা কথাও বলে নাই যাহাতে তাহার বুদ্ধির কিছুমাত্র প্রমাণ হয়। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, “যদি এমন হইতে পারিত যে সেই বড়ো গাড়িটা যখন তাঁহাদের গাড়ির উপর আসিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে আমি বিদ্যুদ্‌বেগে রাস্তার মাঝখানে আসিয়া অতি অনায়াসে সেই উদ্দাম জুড়িঘোড়ার লাগাম ধরিয়া থামাইয়া দিতাম!’ নিজের সেই কাল্পনিক বিক্রমের ছবি যখন তাহার মনের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিল তখন একবার আয়নায় নিজের চেহারা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না।

এমন সময় দেখিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে রাস্তায় দাঁড়াইয়া তাহার বাড়ির নম্বর দেখিতেছে। বিনয় উপর হইতে বলিল, “এই-যে, এই বাড়িই বটে।” ছেলেটি যে তাহারই বাড়ির নম্বর খুঁজিতেছিল সে সম্বন্ধে তাহার মনে সন্দেহমাত্র হয় নাই। তাড়াতাড়ি বিনয় সিঁড়ির উপর চটিজুতা চট্‌ চট্‌ করিতে করিতে নীচে নামিয়া গেল– অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটিকে ঘরের মধ্যে লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল।

সে কহিল, “দিদি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

এই বলিয়া বিনয়ভূষণের হাতে এক পত্র দিল।

বিনয় চিঠিখানা লইয়া প্রথমে লেফাফার উপরটাতে দেখিল, পরিষ্কার মেয়েলি ছাঁদের ইংরেজি অক্ষরে তাহার নাম লেখা। ভিতরে চিঠিপত্র কিছুই নাই, কেবলই কয়েকটি টাকা আছে।

ছেলেটি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই বিনয় তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িয়া দিল না। তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে দোতলার ঘরে লইয়া গেল।

ছেলেটির রঙ তাহার দিদির চেয়ে কালো, কিন্তু মুখের ছাঁদে কতকটা সাদৃশ্য আছে। তাহাকে দেখিয়া বিনয়ের মনে ভারি একটা স্নেহ এবং আনন্দ জন্মিল।

ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ। সে ঘরে ঢুকিয়া দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “এ কার ছবি?”

বিনয় কহিল, “এ আমার একজন বন্ধুর ছবি।”

ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিল, “বন্ধুর ছবি? আপনার বন্ধু কে?”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “তুমি তাঁকে চিনবে না। আমার বন্ধু গৌরমোহন, তাঁকে গোরা বলি। আমরা ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে পড়েছি।”

“এখনো পড়েন?”

“না, এখন আর পড়ি নে।”

“আপনার স–ব পড়া হয়ে গেছে?”

বিনয় এই ছোটো ছেলেটির কাছেও গর্ব করিবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে না পারিয়া কহিল, “হাঁ সব পড়া হয়ে গেছে।”

ছেলেটি বিস্মিত হইয়া একটু নিশ্বাস ফেলিল। সে বোধ হয় ভাবিল, এত বিদ্যা সেও কত দিনে শেষ করিতে পারিবে।

বিনয়। তোমার নাম কী?

“আমার নাম শ্রীসতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।”

বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “মুখোপাধ্যায়?”

তাহার পরে একটু একটু করিয়া পরিচয় পাওয়া গেল। পরেশবাবু ইহাদের পিতা নহেন– তিনি ইহাদের দুই ভাইবোনকে ছেলেবেলা হইতে পালন করিয়াছেন। ইহার দিদির নাম আগে ছিল রাধারানী– পরেশবাবুর স্ত্রী তাহা পরিবর্তন করিয়া “সুচরিতা’ নাম রাখিয়াছেন।

দেখিতে দেখিতে বিনয়ের সঙ্গে সতীশের খুব ভাব হইয়া গেল। সতীশ যখন বাড়ি যাইতে উদ্যত হইল বিনয় কহিল, “তুমি একলা যেতে পারবে?”

সে গর্ব করিয়া কহিল, “আমি তো একলা যাই!”

বিনয় কহিল, “আমি তোমাকে পৌঁছে দিই গে।”

তাহার শক্তির প্রতি বিনয়ের এই সন্দেহ দেখিয়া সতীশ ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, “কেন, আমি তো একলা যেতে পারি।” এই বলিয়া তাহার একলা যাতায়াতের অনেকগুলি বিস্ময়কর দৃষ্টান্তের সে উল্লেখ করিতে লাগিল। কিন্তু তবু যে বিনয় কেন তাহার বাড়ির দ্বার পর্যন্ত তাহার সঙ্গে গেল তাহার ঠিক কারণটি বালক বুঝিতে পারিল না।

সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি ভিতরে আসবেন না?”

বিনয় সমস্ত মনকে দমন করিয়া কহিল, “আর-এক দিন আসব।”

বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া বিনয় সেই শিরোনামা-লেখা লেফাফা পকেট হইতে বাহির করিয়া অনেকক্ষণ দেখিল– প্রত্যেক অক্ষরের টান ও ছাঁদ একরকম মুখস্থ হইয়া গেল– তার পরে টাকা-সমেত সেই লেফাফা বাক্সের মধ্যে যত্ন করিয়া রাখিয়া দিল। এ কয়টা টাকা যে কোনো দুঃসময়ে খরচ করিবে এমন সম্ভাবনা রহিল না।

 গোরা ০২


বর্ষার সন্ধ্যায় আকাশের অন্ধকার যেন ভিজিয়া ভারী হইয়া পড়িয়াছে। বর্ণহীন বৈচিত্র৻হীন মেঘের নিঃশব্দ শাসনের নীচে কলিকাতা শহর একটা প্রকাণ্ড নিরানন্দ কুকুরের মতো লেজের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। কাল সন্ধ্যা হইতে টিপ টিপ করিয়া কেবলই বর্ষণ হইয়াছে; সে বৃষ্টিতে রাস্তার মাটিকে কাদা করিয়া তুলিয়াছে কিন্তু কাদাকে ধুইয়া ভাসাইয়া লইয়া যাইবার মতো বল প্রকাশ করে নাই। আজ বেলা চারটে হইতে বৃষ্টি বন্ধ আছে, কিন্তু মেঘের গতিক ভালো নয়। এইরূপ আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় সন্ধ্যাবেলায় নির্জন ঘরের মধ্যে যখন মন টেকে না এবং বাহিরেও যখন আরাম পাওয়া যায় না সেই সময়টাতে দুটি লোক একটি তেতলা বাড়ির স্যাঁৎসেঁতে ছাতে দুটি বেতের মোড়ার উপর বসিয়া আছে।

এই দুই বন্ধু যখন ছোটো ছিল তখন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই ছাতে ছুটাছুটি খেলা করিয়াছে; পরীক্ষার পূর্বে উভয়ে চীৎকার করিয়া পড়া আবৃত্তি করিতে করিতে এই ছাতে দ্রুতপদে পাগলের মতো পায়চারি করিয়া বেড়াইয়াছে; গ্রীষ্মকালে কালেজ হইতে ফিরিয়া রাত্রে এই ছাতের উপরেই আহার করিয়াছে, তার পরে তর্ক করিতে করিতে কতদিন রাত্রি দুইটা হইয়া গেছে এবং সকালে রৌদ্র আসিয়া যখন তাহাদের মুখের উপর পড়িয়াছে তখন চমকিয়া জাগিয়া উঠিয়া দেখিয়াছে, সেইখানেই মাদুরের উপরে দুইজন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। কালেজে পাস করা যখন একটাও আর বাকি রহিল না তখন এই ছাতের উপরে মাসে একবার করিয়া যে হিন্দুহিতৈষী সভার অধিবেশন হইয়া আসিয়াছে এই দুই বন্ধুর মধ্যে একজন তাহার সভাপতি এবং আর-এক জন তাহার সেক্রেটারি।

যে ছিল সভাপতি তাহার নাম গৌরমোহন; তাহাকে আত্মীয়বন্ধুরা গোরা বলিয়া ডাকে। সে চারি দিকের সকলকে যেন খাপছাড়া রকমে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে তাহার কালেজের পণ্ডিতমহাশয় রজতগিরি বলিয়া ডাকিতেন। তাহার গায়ের রঙটা কিছু উগ্ররকমের সাদা– হলদের আভা তাহাকে একটুও স্নিগ্ধ করিয়া আনে নাই। মাথায় সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, হাড় চওড়া, দুই হাতের মুঠা যেন বাঘের থাবার মতো বড়ো– গলার আওয়াজ এমনি মোটা ও গম্ভীর যে হঠাৎ শুনিলে “কে রে” বলিয়া চমকিয়া উঠিতে হয়। তাহার মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত; চোয়াল এবং চিবুকের হাড় যেন দুর্গদ্বারের দৃঢ় অর্গলের মতো; চোখের উপর ভ্রুরেখা নাই বলিলেই হয় এবং সেখানকার কপালটা কানের দিকে চওড়া হইয়া গেছে। ওষ্ঠাধর পাতলা এবং চাপা; তাহার উপরে নাকটা খাঁড়ার মতো ঝুঁকিয়া আছে। দুই চোখ ছোটো কিন্তু তীক্ষ্ণ; তাহার দৃষ্টি যেন তীরের ফলাটার মতো অতি-দূর অদৃশ্যের দিকে লক্ষ ঠিক করিয়া আছে অথচ এক মুহূর্তের মধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া কাছের জিনিসকেও বিদ্যুতের মতো আঘাত করিতে পারে। গৌরকে দেখিতে ঠিক সুশ্রী বলা যায় না, কিন্তু তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার জো নাই, সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই।

আর তাহার বন্ধু বিনয় সাধারণ বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রলোকের মতো নয়, অথচ উজ্জ্বল; স্বভাবের সৌকুমার্য ও বুদ্ধির প্রখরতা মিলিয়া তাহার মুখশ্রীতে একটি বিশিষ্টতা দিয়াছে। কালেজে সে বরাবরই উচ্চ নম্বর ও বৃত্তি পাইয়া আসিয়াছে; গোরা কোনোমতেই তাহার সঙ্গে সমান চলিতে পারিত না। পাঠ্যবিষয়ে গোরার তেমন আসক্তিই ছিল না; বিনয়ের মতো সে দ্রুত বুঝিতে এবং মনে রাখিতে পারিত না। বিনয়ই তাহার বাহন হইয়া কালেজের পরীক্ষা কয়টার ভিতর দিয়া নিজের পশ্চাতে তাহাকে টানিয়া পার করিয়া আনিয়াছে।

গোরা বলিতেছিল, “শোনো বলি। অবিনাশ যে ব্রাহ্মদের নিন্দে করছিল, তাতে এই বোঝা যায় যে লোকটা বেশ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। এতে তুমি হঠাৎ অমন খাপা হয়ে উঠলে কেন?”

বিনয়। কী আশ্চর্য। এ সম্বন্ধে যে কোনো প্রশ্ন চলতে পারে তাও আমি মনে করতে পারতুম না।

গোরা। তা যদি হয় তবে তোমার মনে দোষ ঘটেছে। এক দল লোক সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে সব বিষয়ে উল্‌টোরকম করে চলবে আর সমাজের লোক অবিচলিতভাবে তাদের সুবিচার করবে এ স্বভাবের নিয়ম নয়। সমাজের লোকে তাদের ভুল বুঝবেই, তারা সোজা ভাবে যেটা করবে এদের চোখে সেটা বাঁকা ভাবে পড়বেই, তাদের ভালো এদের কাছে মন্দ হয়ে দাঁড়াবেই, এইটেই হওয়া উচিত। ইচ্ছামত সমাজ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার যতগুলো শাস্তি আছে এও তার মধ্যে একটা।

বিনয়। যেটা স্বভাবিক সেইটেই যে ভালো, তা আমি বলতে পারি নে।

গোরা একটু উষ্ণ হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমার ভালোয় কাজ নেই। পৃথিবীতে ভালো দু-চারজন যদি থাকে তো থাক্‌ কিন্তু বাকি সবাই যেন স্বাভাবিক নয়। নইলে কাজও চলে না প্রাণও বাঁচে না। ব্রাহ্ম হয়ে বাহাদুরি করবার শখ যাদের আছে অব্রাহ্মরা তাদের সব কাজেই ভুল বুঝে নিন্দে করবে এটুকু দুঃখ তাদের সহ্য করতেই হবে। তারাও বুক ফুলিয়ে বেড়াবে আর তাদের বিরুদ্ধ পক্ষও তাদের পিছন পিছন বাহবা দিয়ে চলবে জগতে এটা ঘটে না, ঘটলেও জগতের সুবিধে হত না।”

বিনয়। আমি দলের নিন্দের কথা বলছি নে– ব্যক্তিগত–

গোরা। দলের নিন্দে আবার নিন্দে কিসের! সে তো মতামত-বিচার। ব্যক্তিগত নিন্দেই তো চাই। আচ্ছা সাধুপুরুষ, তুমি নিন্দে করতে না?

বিনয়। করতুম। খুবই করতুম– কিন্তু সেজন্যে আমি লজ্জিত আছি।

গোরা তাহার ডান হাতের মুঠা শক্ত করিয়া কহিল, “না বিনয়, এ চলবে না, কিছুতেই না।”

বিনয় কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তার পরে কহিল, “কেন, কী হয়েছে? তোমার ভয় কিসের?”

গোরা। আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি তুমি নিজেকে দুর্বল করে ফেলছ।

বিনয় ঈষৎ একটুখানি উত্তেজিত হইয়া কহিল, “দুর্বল! তুমি জান, আমি ইচ্ছে করলে এখনই তাঁদের বাড়ি যেতে পারি– তাঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন– কিন্তু আমি যাই নি।”

গোরা। কিন্তু এই যে যাও নি সেই কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছ না। দিন-রাত্রি কেবল ভাবছ, যাই নি, যাই নি, আমি তাঁদের বাড়ি যাই নি– এর চেয়ে যে যাওয়াই ভালো।

বিনয়। তবে কি যেতেই বল?

গোরা নিজের জানু চাপড়াইয়া কহিল, “না, আমি যেতে বলি নে। আমি তোমাকে লিখে পড়ে দিচ্ছি, যেদিন তুমি যাবে সেদিন একেবারে পুরোপুরিই যাবে। তার পরদিন থেকেই তাদের বাড়ি খানা খেতে শুরু করবে এবং ব্রাহ্মসমাজের খাতায় নাম লিখিয়ে একেবারে দিগ্‌বিজয়ী প্রচারক হয়ে উঠবে।”

বিনয়। বল কী! তার পরে?

গোরা। আর তার পরে! মরার বাড়া তো গাল নেই। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে তুমি গো-ভাগাড়ে গিয়ে মরবে, তোমার আচার বিচার কিছুই থাকবে না, কম্পাস-ভাঙা কাণ্ডারীর মতো তোমার পূর্ব-পশ্চিমের জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে– তখন মনে হবে জাহাজ বন্দরে উত্তীর্ণ করাই কুসংস্কার, সংকীর্ণতা– কেবল না-হক ভেসে চলে যাওয়াই যথার্থ জাহাজ চালানো। কিন্তু এ-সব কথা নিয়ে বকাবকি করতে আমার ধৈর্য থাকে না– আমি বলি তুমি যাও। অধঃপাতের মুখের সামনে পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের সুদ্ধ কেন ভয়ে-ভয়ে রেখে দিয়েছ?

বিনয় হাসিয়া উঠিল, কহিল, “ডাক্তার আশা ছেড়ে দিলেই যে রোগী সব সময়ে মরে তা নয়। আমি তো নিদেন-কালের কোনো লক্ষণ বুঝতে পারছি নে।”

গোরা। পারছ না?

বিনয়। না।

গোরা। নাড়ী ছাড়ে-ছাড়ে করছে না?

বিনয়। না, দিব্যি জোর আছে।

গোরা। মনে হচ্ছে না যে, শ্রীহস্তে যদি পরিবেশন করে তবে ম্লেচ্ছের অন্নই দেবতার ভোগ?

বিনয় অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল, কহিল, “গোরা, বস্‌, এইবার থামো।”

গোরা। কেন, এর মধ্যে তো আবরুর কোনো কথা নেই। শ্রীহস্ত তো অসূর্যম্পশ্য নয়। পুরুষমানুষের সঙ্গে যার শেক্‌হ্যাণ্ড চলে সেই পবিত্র করপল্লবের উল্লেখটি পর্যন্ত যখন তোমার সহ্য হল না, তদা নাশংসে মরণায় সঞ্জয়!

বিনয়। দেখো গোরা, আমি স্ত্রীজাতিকে ভক্তি করে থাকি–আমাদের শাস্ত্রেও–

গোরা। স্ত্রীজাতিকে যে ভাবে ভক্তি করছ তার জন্যে শাস্ত্রের দোহাই পেড়ো না! ওকে ভক্তি বলে না, যা বলে তা যদি মুখে আনি তো মারতে আসবে।

বিনয়। এ তুমি গায়ের জোরে বলছ।

গোরা। শাস্ত্রে মেয়েদের বলেন “পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ’। তাঁরা পুজার্হা, কেননা গৃহকে দীপ্তি দেন। পুরুষমানুষের হৃদয়কে দীপ্ত করে তোলেন বলে বিলিতি বিধানে তাঁদের যে মান দেওয়া হয় তাকে পূজা না বললেই ভালো হয়।

বিনয়। কোনো কোনো স্থলে বিকৃতি দেখা যায় বলে কি একটা বড়ো ভাবের উপর ওরকম কটাক্ষপাত করা উচিত।

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনু, এখন যখন তোমার বিচার করবার বুদ্ধি গেছে তখন আমার কথাটা মেনেই নাও। আমি বলছি বিলিতি শাস্ত্রে স্ত্রীজাতিসম্বন্ধে যে-সমস্ত অত্যুক্তি আছে তার ভিতরকার কথাটা হচ্ছে বাসনা। স্ত্রীজাতিকে পুজো করবার জায়গা হল মার ঘর, সতীলক্ষ্ণী গৃহিণীর আসন। সেখান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের যে স্তব করা হয়, তার মধ্যে অপমান লুকিয়ে আছে। পতঙ্গের মতো তোমার মনটা যে-কারণে পরেশবাবুর বাড়ির চারি দিকে ঘুরছে, ইংরাজিতে তাকে বলে থাকে “লাভ’– কিন্তু ইংরেজের নকল ঐ “লাভ’ ব্যাপারটাকেই সংসারের মধ্যে একটা চরম পুরুষার্থ বলে উপাসনা করতে হবে, এমন বাঁদরামি যেন তোমাকে না পেয়ে বসে!”

বিনয় কশাহত তাজা ঘোড়ার মতো লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “আঃ গোরা, থাক্‌, যথেষ্ট হয়েছে।”

গোরা। কোথায় যথেষ্ট হয়েছে। কিছুই হয় নি। স্ত্রী আর পুরুষকে তাদের স্বস্থানে বেশ সহজ করে দেখতে শিখি নি বলেই আমরা কতকগুলো কবিত্ব জমা করে তুলেছি।

বিনয় কহিল, “আচ্ছা, মানছি স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ ঠিক যে জায়গাটাতে থাকলে সহজ হতে পারত আমরা প্রবৃত্তির ঝোঁকে সেটা লঙ্ঘন করি এবং সেটাকে মিথ্যে করে তুলি, কিন্তু এই অপরাধটা কি কেবল বিদেশেরই? এ সম্বন্ধে ইংরেজের কবিত্ব যদি মিথ্যে হয় তো আমরা ঐ যে কামিনীকাঞ্চনত্যাগ নিয়ে সর্বদা বাড়াবাড়ি করে থাকি সেটাও তো মিথ্যে। মানুষের প্রকৃতি যা নিয়ে সহজে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে তার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্যে কেউ বা প্রেমের সৌন্দর্য-অংশকেই কবিত্বের দ্বারা উজ্জ্বল করে তুলে তার মন্দটাকে লজ্জা দেয়, আর কেউ বা ওর মন্দটাকেই বড়ো করে তুলে কামিনীকাঞ্চনত্যাগের বিধান দিয়ে থাকে; ও দুটো কেবল দুই ভিন্ন প্রকৃতির লোকের ভিন্নরকম প্রণালী। একটাকেই যদি নিন্দে কর তবে অন্যটাকেও রেয়াত করলে চলবে না।”

গোরা। নাঃ, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলুম। তোমার অবস্থা তেমন খারাপ হয় নি। এখনো যখন ফিলজফি তোমার মাথায় খেলছে তখন নির্ভয়ে তুমি “লাভ’ করতে পারো, কিন্তু সময় থাকতে নিজেকে সামলে নিয়ো– হিতৈষী বন্ধুদের এই অনুরোধ।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আঃ, তুমি কি পাগল হয়েছ? আমার আবার “লাভ’। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পরেশবাবুদের আমি যেটুকু দেখেছি এবং ওঁদের সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে ওঁদের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হয়েছে। বোধ করি তাই ওঁদের ঘরের ভিতরকার জীবনযাত্রাটা কী রকম সেটা জানবার জন্যে আমার একটা আকর্ষণ হয়েছিল।”

গোরা। উত্তম কথা সেই আকর্ষণটাই সামলে চলতে হবে। ওঁদের সম্বন্ধে প্রাণি-বৃত্তান্তের অধ্যায়টা নাহয় অনাবিষ্কৃতই রইল। বিশেষত ওঁরা হলেন শিকারি প্রাণী, ওঁদের ভিতরকার ব্যাপার জানতে গিয়ে শেষকালে এত দূর পর্যন্ত ভিতরে যেতে পারে যে তোমার টিকিটি পর্যন্ত দেখবার জো থাকবে না।

বিনয়। দেখো, তোমার একটা দোষ আছে। তুমি মনে কর যত কিছু শক্তি ঈশ্বর কেবল একলা তোমাকেই দিয়েছেন, আর আমরা সবাই দুর্বল প্রাণী।

কথাটা গোরাকে হঠাৎ যেন নূতন করিয়া ঠেকিল; সে উৎসাহবেগে বিনয়ের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “ঠিক বলেছ– ঐটে আমার দোষ– আমার মস্ত দোষ।”

বিনয়। উঃ, ওর চেয়েও তোমার আর-একটা মস্ত দোষ আছে। অন্য লোকের শিরদাঁড়ার উপরে কতটা আঘাত সয় তার ওজনবোধ তোমার একেবারেই নেই।

এমন সময় গোরার বড়ো বৈমাত্র ভাই মহিম তাঁহার পরিপুষ্ট শরীর লইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরা!”

গোরা তাড়াতাড়ি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আজ্ঞে!”

মহিম। দেখতে এলেম বর্ষার জলধরপটল আমাদের ছাদের উপরে গর্জন করতে নেমেছে কি না। আজ ব্যাপারখানা কী? ইংরেজকে বুঝি এতক্ষণে ভারত-সমুদ্রের অর্ধেকটা পথ পার করে দিয়েছ? ইংরেজের বিশেষ কোনো লোকসান দেখছি নে, কিন্তু নীচের ঘরে মাথা ধরে বড়োবউ পড়ে আছে, সিংহনাদে তারই যা অসুবিধে হচ্ছে।

এই বলিয়া মহিম নীচে চলিয়া গেলেন।

গোরা লজ্জা পাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল– লজ্জার সঙ্গে ভিতরে একটু রাগও জ্বলিতে লাগিল, তাহা নিজের বা অন্যের ‘পরে ঠিক বলা যায় না। একটু পরে সে ধীরে ধীরে যেন আপন মনে কহিল, “সব বিষয়েই, যতটা দরকার আমি তার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়ে ফেলি, সেটা যে অন্যের পক্ষে কতটা অসহ্য তা আমার ঠিক মনে থাকে না।’

বিনয় গৌরের কাছে আসিয়া সস্নেহে তার হাত ধরিল।

» গোরা ০৩


গোরা ও বিনয় ছাত হইতে নামিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় গোরার মা উপরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনয় তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল।

গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না। তিনি ছিপ্‌ছিপে পাতলা, আঁটসাঁট; চুল যদি বা কিছু কিছু পাকিয়া থাকে বাহির হইতে দেখা যায় না; হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় তাঁহার বয়স চল্লিশেরও কম। মুখের বেড় অত্যন্ত সুকুমার, নাকের ঠোঁটের চিবুকের ললাটের রেখা কে যেন যত্নে কুঁদিয়া কাটিয়াছে; শরীরের সমস্তই বাহুল্যবর্জিত। মুখে একটি পরিষ্কার ও সতেজ বুদ্ধির ভাব সর্বদাই প্রকাশ পাইতেছে। রঙ শ্যামবর্ণ, গোরার রঙের সঙ্গে তাহার কোনোই তুলনা হয় না। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই একটা জিনিস সকলের চোখে পড়ে– তিনি শাড়ির সঙ্গে শেমিজ পরিয়া থাকেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনকার দিনে মেয়েদের জামা বা শেমিজ পরা যদিও নব্যদলে প্রচলিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে তবু প্রবীণা গৃহিণীরা তাহাকে নিতান্তই খৃস্টানি বলিয়া অগ্রাহ্য করিতেন। আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়ালবাবু কমিসোরিয়েটে কাজ করিতেন, আনন্দময়ী তাঁহার সঙ্গে ছেলেবেলা হইতে পশ্চিমে কাটাইয়াছেন, তাই ভালো করিয়া গা ঢাকিয়া গায়ে কাপড় দেওয়া যে লজ্জা বা পরিহাসের বিষয় এ সংস্কার তাঁহার মনে স্থান পায় নাই। ঘরদুয়ার মাজিয়া ঘষিয়া, ধুইয়া মুছিয়া, রাঁধিয়া বাড়িয়া, সেলাই করিয়া, গুনতি করিয়া, হিসাব করিয়া, ঝাড়িয়া, রৌদ্রে দিয়া, আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীর খবর লইয়া, তবু তাঁহার সময় যেন ফুরাইতে চাহে না। শরীরে অসুখ করিলে তিনি কোনোমতেই তাহাকে আমল দিতে চান না– বলেন, “অসুখে তো আমার কিছু হবে না, কাজ না করতে পেলে বাঁচব কী করে?”

গোরার মা উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরার গলা যখনই নীচে থেকে শোনা যায় তখনই বুঝতে পারি বিনু নিশ্চয়ই এসেছে। ক’দিন বাড়ি একেবারে চুপচাপ ছিল–কী হয়েছে বল তো বাছা? আসিস নি কেন, অসুখবিসুখ করে নি তো?”

বিনয় কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, “না, মা, অসুখ– যে বৃষ্টিবাদল!”

গোরা কহিল, “তাই বৈকি! এর পরে বৃষ্টিবাদল যখন ধরে যাবে তখন বিনয় বলবেন, যে রোদ পড়েছে! দেবতার উপর দোষ দিলে দেবতা তো কোনো জবাব করেন না– আসল মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন।”

বিনয় কহিল, “গোরা, তুমি কী বাজে বকছ!”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা সত্যি বাছা, অমন করে বলতে নেই। মানুষের মন কখনো ভালো থাকে কখনো মন্দ থাকে, সব সময় কি সমান যায়! তা নিয়ে কথা পাড়তে গেলে উৎপাত করা হয়। তা আয় বিনু, আমার ঘরে আয়, তোর জন্যে খাবার ঠিক করেছি।”

গোরা জোর করিয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “না মা, সে হচ্ছে না, তোমার ঘরে আমি বিনয়কে খেতে দেব না।”

আনন্দময়ী। ইস্‌, তাই তো! কেন বাপু, তোকে তো আমি কোনোদিন খেতে বলি নে– এ দিকে তোর বাপ তো ভয়ংকর শুদ্ধাচারী হয়ে উঠেছেন– স্বপাক না হলে খান না। বিনু আমার লক্ষ্ণী ছেলে, তোর মতো ওর গোঁড়ামি নেই, তুই কেবল ওকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখতে চাস।

গোরা। সে কথা ঠিক, আমি জোর করেই ওকে ঠেকিয়ে রাখব। তোমার ঐ খৃস্টান দাসী লছমিয়াটাকে না বিদায় করে দিলে তোমার ঘরে খাওয়া চলবে না।

আনন্দময়ী। ওরে গোরা, অমন কথা তুই মুখে আনিস নে। চিরদিন ওর হাতে তুই খেয়েছিস– ও তোকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছে। এই সেদিন পর্যন্ত ওর হাতের তৈরি চাটনি না হলে তোর যে খাওয়া রুচত না। ছোটোবেলায় তোর যখন বসন্ত হয়েছিল লছমিয়া যে করে তোকে সেবা করে বাঁচিয়েছে সে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।

গোরা। ওকে পেনসন দাও, জমি কিনে দাও, ঘর কিনে দাও, যা খুশি করো, কিন্তু ওকে রাখা চলবে না মা।

আনন্দময়ী। গোরা, তুই মনে করিস টাকা দিলেই সব ঋণ শোধ হয়ে যায়! ও জমিও চায় না, বাড়িও চায় না, তোকে না দেখতে পেলে ও মরে যাবে।

গোরা। তবে তোমার খুশি ওকে রাখো। কিন্তু বিনু তোমার ঘরে খেতে পাবে না। যা নিয়ম তা মানতেই হবে, কিছুতেই তার অন্যথা হতে পারে না। মা, তুমি এতবড়ো অধ্যাপকের বংশের মেয়ে, তুমি যে আচার পালন করে চল না এ কিন্তু —

আনন্দময়ী। ওগো, তোমার মা আগে আচার পালন করেই চলত; তাই নিয়ে অনেক চোখের জল ফেলতে হয়েছে– তখন তুমি ছিলে কোথায়? রোজ শিব গড়ে পুজো করতে বসতুম আর তোমার বাবা এসে টান মেরে ফেলে ফেলে দিতেন। তখন অপরিচিত বামুনের হাতেও ভাত খেতে আমার ঘেন্না করত। সেকালে রেলগাড়ি বেশিদূর ছিল না– গোরুর গাড়িতে, ডাকগাড়িতে, পালকিতে, উটের উপর চড়ে কতদিন ধরে কত উপোস করে কাটিয়েছি। তোমার বাবা কি সহজে আমার আচার ভাঙতে পেরেছিলেন? তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর সায়েব-মনিবরা তাঁকে বাহবা দিত, তাঁর মাইনেই বেড়ে গেল– ঐজন্যেই তাঁকে এক জায়গায় অনেক দিন রেখে দিত– প্রায় নড়াতে চাইত না। এখন তো বুড়োবয়সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাশ রাশ টাকা নিয়ে তিনি হঠাৎ উলটে খুব শুচি হয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু আমি তা পারব না। আমার সাত পুরুষের সংস্কার একটা একটা করে নির্মূল করা হয়েছে– সে কি এখন আর বললেই ফেরে?

গোরা। আচ্ছা, তোমার পূর্বপুরুষদের কথা ছেড়ে দাও– তাঁরা তো কোনো আপত্তি করতে আসছেন না। কিন্তু আমাদের খাতিরে তোমাকে কতকগুলো জিনিস মেনে চলতেই হবে। নাহয় শাস্ত্রের মান নাই রাখলে, স্নেহের মান রাখতে হবে তো।

আনন্দময়ী। ওরে, অত করে আমাকে কী বোঝাচ্ছিস। আমার মনে কী হয় সে আমিই জানি। আমার স্বামী, আমার ছেলে, আমাকে নিয়ে তাদের যদি পদে পদে কেবল বাধতে লাগল তবে আমার আর সুখ কী নিয়ে। কিন্তু তোকে কোলে নিয়েই আমি আচার ভাসিয়ে দিয়েছি তা জানিস? ছোটো ছেলেকে বুকে তুলে নিলেই বুঝতে পারা যায় যে জাত নিয়ে কেউ পৃথিবীতে জন্মায় না। সে কথা যেদিন বুঝেছি সেদিন থেকে এ কথা নিশ্চয় জেনেছি যে আমি যদি খ্রীস্টান বলে ছোটো জাত বলে কাউকে ঘৃণা করি তবে ঈশ্বর তোকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন। তুই আমার কোল ভরে আমার ঘর আলো করে থাক্‌, আমি পৃথিবীর সকল জাতের হাতেই জল খাব।

আজ আনন্দময়ীর কথা শুনিয়া বিনয়ের মনে হঠাৎ কী-একটা অস্পষ্ট সংশয়ের আভাস দেখা দিল। সে একবার আনন্দময়ীর ও একবার গোরার মুখের দিকে তাকাইল, কিন্তু তখনই মন হইতে সকল তর্কের উপক্রম দূর করিয়া দিল।

গোরা কহিল, “মা, তোমার যুক্তিটা ভালো বোঝা গেল না। যারা বিচার ক’রে শাস্ত্র মেনে চলে তাদের ঘরেও তো ছেলে বেঁচে থাকে, আর ঈশ্বর তোমার সম্বন্ধেই বিশেষ আইন খাটাবেন, এ বুদ্ধি তোমাকে কে দিলে?”

আনন্দময়ী। যিনি তোকে দিয়েছেন বুদ্ধিও তিনি দিয়েছেন। তা আমি কী করব বল্‌? আমার এতে কোনো হাত নেই। কিন্তু ওরে পাগল, তোর পাগলামি দেখে আমি হাসব কি কাঁদব তা ভেবে পাই নে। যাক্‌, সে-সব কথা যাক। তবে বিনয় আমার ঘরে খাবে না?

গোরা। ও তো এখনই সুযোগ পেলেই ছোটে, লোভটি ওর ষোলো-আনা। কিন্তু মা, আমি যেতে দেব না। ও যে বামুনের ছেলে, দুটো মিষ্টি দিয়ে সে কথা ওকে ভোলালে চলবে না। ওকে অনেক ত্যাগ করতে হবে, প্রবৃত্তি সামলাতে হবে, তবে ও জন্মের গৌরব রাখতে পারবে। মা, তুমি কিন্তু রাগ কোরো না। আমি তোমার পায়ের ধুলো নিচ্ছি।

আনন্দময়ী। আমি রাগ করব! তুই বলিস কী! তুই যা করছিস এ তুই জ্ঞানে করছিস নে, তা আমি তোকে বলে দিলুম। আমার মনে এই কষ্ট রইল যে তোকে মানুষ করলুম বটে, কিন্তু — যাই হোক গে, তুই যাকে ধর্ম বলে বেড়াস সে আমার মানা চলবে না– নাহয়, তুই আমার ঘরে আমার হাতে নাই খেলি– কিন্তু তোকে তো দু’সন্ধে দেখতে পাব, সেই আমার ঢের। বিনয়, তুমি মুখটি অমন মলিন কোরো না বাপ– তোমার মনটি নরম, তুমি ভাবছ আমি দুঃখ পেলুম– কিছু না বাপ। আর-এক দিন নিমন্ত্রণ করে খুব ভালো বামুনের হাতেই তোমাকে খাইয়ে দেব– তার ভাবনা কী! আমি কিন্তু, বাছা, লছমিয়ার হাতে জল খাব, সে আমি সবাইকে বলে রাখছি।

গোরার মা নীচে চলিয়া গেলেন। বিনয় চুপ করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার পর ধীরে ধীরে কহিল, “গোরা, এটা যেন একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

গোরা। কার বাড়াবাড়ি?

বিনয়। তোমার।

গোরা। এক চুল বাড়াবাড়ি নয়। যেখানে যার সীমা আমি সেইটে ঠিক রক্ষে করে চলতে চাই। কেনো ছুতোয় সূচ্যগ্রভূমি ছাড়তে আরম্ভ করলে শেষকালে কিছুই বাকি থাকে না।

বিনয়। কিন্তু মা যে।

গোরা। মা কাকে বলে সে আমি জানি। আমাকে কি সে আবার মনে করিয়ে দিতে হবে! আমার মা’র মতো মা ক’জনের আছে। কিন্তু আচার যদি না মানতে শুরু করি তবে একদিন হয়তো মাকেও মানব না। দেখো বিনয়, তোমাকে একটা কথা বলি, মনে রেখো– হৃদয় জিনিসটা অতি উত্তম, কিন্তু সকলের চেয়ে উত্তম নয়।

বিনয় কিছুক্ষণ পরে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, “দেখো, গোরা, আজ মা’র কথা শুনে আমার মনের ভিতরে কী রকম একটা নাড়াচাড়া হচ্ছে! আমার বোধ হচ্ছে যেন মার মনে কী একটা কথা আছে, সেইটে তিনি আমাদের বোঝাতে পারছেন না, তাই কষ্ট পাচ্ছেন।”

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “আঃ বিনয়, অত কল্পনা নিয়ে খেলিও না– ওতে কেবলই সময় নষ্ট হয়, আর কোনো ফল হয় না।”

বিনয়। তুমি পৃথিবীর কোনো জিনিসের দিকে কখনো ভালো করে তাকাও না, তাই যেটা তোমার নজরে পড়ে না, সেটাকেই তুমি কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে চাও। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, আমি কতবার দেখেছি মা যেন কিসের জন্যে একটা ভাবনা পুষে রেখেছেন– কী যেন একটা ঠিকমত মিলিয়ে দিতে পারছেন না– সেইজন্যে ওঁর ঘরকরনার ভিতরে একটা দুঃখ আছে। গোরা, তুমি ওঁর কথাগুলো একটু কান পেতে শুনো।

গোরা। কান পেতে যতটা শোনা যায় তা আমি শুনে থাকি– তার চেয়ে বেশি শোনবার চেষ্টা করলে ভুল শোনবার সম্ভাবনা আছে বলে সে চেষ্টাই করি নে।

গোরা ০৪

মত হিসাবে একটা কথা যেমনতরো শুনিতে হয়, মানুষের উপর প্রয়োগ করিবার বেলায় সকল সময় তাহার সেই একান্ত নিশ্চিত ভাবটা থাকে না– অন্তত বিনয়ের কাছে থাকে না, বিনয়ের হৃদয়বৃত্তি অত্যন্ত প্রবল। তাই তর্কের সময় সে একটা মতকে খুব উচ্চস্বরে মানিয়া থাকে, কিন্তু ব্যবহারের বেলা মানুষকে তাহার চেয়ে বেশি না মানিয়া থাকিতে পারে না। এমন-কি, গোরার প্রচারিত মতগুলি বিনয় যে গ্রহণ করিয়াছে তাহা কতটা মতের খাতিরে আর কতটা গোরার প্রতি তাহার একান্ত ভালোবাসার টানে তাহা বলা শক্ত।

গোরাদের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া বাসায় ফিরিবার সময় বর্ষার সন্ধ্যায় যখন সে কাদা বাঁচাইয়া ধীরে ধীরে রাস্তায় চলিতেছিল তখন মত এবং মানুষে তাহার মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব বাধাইয়া দিয়াছিল।

এখনকার কালের নানাপ্রকার প্রকাশ্য এবং গোপন আঘাত হইতে সমাজ যদি আত্মরক্ষা করিয়া চলিতে চায় তবে খাওয়া ছোঁওয়া প্রভৃতি সকল বিষয়ে তাহাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক হইতে হইবে এই মতটি বিনয় গোরার মুখ হইতে অতি সহজেই গ্রহণ করিয়াছে, এ লইয়া বিরুদ্ধ লোকদের সঙ্গে সে তীক্ষ্ণভাবে তর্ক করিয়াছে; বলিয়াছে, শত্রু যখন কেল্লাকে চারি দিকে আক্রমণ করিয়াছে তখন এই কেল্লার প্রত্যেক পথ-গলি দরজা-জানলা প্রত্যেক ছিদ্রটি বন্ধ করিয়া প্রাণ দিয়া যদি রক্ষা করিতে থাকি, তবে তাহাকে উদারতার অভাব বলে না।

কিন্তু আজ ঐ যে আনন্দময়ীর ঘরে গোরা তাহার খাওয়া নিষেধ করিয়া দিল ইহার আঘাত ভিতরে ভিতরে তাহাকে কেবলই বেদনা দিতে লাগিল।

বিনয়ের বাপ ছিল না, মাকেও সে অল্পবয়সে হারাইয়াছে; খুড়া থাকেন দেশে এবং ছেলেবেলা হইতেই পড়াশুনা লইয়া বিনয় কলিকাতার বাসায় একলা মানুষ হইয়াছে। গোরার সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে বিনয় যেদিন হইতে আনন্দময়ীকে জানিয়াছে সেই দিন হইতে তাঁহাকে মা বলিয়াই জানিয়াছে। কতদিন তাঁহার ঘরে গিয়া সে কাড়াকাড়ি করিয়া উৎপাত করিয়া খাইয়াছে; আহার্যের অংশবিভাগ লইয়া আনন্দময়ী গোরার প্রতি পক্ষপাত করিয়া থাকেন এই অপবাদ দিয়া কতদিন সে তাহার প্রতি কৃত্রিম ঈর্ষা প্রকাশ করিয়াছে। দুই-চারি দিন বিনয় কাছে না আসিলেই আনন্দময়ী যে কতটা উৎকন্ঠিত হইয়া উঠিতেন, বিনয়কে কাছে বসাইয়া খাওয়াইবেন এই প্রত্যাশায় কতদিন তিনি তাহাদের সভাভঙ্গের জন্য উৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতেন, তাহা বিনয় সমস্তই জানিত। সেই বিনয় আজ সামাজিক ঘৃণায় আনন্দময়ীর ঘরে গিয়া খাইবে না ইহা কি আনন্দময়ী সহিতে পারেন, না বিনয় সহিবে!

“ইহার পর হইতে ভালো বামুনের হাতে মা আমাকে খাওয়াইবেন, নিজের হাতে আর কখনো খাওয়াইবেন না– এ কথা মা হাসিমুখ করিয়া বলিলেন; কিন্তু এ যে মর্মান্তিক কথা।’ এই কথাটাই বিনয় বারবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে করিতে বাসায় পৌঁছিল।

শূন্যঘর অন্ধকার হইয়া আছে; চারি দিকে কাগজপত্র বই এলোমেলো ছড়ানো; দিয়াশালাই ধরাইয়া বিনয় তেলের শেজ জ্বালাইল– শেজের উপর বেহারার করকোষ্ঠী নানা চিহ্নে অঙ্কিত; লিখিবার টেবিলের উপর যে একটা সাদা কাপড়ের আবরণ আছে তাহার নানান জায়গায় কালি এবং তেলের দাগ; এই ঘরে তাহার প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠিল। মানুষের সঙ্গ এবং স্নেহের অভাব আজ তাহার বুক যেন চাপিয়া ধরিল। দেশকে উদ্ধার, সমাজকে রক্ষা এই-সমস্ত কর্তব্যকে সে কোনোমতেই স্পষ্ট এবং সত্য করিয়া তুলিতে পারিল না– ইহার চেয়ে ঢের সত্য সেই অচিন পাখি যে একদিন শ্রাবণের উজ্জ্বল সুন্দর প্রভাতে খাঁচার কাছে আসিয়া আবার খাঁচার কাছ হইতে চলিয়া গেছে। কিন্তু সেই অচিন পাখির কথা বিনয় কোনোমতেই মনে আমল দিবে না, কোনোমতেই না। সেইজন্য মনকে আশ্রয় দিবার জন্য, যে আনন্দময়ীর ঘর হইতে গোরা তাহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে সেই ঘরটির ছবি মনে আঁকিতে লাগিল।

পঙ্খের-কাজ-করা উজ্জ্বল মেজে পরিষ্কার তক্‌ তক্‌ করিতেছে; এক ধারে তক্তপোশের উপর সাদা রাজহাঁসের পাখার মতো কোমল নির্মল বিছানা পাতা রহিয়াছে; বিছানার পাশেই একটা ছোটো টুলের উপর রেড়ির তেলের বাতি এতক্ষণে জ্বালানো হইয়াছে; মা নিশ্চয়ই নানা রঙের সুতা লইয়া সেই বাতির কাছে ঝুঁকিয়া কাঁথার উপর শিল্পকাজ করিতেছেন, লছমিয়া নীচে মেজের উপর বসিয়া তাহার বাঁকা উচ্চারণের বাংলায় অনর্গল বকিয়া যাইতেছে, মা তাহার অধিকাংশই কানে আনিতেছেন না। মা যখন মনে কোনো কষ্ট পান তখন শিল্পকাজ লইয়া পড়েন– তাঁহার সেই কর্মনিবিষ্ট স্তব্ধ মুখের ছবির প্রতি বিনয় তাহার দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল; সে মনে মনে কহিল, এই মুখের স্নেহদীপ্তি আমাকে আমার সমস্ত মনের বিক্ষেপ হইতে রক্ষা করুক। এই মুখই আমার মাতৃভূমির প্রতিমাস্বরূপ হউক, আমাকে কর্তব্যে প্রেরণ করুক এবং কর্তব্যে দৃঢ় রাখুক। তাঁহাকে মনে মনে একবার মা বলিয়া ডাকিল এবং কহিল, “তোমার অন্ন যে আমার অমৃত নয় এ কথা কোনো শাস্ত্রের প্রমাণেই স্বীকার করিব না।’

নিস্তব্ধ ঘরে বড়ো ঘড়িটা টিক্‌ টিক্‌ করিয়া চলিতে লাগিল; ঘরের মধ্যে বিনয়ের অসহ্য হইয়া উঠিল। আলোর কাছে দেওয়ালের গায়ে একটি টিকটিকি পোকা ধরিতেছে– তাহার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া বিনয় উঠিয়া পড়িল এবং একটা ছাতা লইয়া ঘর হইতে বাহির হইল।

কী করিবে সেটা মনের মধ্যে স্পষ্ট ছিল না। বোধ হয় আনন্দময়ীর কাছে ফিরিয়া যাইবে এইমতোই তাহার মনের অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু কখন এক সময় তাহার মনে উঠিল আজ রবিবার, আজ ব্রাহ্মসভায় কেশববাবুর বক্তৃতা শুনিতে যাই। এ কথা যেমন মনে ওঠা অমনি সমস্ত দ্বিধা দূর করিয়া বিনয় জোরে চলিতে আরম্ভ করিল। বক্তৃতা শুনিবার সময় যে বড়ো বেশি নাই তাহা সে জানিত তবু তাহার সংকল্প বিচলিত হইল না।

যথাস্থানে পৌঁছিয়া দেখিল উপাসকেরা বাহির হইয়া আসিতেছে। ছাতা মাথায় রাস্তার ধারে এক কোণে সে দাঁড়াইল– মন্দির হইতে সেই মুহূর্তেই পরেশবাবু শান্ত-প্রসন্ন-মুখে বাহির হইলেন। তাঁহার সঙ্গে তাঁহার পরিজন চার-পাঁচটি ছিল– বিনয় তাহাদের মধ্যে কেবল একজনের তরুণ মুখ রাস্তার গ্যাসের আলোকে ক্ষণকালের জন্য দেখিল– তাহার পরে গাড়ির চাকার শব্দ হইল এবং এই দৃশ্যটুকু অন্ধকারের মহাসমুদ্রের মধ্যে একটি বুদ্‌বুদের মতো মিলাইয়া গেল।

বিনয় ইংরেজি নভেল যথেষ্ট পড়িয়াছে, কিন্তু বাঙালি ভদ্রঘরের সংস্কার তাহার যাইবে কোথায়? এমন করিয়া মনের মধ্যে আগ্রহ লইয়া কোনো স্ত্রীলোককে দেখিতে চেষ্টা করা যে সেই স্ত্রীলোকের পক্ষে অসম্মানকর এবং নিজের পক্ষে গর্হিত এ কথা সে কোনো তর্কের দ্বারা মন হইতে তাড়াইতে পারে না। তাই বিনয়ের মনের মধ্যে হর্ষের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত একটা গ্লানি জন্মিতে লাগিল। মনে হইল “আমার একটা যেন পতন হইতেছে।’ গোরার সঙ্গে যদিচ সে তর্ক করিয়া আসিয়াছে, তবু যেখানে সামাজিক অধিকার নাই সেখানে কোনো স্ত্রীলোককে প্রেমের চক্ষে দেখা তাহার চিরজীবনের সংস্কারে বাধিতে লাগিল।

বিনয়ের আর গোরার বাড়ি যাওয়া হইল না। মনের মধ্যে নানা কথা তোলপাড় করিতে করিতে বিনয় বাসায় ফিরিল। পরদিন অপরাহে্‌ণ বাসা হইতে বাহির হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে যখন গোরার বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল তখন বর্ষার দীর্ঘদিন শেষ হইয়া সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হইয়া উঠিয়াছে। গোরা সেই সময় আলোটি জ্বালাইয়া লিখিতে বসিয়াছে।

গোরা কাগজ হইতে মুখ না তুলিয়াই কহিল, “কি গো বিনয়, হাওয়া কোন্‌ দিক থেকে বইছে?”

বিনয় সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল, “গোরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। ভারতবর্ষ তোমার কাছে খুব সত্য? খুব স্পষ্ট? তুমি তো দিনরাত্রি তাকে মনে রাখ, কিন্তু কিরকম করে মনে রাখ?”

গোরা লেখা ছাড়িয়া কিছুক্ষণ তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লইয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল; তাহার পরে কলমটা রাখিয়া চৌকির পিঠের দিকে ঠেস দিয়া কহিল, “জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্রে পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে বিহারে কাজে বিশ্রামে সমুদ্রপারের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি করে মনে রেখেছি।”

বিনয়। কোথায় তোমার সেই ভারতবর্ষ?

গোরা বুকে হাত দিয়া কহিল, “আমার এইখানকার কম্পাসটা দিনরাত যেখানে কাঁটা ফিরিয়ে আছে সেইখানে, তোমার মার্শম্যান সাহেবের হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়ার মধ্যে নয়।”

বিনয়। তোমার কাঁটা যে দিকে, সে দিকে কিছু একটা আছে কি?

গোরা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আছে না তো কী– আমি পথ ভুলতে পারি, ডুবে মরতে পারি, কিন্তু আমার সেই লক্ষ্ণীর বন্দরটি আছে। সেই আমার পূর্ণস্বরূপ ভারতবর্ষ– ধনে পূর্ণ, জ্ঞানে পূর্ণ, ধর্মে পূর্ণ– সে ভারতবর্ষ কোথাও নেই! আছে কেবল চারি দিকের এই মিথ্যেটা! এই তোমার কলকাতা শহর, এই আপিস, এই আদালত, এই গোটাকতক ইঁটকাঠের বুদ্‌বুদ! ছোঃ!”

বলিয়া গোরা বিনয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল– বিনয় কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল। গোরা কহিল, “এই যেখানে আমরা পড়ছি শুনছি, চাকরির উমেদারি করে বেড়াচ্ছি, দশটা-পাঁচটায় ভূতের খাটুনি খেটে কী যে করছি তার কিছুই ঠিকানা নেই, এই জাদুকরের মিথ্যে ভারতবর্ষটাকেই আমরা সত্য বলে ঠাউরেছি ব’লেই পঁচিশ কোটি লোক মিথ্যে মানকে মান ব’লে, মিথ্যে কর্মকে কর্ম ব’লে দিনরাত বিভ্রান্ত হয়ে বেড়াচ্ছি– এই মরীচিকার ভিতর থেকে কি আমরা কোনোরকম চেষ্টায় প্রাণ পাব! আমরা তাই প্রতিদিন শুকিয়ে মরছি। একটি সত্য ভারতবর্ষ আছে– পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ, সেইখানে স্থিতি না হলে আমরা কি বুদ্ধিতে কি হৃদয়ে যথার্থ প্রাণরসটা টেনে নিতে পারব না। তাই বলছি, আর সমস্ত ভুলে, খেতাবের মায়া, উঞ্ছবৃত্তির প্রলোভন, সব টান মেরে ফেলে দিয়ে সেই বন্দরের দিকেই জাহাজ ভাসাতে হবে– ডুবি তো ডুবব, মরি তো মরব। সাধে আমি ভারতবর্ষের সত্য মূর্তি, পূর্ণ মূর্তি কোনোদিন ভুলতে পারি নে!”

বিনয়। এ-সব কেবল উত্তেজনার কথা নয়? এ তুমি সত্য বলছ?

গোরা মেঘের মতো গর্জিয়া কহিল, “সত্যই বলছি।”

বিনয়। যারা তোমার মতো দেখতে পাচ্ছে না?

গোরা মুঠা বাঁধিয়া কহিল, “তাদের দেখিয়ে দিতে হবে। এই তো আমাদের কাজ। সত্যের ছবি স্পষ্ট না দেখতে পেলে লোকে আত্মসমর্পণ করবে কোন্‌ উপছায়ার কাছে? ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো– লোকে তা হলে পাগল হয়ে যাবে। তখন কি দ্বারে দ্বারে চাঁদা সেধে বেড়াতে হবে? প্রাণ দেবার জন্যে ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে।”

বিনয়। হয় আমাকে সংসারের দশ জনের মতো ভেসে চলে যেতে দাও নইলে আমাকে সেই মূর্তি দেখাও।

গোরা। সাধনা করো। যদি বিশ্বাস মনে থাকে তা হলে কঠোর সাধনাতেই সুখ পাবে। আমাদের শৌখিন পেট্রিয়টদের সত্যকার বিশ্বাস কিছুই নেই, তাই তাঁরা নিজের এবং পরের কাছে কিছুই জোর করে দাবি করতে পারেন না। স্বয়ং কুবের যদি তাঁদের সেধে বর দিতে আসেন তা হলে তাঁরা বোধ হয় লাটসাহেবের চাপরাশির গিল্‌টি-করা তকমাটার চেয়ে বেশি আর কিছু সাহস করে চাইতেই পারেন না। তাঁদের বিশ্বাস নেই, তাই ভরসা নেই।

বিনয়। গোরা, সকলের প্রকৃতি সমান নয়। তুমি নিজের বিশ্বাস নিজের ভিতরেই পেয়েছ, এবং নিজের আশ্রয় নিজের জোরেই খাড়া করে রাখতে পার, তাই অন্যের অবস্থা ঠিক বুঝতে পার না। আমি বলছি তুমি আমাকে যা হয় একটা কাজে লাগিয়ে দাও– দিনরাত আমাকে খাটিয়ে নাও– নইলে তোমার কাছে যতক্ষণ থাকি মনে হয় যেন একটা কী পেলুম, তার পরে দূরে গেলে এমন কিছু হাতের কাছে পাই নে যেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি।

গোরা। কাজের কথা বলছ? এখন আমাদের একমাত্র কাজ এই যে, যা-কিছু স্বদেশের তারই প্রতি সংকোচহীন সংশয়হীন সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রকাশ করে দেশের অবিশ্বাসীদের মনে সেই শ্রদ্ধার সঞ্চার করে দেওয়া। দেশের সম্বন্ধে লজ্জা করে করে আমরা নিজের মনকে দাসত্বের বিষে দুর্বল করে ফেলেছি। আমাদের প্রত্যেকে নিজের দৃষ্টান্তে তার প্রতিকার করলে তার পর আমরা কাজ করবার ক্ষেত্রটি পাব। এখন যে-কোনো কাজ করতে চাই সে কেবল ইতিহাসের ইস্কুলবইটি ধ’রে পরের কাজের নকল হয়ে ওঠে। সেই ঝুঁটো কাজে কি আমরা কখনো সত্যভাবে আমাদের সমস্ত প্রাণমন দিতে পারব? তাতে কেবল নিজেদের হীন করেই তুলব।

এমন সময় হাতে একটা হুঁকা লইয়া মৃদুমন্দ অলস ভাবে মহিম আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। আপিস হইতে ফিরিয়া জলযোগ সারিয়া, একটা পান মুখে দিয়া এবং গোটাছয়েক পান বাটায় লইয়া রাস্তার ধারে বসিয়া মহিমের এই তামাক টানিবার সময়। আর-কিছুক্ষণ পরেই একটি একটি করিয়া পাড়ার বন্ধুরা জুটিবে, তখন সদর দরজার পাশের ঘরটাতে প্রমারা খেলিবার সভা বসিবে।

মহিম ঘরে ঢুকিতেই গোরা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মহিম হুঁকায় টান দিতে দিতে কহিল, “ভারত-উদ্ধারে ব্যস্ত আছ, আপাতত ভাইকে উদ্ধার করো তো।”

গোরা মহিমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মহিম কহিলেন, “আমাদের আপিসের নতুন যে বড়োসাহেব হয়েছে– ডালকুত্তার মতো চেহারা– সে বেটা ভারি পাজি। সে বাবুদের বলে বেবুন– কারো মা মরে গেলে ছুটি দিতে চায় না, বলে মিথ্যে কথা– কোনো মাসেই কোনো বাঙালি আমলার গোটা মাইনে পাবার জো নেই, জরিমানায় জরিমানায় একেবারে শতছিদ্র করে ফেলে। কাগজে তার নামে একটা চিঠি বেরিয়েছিল, সে বেটা ঠাউরেছে আমারই কর্ম। নেহাত মিথ্যে ঠাওরায় নি। কাজেই এখন আবার স্বনামে তার একটা কড়া প্রতিবাদ না লিখলে টিঁকতে দেবে না। তোমরা তো য়ুনিভার্‌সিটির জলধি মন্থন করে দুই রত্ন উঠেছ– এই চিঠিখানা একটু ভালো করে লিখে দিতে হবে। ওর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে even-handed justice, never-failing generosity, kind courteousness ইত্যাদি ইত্যাদি।”

গোরা চুপ করিয়া রহিল। বিনয় হাসিয়া কহিল, “দাদা, অতগুলো মিথ্যে কথা এক নিশ্বাসে চালাবেন?”

মহিম। শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। অনেক দিন ওদের সংসর্গ করেছি, আমার কাছে কিছুই অবিদিত নেই। ওরা যা মিথ্যে কথা জমাতে পারে সে তারিফ করতে হয়। দরকার হলে ওদের কিছু বাধে না। একজন যদি মিছে বলে তো শেয়ালের মতো আর সব ক’টাই সেই এক সুরে হুক্কাহুয়া করে ওঠে, আমাদের মতো একজন আর-এক জনকে ধরিয়ে দিয়ে বাহবা নিতে চায় না। এটা নিশ্চয় জেনো, ওদের ঠকালে পাপ নেই যদি না পড়ি ধরা।

বলিয়া হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া মহিম টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিলেন–বিনয়ও না হাসিয়া থাকিতে পারিল না।

মহিম কহিলেন, “তোমরা ওদের মুখের উপর সত্যি কথা বলে ওদের অপ্রতিভ করতে চাও! এমনি বুদ্ধি যদি ভগবান তোমাদের না দেবেন তবে দেশের এমন দশা হবে কেন? এটা তো বুঝতে হবে, যার গায়ের জোর আছে বাহাদুরি করে তার চুরি ধরিয়ে দিতে গেলে সে লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকে না। সে উল্‌টে তার সিঁধকাটিটা তুলে পরম সাধুর মতোই হুংকার দিয়ে মারতে আসে। সত্যি কি না বলো।”

বিনয়। সত্যি বৈকি।

মহিম। তার চেয়ে মিছে কথার ঘানি থেকে বিনি পয়সায় যে তেলটুকু বেরোয় তারই এক-আধ ছটাক তার পায়ে মালিশ করে যদি বলি “সাধুজি, বাবা পরমহংস, দয়া করে ঝুলিটা একটু ঝাড়ো, ওর ধুলো পেলেও বেঁচে যাব’ তা হলে তোমারই ঘরের মালের অন্তত একটা অংশ হয়তো তোমারই ঘরে ফিরে আসতে পারে, অথচ শান্তি-ভঙ্গেরও আশঙ্কা থাকে না। যদি বুঝে দেখ তো একেই বলে পেট্রিয়টিজ্‌ম্‌। কিন্তু আমার ভায়া চটছে। ও হিঁদু হয়ে অবধি আমাকে দাদা বলে খুব মানে, ওর সামনে আজ আমার কথাগুলো ঠিক বড়োভায়ের মতো হল না। কিন্তু কী করব ভাই, মিছে কথা সম্বন্ধেও তো সত্যি কথাটা বলতে হবে। বিনয়, সেই লেখাটা কিন্তু চাই। রোসো, আমার নোট লেখা আছে, সেটা নিয়ে আসি।

বলিয়া মহিম তামাক টানিতে টানিতে বাহির হইয়া গেলেন। গোরা বিনয়কে কহিল, “বিনু, তুমি দাদার ঘরে গিয়ে ওঁকে ঠেকাও গে। আমি লেখাটা শেষ করে ফেলি।”

গোরা ০৫

“ওগো, শুনছ? আমি তোমার পুজোর ঘরে ঢুকছি নে, ভয় নেই। আহ্নিক শেষ হলে একবার ও ঘরে যেয়ো– তোমার সঙ্গে কথা আছে। দুজন নূতন সন্ন্যাসী যখন এসেছে তখন কিছুকাল তোমার আর দেখা পাব না জানি, সেইজন্যে বলতে এলুম। ভুলো না, একবার যেয়ো।”

এই বলিয়া আনন্দময়ী ঘরকরনার কাজে ফিরিয়া গেলেন।

কৃষ্ণদয়ালবাবু শ্যামবর্ণ দোহারা-গোছের মানুষ, বেশি লম্বা নহেন। মুখের মধ্যে বড়ো বড়ো দুইটা চোখ সব চেয়ে চোখে পড়ে, বাকি প্রায় সমস্তই কাঁচাপাকা গোঁফে দাড়িতে সমাচ্ছন্ন। ইনি সর্বদাই গেরুয়া রঙের পট্টবস্ত্র পরিয়া আছেন, হাতের কাছে পিতলের কমণ্ডলু, পায়ে খড়ম। মাথার সামনের দিকে টাক পড়িয়া আসিতেছে– বাকি বড়ো বড়ো চুল গ্রন্থি দিয়া মাথার উপরে একটা চূড়া করিয়া বাঁধা।

একদিন পশ্চিমে থাকিতে ইনি পল্‌টনের গোরাদের সঙ্গে মিশিয়া মদ-মাংস খাইয়া একাকার করিয়া দিয়াছেন। তখন দেশের পূজারি পুরোহিত বৈষ্ণব সন্ন্যাসী শ্রেণীর লোকদিগকে গায়ে পড়িয়া অপমান করাকে পৌরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন, এখন না মানেন এমন জিনিস নাই। নূতন সন্ন্যাসী দেখিলেই তাহার কাছে নূতন সাধনার পন্থা শিখিতে বসিয়া যান। মুক্তির নিগূঢ় পথ এবং যোগের নিগূঢ় প্রণালীর জন্য ইঁহার লুব্ধতার অবধি নাই। তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাস করিবেন বলিয়া কৃষ্ণদয়াল কিছুদিন উপদেশ লইতেছিলেন এমন সময় একজন বৌদ্ধ পুরোহিতের সন্ধান পাইয়া সম্প্রতি তাঁহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে।

ইঁহার প্রথম স্ত্রী একটি পুত্র প্রসব করিয়া যখন মারা যান তখন ইঁহার বয়স তেইশ বছর। মাতার মৃত্যুর কারণ বলিয়া, রাগ করিয়া ছেলেটিকে তাঁহার শ্বশুরবাড়ি রাখিয়া কৃষ্ণদয়াল প্রবল বৈরাগ্যের ঝোঁকে একেবারে পশ্চিমে চলিয়া যান এবং ছয় মাসের মধ্যেই কাশীবাসী সার্বভৌম মহাশয়ের পিতৃহীনা পৌত্রী আনন্দময়ীকে বিবাহ করেন।

পশ্চিমে কৃষ্ণদয়াল চাকরির জোগাড় করিলেন এবং মনিবদের কাছে নানা উপায়ে প্রতিপত্তি করিয়া লইলেন। ইতিমধ্যে সার্বভৌমের মৃত্যু হইল; অন্য কোনো অভিভাবক না থাকাতে স্ত্রীকে নিজের কাছে আনিয়াই রাখিতে হইল।

ইতিমধ্যে যখন সিপাহিদের ম্যুটিনি বাধিল সেই সময়ে কৌশলে দুই-এক জন উচ্চপদস্থ ইংরেজের প্রাণরক্ষা করিয়া ইনি যশ এবং জায়গির লাভ করেন। ম্যুটিনির কিছুকাল পরেই কাজ ছাড়িয়া দিলেন এবং নবজাত গোরাকে লইয়া কিছুদিন কাশীতে কাটাইলেন। গোরার বয়স যখন বছর পাঁচেক হইল তখন কৃষ্ণদয়াল কলিকাতায় আসিয়া তাঁহার বড়ো ছেলে মহিমকে তাহার মামার বাড়ি হইতে নিজের কাছে আনাইয়া মানুষ করিলেন। এখন মহিম পিতার মুরুব্বিদের অনুগ্রহে সরকারি খাতাঞ্জিখানায় খুব তেজের সঙ্গে কাজ চালাইতেছে।

গোরা শিশুকাল হইতেই তাহার পাড়ার এবং ইস্কুলের ছেলেদের সর্দারি করিত। মাস্টার-পণ্ডিতের জীবন অসহ্য করিয়া তোলাই তাহার প্রধান কাজ এবং আমোদ ছিল। একটু বয়স হইতেই সে ছাত্রদের ক্লাবে “স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ এবং “বিংশতি কোটি মানবের বাস’ আওড়াইয়া, ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করিয়া ক্ষুদ্র বিদ্রোহীদের দলপতি হইয়া উঠিল। অবশেষে যখন এক সময় ছাত্রসভার ডিম্ব ভেদ করিয়া গোরা বয়স্কসভায় কাকলি বিস্তার করিতে আরম্ভ করিল, তখন কৃষ্ণদয়ালবাবুর কাছে সেটা অত্যন্ত কৌতুকের বিষয় বলিয়া মনে হইল।

বাহিরের লোকের কাছে গোরার প্রতিপত্তি দেখিতে দেখিতে বাড়িয়া উঠিল; কিন্তু ঘরে কাহারো কাছে সে বড়ো আমল পাইল না। মহিম তখন চাকরি করে– সে গোরাকে কখনো বা “পেট্রিয়ট-জ্যাঠা’ কখনো বা “হরিশ মুখুজ্জে দি সেকেণ্ড্‌’ বলিয়া নানাপ্রকারে দমন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। তখন দাদার সঙ্গে গোরার প্রায় মাঝে মাঝে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইত। আনন্দময়ী গোরার ইংরেজ-বিদ্বেষে মনে মনে অত্যন্ত উদ্‌বেগ অনুভব করিতেন। তাহাকে নানাপ্রকারে ঠাণ্ডা করিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু কোনো ফলই হইত না। গোরা রাস্তায় ঘাটে কোনো সুযোগে ইংরেজের সঙ্গে মারামারি করিতে পারিলে জীবন ধন্য মনে করিত।

এ দিকে কেশববাবুর বক্তৃতায় মুগ্ধ হইয়া গোরা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়া পড়িল; আবার এই সময়টাতেই কৃষ্ণদয়াল ঘোরতর আচারনিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। এমন-কি, গোরা তাঁহার ঘরে গেলেও তিনি ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিতেন। গুটি দুই-তিন ঘর লইয়া তিনি নিজের মহল স্বতন্ত্র করিয়া রাখিলেন। ঘটা করিয়া সেই মহলের দ্বারের কাছে “সাধনাশ্রম” নাম লিখিয়া কাষ্ঠফলক লটকাইয়া দিলেন।

বাপের এই কাণ্ডকারখানায় গোরার মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। সে বলিল, “আমি এ-সমস্ত মূঢ়তা সহ্য করিতে পারি না এ আমার চক্ষুশূল।” এই উপলক্ষে গোরা তাহার বাপের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া একেবারে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিয়াছিল– আনন্দময়ী তাহাকে কোনোরকমে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিলেন।

বাপের কাছে যে-সকল ব্রাহ্মণপণ্ডিতের সমাগম হইতে লাগিল গোরা জো পাইলেই তাঁহাদের সঙ্গে তর্ক বাধাইয়া দিত। সে তো তর্ক নয়, প্রায় ঘুষি বলিলেই হয়। তাঁহাদের অনেকেরই পাণ্ডিত্য অতি যৎসামান্য এবং অর্থলোভ অপরিমিত ছিল; গোরাকে তাঁহারা পারিয়া উঠিতেন না, তাহাকে বাঘের মতো ভয় করিতেন। ইঁহাদের মধ্যে কেবল হরচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের প্রতি গোরার শ্রদ্ধা জন্মিল।

বেদান্তচর্চা করিবার জন্য বিদ্যাবাগীশকে কৃষ্ণদয়াল নিযুক্ত করিয়াছিলেন। গোরা প্রথমেই ইঁহার সঙ্গে উদ্ধতভাবে লড়াই করিতে গিয়া দেখিল লড়াই চলে না। লোকটি যে কেবল পণ্ডিত তাহা নয়, তাঁহার মতের ঔদার্য অতি আশ্চর্য। কেবল সংস্কৃত পড়িয়া এমন তীক্ষ্ণ অথচ প্রশস্ত বুদ্ধি যে হইতে পারে গোরা তাহা কল্পনাও করিতে পারিত না। বিদ্যাবাগীশের চরিত্রে ক্ষমা ও শান্তিতে পূর্ণ এমন একটি অবিচলিত ধৈর্য ও গভীরতা ছিল যে তাঁহার কাছে নিজেকে সংযত না করা গোরার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল। হরচন্দ্রের কাছে গোরা বেদান্তদর্শন পড়িতে আরম্ভ করিল। গোরা কোনো কাজ আধা-আধি-রকম করিতে পারে না, সুতরাং দর্শন-আলোচনার মধ্যে সে একেবারে তলাইয়া গেল।

ঘটনাক্রমে এই সময়ে একজন ইংরেজ মিশনারি কোনো সংবাদপত্রে হিন্দুশাস্ত্র ও সমাজকে আক্রমণ করিয়া দেশের লোককে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করিলেন। গোরা তো একেবারে আগুন হইয়া উঠিল। যদিচ সে নিজে অবকাশ পাইলেই শাস্ত্র ও লোকাচারের নিন্দা করিয়া বিরুদ্ধমতের লোককে যত রকম করিয়া পারে পীড়া দিত, তবু হিন্দুসমাজের প্রতি বিদেশী লোকের অবজ্ঞা তাহাকে যেন অঙ্কুশে আহত করিয়া তুলিল।

সংবাদপত্রে গোরা লড়াই শুরু করিল। অপর পক্ষে হিন্দুসমাজকে যতগুলি দোষ দিয়াছিল গোরা তাহার একটাও এবং একটুও স্বীকার করিল না। দুই পক্ষে অনেক উত্তর চালাচালি হইলে পর সম্পাদক বলিলেন, “আমরা আর বেশি চিঠিপত্র ছাপিব না।”

কিন্তু গোরার তখন রোখ চড়িয়া গেছে। সে “হিণ্ডুয়িজ্‌ম্‌’ নাম দিয়া ইংরেজিতে এক বই লিখিতে লাগিল– তাহাতে তাহার সাধ্যমত সমস্ত যুক্তি ও শাস্ত্র ঘাঁটিয়া হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনিন্দনীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করিতে বসিয়া গেল।

এমনি করিয়া মিশনারির সঙ্গে ঝগড়া করিতে গিয়া গোরা আস্তে আস্তে নিজের ওকালতির কাছে নিজে হার মানিল। গোরা বলিল, “আমার আপন দেশকে বিদেশীর আদালতে আসামীর মতো খাড়া করিয়া বিদেশীর আইনমতে তাহার বিচার করিতে আমরা দিবই না। বিলাতের আদর্শের সঙ্গে খুঁটিয়া খুঁটিয়া মিল করিয়া আমরা লজ্জাও পাইব না, গৌরবও বোধ করিব না। যে দেশে জন্মিয়াছি সে দেশের আচার, বিশ্বাস, শাস্ত্র ও সমাজের জন্য পরের ও নিজের কাছে কিছুমাত্র সংকুচিত হইয়া থাকিব না। দেশের যাহা-কিছু আছে তাহার সমস্তই সবলে ও সগর্বে মাথায় করিয়া লইয়া দেশকে ও নিজেকে অপমান হইতে রক্ষা করিব।”

এই বলিয়া গোরা গঙ্গাস্নান ও সন্ধ্যাহ্নিক করিতে লাগিল, টিকি রাখিল, খাওয়া-ছোঁওয়া সম্বন্ধে বিচার করিয়া চলিল। এখন হইতে প্রত্যহ সকালবেলায় সে বাপ-মায়ের পায়ের ধুলা লয়, যে মহিমকে সে কথায় কথায় ইংরেজি ভাষায় “ক্যাড’ ও “স্নব’ বলিয়া অভিহিত করিতে ছাড়িত না, তাহাকে দেখিলে উঠিয়া দাঁড়ায়, প্রণাম করে; মহিম এই হঠাৎ-ভক্তি লইয়া তাহাকে যাহা মুখে আসে তাহাই বলে, কিন্তু গোরা তাহার কোনো জবাব করে না।

গোরা তাহার উপদেশ ও আচরণে দেশের এক দল লোককে যেন জাগাইয়া দিল। তাহারা যেন একটা টানাটানির হাত হইতে বাঁচিয়া গেল; হাঁফ ছাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “আমরা ভালো কি মন্দ, সভ্য কি অসভ্য তাহা লইয়া জবাবদিহি কারো কাছে করিতে চাই না– কেবল আমরা ষোলো-আনা অনুভব করিতে চাই যে আমরা আমরাই।”

কিন্তু কৃষ্ণদয়াল গোরার এই নূতন পরিবর্তনে যে খুশি হইলেন তাহা মনে হইল না। এমন-কি, তিনি একদিন গোরাকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখো বাবা, হিন্দুশাস্ত্র বড়ো গভীর জিনিস। ঋষিরা যে ধর্ম স্থাপন করে গেছেন তা তলিয়ে বোঝা যে-সে লোকের কর্ম নয়। আমার বিবেচনায় না বুঝে এ নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। তুমি ছেলেমানুষ, বরাবর ইংরেজি পড়ে মানুষ হয়েছ, তুমি যে ব্রাহ্মসমাজের দিকে ঝুঁকেছিলে সেটা তোমার ঠিক অধিকারের মতোই কাজ করেছিলে। সেইজন্যেই আমি তাতে কিছুই রাগ করি নি, বরঞ্চ খুশিই ছিলুম। কিন্তু এখন তুমি যে পথে চলেছ এটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। এ তোমার পথই নয়।”

গোরা কহিল, “বলেন কী বাবা? আমি যে হিন্দু। হিন্দুধর্মের গূঢ় মর্ম আজ না বুঝি তো কাল বুঝব– কোনোকালে যদি না বুঝি তবু এই পথে চলতেই হবে। হিন্দুসমাজের সঙ্গে পূর্বজন্মের সম্বন্ধ কাটাতে পারি নি বলেই তো এ জন্মে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি, এমনি করেই জন্মে জন্মে এই হিন্দুধর্মের ও হিন্দুসমাজের ভিতর দিয়েই অবশেষে এর চরমে উত্তীর্ণ হব। যদি কখনো ভুলে অন্য পথের দিকে একটু হেলি আবার দ্বিগুণ জোরে ফিরতেই হবে।”

কৃষ্ণদয়াল কেবলই মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, “কিন্তু , বাবা, হিন্দু বললেই হিন্দু হওয়া যায় না। মুসলমান হওয়া সোজা, খ্রীস্টান যে-সে হতে পারে– কিন্তু হিন্দু! বাস্‌রে! ও বড়ো শক্ত কথা।

গোরা। সে তো ঠিক। কিন্তু আমি যখন হিন্দু হয়ে জন্মেছি, তখন তো সিংহদ্বার পার হয়ে এসেছি। এখন ঠিকমত সাধন করে গেলেই অল্পে অল্পে এগোতে পারব।

কৃষ্ণদয়াল। বাবা, তর্কে তোমাকে ঠিকটি বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যা বলছ সেও সত্য। যার যেটা কর্মফল, নির্দিষ্ট ধর্ম, তাকে একদিন ঘুরে ফিরে সেই ধর্মের পথেই আসতে হবে– কেউ আটকাতে পারবে না। ভগবানের ইচ্ছে। আমরা কী করতে পারি! আমরা তো উপলক্ষ।

কর্মফল এবং ভগবানের ইচ্ছা, সোহহংবাদ এবং ভক্তিতত্ত্ব সমস্তই কৃষ্ণদয়াল সম্পূর্ণ সমান ভাবে গ্রহণ করেন– পরস্পরের মধ্যে যে কোনোপ্রকার সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে তাহা অনুভবমাত্র করেন না।

 গোরা ০৬

আজ আহ্নিক ও স্নানাহার সারিয়া কৃষ্ণদয়াল অনেক দিন পরে আনন্দময়ীর ঘরের মেজের উপর নিজের কম্বলের আসনটি পাতিয়া সাবধানে চারি দিকের সমস্ত সংস্রব হইতে যেন বিবিক্ত হইয়া খাড়া হইয়া বসিলেন।

আনন্দময়ী কহিলেন, “ওগো, তুমি তো তপস্যা করছ, ঘরের কথা কিছু ভাব না, কিন্তু আমি যে গোরার জন্যে সর্বদাই ভয়ে ভয়ে গেলুম।”

কৃষ্ণদয়াল। কেন, ভয় কিসের?

আনন্দময়ী। তা আমি ঠিক বলতে পারি নে। কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, গোরা আজকাল এই যে হিঁদুয়ানি আরম্ভ করেছে এ ওকে কখনোই সইবে না, এ ভাবে চলতে গেলে শেষকালে একটা কী বিপদ ঘটবে। আমি তো তোমাকে তখনই বলেছিলুম, ওর পইতে দিয়ো না। তখন যে তুমি কিছুই মানতে না; বললে, গলায় একগাছা সুতো পরিয়ে দিলে তাতে কারো কিছু আসে যায় না। কিন্তু শুধু তো সুতো নয়– এখন ওকে ঠেকাবে কোথায়?

কৃষ্ণদয়াল। বেশ! সব দোষ বুঝি আমার! গোড়ায় তুমি যে ভুল করলে। তুমি যে ওকে কোনোমতেই ছাড়তে চাইলে না। তখন আমিও গোঁয়ারগোছের ছিলুম– ধর্মকর্ম কোনো-কিছুর তো জ্ঞান ছিল না। এখন হলে কি এমন কাজ করতে পারতুম।

আনন্দময়ী। কিন্তু যাই বল, আমি যে কিছু অধর্ম করেছি সে আমি কোনোমতে মানতে পারব না। তোমার তো মনে আছে ছেলে হবার জন্যে আমি কী না করেছি– যে যা বলেছে তাই শুনেছি– কত মাদুলি কত মন্তর নিয়েছি সে তো তুমি জানই। একদিন স্বপ্নে দেখলুম যেন সাজি ভরে টগরফুল নিয়ে এসে ঠাকুরের পুজো করতে বসেছি– এক সময় চেয়ে দেখি সাজিতে ফুল নেই, ফুলের মতো ধব্‌ধবে একটি ছোট্ট ছেলে; আহা সে কী দেখেছিলুম সে কী বলব, আমার দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল– তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে যাব আর ঘুম ভেঙে গেল। তার দশ দিন না যেতেই তো গোরাকে পেলুম– সে আমার ঠাকুরের দান– সে কি আর-কারো যে আমি কাউকে ফিরিয়ে দেব। আর-জন্মে তাকে গর্ভে ধারণ করে বোধ হয় অনেক কষ্ট পেয়েছিলুম তাই আজ সে আমাকে মা বলতে এসেছে। কেমন করে কোথা থেকে সে এল ভেবে দেখো দেখি। চারি দিক তখন মারামারি কাটাকাটি, নিজের প্রাণের ভয়েই মরি– সেই সময় রাত-দুপুরে সেই মেম যখন আমাদের বাড়িতে এসে লুকোল, তুমি তো তাকে ভয়ে বাড়িতে রাখতেই চাও না– আমি তোমাকে ভাঁড়িয়ে তাকে গোয়ালঘরে লুকিয়ে রাখলুম। সেই রাত্রেই ছেলেটি প্রসব করে সে তো মারা গেল। সেই বাপ-মা মরা ছেলেকে আমি যদি না বাঁচাতুম তো সে কি বাঁচত? তোমার কী! তুমি তো পাদ্রির হাতে ওকে দিতে চেয়েছিলে। কেন! পাদ্রিকে দিতে যাব কেন! পাদ্রি কি ওর মা-বাপ, না ওর প্রাণরক্ষা করেছে? এমন করে যে ছেলে পেয়েছি সে কি গর্ভে পাওয়ার চেয়ে কম। তুমি যাই বল, এ ছেলে যিনি আমাকে দিয়েছেন তিনি স্বয়ং যদি না নেন তবে প্রাণ গেলেও আর কাউকে নিতে দিচ্ছি নে।

কৃষ্ণদয়াল। সে তো জানি। তা, তোমার গোরাকে নিয়ে তুমি থাকো, আমি তো কখনো তাতে কোনো বাধা দিই নি। কিন্তু ওকে ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে তার পরে ওর পইতে না দিলে তো সমাজে মানবে না। তাই পইতে কাজেই দিতে হল। এখন কেবল দুটি কথা ভাববার আছে। ন্যায়ত আমার বিষয়সম্পত্তি সমস্ত মহিমেরই প্রাপ্য– তাই–

আনন্দময়ী। কে তোমার বিষয়সম্পত্তির অংশ নিতে চায়! তুমি যত টাকা করেছ সব তুমি মহিমকে দিয়ে যেয়ো– গোরা তার এক পয়সাও নেবে না। ও পুরুষমানুষ, লেখাপড়া শিখেছে, নিজে খেটে উপার্জন করে খাবে- ও পরের ধনে ভাগ বসাতে যাবে কেন! ও বেঁচে থাক্‌ সেই আমার ঢের– আমার আর কোনো সম্পত্তির দরকার নেই।

কৃষ্ণদয়াল। না, ওকে একেবারে বঞ্চিত করব না, জায়গিরটা ওকেই দিয়ে দেব– কালে তার মুনফা বছরে হাজার টাকা হতে পারবে। এখন ভাবনার কথা হচ্ছে ওর বিবাহ দেওয়া নিয়ে। পূর্বে যা করেছি তা করেছি– কিন্তু এখন তো হিন্দুমতে ব্রাহ্মণের ঘরে ওর বিয়ে দিতে পারব না– তা এতে তুমি রাগই কর আর যাই কর।

আনন্দময়ী। হায় হায়, তুমি মনে কর তোমার মতো পৃথিবীময় গঙ্গাজল আর গোবর ছিটিয়ে বেড়াই নে বলে আমার ধর্মজ্ঞান নেই। ব্রাহ্মণের ঘরে ওর বিয়েই বা দেব কেন, আর রাগ করবই বা কী জন্যে?

কৃষ্ণদয়াল। বল কী! তুমি যে বামুনের মেয়ে।

আনন্দময়ী। তা হই না বামুনের মেয়ে। বামনাই করা তো আমি ছেড়েই দিয়েছি। ঐ তো মহিমের বিয়ের সময় আমার খ্রীস্টানি চাল বলে কুটুম্বরা গোল করেতে চেয়েছিল– আমি তাই ইচ্ছে করেই তফাত হয়ে ছিলুম, কথাটি কই নি। পৃথিবীসুদ্ধ লোক আমাকে খ্রীস্টান বলে, আরো কত কী কথা কয়– আমি সমস্ত মেনে নিয়েই বলি, তা খ্রীস্টান কি মানুষ নয়! তোমরাই যদি এত উঁচু জাত আর ভগবানের এত আদরের তবে তিনি একবার পাঠানের, একবার মোগলের, একবার খ্রীস্টানের পায়ে এমন করে তোমাদের মাথা মুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?

কৃষ্ণদয়াল। ও-সব অনেক কথা, তুমি মেয়েমানুষ সে-সব বুঝবে না। কিন্তু সমাজ একটা আছে– সেটা তো বোঝ, সেটা তোমার মেনে চলাই উচিত।

আনন্দময়ী। আমার বুঝে কাজ নেই। আমি এই বুঝি যে, গোরাকে আমি যখন ছেলে বলে মানুষ করেছি তখন আচার-বিচারের ভড়ং করতে গেলে সমাজ থাক্‌ আর না-থাক্‌ ধর্ম থাকবে না। আমি কেবল সেই ধর্মের ভয়েই কোনোদিন কিছু লুকোই নে– আমি যে কিছু মানছি নে সে সকলকেই জানতে দিই, আর সকলেরই ঘৃণা কুড়িয়ে চুপ করে পড়ে থাকি। কেবল একটি কথাই লুকিয়েছি, তারই জন্যে ভয়ে ভয়ে সারা হয়ে গেলুম, ঠাকুর কখন কী করেন। দেখো, আমার মনে হয় গোরাকে সকল কথা বলে ফেলি, তার পরে অদৃষ্টে যা থাকে তাই হবে।

কৃষ্ণদয়াল ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “না না, আমি বেঁচে থাকতে কোনোমতেই সে হতে পারবে না। গোরাকে তো জানই। এ কথা শুনলে সে কী যে করে বসবে তা কিছুই বলা যায় না। তার পরে সমাজে একটা হুলস্থুল পড়ে যাবে। শুধু তাই? এ দিকে গবর্মেন্ট কী করে তাও বলা যায় না। যদিও গোরার বাপ লড়াইয়ে মারা গেছে, ওর মাও তো মরেছে জানি, কিন্তু সব হাঙ্গামা চুকে গেলে ম্যাজেস্টরিতে খবর দেওয়া উচিত ছিল। এখন এই নিয়ে যদি একটা গোলমাল উঠে পড়ে তা হলে আমার সাধন-ভজন সমস্ত মাটি হবে, আরো কী বিপদ ঘটে বলা যায় না।”

আনন্দময়ী নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিলেন। কৃষ্ণদয়াল কিছুক্ষণ পরে কহিলেন, “গোরার বিবাহ সম্বন্ধে আমি একটা পরামর্শ মনে মনে করেছি। পরেশ ভট্‌চাজ আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ত। সে স্কুল-ইন্‌স্‌পেক্টরি কাজে পেনসন নিয়ে সম্প্রতি কলকাতায় এসে বসেছে। সে ঘোর ব্রাহ্ম। শুনেছি তার ঘরে অনেকগুলি মেয়েও আছে। গোরাকে তার বাড়িতে যদি ভিড়িয়ে দেওয়া যায় তবে যাতায়াত করতে করতে পরেশের কোনো মেয়েকে তার পছন্দ হয়ে যেতেও পারে। তার পরে প্রজাপতির নির্বন্ধ।”

আনন্দময়ী। বল কী! গোরা ব্রাহ্মর বাড়ি যাতায়াত করবে? সেদিন ওর আর নেই।

বলিতে বলিতে স্বয়ং গোরা তাহার মেঘমন্দ্র স্বরে “মা” বলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কৃষ্ণদয়ালকে এখানে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে কিছু আশ্চর্য হইয়া গেল। আনন্দময়ী তাডাতাড়ি উঠিয়া গোরার কাছে গিয়া দুই চক্ষে স্নেহ বিকীর্ণ করিতে করিতে কহিলেন, “কী বাবা, কী চাই?”

“না বিশেষ কিছু না, এখন থাক্‌।” বলিয়া গোরা ফিরিবার উপক্রম করিল।

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “একটু বোসো, একটা কথা আছে। আমার একটি ব্রাহ্মবন্ধু সম্প্রতি কলকাতায় এসেছেন; তিনি হেদোতলায় থাকেন।”

গোরা। পরেশবাবু নাকি?

কৃষ্ণদয়াল। তুমি তাঁকে জানলে কী করে?

গোরা। বিনয় তাঁর বাড়ির কাছেই থাকে, তার কাছে তাঁদের গল্প শুনেছি।

কৃষ্ণদয়াল। আমি ইচ্ছা করি তুমি তাঁদের খবর নিয়ে এসো।

গোরা আপন মনে একটু চিন্তা করিল, তার পরে হঠাৎ বলিল, “আচ্ছা, আমি কালই যাব।”

আনন্দময়ী কিছু আশ্চর্য হইলেন।

গোরা একটু ভাবিয়া আবার কহিল, “না, কাল তো আমার যাওয়া হবে না।”

কৃষ্ণদয়াল। কেন?

গোরা। কাল আমাকে ত্রিবেণী যেতে হবে।

কৃষ্ণদয়াল আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “ত্রিবেণী!”

গোরা। কাল সূর্যগ্রহণের স্নান।

আনন্দময়ী। তুই অবাক করলি গোরা! স্নান করতে চাস কলকাতার গঙ্গা আছে। ত্রিবেণী না হলে তোর স্নান হবে না– তুই যে দেশসুদ্ধ সকল লোককে ছাড়িয়ে উঠলি।

গোরা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।

গোরা যে ত্রিবেণীতে স্নান করিতে সংকল্প করিয়াছে তাহার কারণ এই যে, সেখানে অনেক তীর্থযাত্রী একত্র হইবে। সেই জনসাধারণের সঙ্গে গোরা নিজেকে এক করিয়া মিলাইয়া দেশের একটি বৃহৎ প্রবাহের মধ্যে আপনাকে সমর্পণ করিতে ও দেশের হৃদয়ের আন্দোলনকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে চায়। যেখানে গোরা একটুমাত্র অবকাশ পায় সেখানেই সে তাহার সমস্ত সংকোচ, সমস্ত পূর্বসংস্কার সবলে পরিত্যাগ করিয়া দেশের সাধারণের সঙ্গে সমান ক্ষেত্রে নামিয়া দাঁড়াইয়া মনের সঙ্গে বলিতে চায়, “আমি তোমাদের, তোমরা আমার।”

গোরা ০৭

ভোরে উঠিয়া বিনয় দেখিল রাত্রির মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হইয়া গেছে। সকাল-বেলাকার আলোটি দুধের ছেলের হাসির মতো নির্মল হইয়া ফুটিয়াছে। দুই-একটা সাদা মেঘ নিতান্তই বিনা প্রয়োজনে আকাশে ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

বারান্দায় দাঁড়াইয়া আর-একটি নির্মল প্রভাতের স্মৃতিতে যখন সে পুলকিত হইয়া উঠিতেছিল এমন সময় দেখিল পরেশ এক হাতে লাঠি ও অন্য হাতে সতীশের হাত ধরিয়া রাস্তা দিয়া ধীরে ধীরে চলিয়াছেন। সতীশ বিনয়কে বারান্দায় দেখিতে পাইয়াই হাততালি দিয়া “বিনয়বাবু” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। পরেশও মুখ তুলিয়া চাহিয়া বিনয়কে দেখিতে পাইলেন। বিনয় তাড়াতাড়ি নীচে যেমন নামিয়া আসিল, সতীশকে লইয়া পরেশও তাহার বাসার মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

সতীশ বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “বিনয়বাবু, আপনি যে সেদিন বললেন আমাদের বাড়িতে যাবেন, কই গেলেন না তো?”

বিনয় সস্নেহে সতীশের পিঠে হাত দিয়া হাসিতে লাগিল। পরেশ সাবধানে তাঁহার লাঠিগাছটি টেবিলের গায়ে ঠেস দিয়া দাঁড় করাইয়া চৌকিতে বসিলেন ও কহিলেন, “সেদিন আপনি না থাকলে আমাদের ভারি মুশকিল হত। বড়ো উপকার করেছেন।”

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কী বলেন, কীই বা করেছি।”

সতীশ হঠাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা বিনয়বাবু, আপনার কুকুর নেই?”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “কুকুর? না, কুকুর নেই।”

সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, কুকুর রাখেন নি কেন?”

বিনয় কহিল, “কুকুরের কথাটা কখনো মনে হয় নি।”

পরেশ কহিলেন, “শুনলুম সেদিন সতীশ আপনার এখানে এসেছিল, খুব বোধ হয় বিরক্ত করে গেছে। ও এত বকে যে, ওর দিদি ওকে বক্তিয়ার খিলিজি নাম দিয়েছে।”

বিনয় কহিল, “আমিও খুব বকতে পারি তাই আমাদের দুজনের খুব ভাব হয়ে গেছে। কী বল সতীশবাবু!”

সতীশ এ কথার কোনো উত্তর দিল না; কিন্তু পাছে তাহার নূতন নামকরণ লইয়া বিনয়ের কাছে তাহার গৌরবহানি হয় সেইজন্য সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। এবং কহিল, “বেশ তো, ভালোই তো। বক্তিয়ার খিলিজি ভালোই তো। আচ্ছা বিনয়বাবু, বক্তিয়ার খিলিজি তো লড়াই করেছিল? সে তো বাংলা দেশ জিতে নিয়েছিল?”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “আগে সে লড়াই করত, এখন আর লড়াইয়ের দরকার হয় না, এখন সে শুধু বক্তৃতা করে। আর বাংলা দেশ জিতেও নেয়।”

এমনি করিয়া অনেকক্ষণ কথাবার্তা হইল। পরেশ সকলের চেয়ে কম কথা কহিয়াছিলেন– তিনি কেবল প্রসন্ন শান্ত মুখে মাঝে মাঝে হাসিয়াছেন এবং দুটো-একটা কথায় যোগ দিয়াছেন। বিদায় লইবার সময় চৌকি হইতে উঠিয়া বলিলেন, “আমাদের আটাত্তর নম্বরের বাড়িটা এখান থেকে বরাবর ডান-হাতি গিয়ে–”

সতীশ কহিল, “উনি আমাদের বাড়ি জানেন। উনি যে সেদিন আমার সঙ্গে বরাবর আমাদের দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলেন।”

এ কথায় লজ্জা পাইবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু বিনয় মনে মনে লজ্জিত হইয়া উঠিল। যেন কী-একটা তাহার ধরা পড়িয়া গেল।

বৃদ্ধ কহিলেন, “তবে তো আপনি আমাদের বাড়ি জানেন। তা হলে যদি কখনো আপনার–”

বিনয়। সে আর বলতে হবে না। যখনই–

পরেশ। আমাদের এ তো একই পাড়া– কেবল কলকাতা বলেই এতদিন চেনা-শোনা হয় নি।

বিনয় রাস্তা পর্যন্ত পরেশকে পৌঁছাইয়া দিল। দ্বারের কাছে কিছুক্ষণ সে দাঁড়াইয়া রহিল। পরেশ লাঠি লইয়া ধীরে ধীরে চলিলেন– আর সতীশ ক্রমাগত বকিতে বকিতে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

বিনয় মনে মনে বলিতে লাগিল, পরেশবাবুর মতো এমন বৃদ্ধ দেখি নাই, পায়ের ধুলা লইতে ইচ্ছা করে। আর সতীশ ছেলেটি কী চমৎকার! বাঁচিয়া থাকিলে এ একজন মানুষ হইবে– যেমন বুদ্ধি তেমনি সরলতা।

এই বৃদ্ধ এবং বালকটি যতই ভালো হোক এত অল্পক্ষণের পরিচয়ে তাহাদের সম্বন্ধে এতটা পরিমাণে ভক্তি ও স্নেহের উচ্ছ্বাস সাধারণত সম্ভবপর হইতে পারিত না। কিন্তু বিনয়ের মনটা এমন অবস্থায় ছিল যে, সে অধিক পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে নাই।

তাহার পরে বিনয় মনে মনে ভাবিতে লাগিল– পরেশবাবুর বাড়িতে যাইতেই হইবে, নহিলে ভদ্রতা রক্ষা হইবে না।

কিন্তু গোরার মুখ দিয়া তাহাদের দলের ভারতবর্ষ তাহাকে বলিতে লাগিল, ওখানে তোমার যাতায়াত চলিবে না। খবরদার!

বিনয় পদে পদে তাহাদের দলের ভারতবর্ষের অনেক নিষেধ মানিয়াছে। অনেক সময় দ্বিধা বোধ করিয়াছে, তবু মানিয়াছে। আজ তাহার মনের ভিতরে একটা বিদ্রোহ দেখা দিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, ভারতবর্ষ যেন কেবল নিষেধেরই মূর্তি।

চাকর আসিয়া খবর দিল আহার প্রস্তুত– কিন্তু এখনো বিনয়ের স্নানও হয় নাই। বারোটা বাজিয়া গেছে। হঠাৎ এক সময় বিনয় সজোরে মাথা ঝাড়া দিয়া কহিল, “আমি খাব না, তোরা যা।”

বলিয়া ছাতা ঘাড়ে করিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল– একটা চাদরও কাঁধে লইল না।

বরাবর গোরাদের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। বিনয় জানিত আমহার্স্ট্‌ স্ট্রীটে একটা বাড়ি ভাড়া লইয়া হিন্দুহিতৈষীর আপিস বসিয়াছে; প্রতিদিন মধ্যাহ্নে গোরা আপিসে গিয়া সমস্ত বাংলা দেশে তাহার দলের লোক যেখানে যে আছে সবাইকে পত্র লিখিয়া জাগ্রত করিয়া রাখে। এইখানেই তাহার ভক্তরা তাহার মুখে উপদেশ শুনিতে আসে এবং তাহার সহকারিতা করিয়া নিজেকে ধন্য মনে করে।

সেদিনও গোরা সেই আপিসের কাজে গিয়াছিল। বিনয় একেবারে যেন দৌড়িয়া অন্তঃপুরে আনন্দময়ীর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তখন ভাত খাইতে বসিয়াছিলেন এবং লছমিয়া তাঁহার কাছে বসিয়া তাঁহাকে পাখা করিতেছিল।

আনন্দময়ী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কী রে বিনয়, কী হয়েছে তোর?”

বিনয় তাঁহার সম্মুখে বসিয়া পড়িয়া কহিল, “মা, বড়ো খিদে পেয়েছে, আমাকে খেতে দাও।”

আনন্দময়ী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “তবেই তো মুশকিলে ফেললি। বামুন-ঠাকুর চলে গেছে– তোরা যে আবার–”

বিনয় কহিল, “আমি কি বামুন-ঠাকুরের রান্না খেতে এলুম। তা হলে আমার বাসার বামুন কী দোষ করলে? আমি তোমার পাতের প্রসাদ খাব মা। লছমিয়া, দে তো আমাকে এক গ্লাস জল এনে।”

লছমিয়া জল আনিয়া দিতেই বিনয় ঢক্‌ ঢক্‌ করিয়া খাইয়া ফেলিল। তখন আনন্দময়ী আর-একটা থালা আনাইয়া নিজের পাতের ভাত সস্নেহে সযত্নে মাখিয়া সেই থালে তুলিয়া দিতে থাকিলেন এবং বিনয় বহুদিনের বুভুক্ষুর মতো তাহাই খাইতে লাগিল।

আনন্দময়ীর মনের একটা বেদনা আজ দূর হইল। তাঁহার মুখে প্রসন্নতা দেখিয়া বিনয়েরও বুকের একটা বোঝা যেন নামিয়া গেল। আনন্দময়ী বালিশের খোল সেলাই করিতে বসিয়া গেলেন; কেয়াখয়ের তৈরি করিবার জন্য পাশের ঘরে কেয়াফুল জড়ো হইয়াছিল তাহারই গন্ধ আসিতে লাগিল; বিনয় আনন্দময়ীর পায়ের কাছে ঊর্ধ্বোত্থিত একটা হাতে মাখা রাখিয়া আধ-শোয়া রকমে পড়িয়া রহিল এবং পৃথিবীর আর সমস্ত ভুলিয়া ঠিক সেই আগেকার দিনের মতো আনন্দে বকিয়া যাইতে লাগিল।

 গোরা ০৮

এই একটা বাঁধ ভাঙিয়া যাইতেই বিনয়ের হৃদয়ের নূতন বন্যা আরো যেন উদ্দাম হইয়া উঠিল। আনন্দময়ীর ঘর হইতে বাহির হইয়া রাস্তা দিয়া সে যেন একেবারে উড়িয়া চলিল; মাটির স্পর্শে তাহার যেন পায়ে ঠেকিল না; তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল মনের যে কথাটা লইয়া সে এ-কয়দিন সংকোচে পীড়িত হইয়াছে তাহাই আজ মুখ তুলিয়া সকলের কাছে ঘোষণা করিয়া দেয়।

বিনয় যে মুহূর্তে ৭৮ নম্বরের দরজার কাছে আসিয়া পৌঁছিল ঠিক সেই সময়েই পরেশও বিপরীত দিক দিয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

“আসুন আসুন, বিনয়বাবু, বড়ো খুশি হলুম” এই বলিয়া পরেশ বিনয়কে তাঁহার রাস্তার ধারের বসিবার ঘরটাতে লইয়া গিয়া বসাইলেন। একটি ছোটো টেবিল, তাহার এক ধারে পিঠওয়ালা বেঞ্চি, অন্য ধারে একটা কাঠের ও বেতের চৌকি; দেয়ালে এক দিকে যিশুখ্রীস্টের একটি রঙ-করা ছবি এবং অন্য দিকে কেশববাবুর ফোটোগ্রাফ। টেবিলের উপর দুই-চারি দিনের খবরের কাগজ ভাঁজ করা, তাহার উপরে সীসার কাগজ-চাপা। কোণে একটি ছোটো আলমারি, তাহার উপরের থাকে থিয়োডোর পার্কারের বই সারি সারি সাজানো রহিয়াছে দেখা যাইতেছে। আলমারির মাথার উপরে একটি গ্লোব কাপড় দিয়া ঢাকা রহিয়াছে।

বিনয় বসিল; তাহার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল; মনে হইতে লাগিল তাহার পিঠের দিকের খোলা দরজা দিয়া যদি কেহ ঘরের ভিতরে আসিয়া প্রবেশ করে।

পরেশ কহিলেন, “সোমবারে সুচরিতা আমার একটি বন্ধুর মেয়েকে পড়াতে যায়, সেখানে সতীশের একটি সমবয়সী ছেলে আছে তাই সতীশও তার সঙ্গে গেছে। আমি তাদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছি। আর একটু দেরি হলেই তো আপনার সঙ্গে দেখা হত না।”

খবরটা শুনিয়া বিনয় একই কালে একটা আশাভঙ্গের খোঁচা এবং আরাম মনের মধ্যে অনুভব করিল। পরেশের সঙ্গে তাহার কথাবার্তা দিব্য সহজ হইয়া আসিল।

গল্প করিতে করিতে একে একে পরেশ আজ বিনয়ের সমস্ত খবর জানিতে পারিলেন। বিনয়ের বাপ-মা নাই; খুড়িমাকে লইয়া খুড়া দেশে থাকিয়া বিষয়কর্ম দেখেন। তাহার খুড়তুতো দুই ভাই তাহার সঙ্গে এক বাসায় থাকিয়া পড়াশুনা করিত– বড়োটি উকিল হইয়া তাহাদের জেলা-কোর্টে ব্যবসায় চালাইতেছে, ছোটোটি কলিকাতায় থাকিতেই ওলাউঠা হইয়া মারা গিয়াছে; খুড়ার ইচ্ছা বিনয় ডেপুটি ম্যাজিস্‌ট্রেটির চেষ্টা করে, কিন্তু বিনয় কোনো চেষ্টাই না করিয়া নানা বাজে কাজে নিযুক্ত আছে।

এমনি করিয়া প্রায় এক ঘন্টা কাটিয়া গেল। বিনা প্রয়োজনে আর বেশিক্ষণ থাকিলে অভদ্রতা হয়, তাই বিনয় উঠিয়া পড়িল; কহিল, “বন্ধু সতীশের সঙ্গে আমার দেখা হল না, দুঃখ রইল; তাকে খবর দেবেন আমি এসেছিলুম।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আর-একটু বসলেই তাদের সঙ্গে দেখা হত। তাদের ফেরবার বড়ো আর দেরি নেই।”

এই কথাটুকুর উপরে নির্ভর করিয়া আবার বসিয়া পড়িতে বিনয়ের লজ্জা বোধ হইল। আর-একটু পীড়াপীড়ি করিলে সে বসিতে পারিত– কিন্তু পরেশ অধিক কথা বলিবার বা পীড়াপীড়ি করিবার লোক নহেন, সুতরাং বিদায় লইতে হইল। পরেশ বলিলেন, “আপনি মাঝে মাঝে এলে খুশি হব।”

রাস্তায় বাহির হইয়া বিনয় বাড়ির দিকে ফিরিবার কোনো প্রয়োজন অনুভব করিল না। সেখানে কোনো কাজ নাই। বিনয় কাগজে লিখিয়া থাকে– তাহার ইংরেজি লেখার সকলে খুব তারিফ করে, কিন্তু গত কয়দিন হইতে লিখিতে বসিলে লেখা মাথায় আসে না। টেবিলের সামনে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকাই দায়– মন ছট্‌ফট্‌ করিয়া উঠে। বিনয় তাই আজ বিনা কারণেই উল্‌টা দিকে চলিল।

দু পা যাইতেই একটি বালক-কণ্ঠের চীৎকারধ্বনি শুনিতে পাইল, “বিনয়বাবু, বিনয়বাবু!”

মুখ তুলিয়া দেখিল একটি ভাড়াটে গাড়ির দরজার কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়া সতীশ তাহাকে ডাকাডাকি করিতেছে। গাড়ির ভিতরের আসনে খানিকটা শাড়ি, খানিকটা সাদা জামার আস্তিন, যেটুকু দেখা গেল তাহাতে আরোহীটি যে কে তাহা বুঝিতে কোনো সন্দেহ রহিল না।

বাঙালি ভদ্রতার সংস্কার অনুসারে গাড়ির দিকে দৃষ্টি রক্ষা করা বিনয়ের পক্ষে শক্ত হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে সেইখানেই গাড়ি হইতে নামিয়া সতীশ আসিয়া তাঁহার হাত ধরিল; কহিল, “চলুন আমাদের বাড়ি।”

বিনয় কহিল, “আমি যে তোমাদের বাড়ি থেকে এখনই আসছি।”

সতীশ। বা, আমরা যে ছিলুম না, আবার চলুন।

সতীশের পীড়াপীড়ি বিনয় অগ্রাহ্য করিতে পারিল না। বন্দীকে লইয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই সতীশ উচ্চস্বরে কহিল, “বাবা, বিনয়বাবুকে এনেছি।”

বৃদ্ধ ঘর হইতে বাহির হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “শক্ত হাতে ধরা পড়েছেন, শীঘ্র ছাড়া পাবেন না। সতীশ, তোর দিদিকে ডেকে দে।”

বিনয় ঘরে আসিয়া বসিল, তাহার হৃৎপিণ্ড বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল। পরেশ কহিলেন, “হাঁপিয়ে পড়েছেন বুঝি! সতীশ ভারি দুরন্ত ছেলে।”

ঘরে যখন সতীশ তাহার দিদিকে লইয়া প্রবেশ করিল তখন বিনয় প্রথমে একটি মৃদু সুগন্ধ অনুভব করিল– তাহার পরে শুনিল পরেশবাবু বলিতেছেন, “রাধে, বিনয়বাবু এসেছেন। এঁকে তো তুমি জানই।”

বিনয় চকিতের মতো মুখ তুলিয়া দেখিল, সুচরিতা তাহাকে নমস্কার করিয়া সামনের চৌকিতে বসিল– এবার বিনয় প্রতিনমস্কার করিতে ভুলিল না।

সুচরিতা কহিল, “উনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওঁকে দেখবামাত্র সতীশকে আর ধরে রাখা গেল না, সে গাড়ি থেকে নেমেই ওঁকে টেনে নিয়ে এল। আপনি হয়তো কোনো কাজে যাচ্ছিলেন– আপনার তো কোনো অসুবিধে হয় নি?”

সুচরিতা বিনয়কে সম্বোধন করিয়া কোনো কথা কহিবে বিনয় তাহা প্রত্যাশাই করে নাই। সে কুণ্ঠিত হইয়া ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, আমার কোনো কাজ ছিল না, অসুবিধে কিছুই হয় নি।”

সতীশ সুচরিতার কাপড় ধরিয়া টানিয়া কহিল, “দিদি, চাবিটা দাও-না। আমাদের সেই আর্গিনটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাই।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “এই বুঝি শুরু হল! যার সঙ্গে বক্তিয়ারের ভাব হবে তার আর রক্ষে নেই– আর্গিন তো তাকে শুনতেই হবে, আরো অনেক দুঃখ তার কপালে আছে। বিনয়বাবু, আপনার এই বন্ধুটি ছোটো, কিন্তু এর বন্ধুত্বের দায় বড়ো বেশি– সহ্য করতে পারবেন কি না জানি নে।”

বিনয় সুচরিতার এইরূপ অকুণ্ঠিত আলাপে কেমন করিয়া বেশ সহজে যোগ দিবে কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না। লজ্জা করিবে না দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াও কোনো প্রকারে ভাঙাচোরা করিয়া একটা জবাব দিল, “না, কিছুই না– আপনি সে– আমি– আমার ও বেশ ভালোই লাগে।”

সতীশ তাহার দিদির কাছ হইতে চাবি আদায় করিয়া আর্গিন আনিয়া উপস্থিত করিল। একটা চৌকা কাচের আবরণের মধ্যে তরঙ্গিত সমুদ্রের অনুকরণে নীল-রঙ-করা কাপড়ের উপর একটা খেলার জাহাজ রহিয়াছে। সতীশ চাবি দিয়া দম লাগাইতে আর্গিনের সুরে-তালে জাহাজটা দুলিতে লাগিল এবং সতীশ একবার জাহাজের দিকে ও একবার বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া মনের অস্থিরতা সম্বরণ করিতে পারিল না।

এমনি করিয়া সতীশ মাঝখানে থাকাতে অল্প অল্প করিয়া বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া গেল, এবং ক্রমে সুচরিতার সঙ্গে মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া কথা কহাও তাহার পক্ষে অসম্ভব হইল না।

সতীশ অপ্রাসঙ্গিক হঠাৎ এক সময় বলিয়া উঠিল, “আপনার বন্ধুকে একদিন আমাদের এখানে আনবেন না?”

ইহা হইতে বিনয়ের বন্ধু সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিয়া পড়িল। পরেশবাবুরা নূতন কলিকাতায় আসিয়াছেন, তাঁহারা গোরা সম্বন্ধে কিছুই জানিতেন না। বিনয় তাহার বন্ধুর কথা আলোচনা করিতে করিতে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। গোরার যে কিরূপ অসামান্য প্রতিভা, তাহার হৃদয় যে কিরূপ প্রশস্ত, তাহার শক্তি যে কিরূপ অটল, তাহা বলিতে গিয়া বিনয় যেন কথা শেষ করিতে পারিল না। গোরা যে একদিন সমস্ত ভারতবর্ষের মাথার উপরে মধ্যাহ্নসূর্যের মতো প্রদীপ্ত হইয়া উঠিবে, বিনয় কহিল, “এ বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্র নাই।”

বলিতে বলিতে বিনয়ের মুখে যেন একটা জ্যোতি দেখা দিল, তাহার সমস্ত সংকোচ একেবারে কাটিয়া গেল। এমন-কি, গোরার মত সম্বন্ধে পরেশবাবুর সঙ্গে দুই-একটা বাদপ্রতিবাদও হইল। বিনয় বলিল, “গোরা যে হিন্দুসমাজের সমস্তই অসংকোচে গ্রহণ করতে পারছে তার কারণ সে খুব একটা বড়ো জায়গা থেকে ভারতবর্ষকে দেখছে। তার কাছে ভারতবর্ষের ছোটোবড়ো সমস্তই একটা মহৎ ঐক্যের মধ্যে একটা বৃহৎ সংগীতের মধ্যে মিলে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেরকম করে দেখা আমাদের সকলের পক্ষে সম্ভব নয় বলে ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে বিদেশী আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে তার প্রতি কেবলই অবিচার করি।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি কি বলেন জাতিভেদটা ভালো?”

এমনভাবে কহিল যেন ও-সম্বন্ধে কোনো তর্কই চলিতে পারে না।

বিনয় কহিল, “জাতিভেদটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। অর্থাৎ কোথাও ভালো, কোথাও মন্দ। যদি জিজ্ঞাসা করেন, হাত জিনিসটা কি ভালো, আমি বলব সমস্ত শরীরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ভালো। যদি বলেন, ওড়বার পক্ষে কি ভালো? আমি বলব, না। তেমনি ডানা জিনিসটাও ধরবার পক্ষে ভালো নয়।”

সুচরিতা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আমি ও-সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। আমি জিজ্ঞাসা করছি আপনি কি জাতিভেদ মানেন?”

আর কারো সঙ্গে তর্ক উঠিলে বিনয় জোর করিয়াই বলিত, “হাঁ, মানি।” আজ তাহার তেমন জোর করিয়া বলিতে বাধিল; ইহা কি তাহার ভীরুতা, অথবা জাতিভেদ মানি বলিলে কথাটা যতদূর পৌঁছে আজ তাহার মন ততদূর পর্যন্ত যাইতে স্বীকার করিল না, তাহা নিশ্চয় বলা যায় না। পরেশ পাছে তর্কটা বেশিদূর যায় বলিয়া এইখানেই বাধা দিয়া কহিলেন, “রাধে, তোমার মাকে এবং সকলকে ডেকে আনো– এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”

সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেই সতীশ তাহার সঙ্গে বকিতে বকিতে লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, “বাবা, মা তোমাদের উপরের বারান্দায় আসতে বললেন।”

গোরা ০৯

উপরে গাড়িবারান্দায় একটা টেবিলে শুভ্র কাপড় পাতা, টেবিল ঘেরিয়া চৌকি সাজানো। রেলিঙের বাহিরে কার্নিসের উপরে ছোটো ছোটো টবে পাতাবাহার এবং ফুলের গাছ। বারান্দার উপর হইতে রাস্তার ধারের শিরীষ ও কৃষ্ণচূড়া গাছের বর্ষা-জলধৌত পল্লবিত চিক্কণতা দেখা যাইতেছে।

সূর্য তখনো অস্ত যায় নাই; পশ্চিম আকাশ হইতে ম্লান রৌদ্র সোজা হইয়া বারান্দার এক প্রান্তে আসিয়া পড়িয়াছে।

ছাতে তখন কেহ ছিল না। একটু পরেই সতীশ সাদাকালো-রোঁয়াওয়ালা এক ছোটো কুকুর সঙ্গে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নাম খুদে। এই কুকুরের যতরকম বিদ্যা ছিল সতীশ তাহা বিনয়কে দেখাইয়া দিল। সে এক পা তুলিয়া সেলাম করিল, মাথা মাটিতে ঠেকাইয়া প্রণাম করিল, একখণ্ড বিস্কুট দেখাইতেই লেজের উপর বসিয়া দুই পা জড়ো করিয়া ভিক্ষা চাহিল। এইরূপে খুদে যে খ্যাতি অর্জন করিল সতীশই তাহা আত্মসাৎ করিয়া গর্ব অনুভব করিল– এই যশোলাভে খুদের লেশমাত্র উৎসাহ ছিল না, বস্তুত যশের চেয়ে বিস্কুটটাকে সে ঢের বেশি সত্য বলিয়া গণ্য করিয়াছিল।

কোনো একটা ঘর হইতে মাঝে মাঝে মেয়েদের গলার খিল্‌খিল্‌ হাসি ও কৌতুকের কণ্ঠস্বর এবং তাহার সঙ্গে একজন পুরুষের গলাও শুনা যাইতেছিল। এই অপর্যাপ্ত হাস্যকৌতুকের শব্দে বিনয়ের মনের মধ্যে একটা অপূর্ব মিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে একটা যেন ঈর্ষার বেদনা বহন করিয়া আনিল। ঘরের ভিতরে মেয়েদের গলার এই আনন্দের কলধ্বনি বয়স হওয়া অবধি সে এমন করিয়া কখনো শুনে নাই। এই আনন্দের মাধুর্য তাহার এত কাছে উচ্ছ্বসিত হইতেছে অথচ সে ইহা হইতে এত দূরে। সতীশ তাহার কানের কাছে কী বলিতেছিল, বিনয় তাহা মন দিয়া শুনিতেই পারিল না।

পরেশবাবুর স্ত্রী তাঁহার তিন মেয়েকে সঙ্গে করিয়া ছাতে আসিলেন– সঙ্গে একজন যুবক আসিল, সে তাঁহাদের দূর আত্মীয়।

পরেশবাবুর স্ত্রীর নাম বরদাসুন্দরী। তাঁহার বয়স অল্প নহে কিন্তু দেখিলেই বোঝা যায় যে বিশেষ যত্ন করিয়া সাজ করিয়া আসিয়াছেন। বড়োবয়স পর্যন্ত পাড়াগেঁয়ে মেয়ের মতো কাটাইয়া হঠাৎ এক সময় হইতে আধুনিক কালের সঙ্গে সমান বেগে চলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন; সেইজন্যই তাঁহার সিল্কের শাড়ি বেশি খস্‌খস্‌ এবং উঁচু গোড়ালির জুতা বেশি খট্‌খট্‌ শব্দ করে। পৃথিবীতে কোন্‌ জিনিসটা ব্রাহ্ম এবং কোনটা অব্রাহ্ম তাহারই ভেদ লইয়া তিনি সর্বদাই অত্যন্ত সতর্ক হইয়া থাকেন। সেইজন্যই রাধারানীর নাম পরিবর্তন করিয়া তিনি সুচরিতা রাখিয়াছেন। কোনো-এক সম্পর্কে তাঁহার এক শ্বশুর বহুদিন পরে বিদেশের কর্মস্থান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাদিগকে জামাইষষ্ঠী পাঠাইয়াছিলেন। পরেশবাবু তখন কর্ম উপলক্ষে অনুপস্থিত ছিলেন। বরদাসুন্দরী এই জামাইষষ্ঠীর উপহার সমস্ত ফেরত পাঠাইয়াছিলেন। তিনি এ-সকল ব্যাপারকে কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার অঙ্গ বলিয়া জ্ঞান করেন। মেয়েদের পায়ে মোজা দেওয়াকে এবং টুপি পরিয়া বাহিরে যাওয়াকে তিনি এমনভাবে দেখেন যেন তাহাও ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের একটা অঙ্গ। কোনো ব্রাহ্ম-পরিবারে মাটিতে আসন পাতিয়া খাইতে দেখিয়া তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, আজকাল ব্রাহ্মসমাজ পৌত্তলিকতার অভিমুখে পিছাইয়া পড়িতেছে।

তাঁহার বড়ো মেয়ের নাম লাবণ্য। সে মোটাসোটা, হাসিখুশি, লোকের সঙ্গ এবং গল্পগুজব ভালোবাসে। মুখটি গোলগাল, চোখ দুটি বড়ো, বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। বেশভূষার ব্যাপারে সে স্বভাবতই কিছু ঢিলা, কিন্তু এ সম্বন্ধে তাহার মাতার শাসনে তাহাকে চলিতে হয়। উঁচু গোড়ালির জুতা পরিতে সে সুবিধা বোধ করে না, তবু না পরিয়া উপায় নাই। বিকালে সাজ করিবার সময় মা স্বহস্তে তাহার মুখে পাউডার ও দুই গালে রঙ লাগাইয়া দেন। একটু মোটা বলিয়া বরদাসুন্দরী তাহার জামা এমনি আঁট করিয়া তৈরি করিয়াছেন যে, লাবণ্য যখন সাজিয়া বাহির হইয়া আসে তখন মনে হয় যেন তাহাকে পাটের বস্তার মতো কলে চাপ দিয়া আঁটিয়া বাঁধা হইয়াছে।

মেজো মেয়ের নাম ললিতা। সে বড়ো মেয়ের বিপরীত বলিলেই হয়। তাহার দিদির চেয়ে সে মাথায় লম্বা, রোগা, রঙ আর-একটু কালো, কথাবার্তা বেশি কয় না, সে আপনার নিয়মে চলে, ইচ্ছা করিলে কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিতে পারে। বরদাসুন্দরী তাহাকে মনে মনে ভয় করেন, সহজে তাহাকে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে সাহস করেন না।

ছোটো লীলা, তাহার বয়স বছর দশেক হইবে। সে দৌড়ধাপ উপদ্রব করিতে মজবুত। সতীশের সঙ্গে তাহার ঠেলাঠেলি মারামারি সর্বদাই চলে। বিশেষত খুদে-নামধারী কুকুরটার স্বত্বাধিকার লইয়া উভয়ের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো মীমাংসা হয় নাই। কুকুরের নিজের মত লইলে সে বোধ হয় উভয়ের মধ্যে কাহাকেও প্রভুরূপে নির্বাচন করিত না; তবু দুজনের মধ্যে সে বোধ করি সতীশকেই কিঞ্চিৎ পছন্দ করে। কারণ, লীলার আদরের বেগ সম্বরণ করা এই ছোটো জন্তুটার পক্ষে সহজ ছিল না। বালিকার আদরের চেয়ে বালকের শাসন তাহার কাছে অপেক্ষাকৃত সুসহ ছিল।

বরদাসুন্দরী আসিতেই বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া অবনত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। পরেশবাবু কহিলেন, “এঁরই বাড়িতে সেদিন আমরা–”

বরদা কহিলেন, “ওঃ! বড়ো উপকার করেছেন– আপনি আমাদের অনেক ধন্যবাদ জানবেন।”

শুনিয়া বিনয় এত সংকুচিত হইয়া গেল যে ঠিকমত উত্তর দিতে পারিল না।

মেয়েদের সঙ্গে যে যুবকটি আসিয়াছিল তাহার সঙ্গেও বিনয়ের আলাপ হইয়া গেল। তাহার নাম সুধীর। সে কালেজে বি. এ. পড়ে। চেহারাটি প্রিয়দর্শন, রঙ গৌর, চোখে চশমা, অল্প গোঁফের রেখা উঠিয়াছে। ভাবখানা অত্যন্ত চঞ্চল– এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে চায় না, একটা কিছু করিবার জন্য ব্যস্ত। সর্বদাই মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা করিয়া, বিরক্ত করিয়া, তাহাদিগকে অস্থির করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েরাও তাহার প্রতি কেবলই তর্জন করিতেছে, কিন্তু সুধীরকে নহিলে তাহাদের কোনোমতেই চলে না। সার্কাস দেখাইতে, জুঅলজিকাল গার্ডেনে লইয়া যাইতে, কোনো শখের জিনিস কিনিয়া আনিতে, সুধীর সর্বদাই প্রস্তুত। মেয়েদের সঙ্গে সুধীরের অসংকোচ হৃদ্যতার ভাব বিনিয়ের কাছে অত্যন্ত নূতন এবং বিস্ময়কর ঠেকিল। প্রথমটা সে এইরূপ ব্যবহারকে মনে মনে নিন্দাই করিল, কিন্তু সে নিন্দার সঙ্গে একটু যেন ঈর্ষার ভাব মিশিতে লাগিল।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “মনে হচ্ছে আপনাকে যেন দুই-একবার সমাজে দেখেছি।”

বিনয়ের মনে হইল যেন তাহার কী একটা অপরাধ ধরা পড়িল। সে অনাবশ্যক লজ্জা প্রকাশ করিয়া কহিল, “হাঁ, আমি কেশববাবুর বক্তৃতা শুনতে মাঝে মাঝে যাই।”

বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি বুঝি কলেজে পড়ছেন?”

বিনয় কহিল, “না, এখন আর কলেজে পড়ি নে।”

বরদা কহিলেন, “আপনি কলেজে কতদূর পর্যন্ত পড়েছেন?”

বিনয় কহিল, “এম. এ. পাস করেছি।”

শুনিয়া এই বালকের মতো চেহারা যুবকের প্রতি বরদাসুন্দরীর শ্রদ্ধা হইল। তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া পরেশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমার মনু যদি থাকত তবে সেও এতদিনে এম. এ. পাস করে বের হত।

বরদার প্রথম সন্তান মনোরঞ্জন নয় বছর বয়সে মারা গেছে। যে-কোনো যুবক কোনো বড়ো পাস করিয়াছে, বা বড়ো পদ পাইয়াছে, ভালো বই লিখিয়াছে, বা কোনো ভালো কাজ করিয়াছে শোনেন, বরদার তখনই মনে হয় মনু বাঁচিয়া থাকিলে তাহার দ্বারাও ঠিক এইগুলি ঘটিত। যাহা হউক সে যখন নাই তখন বর্তমানে জনসমাজে তাঁহার মেয়ে তিনটির গুণপ্রচারই বরদাসুন্দরীর একটা বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে ছিল। তাঁহার মেয়েরা যে খুব পড়াশুনা করিতেছে এ কথা বরদা বিশেষ করিয়া বিনয়কে জানাইলেন, মেম তাঁহার মেয়েদের বুদ্ধি ও গুণপনা সম্বন্ধে কবে কী বলিয়াছিল তাহাও বিনয়ের অগোচর রহিল না। যখন মেয়ে-ইস্কুলে প্রাইজ দিবার সময় লেফটেনেন্ট্‌ গবর্নর এবং তাঁহার স্ত্রী আসিয়াছিলেন তখন তাঁহাদিগকে তোড়া দিবার জন্য ইস্কুলের সমস্ত মেয়েদের মধ্যে লাবণ্যকেই বিশেষ করিয়া বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল এবং গবর্নরের স্ত্রী লাবণ্যকে উৎসাহজনক কী-একটা মিষ্টবাক্য বলিয়াছিলেন তাহাও বিনয় শুনিল।

অবশেষে বরদা লাবণ্যকে বলিলেন, “যে সেলাইটার জন্যে তুমি প্রাইজ পেয়েছিলে সেইটে নিয়ে এসো তো মা।”

একটা পশমের সেলাই করা টিয়াপাখির মূর্তি এই বাড়ির আত্মীয়বন্ধুদের নিকট বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। মেমের সহযোগিতায় এই জিনিসটা লাবণ্য অনেক দিন হইল রচনা করিয়াছিল, এই রচনায় লাবণ্যের নিজের কৃতিত্ব যে খুব বেশি ছিল তাহাও নহে– কিন্তু নূতন-আলাপী মাত্রকেই এটা দেখাইতে হইবে সেটা ধরা কথা। পরেশ প্রথম প্রথম আপত্তি করিতেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষ্ফল জানিয়া এখন আর আপত্তিও করেন না। এই পশমের টিয়াপাখির রচনানৈপুণ্য লইয়া যখন বিনয় দুই চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত করিয়াছে তখন বেহারা আসিয়া একখানি চিঠি পরেশের হাতে দিল।

চিঠি পড়িয়া পরেশ প্রফুল্ল হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “বাবুকে উপরে নিয়ে আয়।”

বরদা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে?”

পরেশ কহিলেন, “আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু কৃষ্ণদয়াল তাঁর ছেলেকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করবার জন্যে পাঠিয়েছেন।”

হঠাৎ বিনয়ের হৃৎপিণ্ড লাফাইয়া উঠিল এবং তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। তাহার পরক্ষণেই সে হাত মুঠা করিয়া বেশ একটু শক্ত হইয়া বসিল, যেন কোনো প্রতিকূল পক্ষের বিরুদ্ধে সে নিজেকে দৃঢ় রাখিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠিল। গোরা যে এই পরিবারের লোকদিগকে অশ্রদ্ধার সহিত দেখিবে ও বিচার করিবে ইহা আগে হইতেই বিনয়কে যেন কিছু উত্তেজিত করিয়া তুলিল।

» গোরা ১০

১০

খুঞ্চের উপর জলখাবার ও চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া চাকরের হাতে দিয়া সুচরিতা ছাতে আসিয়া বসিল এবং সেই মুহূর্তে বেহারার সঙ্গে গোরাও আসিয়া প্রবেশ করিল। সুদীর্ঘ শুভ্রকায় গোরার আকৃতি আয়তন ও সাজ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিল।

গোরার কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ, পরনে মোটা ধুতির উপর ফিতা বাঁধা জামা ও মোটা চাদর, পায়ে শুঁড়তোলা কটকি জুতা। সে যেন বর্তমান কালের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান বিদ্রোহের মতো আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার এরূপ সাজসজ্জা বিনয়ও পূর্বে কখনো দেখে নাই।

আজ গোরার মনে একটা বিরোধের আগুন বিশেষ করিয়াই জ্বলিতেছিল। তাহার কারণও ঘটিয়াছিল।

গ্রহণের স্নান-উপলক্ষে কোনো স্টীমার-কোম্পানি কাল প্রত্যুষে যাত্রী লইয়া ত্রিবেণী রওনা হইয়াছিল। পথের মধ্যে মধ্যে এক-এক স্টেশন হইতে বহুতর স্ত্রীলোক যাত্রী দুই-এক জন পুরুষ অভিভাবক সঙ্গে লইয়া জাহাজে উঠিতেছিল। পাছে জায়গা না পায় এজন্য ভারি ঠেলাঠেলি পড়িয়াছিল। পায়ে কাদা লইয়া জাহাজে চড়িবার তক্তাখানার উপরে টানাটানির চোটে পিছলে কেহ বা অসম্‌বৃত অবস্থায় নদীর জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছে; কাহাকেও বা খালাসি ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে; কেহ বা নিজে উঠিয়াছে, কিন্তু সঙ্গী উঠিতে পারে নাই বলিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িতেছে– মাঝে মাঝে দুই-এক পসলা বৃষ্টি আসিয়া তাহাদিগকে ভিজাইয়া দিতেছে, জাহাজে তাহাদের বসিবার স্থান কাদায় ভরিয়া গিয়াছে। তাহাদের মুখে চোখে একটা ত্রস্তব্যস্ত উৎসুক সকরুণ ভাব; তাহারা শক্তিহীন, অথচ তাহারা এত ক্ষুদ্র যে, জাহাজের মাল্লা হইতে কর্তা পর্যন্ত কেহই তাহাদের অনুনয়ে এতটুকু সাহায্য করিবে না ইহা নিশ্চয় জানে বলিয়া তাহাদের চেষ্টার মধ্যে ভারি একটা কাতর আশঙ্কা প্রকাশ পাইতেছে। এইরূপ অবস্থায় গোরা যথাসাধ্য যাত্রীদিগকে সাহায্য করিতেছিল। উপরের ফার্‌স্ট ক্লাসের ডেকে একজন ইংরেজ এবং একটি আধুনিক ধরনের বাঙালিবাবু জাহাজের রেলিং ধরিয়া পরস্পর হাস্যালাপ করিতে করিতে চুরুট মুখে তামাশা দেখিতেছিল। মাঝে মাঝে কোনো যাত্রীর বিশেষ কোনো আকস্মিক দুর্গতি দেখিয়া ইংরেজ হাসিয়া উঠিতেছিল এবং বাঙালিটিও তাহার সঙ্গে যোগ দিতেছিল।

দুই-তিনটি স্টেশন এইরূপে পার হইলে গোরার অসহ্য হইয়া উঠিল। সে উপরে উঠিয়া তাহার বজ্রগর্জনে কহিল, “ধিক্‌ তোমাদের! লজ্জা নাই!”

ইংরেজটা কঠোর দৃষ্টিতে গোরার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল। বাঙালি উত্তর দিল, “লজ্জা! দেশের এই-সমস্ত পশুবৎ মূঢ়দের জন্যই লজ্জা।”

গোরা মুখ লাল করিয়া কহিল, “মূঢ়ের চেয়ে বড়ো পশু আছে– যার হৃদয় নেই।”

বাঙালি রাগ করিয়া কহিল, “এ তোমার জায়গা নয়– এ ফার্‌স্ট ক্লাস।”

গোরা কহিল, “না, তোমার সঙ্গে একত্রে আমার জায়গা নয়– আমার জায়গা ঐ যাত্রীদের সঙ্গে। কিন্তু আমি বলে যাচ্ছি আর আমাকে তোমাদের এই ক্লাসে আসতে বাধ্য কোরো না।”

বলিয়া গোরা হন হন করিয়া নীচে চলিয়া গেল। ইংরেজ তাহার পর হইতে আরাম-কেদারায় দুই হাতায় দুই পা তুলিয়া নভেল পড়ায় মনোনিবেশ করিল। তাহার সহযাত্রী বাঙালি তাহার সঙ্গে পুনরায় আলাপ করিবার চেষ্টা দুই-একবার করিল, কিন্তু আর তাহা তেমন জমিল না। দেশের সাধারণ লোকের দলে সে নহে ইহা প্রমাণ করিবার জন্য খানসামাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মুরগির কোনো ডিশ আহারের জন্য পাওয়া যাইবে কিনা। খানসামা কহিল, “না, কেবল রুটি মাখন চা আছে।”

শুনিয়া ইংরেজকে শুনাইয়া বাঙালিটি ইংরেজি ভাষায় কহিল, “creature comforts সম্বন্ধে জাহাজের সমস্ত বন্দোবস্ত অত্যন্ত যাচ্ছেতাই।”

ইংরেজ কোনো উত্তর করিল না। টেবিলের উপর হইতে তাহার খবরের কাগজ উড়িয়া নীচে পড়িয়া গেল। বাবু চৌকি হইতে উঠিয়া কাগজখানা তুলিয়া দিল, কিন্তু থ্যাঙ্ক্‌স্‌ পাইল না।

চন্দননগরে পৌঁছিয়া নামিবার সময় সাহেব সহসা গোরার কাছে গিয়া টুপি একটু তুলিয়া কহিল, “নিজের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত– আশা করি আমাকে ক্ষমা করিবে।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।

কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি যে সাধারণ লোকদের দুর্গতি দেখিয়া বিদেশীকে ডাকিয়া লইয়া নিজের শ্রেষ্ঠতাভিমানে হাসিতে পারে, ইহার আক্রোশ গোরাকে দগ্ধ করিতে লাগিল। দেশের জনসাধারণ এমন করিয়া নিজেদের সকলপ্রকার অপমান ও দুর্ব্যবহারের অধীনে আনিয়াছে, তাহাদিগকে পশুর মতো লাঞ্ছিত করিলে তাহারাও তাহা স্বীকার করে এবং সকলের কাছেই তাহা স্বাভাবিক ও সংগত বলিয়া মনে হয়, ইহার মূলে যে-একটা দেশব্যাপী সুগভীর অজ্ঞান আছে তাহার জন্য গোরার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল; কিন্তু সকলের চেয়ে তাহার এই বাজিল যে, দেশের এই চিরন্তন অপমান ও দুর্গতিকে শিক্ষিত লোক আপনার গায়ে লয় না– নিজেকে নির্মমভাবে পৃথক করিয়া লইয়া অকাতরে গৌরব বোধ করিতে পারে। আজ তাই শিক্ষিত লোকদের সমস্ত বই-পড়া ও নকল-করা সংস্কারকে একেবারে উপেক্ষা করিবার জন্যই গোরা কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ লাগাইয়া ও একটা নূতন অদ্ভুত কটকি চটি কিনিয়া পরিয়া বুক ফুলাইয়া ব্রাহ্ম-বাড়িতে আসিয়া দাঁড়াইল।

বিনয় মনে মনে ইহা বুঝিতে পারিল, গোরার আজিকার এই-যে সাজ ইহা যুদ্ধসাজ। গোরা কী জানি কী করিয়া বসে এই ভাবিয়া বিনয়ের মনে একটা ভয়, একটা সংকোচ এবং একটা বিরোধের ভাব জাগিয়া উঠিল।

বরদাসুন্দরী যখন বিনয়ের সঙ্গে আলাপ করিতেছিলেন তখন সতীশ অগত্যা ছাতের এক কোণে একটা টিনের লাটিম ঘুরাইয়া নিজের চিত্তবিনোদনে নিযুক্ত ছিল। গোরাকে দেখিয়া তাহার লাটিম ঘোরানো বন্ধ হইয়া গেল; সে ধীরে ধীরে বিনয়ের পাশে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে গোরাকে দেখিতে লাগিল এবং কানে কানে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “ইনিই কি আপনার বন্ধু?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা ছাতে আসিয়া মুহূর্তের এক অংশ কাল বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া আর যেন তাহাকে দেখিতেই পাইল না। পরেশকে নমস্কার করিয়া সে অসংকোচে একটা চৌকি টেবিল হইতে কিছু দূরে সরাইয়া লইয়া বসিল। মেয়েরা যে এখানে কোনো-এক জায়গায় আছে তাহা লক্ষ্য করা সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল।

বরদাসুন্দরী এই অসভ্যের নিকট হইতে মেয়েদিগকে লইয়া চলিয়া যাইবেন স্থির করিতেছিলেন এমন সময় পরেশ তাঁহাকে কহিলেন, “এঁর নাম গৌরমোহন, আমার বন্ধু কৃষ্ণদয়ালের ছেলে।”

তখন গোরা তাঁহার দিকে ফিরিয়া নমস্কার করিল। যদিও বিনয়ের সঙ্গে আলোচনায় সুচরিতা গোরার কথা পূর্বেই শুনিয়াছিল, তবু এই অভ্যাগতটিই যে বিনয়ের বন্ধু তাহা সে বুঝে নাই। প্রথম দৃষ্টিতেই গোরার প্রতি তাহার একটা আক্রোশ জন্মিল। ইংরেজি-শেখা কোনো লোকের মধ্যে গোঁড়া হিঁদুয়ানি দেখিলে সহ্য করিতে পারে সুচরিতার সেরূপ সংস্কার ও সহিষ্ণুতা ছিল না।

পরেশ গোরার কাছে তাঁহার বাল্যবন্ধু কৃষ্ণদয়ালের খবর লইলেন। তাহার পরে নিজেদের ছাত্র-অবস্থার কথা আলোচনা করিয়া বলিলেন, “তখনকার দিনে কলেজে আমরা দুজনেই একজুড়ি ছিলুম– দুজনেই মস্ত কালাপাহাড়– কিছুই মানতুম না– হোটেলে খাওয়াটাই একটা কর্তব্যকর্ম বলে মনে করতুম। দুজনে কতদিন সন্ধ্যার সময় গোলদিঘিতে বসে মুসলমান দোকানের কাবাব খেয়ে তার পরে কী রকম করে আমরা হিন্দুসমাজের সংস্কার করব রাত-দুপুর পর্যন্ত তারই আলোচনা করতুম।”

বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন তিনি কী করেন?”

গোরা কহিল, “এখন তিনি হিন্দু-আচার পালন করেন।”

বরদা কহিলেন, “লজ্জা করে না?”– রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল।

গোরা একটু হাসিয়া কহিল, “লজ্জা করাটা দুর্বল স্বভাবের লক্ষণ। কেউ কেউ বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা করে।”

বরদা। আগে তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন না?

গোরা। আমিও তো এক সময়ে ব্রাহ্ম ছিলুম।

বরদা। এখন আপনি সাকার-উপাসনায় বিশ্বাস করেন?

গোরা। আকার জিনিসটাকে বিনা কারণে অশ্রদ্ধা করব আমার মনে এমন কুসংস্কার নেই। আকারকে গাল দিলেই কি সে ছোটো হয়ে যায়? আকারের রহস্য কে ভেদ করতে পেরেছে?

পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “আকার যে অন্তবিশিষ্ট।”

গোরা কহিল, “অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না। অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অন্তকে আশ্রয় করেছেন– নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায়? যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই। বাক্যের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ।”

বরদা মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “নিরাকারের চেয়ে আকার সম্পূর্ণ আপনি এমন কথা বলেন?”

গোরা। আমি যদি নাও বলতুম তাতে কিছুই আসত যেত না। জগতে আকার আমার বলার উপর নির্ভর করছে না। নিরাকারই যদি যথার্থ পরিপূর্ণতা হত তবে আকার কোথাও স্থান পেত না।

সুচরিতার অত্যন্ত ইচ্ছা করিতে লাগিল কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত লাঞ্ছিত করিয়া দেয়। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া গোরার কথা শুনিতেছে দেখিয়া তাহার মনে মনে রাগ হইল। গোরা এতই জোরের সঙ্গে কথা বলিতেছিল যে, এই জোরকে নত করিয়া দিবার জন্য সুচরিতার মনের মধ্যেও যেন জোর করিতে লাগিল।

এমন সময়ে বেহারা চায়ের জন্য কাৎলিতে গরম জল আনিল। সুচরিতা উঠিয়া চা তৈরি করিতে নিযুক্ত হইল। বিনয় মাঝে মাঝে চকিতের মতো সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া লইল। যদিচ উপাসনা সম্বন্ধে গোরার সঙ্গে বিনয়ের মতের বিশেষ পার্থক্য ছিল না, তবু গোরা যে এই ব্রাহ্ম-পরিবারের মাঝখানে অনাহূত আসিয়া বিরুদ্ধ মত এমন অসংকোচে প্রকাশ করিয়া যাইতেছে ইহাতে বিনয়কে পীড়া দিতে লাগিল। গোরার এইপ্রকার যুদ্ধোদ্যত আচরণের সহিত তুলনা করিয়া বৃদ্ধ পরেশের একটি আত্মসমাহিত প্রশান্ত ভাব, সকলপ্রকার তর্কবিতর্কের অতীত একটি গভীর প্রসন্নতা বিনয়ের হৃদয়কে ভক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল, মতামত কিছুই নয়–অন্তঃকরণের মধ্যে পূর্ণতা, স্তব্ধতা ও আত্মপ্রসাদ ইহাই সকলের চেয়ে দুর্লভ। কথাটার মধ্যে কোন্‌টা সত্য কোন্‌টা মিথ্যা তাহা লইয়া যতই তর্ক কর-না কেন, প্রাপ্তির মধ্যে যেটা সত্য সেইটাই আসল। পরেশ সকল কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে এক-একবার চোখ বুজিয়া নিজের অন্তরের মধ্যে তলাইয়া লইতেছিলেন–ইহা তাঁহার অভ্যাস–তাঁহার সেই সময়কার অন্তর্নিবিষ্ট শান্ত মুখশ্রী বিনয় একদৃষ্টে দেখিতেছিল। গোরা যে এই বৃদ্ধের প্রতি ভক্তি অনুভব করিয়া নিজের বাক্য সংযত করিতেছিল না, ইহাতে বিনয় বড়োই আঘাত পাইতেছিল।

সুচরিতা কয়েক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া পরেশের মুখের দিকে চাহিল। কাহাকে চা খাইতে অনুরোধ করিবে না-করিবে তাহা লইয়া তাহার মনে দ্বিধা হইতেছিল। বরদাসুন্দরী গোরার দিকে চাহিয়াই একেবারে বলিয়া বসিলেন, “আপন এ-সমস্ত কিছু খাবেন না বুঝি?”

গোরা কহিল, “না।”

বরদা। কেন? জাত যাবে?

গোরা বলিল, “হাঁ।”

বরদা। আপনি জাত মানেন!

গোরা। জাত কি আমার নিজের তৈরি যে মানব না? সমাজকে যখন মানি তখন জাতও মানি।

বরদা। সমাজকে কি সব কথায় মানতেই হবে?

গোরা। না মানলে সমাজকে ভাঙা হয়।

বরদা। ভাঙলে দোষ কী?

গোরা। যে ডালে সকলে মিলে বসে আছি সে ডাল কাটলেই বা দোষ কী?

সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, “মা, মিছে তর্ক করে লাভ কী? উনি আমাদের ছোঁওয়া খাবেন না।”

গোরা সুচরিতার মুখের দিতে তাহার প্রখর দৃষ্টি একবার স্থাপিত করিল। সুচরিতা বিনয়ের দিকে চাহিয়া ঈষৎ সংশয়ের সহিত কহিল, “আপনি কি–”

বিনয় কোনোকালে চা খায় না। মুসলমানের তৈরি পাঁউরুটি-বিস্কুট খাওয়াও অনেক দিন ছাড়িয়া দিয়াছে কিন্তু আজ তাহার না খাইলে নয়। সে জোর করিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, “হাঁ খাব বৈকি।” বলিয়া গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরার ওষ্ঠপ্রান্তে ঈষৎ একটু কঠোর হাসি দেখা দিল। বিনয়ের মুখে চা তিতো ও বিস্বাদ লাগিল, কিন্তু সে খাইতে ছাড়িল না।

বরদাসুন্দরী মনে মনে বলিলেন, “আহা, এই বিনয় ছেলেটি বড়ো ভালো।’

তখন তিনি গোরার দিক হইতে একেবারেই মুখ ফিরাইয়া বিনয়ের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন। তাই দেখিয়া পরেশ আস্তে আস্তে গোরার কাছে তাঁহার চৌকি টানিয়া লইয়া তাহার সঙ্গে মৃদুস্বরে আলাপ করিতে লাগিলেন।

এমন সমস রাস্তা দিয়া চিনেবাদামওয়ালা গরম চিনেবাদামভাজা হাঁকিয়া যাইতেই লীলা হাততালি দিয়া উঠিল; কহিল, “সুধীরদা, চিনেবাদাম ডাকো।”

বলিতেই ছাতের বারান্দা ধরিয়া সতীশ চিনাবাদামওয়ালাকে ডাকিতে লাগিল।

ইতিমধ্যে আর-একটি ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে সকলেই পানুবাবু বলিয়া সম্ভাষণ করিল, কিন্তু তাঁহার আসল নাম হারানচন্দ্র নাগ। দলের মধ্যে ইঁহার বিদ্বান ও বুদ্ধিমান বলিয়া বিশেষ খ্যাতি আছে। যদিও স্পষ্ট করিয়া কোনো পক্ষই কোনো কথা বলে নাই, তথাপি, ইঁহার সঙ্গেই সুচরিতার বিবাহ হইবে এই প্রকারের একটা সম্ভাবনা আকাশে ভাসিতেছিল। পানুবাবুর হৃদয় যে সুচরিতার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল তাহাতে কাহারো সন্দেহ ছিল না এবং ইহাই লইয়া মেয়েরা সুচরিতাকে সর্বদা ঠাট্টা করিতে ছাড়িত না।

পানুবাবু ইস্কুলে মাস্টারি করেন। বরদাসুন্দরী তাঁহাকে ইস্কুল-মাস্টার মাত্র জানিয়া বড়ো শ্রদ্ধা করেন না। তিনি ভাবে দেখান যে, পানুবাবু যে তাঁহার কোনো মেয়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিতে সাহস করেন নাই সে ভালোই হইয়াছে। তাঁহার ভাবী জামাতারা ডেপুটিগিরির লক্ষ্যবেধরূপে অতি দুঃসাধ্য পণে আবদ্ধ।

সুচরিতা হারানকে এক পেয়ালা চা অগ্রসর করিয়া দিতেই লাবণ্য দূর হইতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। সেই হাসিটুকু বিনয়ের অগোচর রহিল না। অতি অল্প কালের মধ্যেই দুই-একটা বিষয়ে বিনয়ের নজর বেশ একটু তীক্ষ্ণ এবং সতর্ক হইয়া উঠিয়াছে–দর্শননৈপুণ্য সম্বন্ধে পূর্বে সে প্রসিদ্ধ ছিল না।

এই যে হারান ও সুধীর এ-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অনেক দিন হইতে পরিচিত, এবং এই পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত যে তাহারা মেয়েদের মধ্যে পরস্পর ইঙ্গিতের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে, বিনয়ের বুকের মধ্যে ইহা বিধাতার অবিচার বলিয়া বাজিতে লাগিল।

এ দিকে হারানের অভ্যাগমে সুচরিতার মন যেন একটু আশান্বিত হইয়া উঠিল। গোরার স্পর্ধা যেমন করিয়া হউক কেহ দমন করিয়া দিলে তবে তাহার গায়ের জ্বালা মেটে। অন্য সময়ে হারানের তার্কিকতায় সে অনেক বার বিরক্ত হইয়াছে, কিন্তু আজ এই তর্কবীরকে দেখিয়া সে আনন্দের সঙ্গে তাঁহাকে চা ও পাঁউরুটির রসদ জোগাইয়া দিল।

পরেশ কহিল, “পানুবাবু, ইনি আমাদের–”

হারান কহিলেন, “ওঁকে বিলক্ষণ জানি। উনি এক সময়ে আমাদের ব্রাহ্মসমাজের একজন খুব উৎসাহী সভ্য ছিলেন।”

এই বলিয়া গোরার সঙ্গে কোনোপ্রকার আলাপের চেষ্টা না করিয়া হারান চায়ের পেয়ালার প্রতি মন দিলেন।

সেই সময়ে দুই-এক জন মাত্র বাঙালি সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হইয়া এ দেশে আসিয়াছেন। সুধীর তাঁহাদেরই একজনের অভ্যর্থনার গল্প তুলিল। হারান কহিলেন, “পরীক্ষায় বাঙালি যতই পাস করুন, বাঙালির দ্বারা কোনো কাজ হবে না।

কোনো বাঙালি ম্যাজিস্‌্‌ট্রেট বা জজ ডিস্ট্রিক্টের ভার লইয়া যে কখনো কাজ চালাইতে পারিবে না ইহাই প্রতিপন্ন করিবার জন্য হারান বাঙালির চরিত্রের নানা দোষ ও দুর্বলতার ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে গোরার মুখ লাল হইয়া উঠিল–সে তাহার সিংহনাদকে যথাসাধ্য রুদ্ধ করিয়া কহিল, “এই যদি সত্যই আপনার মত হয় তবে আপনি আরামে এই টেবিলে বসে বসে পাঁউরুটি চিবোচ্ছেন কোন্‌ লজ্জায়!”

হারান বিস্মিত হইয়া ভুরু তুলিয়া কহিলেন, “কী করতে বলেন?”

গোরা। হয় বাঙালি-চরিত্রের কলঙ্ক মোচন করুন, নয় গলায় দড়ি দিয়ে মরুন গে। আমাদের জাতের দ্বারা কখনো কিছুই হবে না, এ কথা কি এতই সহজে বলবার? আপনার গলায় রুটি বেধে গেল না?

হারান। সত্য কথা বলব না?

গোরা। রাগ করবেন না, কিন্তু এ কথা যদি আপনি যথার্থই সত্য বলে জানতেন তা হলে অমন আরামে অত আস্ফালন করে বলতে পারতেন না। কথাটি মিথ্যে জানেন বলেই আপনার মুখ দিয়ে বেরোল। হারানবাবু, মিথ্যা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরো পাপ, এবং স্বজাতির মিথ্যা নিন্দার মতো পাপ অল্পই আছে।

হারান ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। গোরা কহিল, “আপনি একলাই কি আপনার সমস্ত স্বজাতির চেয়ে বড়ো? রাগ আপনি করবেন–আর আমাদের পিতৃপিতামহের হয়ে আমরা সমস্ত সহ্য করব!”

ইহার পর হারানের পক্ষে হার মানা আরো শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি আরো সুর চড়াইয়া বাঙালির নিন্দায় প্রবৃত্ত হইলেন। বাঙালি-সমাজের নানাপ্রকার প্রথার উল্লেখে কহিলেন, “এ-সমস্ত থাকতে বাঙালির কোনো আশা নেই।”

গোরা কহিল, “আপনি যাকে কুপ্রথা বলছেন সে কেবল ইংরেজি বই মুখস্থ করে বলছেন, নিজে ও সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। ইংরেজের সমস্ত কুপ্রথাকেও যখন আপনি ঠিক করেই এমনি অবজ্ঞা করতে পারবেন তখন এ সম্বন্ধে কথা কবেন।”

পরেশ এই প্রসঙ্গ বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ক্রুদ্ধ হারান নিবৃত্ত হইলেন না। সূর্য অস্ত গেল; মেঘের ভিতর হইতে একটা অপরূপ আরক্ত আভায় সমস্ত আকাশ লাবণ্যময় হইয়া উঠিল; সমস্ত তর্কের কোলাহল ছাপাইয়া বিনয়ের প্রাণের ভিতরে একটা সুর বাজিতে লাগিল। পরেশ তাঁহার সায়ংকালীন উপাসনায় মন দিবার জন্য ছাত হইতে উঠিয়া বাগানের প্রান্তে একটা বড়ো চাঁপাগাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে গিয়া বসিলেন।

গোরার প্রতি বরদাসুন্দীর মন যেমন বিমুখ হইয়াছিল হারানও তেমনি তাঁহার প্রিয় ছিল না। এই উভয়ের তর্ক যখন তাঁহার একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল তিনি বিনয়কে ডাকিয়া কহিলেন, “আসুন বিনয়বাবু, আমরা ঘরে যাই।”

বরদাসুন্দরীর এই সস্নেহ পক্ষপাত স্বীকার করিয়া বিনয়কে ছাত ছাড়িয়া অগত্যা ঘরের মধ্যে যাইতে হইল। বরদা তাঁহার মেয়েদের ডাকিয়া লইলেন। সতীশ তর্কের গতিক দেখিয়া পূর্বেই চিনাবাদামের কিঞ্চিৎ অংশ সংগ্রহ-পূর্বক খুদে কুকুরকে সঙ্গে লইয়া অন্তর্ধান করিয়াছিল।

বরদাসুন্দরী বিনয়ের কাছে তাঁহার মেয়েদের গুণপনার পরিচয় দিতে লাগিলেন। লাবণ্যকে বলিলেন, “তোমার সেই খাতাটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাও-না।”

বাড়ির নূতন-আলাপীদের এই খাতা দেখানো লাবণ্যর অভ্যাস হইয়াছিল। এমন-কি, সে ইহার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করিয়া থাকিত। আজ তর্ক উঠিয়া পড়াতে সে ক্ষুণ্ন হইয়া পড়িয়াছিল।

বিনয় খাতা খুলিয়া দেখিল, তাহাতে কবি মূর এবং লংফেলোর ইংরেজি কবিতা লেখা। হাতের অক্ষরে যত্ন এবং পারিপাট্য প্রকাশ পাইতেছে। কবিতাগুলির শিরোনামা এবং আরম্ভের অক্ষর রোম্যান ছাঁদে লিখিত।

এই লেখাগুলি দেখিয়া বিনয়ের মনে অকৃত্রিম বিস্ময় উৎপন্ন হইল। তখনকার দিনে মূরের কবিতা খাতায় কপি করিতে পারা মেয়েদের পক্ষে কম বাহাদুরি ছিল না। বিনয়ের মন যথোচিত অভিভূত হইয়াছে দেখিয়া বরদাসুন্দরী তাঁহার মেজো মেয়েকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ললিতা, লক্ষ্ণী মেয়ে আমার, তোমার সেই কবিতাটা–”

ললিতা শক্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “না মা, আমি পারব না। সে আমার ভালো মনে নেই।” বলিয়া সে দূরে জানালার কাছে দাঁড়াইয়া রাস্তা দেখিতে লাগিল।

বরদাসুন্দরী বিনয়কে বুঝাইয়া দিলেন, মনে সমস্তই আছে, কিন্তু ললিতা বড়ো চাপা, বিদ্যা বাহির করিতে চায় না। এই বলিয়া ললিতার আশ্চর্য বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয়-স্বরূপ দুই-একটা ঘটনা বিবৃত করিয়া বলিলেন, ললিতা শিশুকাল হইতেই এইরূপ, কান্না পাইলেও মেয়ে চোখের জল ফেলিতে চাহিত না। এ সম্বন্ধে বাপের সঙ্গে ইহার সাদৃশ্য আলোচনা করিলেন।

এইবার লীলার পালা। তাহাকে অনুরোধ করিতেই সে প্রথমে খুব খানিকটে খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া তাহার পরে কল-টেপা আর্গিনের মতো অর্থ না বুঝিয়া ‘Twinkle twinkle little star’ কবিতাটা গড়্‌ গড়্‌ করিয়া এক নিশ্বাসে বলিয়া গেল।

এইবার সংগীতবিদ্যার পরিচয় দিবার সময় আসিয়াছে জানিয়া ললিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

বাহিরের ছাতে তর্ক তখন উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে। হারান তখন রাগের মাথায় তর্ক ছাড়িয়া গালি দিবার উপক্রম করিতেছেন। হারানের অসহিষ্ণুতায় লজ্জিত ও বিরক্ত হইয়া সুচরিতা গোরার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছে। হারানের পক্ষে সেটা কিছুমাত্র সান্ত্বনাজনক বা শান্তিকর হয় নাই।

আকাশে অন্ধকার এবং শ্রাবণের মেঘ ঘনাইয়া আসিল; বেলফুলের মালা হাঁকিয়া রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা চলিয়া গেল। সম্মুখের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছের পল্লবপুঞ্জের মধ্যে জোনাকি জ্বলিতে লাগিল। পাশের বাড়ির পুকুরের জলের উপর একটা নিবিড় কালিমা পড়িয়া গেল।

সান্ধ্য উপাসনা শেষ করিয়া পরেশ ছাতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া গোরা ও হারান উভয়েই লজ্জিত হইয়া ক্ষান্ত হইল। গোরা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,”রাত হয়ে গেছে, আজ তবে আসি।”

বিনয়ও ঘর হইতে বিদায় লইয়া ছাতে আসিয়া দেখা দিল। পরেশ গোরাকে কহিলেন, “দেখো, তোমার যখন ইচ্ছা এখানে এসো। কৃষ্ণদয়াল আমার ভাইয়ের মতো ছিলেন। তাঁর সঙ্গে এখন আমার মতের মিল নেই, দেখাও হয় না, চিঠিপত্র লেখাও বন্ধ আছে, কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুত্ব রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে থাকে। কৃষ্ণদয়ালের সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ অতি নিকটের। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।”

পরেশের সস্নেহ শান্ত কণ্ঠস্বরে গোরার এতক্ষণকার তর্কতাপ যেন জুড়াইয়া গেল। প্রথমে আসিয়া গোরা পরেশকে বড়ো একটা খাতির করে নাই। যাইবার সময় যথার্থ ভক্তির সঙ্গে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গেল। সুচরিতাকে গোরা কোনোপ্রকার বিদায়সম্ভাষণ করিল না। সুচরিতা যে সম্মুখে আছে ইহা কোনো আচরণের দ্বারা স্বীকার করাকেই সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল। বিনয় পরেশকে নতভাবে প্রণাম করিয়া সুচরিতার দিকে ফিরিয়া তাহাকে নমস্কার করিল এবং লজ্জিত হইয়া তাড়াতাড়ি গোরার অনুসরণ করিয়া বাহির হইয়া গেল।

হারান এই বিদায়সম্ভাষণ-ব্যাপার এড়াইয়া ঘরের মধ্যে গিয়া টেবিলের উপরকার একটি “ব্রহ্মসংগীত’ বই লইয়া তাহার পাতা উল্‌টাইতে লাগিলেন।

বিনয় ও গোরা চলিয়া যাইবামাত্র হারান দ্রুতপদে ছাতে আসিয়া পরেশকে কহিলেন, “দেখুন, সকলের সঙ্গেই মেয়েদের আলাপ করিয়ে দেওয়া আমি ভালো মনে করি নে।”

সুচরিতা ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিল, তাই সে ধৈর্য সম্বরণ করিতে পারিল না; কহিল, “বাবা যদি সে নিয়ম মানতেন তা হলে তো আপনাদের সঙ্গেও আমাদের আলাপ হতে পারত না।”

হারান কহিলেন, “আলাপ-পরিচয় নিজেদের সমাজের মধ্যেই বদ্ধ হলে ভালো হয়।”

পরেশ হাসিয়া কহিলেন, “আপনি পারিবারিক অন্তঃপুরকে আর-একটুখানি বড়ো করে একটা সামাজিক অন্তঃপুর বানাতে চান। কিন্তু আমি মনে করি নানা মতের ভদ্রলোকের সঙ্গে মেয়েদের মেশা উচিত; নইলে তাদের বুদ্ধিকে জোর করে খর্ব করে রাখা হয়। এতে ভয় কিম্বা লজ্জার কারণ তো কিছুই দেখি নে।”

হারান। ভিন্ন মতের লোকের সঙ্গে মেয়েরা মিশবে না এমন কথা বলি নে, কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয় সে ভদ্রতা যে এঁরা জানেন না।

পরেশ। না না, বলেন কী। ভদ্রতার অভাব আপনি যাকে বলছেন সে একটা সংকোচমাত্র–মেয়েদের সঙ্গে না মিশলে সেটা কেটে যায় না।

সুচরিতা উদ্ধত ভাবে কহিল, “দেখুন পানুবাবু, আজকের তর্কে আমাদের সমাজের লোকের ব্যবহারেই আমি লজ্জিত হচ্ছিলুম।”

ইতিমধ্যে লীলা দৌড়িয়া আসিয়া “দিদি” “দিদি” করিয়া সুচরিতার হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেল।

গোরা ১১

১১

সেদিন তর্কে গোরাকে অপদস্থ করিয়া সুচরিতার সম্মুখে নিজের জয়পতাকা তুলিয়া ধরিবার জন্য হারানের বিশেষ ইচ্ছা ছিল, গোড়ায় সুচরিতাও তাহার আশা করিয়াছিল। কিন্তু দৈবক্রমে ঠিক তার বিপরীত ঘটিল। ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক মতে সুচরিতার সঙ্গে গোরার মিল ছিল না। কিন্তু স্বদেশের প্রতি মমত্ব, স্বজাতির জন্য বেদনা তাহার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। যদিচ দেশের ব্যাপার লইয়া সে সর্বদা আলোচনা করে নাই, কিন্তু সেদিন স্বজাতির নিন্দায় গোরা যখন অকস্মাৎ বজ্রনাদ করিয়া উঠিল তখন সুচরিতার সমস্ত মনের মধ্যে তাহার অনুকূল প্রতিধ্বনি বাজিয়া উঠিয়াছিল। এমন বলের সঙ্গে এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের সম্বন্ধে কেহ তাহার সম্মুখে কথা বলে নাই। সাধারণত আমাদের দেশের লোকেরা স্বজাতি ও স্বদেশের আলোচনায় কিছু-না-কিছু মুরুব্বিয়ানা ফলাইয়া থাকে; তাহাকে গভীর ভাবে সত্য ভাবে বিশ্বাস করে না; এইজন্য মুখে কবিত্ব করিবার বেলায় দেশের সম্বন্ধে যাহাই বলুক দেশের প্রতি তাহাদের ভরসা নাই; কিন্তু গোরা তাহার স্বদেশের সমস্ত দুঃখ-দুর্গতি দুর্বলতা ভেদ করিয়াও একটা মহৎ সত্যাপদার্থকে প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে পাইত– সেইজন্য দেশের দারিদ্র৻কে কিছুমাত্র অস্বীকার না করিয়াও সে দেশের প্রতি এমন একটি বলিষ্ঠ শ্রদ্ধা স্থাপন করিয়াছিল। দেশের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি এমন তাহার অবিচলিত বিশ্বাস ছিল যে, তাহার কাছে আসিলে, তাহার দ্বিধাবিহীন দেশভক্তির বাণী শুনিলে সংশয়ীকে হার মানিতে হইত। গোরার এই অক্ষুণ্ন ভক্তির সম্মুখে হারানের অবজ্ঞাপূর্ণ তর্ক সুচরিতাকে প্রতি মুহূর্তে যেন অপমানের মতো বাজিতেছিল। সে মাঝে মাঝে সংকোচ বিসর্জন দিয়া উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে প্রতিবাদ না করিয়া থাকিতে পারে নাই।

তাহার পরে হারান যখন গোরা ও বিনয়ের অসাক্ষাতে ক্ষুদ্র-ঈর্ষা-বশত তাহাদের প্রতি অভদ্রতার অপবাদ আরোপ করিলেন তখনো এই অন্যায় ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে সুচরিতাকে গোরাদের পক্ষে দাঁড়াইতে হইল।

অথচ গোরার বিরুদ্ধে সুচরিতার মনের বিদ্রোহ একেবারেই যে শান্ত হইয়াছে তাহাও নহে। গোরার একপ্রকার গায়ে-পড়া উদ্ধত হিন্দুয়ানি তাহাকে এখনো মনে মনে আঘাত করিতেছিল। সে একরকম করিয়া বুঝিতে পারিতেছিল এই হিন্দুয়ানির মধ্যে একটা প্রতিকূলতার ভাব আছে–ইহা সহজ প্রশান্ত নহে, ইহা নিজের ভক্তি-বিশ্বাসের মধ্যে পর্যাপ্ত নহে, ইহা অন্যকে আঘাত করিবার জন্য সর্বদাই উগ্রভাবে উদ্যত।

সেদিন সন্ধ্যায় সকল কথায়, সকল কাজে, আহার করিবার কালে, লীলাকে গল্প বলিবার সময়, ক্রমাগতই সুচরিতার মনের তলদেশে একটা কিসের বেদনা কেবলই পীড়া দিতে লাগিল–তাহা কোনোমতেই সে দূর করিতে পারিল না। কাঁটা কোথায় আছে তাহা জানিতে পারিলে তবে কাঁটা তুলিয়া ফেলিতে পারা যায়। মনের কাঁটাটি খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য সেদিন রাত্রে সুচরিতা সেই গাড়িবারান্দার ছাতে একলা বসিয়া রহিল।

রাত্রির স্নিগ্ধ অন্ধকার দিয়া সে নিজের মনের অকারণ তাপ যেন মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না। তাহার বুকের অনির্দেশ্য বোঝাটার জন্য তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিল, কিন্তু কান্না আসিল না।

একজন অপরিচিত যুবা কপালে তিলক কাটিয়া আসিয়াছে, অথবা তাহাকে তর্কে পরাস্ত করিয়া তাহার অহংকার নত করা গেল না এইজন্যই সুচরিতা এতক্ষণ ধরিয়া পীড়া বোধ করিতেছে, ইহার অপেক্ষা অদ্ভুত হাস্যকর কিছুই হইতে পারে না। এই কারণটাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়া মন হইতে সে বিদায় করিয়া দিল। তখন আসল কারণটা মনে পড়িল এবং মনে পড়িয়া তাহার ভারি লজ্জা বোধ হইল। আজ তিন-চার ঘন্টা সুচরিতা সেই যুবকের সম্মুখেই বসিয়া ছিল এবং মাঝে মাঝে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া তর্কেও যোগ দিয়াছে অথচ সে তাহাকে একেবারে যেন লক্ষ্যমাত্রই করে নাই–যাইবার সময়েও তাহাকে সে যেন চোখে দেখিতেই পাইল না। এই পরিপূর্ণ উপেক্ষাই যে সুচরিতাকে গভীরভাবে বিঁধিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বাহিরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাসটা থাকিলে যে একটা সংকোচ জন্মে, বিনয়ের ব্যবহারে যে একটি সংকোচের পরিচয় পাওয়া যায়– সেই সংকোচের মধ্যে একটা সলজ্জ নম্রতা আছে। গোরার আচরণে তাহার চিহ্নমাত্রও ছিল না। তাহার সেই কঠোর এবং প্রবল ঔদাসীন্য সহ্য করা বা তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দেওয়া সুচরিতার পক্ষে আজ কেন এমন অসম্ভব হইয়া উঠিল? এতবড়ো উপেক্ষার সম্মুখেও সে যে আত্মসংবরণ না করিয়া তর্কে যোগ দিয়াছিল, নিজের এই প্রগল্‌ভতায় সে যেন মরিয়া যাইতেছিল। হারানের অন্যায় তর্কে একবার যখন সুচরিতা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল তখন গোরা তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল; সে চাহনিতে সংকোচের লেশমাত্র ছিল না– কিন্তু সে চাহনির ভিতর কী ছিল তাহাও বোঝা শক্ত। তখন কি সে মনে মনে বলিতেছিল– এ মেয়েটি কী নির্লজ্জ, অথবা, ইহার অহংকার তো কম নয়, পুরুষমানুষের তর্কে এ অনাহূত যোগ দিতে আসে? তাহাই যদি সে মনে করিয়া থাকে তাহাতে কী আসে যায়? কিছুই আসে যায় না, তবু সুচরিতা অত্যন্ত পীড়া বোধ করিতে লাগিল। এ-সমস্তই ভুলিয়া যাইতে, মুছিয়া ফেলিতে সে একান্ত চেষ্টা করিল কিন্তু কোনোমতেই পারিল না। গোরার উপর তাহার রাগ হইতে লাগিল– গোরাকে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন উদ্ধত যুবক বলিয়া সমস্ত মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে চাহিল কিন্তু তবু সেই বিপুলকায় বজ্রকণ্ঠ পুরুষের সেই নিঃসংকোচ দৃষ্টির স্মৃতির সম্মুখে সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত ছোটো হইয়া গেল– কোনোমতেই সে নিজের গৌরব খাড়া করিয়া রাখিতে পারিল না।

সকলের বিশেষ লক্ষগোচর হওয়া, আদর পাওয়া সুচরিতার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। সে যে মনে মনে এই আদর চাহিত তাহা নহে, কিন্তু আজ গোরার নিকট হইতে উপেক্ষা কেন তাহার কাছে এত অসহ্য হইল? অনেক ভাবিয়া সুচরিতা শেষকালে স্থির করিল যে, গোরাকে সে বিশেষ করিয়া হার মানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল বলিয়াই তাহার অবিচলিত অনবধান এত করিয়া হৃদয়ে আঘাত করিতেছে।

এমনি করিয়া নিজের মনখানা লইয়া টানাছেঁড়া করিতে করিতে রাত্রি বাড়িয়া যাইতে লাগিল। বাতি নিবাইয়া দিয়া বাড়ির সকলেই ঘুমাইতে গিয়াছে। সদর-দরজা বন্ধ হইবার শব্দ হইল– বোঝা গেল বেহারা রান্না-খাওয়া সারিয়া এইবার শুইতে যাইবার উপক্রম করিতেছে। এমন সময় ললিতা তাহার রাত্রির কাপড় পরিয়া ছাতে আসিল। সুচরিতাকে কিছুই না বলিয়া তাহার পাশ দিয়া গিয়া ছাতের এক কোণে রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইল। সুচরিতা মনে মনে একটু হাসিল, বুঝিল ললিতা তাহার প্রতি অভিমান করিয়াছে। আজ যে তাহার ললিতার সঙ্গে শুইবার কথা ছিল তাহা সে একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু ভুলিয়া গেছি বলিলে ললিতার কাছে অপরাধ ক্ষালন হয় না– কারণ, ভুলিতে পারাটাই সকলের চেয়ে গুরুতর অপরাধ। সে যে যথাসময়ে প্রতিশ্রুতি মনে করাইয়া দিবে তেমন মেয়ে নয়। এতক্ষণ সে শক্ত হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিল– যতই সময় যাইতেছিল ততই তাহার অভিমান তীব্র হইয়া উঠিতেছিল। অবশেষে যখন নিতান্তই অসহ্য হইয়া উঠিল তখন সে বিছানা ছাড়িয়া কেবল নীরবে জানাইতে আসিল যে আমি এখনো জাগিয়া আছি।

সুচরিতা চৌকি ছাড়িয়া ধীরে ধীরে ললিতার কাছে আসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল– কহিল, “ললিতা, লক্ষ্ণী ভাই, রাগ কোরো না ভাই।”

ললিতা সুচরিতার হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, “না, রাগ কেন করব? তুমি বসো-না।”

সুচরিতা তাহার হাত টানিয়া লইয়া কহিল, “চলো ভাই, শুতে যাই।”

ললিতা কোনো উত্তর না করিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে সুচরিতা তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া শোবার ঘরে লইয়া গেল।

ললিতা রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “কেন তুমি এত দেরি করলে? জান এগারোটা বেজেছে। আমি সমস্ত ঘড়ি শুনেছি। এখনই তো তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”

সুচরিতা ললিতাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কহিল, “আজ আমার অন্যায় হয়ে গেছে ভাই।”

যেমনি অপরাধ স্বীকার করা ললিতার আর রাগ রহিল না। একেবারে নরম হইয়া কহিল, “এতক্ষণ একলা বসে কার কথা ভাবছিলে দিদি? পানুবাবুর কথা?”

তাহাকে তর্জনী দিয়া আঘাত করিয়া সুচরিতা কহিল, “দূর!”

পানুবাবুকে ললিতা সহিতে পারিত না। এমন-কি, তাহার অন্য বোনের মতো তাহাকে লইয়া সুচরিতাকে ঠাট্টা করাও তাহার পক্ষে অসাধ্য ছিল। পানুবাবু সুচরিতাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন এ কথা মনে করিলে তাহার রাগ হইত।

একটুখানি চুপ করিয়া ললিতা কথা তুলিল, “আচ্ছা দিদি, বিনয়বাবু লোকটি কিন্তু বেশ। না?”

সুচরিতার মনের ভাবটা যাচাই করিবার উদ্দেশ্য যে এ প্রশ্নের মধ্যে ছিল না তাহা বলিতে পারি না।

সুচরিতা কহিল, “হাঁ, বিনয়বাবু লোকটি ভালো বৈকি– বেশ ভালোমানুষ।”

ললিতা যে সুর আশা করিয়াছিল তাহা তো সম্পূর্ণ বাজিল না। তখন সে আবার কহিল, “কিন্তু যাই বল দিদি, আমার গৌরমোহনবাবুকে একেবারেই ভালো লাগে নি। কী রকম কটা কটা রঙ, কাঠখোট্টা চেহারা, পৃথিবীর কাউকে যেন গ্রাহ্যই করেন না। তোমার কী রকম লাগল?”

সুচরিতা কহিল, “বড়ো বেশি রকম হিঁদুয়ানি।”

ললিতা কহিল, “না, না, আমাদের মেসোমশায়ের তো খুবই হিঁদুয়ানি, কিন্তু সে আর-এক রকমের। এ যেন– ঠিক বলতে পারি নে কী রকম।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “কী রকমই বটে।” বলিয়া গোরার সেই উচ্চ শুভ্র ললাটে তিলক-কাটা মূর্তি মনে আনিয়া সুচরিতা রাগ করিল। রাগ করিবার কারণ এই যে, ঐ তিলকের দ্বারা গোরা কপালে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে যে তোমাদের হইতে আমি পৃথক। সেই পার্থক্যের প্রচণ্ড অভিমানকে সুচরিতা যদি ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত তবেই তাহার গায়ের জ্বালা মিটিত।

আলোচনা বন্ধ হইল, ক্রমে দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রি যখন দুইটা সুচরিতা জাগিয়া দেখিল, বাহিরে ঝম্‌ ঝম্‌ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে; মাঝে মাঝে তাহাদের মশারির আবরণ ভেদ করিয়া বিদ্যুতের আলো চমকিয়া উঠিতেছে; ঘরের কোণে যে প্রদীপ ছিল সেটা নিবিয়া গেছে। সেই রাত্রির নিস্তব্ধতায় অন্ধকারে, অবিশ্রাম বৃষ্টির শব্দে, সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বেদনা বোধ হইতে লাগিল। সে এপাশ ওপাশ করিয়া ঘুমাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল– পাশেই ললিতাকে গভীর সুপ্তিতে মগ্ন দেখিয়া তাহার ঈর্ষা জন্মিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বিরক্ত হইয়া সে বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল। খোলা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া সম্মুখের ছাতের দিকে চাহিয়া– মাঝে মাঝে বাতাসের বেগে গায়ে বৃষ্টির ছাট লাগিতে লাগিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া আজ সন্ধ্যাবেলাকার সমস্ত ব্যাপারে তন্ন তন্ন করিয়া তাহার মনে উদয় হইল। সেই সূর্যাস্তরঞ্জিত গাড়িবারান্দার উপর গোরার উদ্দীপ্ত মুখ স্পষ্ট ছবির মতো তাহার স্মৃতিতে জাগিয়া উঠিল এবং তখন তর্কের যে-সমস্ত কথা কানে শুনিয়া ভুলিয়া গিয়াছিল সে সমস্তই গোরার গভীর প্রবল কণ্ঠস্বরে জড়িত হইয়া আগাগোড়া তাহার মনে পড়িল। কানে বাজিতে লাগিল, “আপনারা যাদের অশিক্ষিত বলেন আমি তাদেরই দলে, আপনারা যাকে কুসংস্কার বলেন আমার সংস্কার তাই। যতক্ষণ না আপনি দেশকে ভালোবাসবেন এবং দেশের লোকের সঙ্গে এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মুখ থেকে দেশের নিন্দা আমি এক বর্ণও সহ্য করতে পারব না।” এ কথার উত্তরে পানুবাবু কহিলেন, “এমন করলে দেশের সংশোধন হবে কী করে?” গোরা গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “সংশোধন! সংশোধন ঢের পরের কথা। সংশোধনের চেয়েও বড়ো কথা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। আগে আমরা এক হব তা হলেই সংশোধন ভিতর থেকে আপনিই হবে। আপনারা যে পৃথক হয়ে দেশকে খণ্ড খণ্ড করতে চান– আপনারা বলেন, দেশের কুসংস্কার আছে অতএব আমরা সুসংস্কারীর দল আলাদা হয়ে থাকব। আমি এই কথা বলি, আমি কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে কারো থেকে পৃথক হব না, এই আমার সকলের চেয়ে বড়ো আকাঙক্ষা– তার পর এক হলে কোন্‌ সংস্কার থাকবে, কোন্‌ সংস্কার যাবে, তা আমার দেশই জানে এবং দেশের যিনি বিধাতা তিনিই জানেন।” পানুবাবু কহিলেন, “এমন-সকল প্রথা ও সংস্কার আছে যা দেশকে এক হতে দিচ্ছে না।” গোরা কহিল, “যদি এই কথা মনে করেন যে আগে সেই-সমস্ত প্রথা ও সংস্কারকে একে একে উৎপাটিত করে ফেলবেন তার পরে দেশ এক হবে তবে সমুদ্রকে ছেঁচে ফেলে সমুদ্র পার হবার চেষ্টা করা হবে। অবজ্ঞা ও অহংকার দূর করে নম্র হয়ে ভালোবেসে নিজেকে অন্তরের সঙ্গে সকলের করুন, সেই ভালোবাসার কাছে সহস্র ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা সহজেই হার মানবে। সকল দেশের সকল সমাজেই ত্রুটি ও অপূর্ণতা আছে কিন্তু দেশের লোক স্বজাতির প্রতি ভালোবাসার টানে যতক্ষণ এক থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিষ কাটিয়ে চলতে পারে। পচবার কারণ হাওয়ার মধ্যেই আছে। কিন্তু বেঁচে থাকলেই সেটা কাটিয়ে চলি, মরে গেলেই পচে উঠি। আমি আপনাকে বলছি সংশোধন করতে যদি আসেন তো আমরা সহ্য করব না, তা আপনারাই হোন বা মিশনারিই হোন।” পানুবাবু কহিলেন, “কেন করবেন না?” গোরা কহিল, “করব না তার কারণ আছে। বাপ-মায়ের সংশোধন সহ্য করা যায় কিন্তু পাহারাওয়ালার সংশোধনে শোধনের চেয়ে অপমান অনেক বেশি; সেই সংশোধন সহ্য করতে হলে মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়। আগে আত্মীয় হবেন তার পর সংশোধক হবেন– নইলে আপনার মুখের ভালো কথাতেও আমাদের অনিষ্ট হবে।” এমনি করিয়া একটি একটি সমস্ত কথা আগাগোড়া সুচরিতার মনে উঠিতে লাগিল এবং এইসঙ্গে মনের মধ্যে একটা অনির্দেশ্য বেদনাও কেবলই পীড়া দিতে থাকিল। শ্রান্ত হইয়া সুচরিতা বিছানায় ফিরিয়া আসিল এবং চোখের উপর করতল চাপিয়া সমস্ত ভাবনাকে ঠেলিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিল কিন্তু তাহার মুখ ও কান ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল এবং এই-সমস্ত আলোচনা ভাঙিয়া চুরিয়া তাহার মনের মধ্যে কেবলই আনাগোনা করিতে থাকিল।

গোরা ১২

১২

বিনয় ও গোরা পরেশের বাড়ি হইতে রাস্তায় বাহির হইলে বিনয় কহিল, “গোরা, একটু আস্তে আস্তে চলো ভাই– তোমার পা দুটো আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো– ওর চালটা একটু খাটো না করলে তোমার সঙ্গে যেতে আমরা হাঁপিয়ে পড়ি।”

গোরা কহিল, “আমি একলাই যেতে চাই, আমার আজ অনেক কথা ভাববার আছে।”

বলিয়া তাহার স্বাভাবিক দ্রুতগতিতে সে বেগে চলিয়া গেল।

বিনয়ের মনে আঘাত লাগিল। সে আজ গোরার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া তাহার নিয়ম ভঙ্গ করিয়াছে। সে সম্বন্ধে গোরার কাছে তিরস্কার ভোগ করিলে সে খুশি হইত। একটা ঝড় হইয়া গেলেই তাহাদের চিরদিনের বন্ধুত্বের আকাশ হইতে গুমট কাটিয়া যাইত এবং সে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিত।

তাহা ছাড়া আর-একটা কথা তাহাকে পীড়া দিতেছিল। আজ হঠাৎ গোরা পরেশের বাড়িতে প্রথম আসিয়াই বিনয়কে সেখানে বন্ধুভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া নিশ্চয়ই মনে করিয়াছে বিনয় এ বাড়িতে সর্বদাই যাতায়াত করে। অবশ্য, যাতায়াত করিলে যে কোনো অপরাধ আছে তাহা নয়; গোরা যাহাই বলুক পরেশবাবুর সুশিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হইবার সুযোগ পাওয়া বিনয় একটা বিশেষ লাভ বলিয়া গণ্য করিতেছে; ইঁহাদের সঙ্গে মেশামেশি করাতে গোরা যদি কোনো দোষ দেখে তবে সেটা তাহার নিতান্ত গোঁড়ামি; কিন্তু পূর্বের কথাবার্তায় গোরা নাকি জানিয়াছে যে বিনয় পরেশবাবুর বাড়িতে যাওয়া-আসা করে না, আজ সহসা তাহার মনে হইতে পারে যে সে কথাটা সত্য নয়। বিশেষত বরদাসুন্দরী তাহাকে বিশেষ করিয়া ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন, সেখানে তাঁহার মেয়েদের সঙ্গে তাহার আলাপ হইতে লাগিল– গোরার তীক্ষ্ণ লক্ষ হইতে ইহা এড়াইয়া যায় নাই। মেয়েদের সঙ্গে এইরূপ মেলামেশায় ও বরদাসুন্দরীর আত্মীয়তায় মনে মনে বিনয় ভারি একটা গৌরব ও আনন্দ অনুভব করিতেছিল– কিন্তু সেইসঙ্গে এই পরিবারে গোরার সঙ্গে তাহার আদরের পার্থক্য তাহাকে ভিতরে ভিতরে বাজিতেছিল। আজ পর্যন্ত এই দুটি সহপাঠীর নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝখানে কেহই বাধাস্বরূপ দাঁড়ায় নাই। একবার কেবল গোরার ব্রাহ্মসামাজিক উৎসাহে উভয়ের বন্ধুত্বে একটা ক্ষণিক আচ্ছাদন পড়িয়াছিল– কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি বিনয়ের কাছে মত জিনিসটা খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে– সে মত লইয়া যতই লড়ালড়ি করুক-না কেন, মানুষই তাহার কাছে বেশি সত্য। এবারে তাহাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে মানুষের আড়াল পড়িবার উপক্রম হইয়াছে বলিয়া সে ভয় পাইয়াছে। পরেশের পরিবারের সহিত সম্বন্ধকে বিনয় মূল্যবান বলিয়া জ্ঞান করিতেছে, কারণ ,তাহার জীবনে ঠিক এমন আনন্দের আস্বাদন সে আর কখনো পায় নাই– কিন্তু গোরার বন্ধুত্ব বিনয়ের জীবনের অঙ্গীভূত; সেই বন্ধুত্ব হইতে বিবাহিত জীবনকেই সে কল্পনা করিতে পারে না।

এ পর্যন্ত কোনো মানুষকেই বিনয় গোরার মতো তাহার হৃদয়ের এত কাছে আসিতে দেয় নাই। আজ পর্যন্ত সে কেবল বই পড়িয়াছে এবং গোরার সঙ্গে তর্ক করিয়াছে, ঝগড়া করিয়াছে, আর গোরাকেই ভালোবাসিয়াছে; সংসারে আর কাহাকেও কিছুমাত্র আমল দিবার অবকাশই হয় নাই। গোরারও ভক্তসম্প্রদায়ের অভাব নাই, কিন্তু বন্ধু বিনয় ছাড়া আর কেহই ছিল না। গোরার প্রকৃতির মধ্যে একটা নিঃসঙ্গতার ভাব আছে– এ দিকে সে সামান্য লোকের সঙ্গে মিশিতে অবজ্ঞা করে না– অথচ নানাবিধ লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করা তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অধিকাংশ লোকই তাহার সঙ্গে একটা দূরত্ব অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না।

আজ বিনয় বুঝিতে পারিল পরেশবাবুর পরিজনদের প্রতি তাহার হৃদয় গভীরতর রূপে আকৃষ্ট হইতেছে। অথচ আলাপ বেশিদিনের নহে। ইহাতে সে গোরার কাছে যেন একটা অপরাধের লজ্জা বোধ করিতে লাগিল।

এই যে বরদাসুন্দরী আজ বিনয়কে তাঁহার মেয়েদের ইংরেজি হস্তলিপি ও শিল্পকাজ দেখাইয়া ও আবৃত্তি শুনাইয়া মাতৃগর্ব প্রকাশ করিতেছিলেন, গোরার কাছে যে ইহা কিরূপ অবজ্ঞাজনক তাহা বিনয় মনে মনে সুস্পষ্ট কল্পনা করিতেছিল। বস্তুতই ইহার মধ্যে যথেষ্ট হাস্যকর ব্যাপার ছিল; এবং বরদাসুন্দরীর মেয়েরা যে অল্পস্বল্প ইংরেজি শিখিয়াছে, ইংরেজ মেমের কাছে প্রশংসা পাইয়াছে, এবং লেফ্‌টেনাণ্ট গবর্নরের স্ত্রীর কাছে ক্ষণকালের জন্য প্রশ্রয় লাভ করিয়াছে, এই গর্বের মধ্যে এক হিসাবে একটা দীনতাও ছিল। কিন্তু এ-সমস্ত বুঝিয়া জানিয়াও বিনয় এ ব্যাপারটাকে গোরার আদর্শ-অনুসারে ঘৃণা করিতে পারে নাই। তাহার এ-সমস্ত বেশ ভালোই লাগিতেছিল। লাবণ্যের মতো মেয়ে– মেয়েটি দিব্য সুন্দর দেখিতে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই– বিনয়কে নিজের হাতের লেখা মূরের কবিতা দেখাইয়া যে বেশ একটু অহংকার বোধ করিতেছিল, ইহাতে বিনয়েরও অহংকারের তৃপ্তি হইয়াছিল। বরদাসুন্দরীর মধ্যে এ কালের ঠিক রঙটি ধরে নাই অথচ তিনি অতিরিক্ত উদগ্রভাবে একালীয়তা ফলাইতে ব্যস্ত– বিনয়ের কাছে এই অসামঞ্জস্যের অসংগতিটা ধরা পড়ে নাই যে তাহা নহে, তবুও বরদাসুন্দরীকে বিনয়ের বেশ ভালো লাগিয়াছিল; তাঁহার অহংকার ও অসহিষ্ণুতার সারল্যটুকুতে বিনয়ের প্রীতি বোধ হইয়াছিল। মেয়েরা যে তাহাদের হাসির শব্দে ঘর মধুর করিয়া রাখিয়াছে, চা তৈরি করিয়া পরিবেশন করিতেছে, নিজেদের হাতের শিল্পে ঘরের দেয়াল সাজাইয়াছে, এবং সেইসঙ্গে ইংরেজি কবিতা পড়িয়া উপভোগ করিতেছে, ইহা যতই সামান্য হউক বিনয় ইহাতেই মুগ্ধ হইয়াছে। বিনয় এমন রস তাহার মানবসঙ্গবিরল জীবনে আর কখনো পায় নাই। এই মেয়েদের বেশভূষা হাসি-কথা কাজকর্ম লইয়া কত মধুর ছবিই যে সে মনে মনে আঁকিতে লাগিল তাহার আর সংখ্যা নাই। শুধু বই পড়িয়া এবং মত লইয়া তর্ক করিতে করিতে যে ছেলে কখন যৌবনে পদার্পণ করিয়াছে জানিতেও পারে নাই, তাহার কাছে পরেশের ঐ সামান্য বাসাটির অভ্যন্তরে এক নূতন এবং আশ্চর্য জগৎ প্রকাশ পাইল।

গোরা যে বিনয়ের সঙ্গ ছাড়িয়া রাগ করিয়া চলিয়া গেল সে রাগকে বিনয় অন্যায় মনে করিতে পারিল না। এই দুই বন্ধুর বহুদিনের সম্বন্ধে এতকাল পরে আজ একটা সত্যকার ব্যাঘাত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

বর্ষারাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারকে স্পন্দিত করিয়া মাঝে মাঝে মেঘ ডাকিয়া উঠিল। বিনয়ের মনে অত্যন্ত একটা ভার বোধ হইতে লাগিল। তাহার মনে হইল তাহার জীবন চিরদিন যে পথ বাহিয়া আসিতেছিল আজ তাহা ছাড়িয়া দিয়া আর-একটা নূতন পথ লইয়াছে। এই অন্ধকারের মধ্যে গোরা কোথায় গেল এবং সে কোথায় চলিল।

বিচ্ছেদের মুখে প্রেমের বেগ বাড়িয়া উঠে। গোরার প্রতি প্রেম বিনয়ের হৃদয়ে যে কত বৃহৎ এবং কত প্রবল, আজ সেই প্রেমে আঘাত লাগিবার দিনে তাহা বিনয় অনুভব করিল।

বাসায় আসিয়া রাত্রির অন্ধকার এবং ঘরের নির্জনতাকে বিনয়ের অত্যন্ত নিবিড় এবং শূন্য বোধ হইতে লাগিল। গোরার বাড়ি যাইবার জন্য একবার সে বাহিরে আসিল; কিন্তু আজ রাত্রে গোরার সঙ্গে যে তাহার হৃদয়ের মিলন হইতে পারিবে এমন সে আশা করিতে পারিল না; তাই সে আবার ফিরিয়া গিয়া শ্রান্ত হইয়া বিছানার মধ্যে শুইয়া পড়িল।

পরের দিন সকালে উঠিয়া তাহার মন হালকা হইয়া গেল। রাত্রে কল্পনায় সে আপনার বেদনাকে অনাবশ্যক অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছিল– সকালে গোরার সহিত বন্ধুত্ব এবং পরেশের পরিবারের সহিত আলাপ তাহার কাছে একান্ত পরস্পরবিরোধী বলিয়া বোধ হইল না। ব্যাপারখানা এমন কী গুরুতর, এই বলিয়া কাল রাত্রিকার মনঃপীড়ায় আজ বিনয়ের হাসি পাইল।

বিনয় কাঁধে একখানা চাদর লইয়া দ্রুতপদে গোরার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। গোরা তখন তাহার নীচের ঘরে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিল। বিনয় যখন রাস্তায় তখনই গোরা তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিল– কিন্তু আজ বিনয়ের আগমনে খবরের কাগজ হইতে তাহার দৃষ্টি উঠিল না। বিনয় আসিয়াই কোনো কথা না বলিয়া ফস্‌ করিয়া গোরার হাত হইতে কাগজখানা কাড়িয়া লইল।

গোরা কহিল, “বোধ করি তুমি ভুল করেছ– আমি গৌরমোহন– একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু।”

বিনয় কহিল, “ভুল তুমিই হয়তো করছ। আমি হচ্ছি শ্রীযুক্ত বিনয়– উক্ত গৌরমোহনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বন্ধু।”

গোরা। কিন্তু গৌরমোহন এতই বেহায়া যে, সে তার কুসংস্কারের জন্য কারো কাছে কোনোদিন লজ্জা বোধ করে না।

বিনয়। বিনয়ও ঠিক তদ্রূপ। তবে কিনা সে নিজের সংস্কার নিয়ে তেড়ে অন্যকে আক্রমণ করতে যায় না।

দেখিতে দেখিতে দুই বন্ধুতে তুমুল তর্ক বাধিয়া উঠিল। পাড়াসুদ্ধ লোক বুঝিতে পারিল আজ গোরার সঙ্গে বিনয়ের সাক্ষাৎ ঘটিয়াছে।

গোরা কহিল, “তুমি যে পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করছ সে কথা সেদিন আমার কাছে অস্বীকার করার কী দরকার ছিল?”

বিনয়। কোনো দরকার-বশত অস্বীকার করি নি– যাতায়াত করি নে বলেই অস্বীকার করেছিলুম। এতদিন পরে কাল প্রথম তাঁদের বাড়িতে প্রবেশ করেছি।

গোরা। আমার সন্দেহ হচ্ছে অভিমন্যুর মতো তুমি প্রবেশ করবার রাস্তাই জান– বেরোবার রাস্তা জান না।

বিনয়। তা হতে পারে– ঐটে হয়তো আমার জন্মগত প্রকৃতি। আমি যাকে শ্রদ্ধা করি বা ভালোবাসি তাকে আমি ত্যাগ করতে পারি নে। আমার এই স্বভাবের পরিচয় তুমিও পেয়েছ।

গোরা। এখন থেকে তা হলে ওখানে যাতায়াত চলতে থাকবে?

বিনয়। একলা আমারই যে চলতে থাকবে এমন কী কথা আছে? তোমারও তো চলৎশক্তি আছে, তুমি তো স্থাবর পদার্থ নও।

গোরা। আমি তো যাই এবং আসি, কিন্তু তোমার যে লক্ষণ দেখলুম তুমি যে একেবারে যাবারই দাখিল। গরম চা কী রকম লাগল?

বিনয়। কিছু কড়া লেগেছিল।

গোরা। তবে?

বিনয়। না খাওয়াটা তার চেয়ে বেশি কড়া লাগত।

গোরা। সমাজপালনটা তা হলে কি কেবলমাত্র ভদ্রতাপালন?

বিনয়। সব সময়ে নয়। কিন্তু দেখো গোরা, সমাজের সঙ্গে যেখানে হৃদয়ের সংঘাত বাধে সেখানে আমার পক্ষে–

গোরা অধীর হইয়া উঠিয়া বিনয়কে কথাটা শেষ করিতেই দিল না। সে গর্জিয়া কহিল, “হৃদয়! সমাজকে তুমি ছোটো করে তুচ্ছ করে দেখ বলেই কথায় কথায় তোমার হৃদয়ের সংঘাত বাধে। কিন্তু সমাজকে আঘাত করলে তার বেদনা যে কতদূর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয় তা যদি অনুভব করতে তা হলে তোমার ঐ হৃদয়টার কথা তুলতে তোমার লজ্জা বোধ হত। পরেশবাবুর মেয়েদের মনে একটুখানি আঘাত দিতে তোমার ভারি কষ্ট লাগে– কিন্তু আমার কষ্ট লাগে এতটুকুর জন্য সমস্ত দেশকে যখন অনায়াসে আঘাত করতে পার।”

বিনয় কহিল, “তবে সত্য কথা বলি ভাই গোরা। এক পেয়ালা চা খেলে সমস্ত দেশকে যদি আঘাত করা হয় তবে সে আঘাতে দেশের উপকার হবে। তার থেকে বাঁচিয়ে চললে দেশটাকে অত্যন্ত দুর্বল, বাবু করে তোলা হবে।”

গোরা। ওগো মশায়, ও-সমস্ত যুক্তি আমি জানি– আমি যে একেবারে অবুঝ তা মনে কোরো না। কিন্তু এ-সমস্ত এখনকার কথা নয়। রুগি ছেলে যখন ওষুধ খেতে চায় না, মা তখন সুস্থ শরীরেও নিজে ওষুধ খেয়ে তাকে জানাতে চায় যে তোমার সঙ্গে আমার এক দশা– এটা তো যুক্তির কথা নয়, এটা ভালোবাসার কথা। এই ভালোবাসা না থাকলে যতই যুক্তি থাক্‌-না ছেলের সঙ্গে মায়ের যোগ নষ্ট হয়। তা হলে কাজও নষ্ট হয়। আমিও চায়ের পেয়ালা নিয়ে তর্ক করি না– কিন্তু দেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ আমি সহ্য করতে পারি না– চা না খাওয়া তার চেয়ে ঢের সহজ, পরেশবাবুর মেয়ের মনে কষ্ট দেওয়া তার চেয়ে ঢের ছোটো। সমস্ত দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেলাই আমাদের এখনকার অবস্থায় সকলের চেয়ে প্রধান কাজ– যখন মিলন হয়ে যাবে তখন চা খাবে কি না-খাবে দু কথায় সে তর্কের মীমাংসা হয়ে যাবে।

বিনয়। তা হলে আমার দ্বিতীয় পেয়ালা চা খাবার অনেক বিলম্ব আছে দেখছি।

গোরা। না, বেশি বিলম্ব করবার দরকার নেই। কিন্তু, বিনয়, আমাকে আর কেন? হিন্দুসমাজের অনেক অপ্রিয় জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও ছাড়বার সময় এসেছে। নইলে পরেশবাবুর মেয়েদের মনে আঘাত লাগবে।

এমন সময় অবিনাশ ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে গোরার শিষ্য। গোরার মুখ হইতে সে যাহা শোনে তাহাই সে নিজের বুদ্ধি-দ্বারা ছোটো এবং নিজের ভাষার দ্বারা বিকৃত করিয়া চারি দিকে বলিয়া বেড়ায়। গোরার কথা যাহারা কিছুই বুঝিতে পারে না, অবিনাশের কথা তাহারা বোঝে ও প্রশংসা করে।

বিনয়ের প্রতি অবিনাশের অত্যন্ত একটা ঈর্ষার ভাব আছে। তাই সে জো পাইলেই বিনয়ের সঙ্গে নির্বোধের মতো তর্ক করিতে চেষ্টা করে। বিনয় তাহার মূঢ়তায় অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠে– তখন গোরা অবিনাশের তর্ক নিজে তুলিয়া লইয়া বিনয়ের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। অবিনাশ মনে করে তাহারই যুক্তি যেন গোরার মুখ দিয়া বাহির হইতেছে।

অবিনাশ আসিয়া পড়াতে গোরার সঙ্গে মিলন-ব্যাপারে বিনয় বাধা পাইল। সে তখন উঠিয়া উপরে গেল। আনন্দময়ী তাঁহার ভাঁড়ার-ঘরের সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া তরকারি কুটিতেছিলেন।

আনন্দময়ী কহিলেন, “অনেকক্ষণ থেকে তোমাদের গলা শুনতে পাচ্ছি। এত সকালে যে? জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছ তো?”

অন্য দিন হইলে বিনয় বলিত, না, খাই নাই– এবং আনন্দময়ীর সম্মুখে বসিয়া তাহার আহার জমিয়া উঠিত। কিন্তু আজ বলিল, “না মা, খাব না– খেয়েই বেরিয়েছি।”

আজ বিনয় গোরার কাছে অপরাধ বাড়াইতে ইচ্ছা করিল না। পরেশবাবুর সঙ্গে তাহার সংস্রবের জন্য গোরা যে এখনো তাহাকে ক্ষমা করে নাই, তাহাকে একটু যেন দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে, ইহা অনুভব করিয়া তাহার মনের ভিতরে ভিতরে একটা ক্লেশ হইতেছিল। সে পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া আলুর খোসা ছাড়াইতে বসিয়া গেল।

মিনিট পনেরো পরে নীচে গিয়া দেখিল গোরা অবিনাশকে লইয়া বাহির হইয়া গেছে। গোরার ঘরে বিনয় অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে খবরের কাগজ হাতে লইয়া শূন্যমনে বিজ্ঞাপন দেখিতে লাগিল। তাহার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহির হইয়া চলিয়া গেল।

 গোরা ১৩

১৩

মধ্যাহ্নে গোরার কাছে যাইবার জন্য বিনয়ের মন আবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। বিনয় গোরার কাছে নিজেকে নত করিতে কোনোদিন সংকোচ বোধ করে নাই। কিন্তু নিজের অভিমান না থাকিলেও বন্ধুত্বের অভিমানকে ঠেকানো শক্ত। পরেশবাবুর কাছে ধরা দিয়া বিনয় গোরার প্রতি তাহার এতদিনকার নিষ্ঠায় একটু যেন খাটো হইয়াছে বলিয়া অপরাধ অনুভব করিতেছিল বটে, কিন্তু সেজন্য গোরা তাহাকে পরিহাস ও ভর্ৎসনা করিবে এই পর্যন্তই আশা করিয়াছিল, তাহাকে যে এমন করিয়া ঠেলিয়া রাখিবার চেষ্টা করিবে তাহা সে মনেও করে নাই। বাসা হইতে খানিকটা দূর বাহির হইয়া বিনয় আবার ফিরিয়া আসিল; বন্ধুত্ব পাছে অপমানিত হয় এই ভয়ে সে গোরার বাড়িতে যাইতে পারিল না।

মধ্যাহ্নে আহারের পর গোরাকে একখানা চিঠি লিখিবে বলিয়া কাগজ কলম লইয়া বিনয় বসিয়াছে; বসিয়া অকারণে কলমটাকে ভোঁতা অপবাদ দিয়া একটা ছুরি লইয়া অতিশয় যত্নে একটু একটু করিয়া তাহার সংস্কার করিতে লাগিয়াছে, এমন সময়ে নীচে হইতে “বিনয়” বলিয়া ডাক আসিল। বিনয় কলম ফেলিয়া তাড়াতাড়ি নীচে গিয়া বলিল, “মহিমদাদা, আসুন, উপরে আসুন।”

মহিম উপরের ঘরে আসিয়া বিনয়ের খাটের উপর বেশ চৌকা হইয়া বসিলেন এবং ঘরের আসবাবপত্র বেশ ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “দেখো বিনয়, তোমার বাসা যে আমি চিনি নে তা নয়– মাঝে মাঝে তোমার খবর নিয়ে যাই এমন ইচ্ছাও করে, কিন্তু আমি জানি তোমরা আজকালকার ভালো ছেলে, তোমাদের এখানে তামাকটি পাবার জো নেই, তাই বিশেষ প্রয়োজন না হলে–”

বিনয়কে ব্যস্ত হইয়া উঠিতে দেখিয়া মহিম কহিলেন, “তুমি ভাবছ এখনই বাজার থেকে নতুন হুঁকো কিনে এনে আমাকে তামাক খাওয়াবে, সে চেষ্টা কোরো না। তামাক না দিলে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু নতুন হুঁকোয় আনাড়ি হাতের সাজা তামাক আমার সহ্য হবে না।”

এই বলিয়া মহিম বিছানা হইতে একটা হাতপাখা তুলিয়া লইয়া হাওয়া খাইতে খাইতে কহিলেন, “আজ রবিবারের দিবানিদ্রাটা সম্পূর্ণ মাটি করে তোমার এখানে এসেছি তার একটু কারণ আছে। আমার একটি উপকার তোমাকে করতেই হবে।”

বিনয় “কী উপকার” জিজ্ঞাসা করিল। মহিম কহিলেন, “আগে কথা দাও, তবে বলব।”

বিনয়। আমার দ্বারা যদি সম্ভব হয় তবে তো?

মহিম। কেবলমাত্র তোমার দ্বারাই সম্ভব। আর কিছু নয়, তুমি একবার “হাঁ’ বললেই হয়।

বিনয়। আমাকে এত করে কেন বলছেন? আপনি তো জানেন আমি আপনাদের ঘরেরই লোক– পারলে আপনার উপকার করব না এ হতেই পারে না।

মহিম পকেট হইতে একটা পানের দোনা বাহির করিয়া তাহা হইতে গোটা দুয়েক পান বিনয়কে দিয়া বাকি তিনটে নিজের মুখে পুরিলেন ও চিবাইতে চিবাইতে কহিলেন, “আমার শশিমুখীকে তো তুমি জানই। দেখতে শুনতে নেহাত মন্দ নয়, অর্থাৎ বাপের মতো হয় নি। বয়স প্রায় দশের কাছাকাছি হল, এখন ওকে পাত্রস্থ করবার সময় হয়েছে। কোন্‌ লক্ষ্ণীছাড়ার হাতে পড়বে এই ভেবে আমার তো রাত্রে ঘুম হয় না।”

বিনয় কহিল, “ব্যস্ত হচ্ছেন কেন– এখনো সময় আছে।”

মহিম। নিজের মেয়ে যদি থাকত তো বুঝতে কেন ব্যস্ত হচ্ছি। বছর গেলেই বয়েস আপনি বাড়ে কিন্তু পাত্র তো আপনি আসে না। কাজেই দিন যত যায় মন ততই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এখন, তুমি যদি একটু আশ্বাস দাও তা হলে নাহয় দু-দিন সবুর করতেও পারি।

বিনয়। আমার তো বেশি লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় নেই– কলকাতার মধ্যে আপনাদের বাড়ি ছাড়া আর-কোনো বাড়ি জানি নে বললেই হয়– তবু আমি খোঁজ করে দেখব।

মহিম। শশিমুখীর স্বভাবচরিত্র তো জান।

বিনয়। জানি বৈকি। ওকে এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি– লক্ষ্ণী মেয়ে।

মহিম। তবে আর বেশিদূর খোঁজ করবার কী দরকার বাপু? ও মেয়ে তোমারই হাতে সমর্পণ করব।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “বলেন কী?”

মহিম। কেন, অন্যায় কী বলেছি! অবশ্য, কুলে তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো– কিন্তু বিনয়, এত পড়াশুনা করে যদি তোমরা কুল মানবে তবে হল কী!

বিনয়। না, না, কুলের কথা হচ্ছে না, কিন্তু বয়েস যে–

মহিম। বল কী! শশীর বয়েস কম কী হল! হিঁদুর ঘরের মেয়ে তো মেম-সাহেব নয়– সমাজকে তো উড়িয়ে দিলে চলে না।

মহিম সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন– বিনয়কে তিনি অস্থির করিয়া তুলিলেন। অবশেষে বিনয় কহিল, “আমাকে একটু ভাববার সময় দিন।”

মহিম। আমি তো আজ রাত্রেই দিন স্থির করছি নে।

বিনয়। তবু বাড়ির লোকদের–

মহিম। হাঁ, সে তো বটেই। তাঁদের মত নিতে হবে বৈকি। তোমার খুড়োমশায় যখন বর্তমান আছেন তাঁর অমতে তো কিছু হতে পারে না।

এই বলিয়া পকেট হইতে দ্বিতীয় পানের দোনা নিঃশেষ করিয়া যেন কথাটা পাকাপাকি হইয়া আসিয়াছে এইরূপ ভাব করিয়া মহিম চলিয়া গেলেন।

কিছুদিন পূর্বে আনন্দময়ী একবার শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহের প্রস্তাব আভাসে উত্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু বিনয় তাহা কানেও তোলে নাই। আজও প্রস্তাবটা যে বিশেষ সংগত বোধ হইল তাহা নহে কিন্তু তবু কথাটা মনের মধ্যে একটুখানি যেন স্থান পাইল। বিনয়ের মনে হইল এই বিবাহ ঘটিলে আত্মীয়তা-সম্বন্ধে গোরা তাহাকে কোনোদিন ঠেলিতে পারিবে না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে হৃদয়াবেগের সঙ্গে জড়িত করাকে ইংরেজিয়ানা বলিয়াই সে এতদিন পরিহাস করিয়া আসিয়াছে, তাই শশিমুখীকে বিবাহ করাটা তাহার কাছে অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল না। মহিমের এই প্রস্তাব লইয়া গোরার সঙ্গে পরামর্শ করিবার যে একটা উপলক্ষ জুটিল আপাতত ইহাতেই সে খুশি হইল। বিনয়ের ইচ্ছা গোরা এই লইয়া তাহাকে একটু পীড়াপীড়ি করে। মহিমকে সহজে সম্মতি না দিলে মহিম গোরাকে দিয়া তাহাকে অনুরোধ করাইবার চেষ্টা করিবে ইহাতে বিনয়ের সন্দেহ ছিল না।

এই সমস্ত আলোচনা করিয়া বিনয়ের মনের অবসাদ কাটিয়া গেল। সে তখনই গোরার বাড়ি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া চাদর কাঁধে বাহির হইয়া পড়িল। অল্প একটু দূর যাইতেই পশ্চাৎ হইতে শুনিতে পাইল, “বিনয়বাবু।” পিছন ফিরিয়া দেখিল সতীশ তাহাকে ডাকিতেছে।

সতীশকে সঙ্গে লইয়া আবার বিনয় বাসায় প্রবেশ করিল। সতীশ পকেট হইতে রুমালের পুঁটুলি বাহির করিয়া কহিল, “এর মধ্যে কী আছে বলুন দেখি।”

বিনয় “মড়ার মাথা” “কুকুরের বাচ্ছা” প্রভৃতি নানা অসম্ভব জিনিসের নাম করিয়া সতীশের নিকট তর্জন লাভ করিল। তখন সতীশ তাহার রুমাল খুলিয়া গোটাপাঁচেক কালো কালো ফল বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কী বলুন দেখি।”

বিনয় যাহা মুখে আসিল তাহাই বলিল। অবশেষে পরাভব স্বীকার করিলে সতীশ কহিল, রেঙ্গুনে তাহার এক মামা আছেন তিনি সেখানকার এই ফল তাহার মা’র কাছে পাঠাইয়া দিয়াছেন– মা তাহারই পাঁচটা বিনয়বাবুকে উপহার পাঠাইয়াছেন।

ব্রহ্মদেশের ম্যাঙ্গোষ্টিন ফল তখনকার দিনে কলিকাতায় সুলভ ছিল না– তাই বিনয় ফলগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া টিপিয়া টুপিয়া কহিল, “সতীশবাবু, ফলগুলো খাব কী করে?”

সতীশ বিনয়ের এই অজ্ঞতায় হাসিয়া কহিল, “দেখবেন, কামড়ে খাবেন না যেন– ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয়।”

সতীশ নিজেই এই ফল কামড় দিয়া খাইবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া আজ কিছুক্ষণ পূর্বে আত্মীয়স্বজনদের কাছে হাস্যাস্পদ হইয়াছে– সেইজন্য বিনয়ের অনভিজ্ঞতায় বিজ্ঞজনোচিত হাস্য করিয়া তাহার মনের বেদনা দূর হইল।

তাহার পরে দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে কিছুক্ষণ কৌতুকালাপ হইলে পর সতীশ কহিল, “বিনয়বাবু, মা বলেছেন আপনার যদি সময় থাকে তো একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে– আজ লীলার জন্মদিন।”

বিনয় বলিল, “আজ ভাই, আমার সময় হবে না, আজ আমি আর-এক জায়গায় যাচ্ছি।”

সতীশ। কোথায় যাচ্ছেন?

বিনয়। আমার বন্ধুর বাড়িতে।

সতীশ। আপনার সেই বন্ধু?

বিনয়। হাঁ।

“বন্ধুর বাড়ি যেতে পারেন অথচ আমাদের বাড়ি যাবেন না’ ইহার যৌক্তিকতা সতীশ বুঝিতে পারিল না– বিশেষত বিনয়ের এই বন্ধুকে সতীশের ভালো লাগে নাই; সে যেন ইস্কুলের হেড মাস্টারের চেয়ে কড়া লোক, তাহাকে আর্গিন শুনাইয়া কেহ যশ লাভ করিবে সে এমন ব্যক্তিই নয়– এমন লোকের কাছে যাইবার জন্য বিনয় যে কিছুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করিবে তাহা সতীশের কাছে ভালোই লাগিল না। সে কহিল, “না বিনয়বাবু, আপনি আমাদের বাড়ি আসুন।”

“আহ্বানসত্ত্বেও পরেশবাবুর বাড়িতে না গিয়া গোরার কাছে যাইব’ বিনয় এটা মনে মনে খুব আস্ফালন করিয়া বলিয়াছিল। আহত বন্ধুত্বের অভিমানকে আজ সে ক্ষুণ্ন হইতে দিবে না, গোরার প্রতি বন্ধুত্বের গৌরবকেই সে সকলের ঊর্ধ্বে রাখিবে ইহাই সে স্থির করিয়াছিল।

কিন্তু হার মানিতে তাহার বেশিক্ষণ লাগিল না। দ্বিধা করিতে করিতে মনের মধ্যে আপত্তি করিতে করিতে অবশেষে বালকের হাত ধরিয়া সেই আটাত্তর নম্বরেরই পথে সে চলিল। বর্মা হইতে আগত দুর্লভ ফলের এক অংশ বিনয়কে মনে করিয়া পাঠানোতে যে আত্মীয়তা প্রকাশ পাইয়াছে তাহাকে খাতির না করা বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব।

বিনয় পরেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া দেখিল পানুবাবু এবং আর-কয়েক জন অপরিচিত ব্যক্তি পরেশবাবুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। লীলার জন্মদিনের মধ্যাহ্নভোজনে তাহারা নিমন্ত্রিত ছিল। পানুবাবু যেন বিনয়কে দেখিতে পান নাই এমনি ভাবে চলিয়া গেলেন।

বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই বিনয় খুব একটা হাসির ধ্বনি এবং দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনিতে পাইল। সুধীর লাবণ্যর চাবি চুরি করিয়াছে; শুধু তাই নয়, দেরাজের মধ্যে লাবণ্যর খাতা আছে এবং সেই খাতার মধ্যে কবিযশঃপ্রার্থিনীর উপহাস্যতার উপকরণ আছে, তাহাই এই দস্যু লোকসমাজে উদ্‌ঘাটন করিবে বলিয়া শাসাইতেছে– ইহাই লইয়া উভয় পক্ষে যখন দ্বন্দ্ব চলিতেছে এমন সময়ে রঙ্গভূমিতে বিনয় প্রবেশ করিল।

তাহাকে দেখিয়া লাবণ্যের দল মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্ধান করিল। সতীশ তাহাদের কৌতুকের ভাগ লইবার জন্য তাহাদের পশ্চাতে ছুটিল। কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “মা আপনাকে একটু বসতে বললেন, এখনই তিনি আসছেন। বাবা অনাথবাবুদের বাড়ি গেছেন, তাঁরও আসতে দেরি হবে না।”

সুচরিতা বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া দিবার জন্য গোরার কথা তুলিল। হাসিয়া কহিল, “তিনি বোধ হয় আমাদের এখানে আর কখনো আসবেন না?”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”

সুচরিতা কহিল, “আমরা পুরুষদের সামনে বেরোই দেখে তিনি নিশ্চয় অবাক হয়ে গেছেন। ঘরকরনার মধ্যে ছাড়া মেয়েদের আর কোথাও দেখলে তিনি বোধ হয় তাদের শ্রদ্ধা করতে পারেন না।”

বিনয় ইহার উত্তর দিতে কিছু মুশকিলে পড়িয়া গেল। কথাটার প্রতিবাদ করিতে পারিলেই সে খুশি হইত, কিন্তু মিথ্যা বলিবে কী করিয়া? বিনয় কহিল, “গোরার মত এই যে, ঘরের কাজেই মেয়েরা সম্পূর্ণ মন না দিলে তাদের কর্তব্যের একাগ্রতা নষ্ট হয়।”

সুচরিতা কহিল, “তা হলে মেয়েপুরুষে মিলে ঘরবাহিরকে একেবারে ভাগ করে নিলেই তো ভালো হত। পুরুষকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় বলে তাঁদের বাইরের কর্তব্য হয়তো ভালো করে সম্পন্ন হয় না। আপনিও আপনার বন্ধুর মতে মত দেন না কি?”

নারীনীতি সম্বন্ধে এ-পর্যন্ত তো বিনয় গোরার মতেই মত দিয়া আসিয়াছিল। ইহা লইয়া সে কাগজে লেখালেখিও করিয়াছে। কিন্তু সেইটেই যে বিনয়ের মত, এখন তাহা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না। সে কহিল, “দেখুন, আসলে এ-সকল বিষয়ে আমরা অভ্যাসের দাস। সেইজন্যেই মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেখলে মনে খটকা লাগে– অন্যায় বা অকর্তব্য বলে যে খারাপ লাগে সেটা কেবল আমরা জোর করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করি। যুক্তিটা এ স্থলে উপলক্ষ মাত্র, সংস্কারটাই আসল।”

সুচরিতা কহিল, “আপনার বন্ধুর মনে বোধ হয় সংস্কারগুলো খুব দৃঢ়।”

বিনয়। বাইরে থেকে দেখে হঠাৎ তাই মনে হয়। কিন্তু একটা কথা আপনি মনে রাখবেন আমাদের দেশের সংস্কারগুলিতে তিনি যে চেপে ধরে থাকেন, তার কারণ এ নয় যে সেই সংস্কারগুলিকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন। আমরা দেশের প্রতি অন্ধ অশ্রদ্ধাবশত দেশের সমস্ত প্রথাকে অবজ্ঞা করতে বসেছিলুম বলেই তিনি এই প্রলয়কার্যে বাধা দিতে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, আগে আমাদের দেশকে শ্রদ্ধার দ্বারা, প্রীতর দ্বারা সমগ্রভাবে পেতে হবে, জানতে হবে, তার পরে আপনিই ভিতর থেকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের নিয়মে সংশোধনের কাজ চলবে।

সুচরিতা কহিল, “আপনিই যদি হত তা হলে এতদিন হয় নি কেন?”

বিনয়। হয় নি তার কারণ, ইতিপূর্বে দেশ বলে আমাদের সমস্ত দেশকে, জাতি বলে আমাদের সমস্ত জাতিকে এক করে দেখতে পারি নি। তখন যদি বা আমাদের স্বজাতিকে অশ্রদ্ধা করি নি তেমনি শ্রদ্ধাও করি নি– অর্থাৎ তাকে লক্ষ্যই করা যায় নি– সেইজন্যেই তার শক্তি জাগে নি। এক সময়ে রোগীর দিকে না তাকিয়ে তাকে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল– এখন তাকে ডাক্তারখানায় আনা হয়েছে বটে, কিন্তু ডাক্তার তাকে এতই অশ্রদ্ধা করে যে, একে একে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো দীর্ঘ শুশ্রুষাসাধ্য চিকিৎসা সম্বন্ধে সে ধৈর্য ধরে বিচার করে না। এই সময়ে আমার বন্ধু ডাক্তারটি বলছেন আমার এই পরমাত্মীয়টিকে যে চিকিৎসার চোটে আগাগোড়া নিঃশেষ করে ফেলবে এ আমি সহ্য করতে পারব না। এখন আমি এই ছেদনকার্য একেবারেই বন্ধ করে দেব এবং অনুকূল পথ্য-দ্বারা আগে এর নিজের ভিতরকার জীবনীশক্তিকে জাগিয়ে তুলব, তার পরে ছেদন করলেও রোগী সইতে পারবে, ছেদন না করলেও হয়তো রোগী সেরে উঠবে। গোরা বলেন, গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় সকলের চেয়ে বড়ো পথ্য– এই শ্রদ্ধার অভাবেই আমরা দেশকে সমগ্রভাবে জানতে পারছি নে– জানতে পারছি নে বলেই তার সম্বন্ধে যা ব্যবস্থা করছি তা কুব্যবস্থা হয়ে উঠছে। দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানবার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না।

সুচরিতা একটু একটু করিয়া খোঁচা দিয়া দিয়া গোরার সম্বন্ধে আলোচনাকে নিবিতে দিল না। বিনয়ও গোরার পক্ষে তাহার যাহা-কিছু বলিবার তাহা খুব ভালো করিয়াই বলিতে লাগিল। এমন যুক্তির কথা এমন দৃষ্টান্ত দিয়া এমন গুছাইয়া আর কখনো যেন সে বলে নাই; গোরাও তাহার নিজের মত এমন পরিষ্কার করিয়া এমন উজ্জ্বল করিয়া বলিতে পারিত কি না সন্দেহ; বিনয়ের বুদ্ধি ও প্রকাশক্ষমতার এই অপূর্ব উত্তেজনায় তাহার মনে একটা আনন্দ জন্মিতে লাগিল এবং সেই আনন্দে তাহার মুখ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “দেখুন, শাস্ত্রে বলে, আত্মানং বিদ্ধি– আপনাকে জানো। নইলে মুক্তি কিছুতেই নেই। আমি আপনাকে বলছি, আমার বন্ধু গোরা ভারতবর্ষের সেই আত্মবোধের প্রকাশ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাকে আমি সামান্য লোক বলে মনে করতে পারি নে। আমাদের সকলের মন যখন তুচ্ছ আকর্ষণে নূতনের প্রলোভনে বাহিরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ঐ একটিমাত্র লোক এই-সমস্ত বিক্ষিপ্ততার মাঝখানে অটলভাবে দাঁড়িয়ে সিংহগর্জনে সেই পুরাতন মন্ত্র বলছে– আত্মানাং বিদ্ধি।”

এই আলোচনা আরো অনেকক্ষণ চলিতে পারিত– সুচরিতাও ব্যগ্র হইয়া শুনিতেছিল– কিন্তু হঠাৎ পাশের একটা ঘর হইতে সতীশ চীৎকার করিয়া আবৃত্তি আরম্ভ করিল–

“বোলো না কাতর স্বরে না করি বিচার
জীবন স্বপনসম মায়ার সংসার।”

বেচারা সতীশ বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতদের সামনে বিদ্যা ফলাইবার কোনো অবকাশ পায় না। লীলা পর্যন্ত ইংরেজি কবিতা আওড়াইয়া সভা গরম করিয়া তোলে, কিন্তু সতীশকে বরদাসুন্দরী ডাকেন না। অথচ লীলার সঙ্গে সকল বিষয়েই সতীশের খুব একটা প্রতিযোগিতা আছে। কোনোমতে লীলার দর্প চূর্ণ করা সতীশের জীবনের প্রধান সুখ। বিনয়ের সম্মুখে কাল লীলার পরীক্ষা হইয়া গেছে। তখন অনাহূত সতীশ তাহাকে ছাড়াইয়া উঠিবার কোনো চেষ্টা করিতে পারে নাই। চেষ্টা করিলেও বরদাসুন্দরী তখনই তাহাকে দাবাইয়া দিতেন; তাই সে আজ পাশের ঘরে যেন আপন মনে উচ্চস্বরে কাব্যচর্চায় প্রবৃত্ত হইল। শুনিয়া সুচরিতা হাস্যসম্বরণ করিতে পারিল না।

এমন সময় লীলা তাহার মুক্ত বেণী দোলাইয়া ঘরে ঢুকিয়া সুচরিতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার কানে কানে কী একটা বলিল। অমনি সতীশ ছুটিয়া তাহার পিছনে আসিয়া কহিল, “আচ্ছা লীলা, বলো দেখি “মনোযোগ’ মানে কী?”

লীলা কহিল, “বলব না।”

সতীশ। ইস! বলব না! জান না তাই বলো-না।

বিনয় সতীশকে কাছে টানিয়া লইয়া হাসিয়া কহিল, “তুমি বলো দেখি মনোযোগ মানে কী?”

সতীশ সগর্বে মাথা তুলিয়া কহিল, “মনোযোগ মানে মনোনিবেশ।”

সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “মনোনিবেশ বলতে কী বোঝায়?”

আত্মীয় না হইলে আত্মীয়কে এমন বিপদে কে ফেলিতে পারে? সতীশ প্রশ্নটা যেন শুনিতে পায় নাই এমনি ভাবে লাফাইতে লাফাইতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

বিনয় আজ পরেশবাবুর বাড়ি হইতে সকাল সকাল বিদায় লইয়া গোরার কাছে যাইবে নিশ্চয় স্থির করিয়া আসিয়াছিল। বিশেষত গোরার কথা বলিতে বলিতে গোরার কাছে যাইবার উৎসাহও তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিল। তাই সে ঘড়িতে চারটে বাজিতে শুনিয়া তাড়াতাড়ি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল।

সুচরিতা কহিল, “আপনি এখনই যাবেন? মা আপনার জন্য খাবার তৈরি করছেন; আর-একটু পরে গেলে চলবে না?”

বিনয়ের পক্ষে এ তো প্রশ্ন নয়, এ হুকুম। সে তখনই বসিয়া পড়িল। লাবণ্য রঙিন রেশমের কাপড়ে সাজিয়া গুজিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “দিদি, খাবার তৈরি হয়েছে। মা ছাতে আসতে বললেন।”

ছাতে আসিয়া বিনয়কে আহারে প্রবৃত্ত হইতে হইল। বরদাসুন্দরী তাঁহার সব সন্তানদের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিতে লাগিলেন। ললিতা সুচরিতাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। লাবণ্য একটা চৌকিতে বসিয়া ঘাড় হেট করিয়া দুই লোহার কাঠি লইয়া বুনানির কার্যে লাগিল– তাহাকে কবে একজন বলিয়াছিল বুনানির সময় তাহার কোমল আঙুলগুলির খেলা ভারি সুন্দর দেখায়, সেই অবধি লোকের সাক্ষাতে বিনা প্রয়োজনে বুনানি করা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল।

পরেশ আসিলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিল। আজ রবিবারে উপাসনা-মন্দিরে যাইবার কথা। বরদাসুন্দরী বিনয়কে কহিলেন, “যদি আপত্তি না থাকে আমাদের সঙ্গে সমাজে যাবেন?”

ইহার পর কোনো ওজর-আপত্তি করা চলে না। দুই গাড়িতে ভাগ করিয়া সকলে উপাসনালয়ে গেলেন। ফিরিবার সময় যখন গাড়িতে উঠিতেছেন তখন হঠাৎ সুচরিতা চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “ঐ যে গৌরমোহনবাবু যাচ্ছেন।”

গোরা যে এই দলকে দেখিতে পাইয়াছিল তাহাতে কাহারো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যেন দেখিতে পায় নাই এইরূপ ভাব করিয়া সে বেগে চলিয়া গেল। গোরার এই উদ্ধত অশিষ্টতায় বিনয় পরেশবাবুদের কাছে লজ্জিত হইয়া মাথা হেঁট করিল। কিন্তু সে মনে মনে স্পষ্ট বুঝিল, বিনয়কেই এই দলের মধ্যে দেখিয়া গোরা এমন প্রবল বেগে বিমুখ হইয়া চলিয়া গেল। এতক্ষণ তাহার মনের মধ্যে যে-একটি আনন্দের আলো জ্বলিতেছিল তাহা একেবারে নিবিয়া গেল। সুচরিতা বিনয়ের মনের ভাব ও তাহার কারণটা তখনই বুঝিতে পারিল, এবং বিনয়ের মতো বন্ধুর প্রতি গোরার এই অবিচারে ও ব্রাহ্মদের প্রতি তাহার এই অন্যায় অশ্রদ্ধায় গোরার উপরে আবার তাহার রাগ হইল– কোনোমতে গোরার পরাভব ঘটে এই সে মনে মনে ইচ্ছা করিল।

 গোরা ১৪

১৪

গোরা যখন মধ্যাহ্নে খাইতে বসিল, আনন্দময়ী আস্তে আস্তে কথা পাড়িলেন, “আজ সকালে বিনয় এসেছিল। তোমার সঙ্গে দেখা হয় নি?”

গোরা খাবার থালা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিল, “হাঁ, হয়েছিল।”

আনন্দময়ী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন– তাহার পর কহিলেন, “তাকে থাকতে বলেছিলুম, কিন্তু সে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে চলে গেল।”

গোরা কোনো উত্তর করিল না। আনন্দময়ী কহিলেন, “তার মনে কী একটা কষ্ট হয়েছে গোরা। আমি তাকে এমন কখনো দেখি নি। আমার মন বড়ো খারাপ হয়ে আছে।”

গোরা চুপ করিয়া খাইতে লাগিল। আনন্দময়ী অত্যন্ত স্নেহ করিতেন বলিয়াই গোরাকে মনে মনে একটু ভয় করিতেন। সে যখন নিজে তাঁহার কাছে মন না খুলিত তখন তিনি তাহাকে কোনো কথা লইয়া পীড়াপীড়ি করিতেন না। অন্যদিন হইলে এইখানেই চুপ করিয়া যাইতেন, কিন্তু আজ বিনয়ের জন্য তাঁহার মন বড়ো বেদনা পাইতেছিল বলিয়াই কহিলেন, “দেখো, গোরা, একটি কথা বলি, রাগ কোরো না। ভগবান অনেক মানুষ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সকলের জন্যে কেবল একটিমাত্র পথ খুলে রাখেন নি। বিনয় তোমাকে প্রাণের মতো ভালোবাসে, তাই সে তোমার কাছ থেকে সমস্তই সহ্য করে– কিন্তু তোমারই পথে তাকে চলতে হবে এ জবর্দস্তি করলে সেটা সুখের হবে না।”

গোরা কহিল, “মা, আর-একটু দুধ এনে দাও।”

কথাটা এইখানেই চুকিয়া গেল। আহারান্তে আনন্দময়ী তাঁহার তক্তপোশে চুপ করিয়া বসিয়া সেলাই করিতে লাগিলেন। লছমিয়া বাড়ির বিশেষ কোনো ভৃত্যের দুর্ব্যবহার- সম্বন্ধীয় আলোচনায় আনন্দময়ীকে টানিবার বৃথা চেষ্টা করিয়া মেজের উপর শুইয়া পড়িয়া ঘুমাইতে লাগিল।

গোরা চিঠিপত্র লিখিয়া অনেকটা সময় কাটাইয়া দিল। গোরা তাহার উপর রাগ করিয়াছে বিনয় তাহা আজ সকালে স্পষ্ট দেখিয়া গেছে, তবু যে সে এই রাগ মিটাইয়া ফেলিবার জন্য গোরার কাছে আসিবে না ইহা হইতেই পারে না জানিয়া সে সকল কর্মের মধ্যেই বিনয়ের পদশব্দের জন্য কান পাতিয়া রহিল।

বেলা বহিয়া গেল– বিনয় আসিল না। লেখা ছাড়িয়া গোরা উঠিবে মনে করিতেছে এমন সময় মহিম আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। আসিয়াই চৌকিতে বসিয়া পড়িয়া কহিলেন, “শশিমুখীর বিয়ের কথা কী ভাবছ গোরা?”

এ কথা গোরা এক দিনের জন্যও ভাবে নাই, সুতরাং অপরাধীর মতো তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল।

বাজারে পাত্রের মূল্য যে কিরূপ চড়া এবং ঘরে অর্থের অবস্থা যে কিরূপ অসচ্ছল তাহা আলোচনা করিয়া গোরাকে একটা উপায় ভাবিতে বলিলেন। গোরা যখন ভাবিয়া কিনারা পাইল না তখন তিনি তাহাকে চিন্তাসংকট হইতে উদ্ধার করিবার জন্য বিনয়ের কথাটা পাড়িলেন। এত ঘোরফের করিবার কোনো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু মহিম গোরাকে মুখে যাই বলুন মনে মনে ভয় করিতেন।

এ প্রসঙ্গে বিনয়ের কথা যে উঠিতে পারে গোরা তাহা কখনো স্বপ্নেও ভাবে নাই। বিশেষত গোরা এবং বিনয় স্থির করিয়াছিল, তাহারা বিবাহ না করিয়া দেশের কাজে জীবন উৎসর্গ করিবে। গোরা তাই বলিল, “বিনয় বিয়ে করবে কেন?”

মহিম কহিলেন, “এই বুঝি তোমাদের হিঁদুয়ানি! হাজার টিকি রাখ আর ফোঁটা কাট সাহেবিয়ানা হাড়ের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে। শাস্ত্রের মতে বিবাহটা যে ব্রাহ্মণের ছেলের একটা সংস্কার তা জান?”

মহিম এখনকার ছেলেদের মতো আচারও লঙ্ঘন করেন না, আবার শাস্ত্রের ধারও ধারেন না। হোটেলে খানা খাইয়া বাহাদুরি করাকেও তিনি বাড়াবাড়ি মনে করেন, আবার গোরার মতো সর্বদা শ্রুতিস্মৃতি লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করাকেও তিনি প্রকৃতিস্থ লোকের লক্ষণ বলিয়া জ্ঞান করেন না। কিন্তু, যস্মিন্‌ দেশে যদাচারঃ– গোরার কাছে শাস্ত্রের দোহাই পাড়িতে হইল।

এ প্রস্তাব যদি দুইদিন আগে আসিত তবে গোরা একেবারে কানেই লইত না। আজ তাহার মনে হইল, কথাটা নিতান্ত উপেক্ষার যোগ্য নহে। অন্তত এই প্রস্তাবটা লইয়া এখনই বিনয়ের বাসায় যাইবার একটা উপলক্ষ জুটিল।

গোরা শেষকালে বলিল, “আচ্ছা, বিনয়ের ভাবখানা কী বুঝে দেখি।”

মহিম কহিলেন, “সে আর বুঝতে হবে না। তোমার কথা সে কিছুতেই ঠেলতে পারবে না। ও ঠিক হয়ে গেছে। তুমি বললেই হবে।”

সেই সন্ধ্যার সময়েই গোরা বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত। ঝড়ের মতো তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ঘরে কেহ নাই। বেহারাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করাতে সে কহিল, “বাবু আটাত্তর নম্বর বাড়িতে গিয়াছেন।” শুনিয়া গোরার সমস্ত মন বিকল হইয়া উঠিল। আজ সমস্ত দিন যাহার জন্য গোরার মনে শান্তি ছিল না সেই বিনয় আজকাল গোরার কথা মনে করিবার অবকাশমাত্র পায় না। গোরা রাগই করুক আর দুঃখিতই হউক, বিনয়ের শান্তি ও সান্ত্বনার কোনো ব্যাঘাত ঘটিবে না।

পরেশবাবুর পরিবারদের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধে, গোরার অন্তঃকরণ একেবারে বিষাক্ত হইয়া উঠিল। সে মনের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা বিদ্রোহ বহন করিয়া পরেশবাবুর বাড়ির দিকে ছুটিল। ইচ্ছা ছিল সেখানে এমন-সকল কথা উত্থাপন করিবে যাহা শুনিয়া এই ব্রাহ্ম-পরিবারের হাড়ে জ্বালা ধরিবে এবং বিনয়েরও আরাম বোধ হইবে না।

পরেশবাবুর বাসায় গিয়া শুনিল তাঁহারা কেহই বাড়িতে নাই, সকলেই উপাসনা-মন্দিরে গিয়াছেন। মুহূর্তকালের জন্য সংশয় হইল বিনয় হয়তো যায় নাই– সে হয়তো এই ক্ষণেই গোরার বাড়িতে গেছে।

থাকিতে পারিল না। গোরা তাহার স্বাভাবিক ঝড়ের গতিতে মন্দিরের দিকেই গেল। দ্বারের কাছে গিয়া দেখিল বিনয় বরদাসুন্দরীর অনুসরণ করিয়া তাঁহাদের গাড়িতে উঠিতেছে– সমস্ত রাস্তার মাঝখানে নির্লজ্জের মতো অন্য পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে এক গাড়িতে গিয়া বসিতেছে! মূঢ়! নাগপাশে এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয়! এত সত্বর! এত সহজে! তবে বন্ধুত্বের আর ভদ্রস্থতা নাই। গোরা ঝড়ের মতোই ছুটিয়া চলিয়া গেল– আর গাড়ির অন্ধকারের মধ্যে বিনয় রাস্তার দিকে তাকাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

বরদাসুন্দরী মনে করিলেন আচার্যের উপদেশ তাহার মনের মধ্যে কাজ করিতেছে– তিনি তাই কোনো কথা বলিলেন না।

গোরা ১৫

১৫

রাত্রে গোরা বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া অন্ধকার ছাতের উপর বেড়াইতে লাগিল।

তাহার নিজের উপর রাগ হইল। রবিবারটা কেন সে এমন বৃথা কাটিতে দিল। ব্যক্তিবিশেষের প্রণয় লইয়া অন্য সমস্ত কাজ নষ্ট করিবার জন্য তো গোরা পৃথিবীতে আসে নাই। বিনয় যে পথে যাইতেছে সে পথ হইতে তাহাকে টানিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলে কেবলই সময় নষ্ট এবং নিজের মনকে পীড়িত করা হইবে। অতএব জীবনের যাত্রাপথে এখন হইতে বিনয়কে বাদ দিতে হইবে। জীবনে গোরার একটিমাত্র বন্ধু আছে তাহাকেই ত্যাগ করিয়া গোরা তাহার ধর্মকে সত্য করিয়া তুলিবে। এই বলিয়া গোরা জোর করিয়া হাত নাড়িয়া বিনয়ের সংস্রবকে নিজের চারি দিক হইতে যেন সরাইয়া ফেলিল।

এমন সময় মহিম ছাতে আসিয়া হাঁপাইতে লাগিলেন– কহিলেন, “মানুষের যখন ডানা নেই তখন এই তেতলা বাড়ি তৈরি করা কেন? ডাঙার মানুষ হয়ে আকাশে বাস করবার চেষ্টা করলে আকাশবিহারী দেবতার সয় না। বিনয়ের কাছে গিয়েছিলে?”

গোরা তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “বিনয়ের সঙ্গে শশিমুখীর বিয়ে হতে পারবে না।”

মহিম। কেন, বিনয়ের মত নেই নাকি?

গোরা। আমার মত নেই।

মহিম হাত উল্‌টাইয়া কহিলেন, “বেশ! এ আবার একটা নতুন ফ্যাসাদ দেখছি। তোমার মত নেই। কারণটা কী শুনি।”

গোরা। আমি বেশ বুঝেছি বিনয়কে আমাদের সমাজে ধরে রাখা শক্ত হবে। ওর সঙ্গে আমাদের ঘরের মেয়ের বিবাহ চলবে না।

মহিম। ঢের ঢের হিঁদুয়ানি দেখেছি, কিন্তু এমনটি আর কোথাও দেখলুম না। কাশী-ভাটপাড়া ছাড়িয়ে গেলে! তুমি যে দেখি ভবিষ্যৎ দেখে বিধান দাও। কোন্‌ দিন বলবে, স্বপ্নে দেখলুম খ্রীস্টান হয়েছ, গোবর খেয়ে জাতে উঠতে হবে।

অনেক বকাবকির পর মহিম কহিলেন, “মেয়েকে তো মূর্খর হাতে দিতে পারি নে। যে ছেলে লেখাপড়া শিখেছে, যার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, সে ছেলে মাঝে মাঝে শাস্ত্র ডিঙিয়ে চলবেই। সেজন্যে তার সঙ্গে তর্ক করো, তাকে গাল দাও– কিন্তু তার বিয়ে বন্ধ করে মাঝে থেকে আমার মেয়েটাকে শাস্তি দাও কেন! তোমাদের সমস্তই উল্‌টো বিচার।”

মহিম নীচে আসিয়া আনন্দময়ীকে কহিলেন, “মা, তোমার গোরাকে তুমি ঠেকাও।”

আনন্দময়ী উদ্‌বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হয়েছে?”

মহিম। শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ আমি একরকম পাকা করেই এনেছিলুম। গোরাকেও রাজি করেছিলুম, ইতিমধ্যে গোরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে বিনয় যথেষ্ট পরিমাণে হিঁদু নয়– মনু-পরাশরের সঙ্গে তার মতের একটু-আধটু অনৈক্য হয়ে থাকে। তাই গোরা বেঁকে দাঁড়িয়েছে– গোরা বাঁকলে কেমন বাঁকে সে তো জানই। কলিযুগের জনক যদি পণ করতেন যে বাঁকা গোরাকে সোজা করলে তবে সীতা দেব, তবে শ্রীরামচন্দ্র হার মেনে যেতেন এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। মনু-পরাশরের নীচেই পৃথিবীর মধ্যে সে একমাত্র তোমাকেই মানে। এখন তুমি যদি গতি করে দাও তো মেয়েটা তরে যায়। অমন পাত্র খুঁজলে পাওয়া যাবে না।

এই বলিয়া গোরার সঙ্গে আজ ছাতে যা কথাবার্তা হইয়াছে মহিম তাহা সমস্ত বিবৃত করিয়া কহিলেন। বিনয়ের সঙ্গে গোরার একটা বিরোধ যে ঘনাইয়া উঠিতেছে ইহা বুঝিতে পারিয়া আনন্দময়ীর মন অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিল।

আনন্দময়ী উপরে আসিয়া দেখিলেন, গোরা ছাতে বেড়ানো বন্ধ করিয়া ঘরে একটা চৌকির উপর বসিয়া আর একটা চৌকিতে পা তুলিয়া বই পড়িতেছে। আনন্দময়ী তাহার কাছে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিলেন। গোরা সামনের চৌকি হইতে পা নামাইয়া খাড়া হইয়া বসিয়া আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিল।

আনন্দময়ী কহিলেন, “বাবা গোরা, আমার একটি কথা রাখিস– বিনয়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস নে। আমার কাছে তোরা দুজনে দুটি ভাই– তোদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে আমি সইতে পারব না।”

গোরা কহিল, “বন্ধু যদি বন্ধন কাটতে চায় তবে তার পিছনে ছুটোছুটি করে আমি সময় নষ্ট করতে পারব না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “বাবা, আমি জানি নে তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে। কিন্তু বিনয় তোমার বন্ধন কাটাতে চাচ্ছে এ কথা যদি বিশ্বাস কর তবে তোমার বন্ধুত্বের জোর কোথায়?”

গোরা। মা, আমি সোজা চলতে ভালোবাসি, যারা দু দিক রাখতে চায় আমার সঙ্গে তাদের বনবে না। দু নৌকোয় পা দেওয়া যার স্বভাব আমার নৌকো থেকে তাকে পা সরাতে হবে– এতে আমারই কষ্ট হোক আর তারই কষ্ট হোক।

আনন্দময়ী। কী হয়েছে বল্‌ দেখি। ব্রাহ্মদের ঘরে সে আসা-যাওয়া করে এই তো তার অপরাধ?

গোরা। সে অনেক কথা মা।

আনন্দময়ী। হোক অনেক কথা– কিন্তু আমি একটি কথা বলি, গোরা, সব বিষয়েই তোমার এত জেদ যে, তুমি যা ধর তা কেউ ছাড়াতে পারে না। কিন্তু বিনয়ের বেলাই তুমি এমন আলগা কেন? তোমার অবিনাশ যদি দল ছাড়তে চাইত তুমি কি তাকে সহজে ছাড়তে? তোমার বন্ধু বলেই কি ও তোমার সকলের চেয়ে কম?

গোরা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। আনন্দময়ীর এই কথাতে সে নিজের মনটা পরিষ্কার দেখিতে পাইল। এতক্ষণ সে মনে করিতেছিল যে, সে কর্তব্যের জন্য তাহার বন্ধুত্বকে বিসর্জন দিতে যাইতেছে, এখন স্পষ্ট বুঝিল ঠিক তাহার উল্‌টা। তাহার বন্ধুত্বের অভিমানে বেদনা লাগিয়াছে বলিয়াই বিনয়কে বন্ধুত্বের চরম শাস্তি দিতে সে উদ্যত হইয়াছে। সে মনে জানিত বিনয়কে বাঁধিয়া রাখিবার জন্য বন্ধুত্বই যথেষ্ট– অন্য কোনোপ্রকার চেষ্টা প্রণয়ের অসম্মান।

আনন্দময়ী যেই বুঝিলেন তাঁহার কথাটা গোরার মনে একটুখানি লাগিয়াছে অমনি তিনি আর কিছু না বলিয়া আস্তে আস্তে উঠিবার উপক্রম করিলেন। গোরাও হঠাৎ বেগে উঠিয়া পড়িয়া আলনা হইতে চাদর তুলিয়া কাঁধে ফেলিল।

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাও গোরা?”

গোরা কহিল, “আমি বিনয়ের বাড়ি যাচ্ছি।”

আনন্দময়ী। খাবার তৈরি আছে খেয়ে যাও।

গোরা। আমি বিনয়কে ধরে আনছি, সেও এখানে খাবে।

আনন্দময়ী আর কিছু না বলিয়া নীচের দিকে চলিলেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিয়া হঠাৎ থামিয়া কহিলেন, “ঐ বিনয় আসছে।”

বলিতে বলিতে বিনয় আসিয়া পড়িল। আনন্দময়ীর চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসিল। তিনি স্নেহে বিনয়ের গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বিনয়, বাবা, তুমি খেয়ে আস নি?”

বিনয় কহিল, “না, মা!”

আনন্দময়ী। তোমাকে এইখানেই খেতে হবে।

বিনয় একবার গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরা কহিল, “বিনয়, অনেক দিন বাঁচবে। তোমার ওখানেই যাচ্ছিলুম।”

আনন্দময়ীর বুক হালকা হইয়া গেল– তিনি তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেলেন।

দুই বন্ধু ঘরে আসিয়া বসিলে গোরা যাহা-তাহা একটা কথা তুলিল– কহিল, “জান, আমাদের ছেলেদের জন্যে একজন বেশ ভালো জিমনাষ্টিক মাস্টার পেয়েছি। সে শেখাচ্ছে বেশ।”

মনের ভিতরের আসল কথাটা এখনো কেহ পাড়িতে সাহস করিল না।

দুই জনে যখন খাইতে বসিয়া গেল তখন আনন্দময়ী তাহাদের কথাবার্তায় বুঝিতে পারিলেন এখনো তাহাদের উভয়ের মধ্যে বাধো-বাধো রহিয়াছে। পর্দা উঠিয়া যায় নাই। তিনি কহিলেন, “বিনয়, রাত অনেক হয়েছে, তুমি আজ এইখানেই শুয়ো। আমি তোমার বাসায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

বিনয় চকিতের মধ্যে গোরার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “ভুক্‌ত্‌বা রাজবদাচরেৎ। খেয়ে রাস্তায় হাঁটা নিয়ম নয়। তা হলে এইখানেই শোয়া যাবে।”

আহারান্তে দুই বন্ধু ছাতে আসিয়া মাদুর পাতিয়া বসিল। ভাদ্রমাস পড়িয়াছে; শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছে। হালকা পাতলা সাদা মেঘ ক্ষণিক ঘুমের ঘোরের মতো মাঝে মাঝে চাঁদকে একটুখানি ঝাপসা করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে উড়িয়া চলিতেছে। চারি দিকে দিগন্ত পর্যন্ত নানা আয়তনের উঁচু নিচু ছাদের শ্রেণী ছায়াতে আলোতে এবং মাঝে মাঝে গাছের মাথার সঙ্গে মিশিয়া যেন সম্পূর্ণ প্রয়োজনহীন একটা প্রকাণ্ড অবাস্তব খেয়ালের মতো পড়িয়া রহিয়াছে।

গির্জার ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা বাজিল; বরফওয়ালা তাহার শেষ হাঁক হাঁকিয়া চলিয়া গেল। গাড়ির শব্দ মন্দ হইয়া আসিয়াছে। গোরাদের গলিতে জাগরণের লক্ষণ নাই, কেবল প্রতিবেশীর আস্তাবলে কাঠের মেঝের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দ এক-এক বার শোনা যাইতেছে এবং কুকুর ঘেউ ঘেউ করিয়া উঠিতেছে।

দুই জনে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে বিনয় প্রথমটা একটু দ্বিধা করিয়া অবশেষে পরিপূর্ণবেগে তাহার মনের কথাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিল। বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি জানি এ-সব বিষয়ে তোমার মন নেই, কিন্তু তোমাকে না বললে আমি বাঁচব না। আমি ভালো মন্দ কিছুই বুঝতে পারছি নে– কিন্তু এটা নিশ্চয় এর সঙ্গে কোনো চাতুরী খাটবে না। বইয়েতে অনেক কথা পড়েছি এবং এতদিন মনে করে এসেছি সব জানি। ঠিক যেন ছবিতে জল দেখে মনে করতুম সাঁতার দেওয়া খুব সহজ– কিন্তু আজ জলের মধ্যে পড়ে এক মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, এ তো ফাঁকি নয়।”

এই বলিয়া বিনয় তাহার জীবনের এই আশ্চর্য আবির্ভাবকে একান্ত চেষ্টায় গোরার সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত করিতে লাগিল।

বিনয় বলিতে লাগিল, আজকাল তাহার কাছে সমস্ত দিন ও রাত্রির মধ্যে কোথাও যেন কিছু ফাঁক নাই– সমস্ত আকাশের মধ্যে কোথাও যেন কোনো রন্ধ্র নাই, সমস্ত একেবারে নিবিড়ভাবে ভরিয়া গেছে– বসন্তকালের মউচাক যেমন মধুতে ভরিয়া ফাটিয়া যাইতে চায়, তেমনিতরো। আগে এই বিশ্বচরাচরের অনেকখানি তাহার জীবনের বাহিরে পড়িয়া থাকিত। যেটুকুতে তাহার প্রয়োজন সেইটুকুতেই তাহার দৃষ্টি বদ্ধ ছিল। আজ সমস্তই তাহার সম্মুখে আসিতেছে, সমস্তই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে, সমস্তই একটা নূতন অর্থে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিত না পৃথিবীকে সে এত ভালোবাসে, আকাশ এমন আশ্চর্য, আলোক এমন অপূর্ব, রাস্তার অপরিচিত পথিকের প্রবাহও এমন গভীরভাবে সত্য। তাহার ইচ্ছা করে সকলের জন্য সে একটা-কিছু করে, তাহার সমস্ত শক্তিকে আকাশের সূর্যের মতো সে জগতের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।

বিনয় যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে এই-সমস্ত কথা বলিতেছে তাহা হঠাৎ মনে হয় না। সে যেন কাহারো নাম মুখে আনিতে পারে না– আভাস দিতে গেলেও কুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। এই-যে আলোচনা করিতেছে ইহার জন্য সে যেন কাহার প্রতি অপরাধ অনুভব করিতেছে। ইহা অন্যায়, ইহা অপমান– কিন্তু আজ এই নির্জন রাত্রে নিস্তব্ধ আকাশে বন্ধুর পাশে বসিয়া এ অন্যায়টুকু সে কোনোমতেই কাটাইতে পারিল না।

সে কী মুখ! প্রাণের আভা তাহার কপোলের কোমলতার মধ্যে কী সুকুমার ভাবে প্রকাশ পাইতেছে! হাসিতে তাহার অন্তঃকরণ কী আশ্চর্য আলোর মতো ফুটিয়া পড়ে! ললাটে কী বুদ্ধি! এবং ঘন পল্লবের ছায়াতলে দুই চক্ষুর মধ্যে কী নিবিড় অনির্বচনীয়তা! আর সেই দুটি হাত– সেবা এবং স্নেহকে সৌন্দর্যে সার্থক করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, সে যেন কথা কহিতেছে। বিনয় নিজের জীবনকে যৌবনকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে, এই আনন্দে তাহার বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যাহা না দেখিয়াই জীবন সাঙ্গ করে– বিনয় যে তাহাকে এমন করিয়া চোখের সামনে মূর্তিমান দেখিতে পাইবে ইহার চেয়ে আশ্চর্য কিছুই নাই।

কিন্তু এ কী পাগলামি! এ কী অন্যায়। হোক অন্যায়, আর তো ঠেকাইয়া রাখা যায় না। এই স্রোতেই যদি কোনো একটা কূলে তুলিয়া দেয় তো ভালো, আর যদি ভাসাইয়া দেয়, যদি তলাইয়া লয় তবে উপায় কী! মুশকিল এই যে, উদ্ধারের ইচ্ছাও হয় না– এতদিনকার সমস্ত সংস্কার, সমস্ত স্থিতি হারাইয়া চলিয়া যাওয়াই যেন জীবনের সার্থক পরিণাম।

গোরা চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল। এই ছাতে এমনি নির্জন নিষুপ্ত জ্যোৎস্নারাত্রে আরো অনেক দিন দুইজনে অনেক কথা হইয়া গেছে– কত সাহিত্য, কত লোকচরিত্র কত সমাজহিতের আলোচনা, ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা সম্বন্ধে দুইজনের কত সংকল্প। কিন্তু এমন কথা ইহার পূর্বে আর কোনোদিন হয় নাই। মানবহৃদয়ের এমন একটা সত্য পদার্থ, এমন একটা প্রবল প্রকাশ এমন করিয়া গোরার সামনে আসিয়া পড়ে নাই। এই-সমস্ত ব্যাপারকে সে এতদিন কবিত্বের আবর্জনা বলিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছে– আজ সে ইহাকে এত কাছে দেখিল যে ইহাকে আর অস্বীকার করিতে পারিল না। শুধু তাহাই নয়, ইহার বেগ তাহার মনকে ঠেলা দিল, ইহার পুলক তাহার সমস্ত শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের মতো খেলিয়া গেল। তাহার যৌবনের একটা অগোচর অংশের পর্দা মুহূর্তের জন্য হাওয়ায় উড়িয়া গেল এবং সেই এতদিনকার রুদ্ধ কক্ষে এই শরৎ-নিশীথের জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়া একটা মায়া বিস্তার করিয়া দিল।

চন্দ্র কখন এক সময় ছাদগুলার নীচে নামিয়া গেল। পূর্ব দিকে তখন নিদ্রিত মুখের হাসির মতো একটুখানি আলোকের আভাস দিয়াছে। এতক্ষণ পরে বিনয়ের মনটা হালকা হইয়া একটা সংকোচ উপস্থিত হইল। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “আমার এ-সমস্ত কথা তোমার কাছে খুব ছোটো। তুমি আমাকে হয়তো মনে মনে অবজ্ঞা করছ। কিন্তু কী করব বলো– কখনো তোমার কাছে কিছু লুকোই নি– আজও লুকোলুম না, তুমি বোঝ আর না বোঝ।”

গোরা বলিল, “বিনয়, এ-সব কথা আমি যে ঠিক বুঝি তা বলতে পারি নে। দু-দিন আগে তুমিও বুঝতে না। জীবনব্যাপারের মধ্যে এই-সমস্ত আবেগ এবং আবেশ আমার কাছে যে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত ছোটো ঠেকেছে সে কথাও অস্বীকার করতে পারি নে। তাই বলে এটা যে বাস্তবিকই ছোটো তা হয়তো নয়– এর শক্তি, এর গভীরতা আমি প্রত্যক্ষ করি নি বলেই এটা আমার কাছে বস্তুহীন মায়ার মতো ঠেকেছে– কিন্তু তোমার এত বড়ো উপলব্ধিকে আজ আমি মিথ্যা বলব কী করে? আসল কথা হচ্ছে এই, যে লোক যে ক্ষেত্রে আছে সে ক্ষেত্রের বাইরের সত্য যদি তার কাছে ছোটো হয়ে না থাকে তবে সে ব্যক্তি কাজ করতেই পারে না। এইজন্যই ঈশ্বর দূরের জিনিসকে মানুষের দৃষ্টির কাছে খাটো করে দিয়েছেন– সব সত্যকেই সমান প্রত্যক্ষ করিয়ে তাকে মহা বিপদে ফেলেন নি। আমাদের একটা দিক বেছে নিতেই হবে, সব একসঙ্গে আঁকড়ে ধরবার লোভ ছাড়তেই হবে, নইলে সত্যকেই পাব না। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে সত্যের যে মূর্তিকে প্রত্যক্ষ করছ, আমি সেখানে সে মূর্তিকে অভিবাদন করতে যেতে পারব না– তা হলে আমার জীবনের সত্যকে হারাতে হবে। হয় এ দিক, নয় ও দিক।”

বিনয় কহিল, “হয় বিনয়, নয় গোরা। আমি নিজেকে ভরে নিতে দাঁড়িয়েছি, তুমি নিজেকে ত্যাগ করতে দাঁড়িয়েছ।”

গোরা অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “বিনয়, তুমি মুখে মুখে বই রচনা কোরো না। তোমার কথা শুনে আমি একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, তোমার জীবনে তুমি আজ একটা প্রবল সত্যের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছ– তার সঙ্গে ফাঁকি চলে না। সত্যকে উপলব্ধি করলেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে– সে আর থাকবার জো নেই। আমি যে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছি সেই ক্ষেত্রের সত্যকেও অমনি করেই একদিন আমি উপলব্ধি করব এই আমার আকাঙক্ষা। তুমি এতদিন বই-পড়া প্রেমের পরিচয়েই পরিতৃপ্ত ছিলে– আমিও বই-পড়া স্বদেশপ্রেমকেই জানি– প্রেম আজ তোমার কাছে যখনই প্রত্যক্ষ হল তখনই বুঝতে পেরেছ বইয়ের জিনিসের চেয়ে এ কত সত্য– এ তোমার সমস্ত জগৎ-চরাচর অধিকার করে বসেছে, কোথাও তুমি এর কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছ না– স্বদেশপ্রেম যেদিন আমার সম্মুখে এমনি সর্বাঙ্গীণভাবে প্রত্যক্ষগোচর হবে সেদিন আমারও আর রক্ষা নেই। সেদিন সে আমার ধনপ্রাণ, আমার অস্থিমজ্জারক্ত, আমার আকাশ-আলোক, আমার সমস্তই অনায়াসে আকর্ষণ করে নিতে পারবে। স্বদেশের সেই সত্যমূর্তি যে কী আশ্চর্য অপরূপ, কী সুনিশ্চিত সুগোচর, তার আনন্দ তার বেদনা যে কী প্রচণ্ড প্রবল, যা বন্যার স্রোতের মতো জীবন-মৃত্যুকে এক মুহূর্তে লঙ্ঘন করে যায়, তা আজ তোমার কথা শুনে মনে মনে অল্প অল্প অনুভব করতে পারছি। তোমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে আজ আঘাত করেছে– তুমি যা পেয়েছ তা আমি কোনোদিন বুঝতে পারব কি না জানি না– কিন্তু আমি যা পেতে চাই তার আস্বাদ যেন তোমার ভিতর দিয়েই আমি অনুভব করছি।”

বলিতে বলিতে গোরা মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। পূর্ব দিকের উষার আভাস তাহার কাছে যেন একটা বাক্যের মতো, বার্তার মতো প্রকাশ পাইল যেন প্রাচীন তপোবনের একটা বেদমন্ত্রের মতো উচ্চারিত হইয়া উঠিল; তাহার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিল– মুহূর্তের জন্য সে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল, এবং ক্ষণকালের জন্য তাহার মনে হইল তাহার ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া একটি জ্যোতির্লেখা সূক্ষ্ণ মৃণালের ন্যায় উঠিয়া একটি জ্যোতির্ময় শতদলে সমস্ত আকাশে পরিব্যাপ্ত হইয়া বিকশিত হইল– তাহার সমস্ত প্রাণ, সমস্ত চেতনা, সমস্ত শক্তি যেন ইহাতে একেবারে পরম আনন্দে নিঃশেষিত হইয়া গেল।

গোরা যখন আপনাতে আপনি ফিরিয়া আসিল তখন সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বিনয়, তোমার এ প্রেমকেও পার হয়ে আসতে হবে– আমি বলছি, ওখানে থামলে চলবে না। আমাকে যে মহাশক্তি আহ্বান করছেন তিনি যে কত বড়ো সত্য একদিন তোমাকে আমি তা দেখাব। আমার মনের মধ্যে আজ ভারি আনন্দ হচ্ছে–তোমাকে আজ আমি আর কারো হাতে ছেড়ে দিতে পারব না।”

বিনয় মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া গোরার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। গোরা তাহাকে একটা অপূর্ব উৎসাহে দুই হাত দিয়া বুকে চাপিয়া ধরিল– কহিল, “ভাই বিনয়, আমরা মরব, এক মরণে মরব। আমরা দুজনে এক, আমাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করবে না, কেউ বাধা দিতে পারবে না।”

গোরার এই গভীর উৎসাহের বেগ বিনয়েরও হৃদয়ের মধ্যে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল; সে কোনো কথা না বলিয়া গোরার এই আকর্ষণে আপনাকে ছাড়িয়া দিল।

গোরা বিনয় দুইজনে নীরবে পাশাপাশি বেড়াইতে লাগিল। পূর্বাকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। গোরা কহিল, “ভাই, আমার দেবীকে আমি যেখানে দেখতে পাচ্ছি সে তো সৌন্দর্যের মাঝখানে নয়– সেখানে দুর্ভিক্ষ দারিদ্র৻, সেখানে কষ্ট আর অপমান। সেখানে গান গেয়ে, ফুল দিয়ে পুজো নয়; সেখানে প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে পুজো করতে হবে– আমার কাছে সেইটেই সব চেয়ে বড়ো আনন্দ মনে হচ্ছে– সেখানে সুখ দিয়ে ভোলাবার কিছু নেই– সেখানে নিজের জোরে সম্পূর্ণ জাগতে হবে, সম্পূর্ণ দিতে হবে– মাধুর্য নয়, এ একটা দুর্জয় দুঃসহ আবির্ভাব– এ নিষ্ঠুর, এ ভয়ংকর– এর মধ্যে সেই কঠিন ঝংকার আছে যাতে করে সপ্তসুর একসঙ্গে বেজে উঠে তার ছিঁড়ে পড়ে যায়। মনে করলে আমার বুকের মধ্যে উল্লাস জেগে ওঠে– আমার মনে হয়, এই আনন্দই পুরুষের আনন্দ– এই হচ্ছে জীবনের তাণ্ডবনৃত্য– পুরাতনের প্রলয়যজ্ঞের আগুনের শিখার উপরে নূতনের অপরূপ মূর্তি দেখবার জন্যই পুরুষের সাধনা। রক্তবর্ণ আকাশক্ষেত্রে একটা বন্ধনমুক্ত জ্যোতির্ময় ভবিষ্যৎকে দেখতে পাচ্ছি– আজকেকার এই আসন্ন প্রভাতের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি– দেখো আমার বুকের ভিতরে কে ডমরু বাজাচ্ছে।”

বলিয়া বিনয়ের হাত লইয়া গোরা নিজের বুকের উপরে চাপিয়া ধরিল।

বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমি তোমার সঙ্গেই যাব। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি আমাকে কোনোদিন তুমি দ্বিধা করতে দিয়ো না। একেবারে ভাগ্যের মতো নির্দয় হয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেয়ো। আমাদের দুইজনের এক পথ– কিন্তু আমাদের শক্তি তো সমান নয়।”

গোরা কহিল, “আমাদের প্রকৃতির মধ্যে ভেদ আছে, কিন্তু একটা মহৎ আনন্দে আমাদের ভিন্ন প্রকৃতিকে এক করে দেবে। তোমাতে আমাতে যে ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বড়ো প্রেমে আমাদের এক করে দেবে। সেই প্রেম যতক্ষণে সত্য না হবে ততক্ষণে আমাদের দুজনের মধ্যে পদে পদে অনেক আঘাত-সংঘাত বিরোধ-বিচ্ছেদ ঘটতে থাকবে– তার পরে একদিন আমরা সমস্ত ভুলে গিয়ে, আমাদের পার্থক্যকে আমাদের বন্ধুত্বকেও ভুলে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড একটা প্রচণ্ড আত্মপরিহারের মধ্যে অটল বলে মিলে গিয়ে দাঁড়াতে পারব– সেই কঠিন আনন্দই আমাদের বন্ধুত্বের শেষ পরিণাম হবে।”

বিনয় গোরার হাত ধরিয়া কহিল, “তাই হোক।”

গোরা কহিল, “ততদিন কিন্তু আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দেব। আমার সব অত্যাচার তোমাকে সইতে হবে– কেননা আমাদের বন্ধুত্বকেই জীবনের শেষ লক্ষ্য করে দেখতে পারব না– যেমন করে হোক তাকেই বাঁচিয়ে চলবার চেষ্টা করে তার অসম্মান করব না। এতে যদি বন্ধুত্ব ভেঙে পড়ে তা হলে উপায় নেই, কিন্তু যদি বেঁচে থাকে তা হলে বন্ধুত্ব সার্থক হবে।”

এমন সময়ে দুইজনে পদশব্দে চমকিয়া উঠিয়া পিছনে চাহিয়া দেখিল, আনন্দময়ী ছাতে আসিয়াছেন। তিনি দুইজনের হাত ধরিয়া ঘরের দিকে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “চলো, শোবে চলো।”

দুইজনেই বলিল, “আর ঘুম হবে না মা।”

“হবে” বলিয়া আনন্দময়ী দুই বন্ধুকে জোর করিয়া বিছানায় পাশাপাশি শোয়াইয়া দিলেন এবং ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দুজনের শিয়রের কাছে পাখা করিতে বসিলেন।

বিনয় কহিল, “মা, তুমি পাখা করতে বসলে কিন্তু আমাদের ঘুম হবে না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কেমন না হয় দেখব। আমি চলে গেলেই তোমরা আবার কথা আরম্ভ করে দেবে, সেটি হচ্ছে না।”

দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িলে আনন্দময়ী আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় দেখিলেন, মহিম উপরে উঠিয়া আসিতেছেন। আনন্দময়ী কহিলেন, “এখন না– কাল সমস্ত রাত ওরা ঘুমোয় নি। আমি এইমাত্র ওদের ঘুম পাড়িয়ে আসছি।”

মহিম কহিলেন, “বাস্‌্‌ রে, একেই বলে বন্ধুত্ব। বিয়ের কথাটা উঠেছিল কি জান?”

আনন্দময়ী। জানি নে।

মহিম। বোধ হয় একটা কিছু ঠিক হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙবে কখন? শীঘ্র বিয়েটা না হলে বিঘ্ন অনেক আছে।

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “ওরা ঘুমিয়ে পড়ার দরুণ বিঘ্ন হবে না– আজ দিনের মধ্যেই ঘুম ভাঙবে।”

গোরা ১৬

১৬

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তুমি সুচরিতার বিয়ে দেবে না নাকি?”

পরেশবাবু তাঁহার স্বাভাবিক শান্ত গম্ভীর ভাবে কিছুক্ষণ পাকা দাড়িতে হাত বুলাইলেন– তার পর মৃদুস্বরে কহিলেন, “পাত্র কোথায়?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কেন, পানুবাবুর সঙ্গে ওর বিবাহের কথা তো ঠিক হয়েই আছে– অন্তত আমরা তো মনে মনে তাই জানি– সুচরিতাও জানে।”

পরেশ কহিলেন, “পানুবাবুকে রাধারানীর ঠিক পছন্দ হয় বলে আমার মনে হচ্ছে না।”

বরদাসুন্দরী। দেখো, ঐগুলো আমার ভালো লাগে না। সুচরিতাকে আমার আপন মেয়েদের থেকে কোনো তফাত করে দেখি নে, কিন্তু তাই বলে এ কথাও তো বলতে হয় উনিই বা কী এমন অসামান্য! পানুবাবুর মতো বিদ্বান ধার্মিক লোক যদি ওকে পছন্দ করে থাকে, সেটা কি উড়িয়ে দেবার জিনিস? তুমি যাই বল, আমার লাবণ্যকে তো দেখতে ওর চেয়ে অনেক ভালো, কিন্তু আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি আমরা যাকে পছন্দ করে দেব ও তাকেই বিয়ে করবে, কখনো “না” বলবে না। তোমরা যদি সুচরিতার দেমাক বাড়িয়ে তোল তা হলে ওর পাত্র মেলাই ভার হবে।

পরেশ ইহার পরে আর কোনো কথাই বলিলেন না। বরদাসুন্দরীর সঙ্গে তিনি কোনোদিন তর্ক করিতেন না। বিশেষত সুচরিতার সম্বন্ধে।

সতীশকে জন্ম দিয়া যখন সুচরিতার মার মৃত্যু হয় তখন সুচরিতার বয়স সাত। তাহার পিতা রামশরণ হালদার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন এবং পাড়ার লোকের অত্যাচারে গ্রাম ছাড়িয়া ঢাকায় আসিয়া আশ্রয় লন। সেখানে পোস্ট-আপিসের কাজে যখন নিযুক্ত ছিলেন তখন পরেশের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। সুচরিতা তখন হইতে পরেশকে ঠিক নিজের পিতার মতোই জানিত।

রামশরণের মৃত্যু হঠাৎ ঘটিয়াছিল। তাঁহার টাকাকড়ি যাহা-কিছু ছিল তাহা তাঁহার ছেলে ও মেয়ের নামে দুই ভাগে দান করিয়া তিনি উইলপত্রে পরেশবাবুকে ব্যবস্থা করিবার ভার দিয়াছিলেন। তখন হইতে সতীশ ও সুচরিতা পরেশের পরিবারভুক্ত হইয়া গিয়াছিল।

ঘরের বা বাহিরের লোকে সুচরিতার প্রতি বিশেষ স্নেহ বা মনোযোগ করিলে বরদাসুন্দরীর মনে ভালো লাগিত না। অথচ যে কারণেই হউক সুচরিতা সকলের কাছ হইতেই স্নেহ ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিত। বরদাসুন্দরীর মেয়েরা তাহার ভালোবাসা লইয়া পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করিত। বিশেষত মেজো মেয়ে ললিতা তাহার ঈর্ষাপরায়ণ প্রণয়ের দ্বারা সুচরিতাকে দিনরাত্রি যেন আঁকড়িয়া থাকিতে চাহিত।

পড়াশুনার খ্যাতিতে তাঁহার মেয়েরা তখনকার কালের সকল বিদুষীকেই ছাড়াইয়া যাইবে বরদাসুন্দরীর মনে এই আকাঙক্ষা ছিল। সুচরিতা তাঁহার মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে মানুষ হইয়া এ সম্বন্ধে তাহাদের সমান ফল লাভ করিবে ইহা তাঁহার পক্ষে সুখকর ছিল না। সেইজন্য ইস্কুলে যাইবার সময় সুচরিতার নানাপ্রকার বিঘ্ন ঘটিতে থাকিত।

সেই-সকল বিঘ্নের কারণ অনুমান করিয়া পরেশ সুচরিতার ইস্কুল বন্ধ করিয়া দিয়া তাহাকে নিজেই পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। শুধু তাই নয়, সুচরিতা বিশেষভাবে তাঁহারই যেন সঙ্গিনীর মতো হইয়া উঠিল। তিনি তাহার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করিতেন, যেখানে যাইতেন তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন, যখন দূরে থাকিতে বাধ্য হইতেন তখন চিঠিতে বহুতর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া বিস্তারিত আলোচনা করিতেন। এমনি করিয়া সুচরিতার মন তাহার বয়স ও অবস্থাকে ছাড়াইয়া অনেকটা পরিণত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার মুখশ্রীতে ও আচরণে যে-একটি গম্ভীর্যের বিকাশ হইয়াছিল তাহাতে কেহ তাহাকে বালিকা বলিয়া গণ্য করিতে পারিত না; এবং লাবণ্য যদিচ বয়সে প্রায় তাহার সমান ছিল তবু সকল বিষয়ে সুচরিতাকে সে আপনার চেয়ে বড়ো বলিয়াই মনে করিত, এমন-কি, বরদাসুন্দরীও তাহাকে ইচ্ছা করিলেও কোনোমতেই তুচ্ছ করিতে পারিতেন না।

পাঠকেরা পূর্বেই পরিচয় পাইয়াছেন হারানবাবু অত্যন্ত উৎসাহী ব্রাহ্ম; ব্রাহ্ম-সমাজের সকল কাজেই তাঁহার হাত ছিল– তিনি নৈশ-স্কুলের শিক্ষক, কাগজের সম্পাদক, স্ত্রীবিদ্যালয়ের সেক্রেটারি– কিছুতেই তাঁহার শ্রান্তি ছিল না। এই যুবকটিই যে একদিন ব্রাহ্মসমাজে অত্যুচ্চ স্থান অধিকার করিবে সকলেরই মনে এই আশা ছিল। বিশেষত ইংরেজি ভাষায় তাঁহার অধিকার ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁহার পারদর্শিতা সম্বন্ধে খ্যাতি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের যোগে ব্রাহ্মসমাজের বাহিরেও বিস্তৃত হইয়াছিল।

এই-সকল নানা কারণে অন্যান্য সকল ব্রাহ্মের ন্যায় সুচরিতাও হারানবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিত। ঢাকা হইতে কলিকাতা আসিবার সময় হারানবাবুর সহিত পরিচয়ের জন্য তাহার মনের মধ্যে বিশেষ ঔৎসুক্যও জন্মিয়াছিল।

অবশেষে বিখ্যাত হারানবাবুর সঙ্গে শুধু যে পরিচয় হইল তাহা নহে, অল্প দিনের মধ্যেই সুচরিতার প্রতি তাঁহার হৃদয়ের আকৃষ্ট ভাব প্রকাশ করিতে হারানবাবু সংকোচ বোধ করিলেন না। স্পষ্ট করিয়া তিনি যে সুচরিতার নিকট তাঁহার প্রণয় জ্ঞাপন করিয়াছিলেন তাহা নহে– কিন্তু সুচরিতার সর্বপ্রকার অসম্পূর্ণতা পূরণ, তাহার ত্রুটি সংশোধন, তাহার উৎসাহ বর্ধন, তাহার উন্নতি সাধনের জন্য তিনি এমনি মনোযোগী হইয়া উঠিলেন যে এই কন্যাকে যে তিনি বিশেষভাবে আপনার উপযুক্ত সঙ্গিনী করিয়া তুলিতে ইচ্ছা করিয়াছেন তাহা সকলের কাছেই সুগোচর হইয়া উঠিল।

এই ঘটনায় হারানবাবুর প্রতি বরদাসুন্দরীর পূর্বতন শ্রদ্ধা নষ্ট হইয়া গেল এবং ইহাকে তিনি সামান্য ইস্কুলমাস্টার মাত্র বলিয়া অবজ্ঞা করিতে চেষ্টা করিলেন।

সুচরিতাও যখন বুঝিতে পারিল যে, সে বিখ্যাত হারানবাবুর চিত্ত জয় করিয়াছে তখন মনের মধ্যে ভক্তিমিশ্রিত গর্ব অনুভব করিল।

প্রধান পক্ষের নিকট হইতে কোনো প্রস্তাব উপস্থিত না হইলেও হারানবাবুর সঙ্গেই সুচরিতার বিবাহ নিশ্চয় বলিয়া সকলে যখন স্থির করিয়াছিল তখন সুচরিতাও মনে মনে তাহাতে সায় দিয়াছিল এবং হারানবাবু ব্রাহ্মসমাজের যে-সকল হিতসাধনের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন কিরূপ শিক্ষা ও সাধনার দ্বারা সেও তাহার উপযুক্ত হইবে এই তাহার এক বিশেষ উৎকণ্ঠার বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল। সে যে কোনো মানুষকে বিবাহ করিতে যাইতেছে তাহা হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারে নাই সে যেন ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের সুমহৎ মঙ্গলকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত হইয়াছে, সেই মঙ্গল প্রচুর-গ্রন্থপাঠ দ্বারা অত্যুচ্চ বিদ্বান এবং তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা নিরতিশয় গম্ভীর। এই বিবাহের কল্পনা তাহার কাছে ভয় সম্ভ্রম ও দুঃসাধ্য দায়িত্ববোধের দ্বারা রচিত একটা পাথরের কেল্লার মতো বোধ হইতে লাগিল– তাহা যে কেবল সুখে বাস করিবার তাহা নহে, তাহা লড়াই করিবার– তাহা পারিবারিক নহে, তাহা ঐতিহাসিক।

এই অবস্থাতেই যদি বিবাহ হইয়া যাইত তবে অন্তত কন্যাপক্ষের সকলেই এই বিবাহকে বিশেষ একটা সৌভাগ্য বলিয়াই জ্ঞান করিত। কিন্তু হারানবাবু নিজের উৎকৃষ্ট মহৎ জীবনের দায়িত্বকে এতই বড়ো করিয়া দেখিতেন যে কেবলমাত্র ভালো লাগার দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া বিবাহ করাকে তিনি নিজের অযোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিলেন। এই বিবাহ-দ্বারা ব্রাহ্মসমাজ কী পরিমাণে লাভবান হইবে তাহা সম্পূর্ণ বিচার না করিয়া তিনি এ কাজে প্রবৃত্ত হইতে পারিলেন না। এই কারণে তিনি সেই দিক হইতে সুচরিতাকে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন।

এরূপ ভাবে পরীক্ষা করিতে গেলে পরীক্ষা দিতেও হয়। হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে সুপরিচিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহাকে তাঁহার বাড়ির লোকে যে পানুবাবু বলিয়া ডাকিত, এ পরিবারেও তাঁহার সেই পানুবাবু নাম প্রচার হইল। এখন তাঁহাকে কেবলমাত্র ইংরেজি বিদ্যার ভাণ্ডার, তত্ত্বজ্ঞানের আধার ও ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের অবতাররূপে দেখা সম্ভবপর হইল না– তিনি যে মানুষ, এই পরিচয়টাই সকলের চেয়ে নিকট হইয়া উঠিল। তখন তিনি কেবলমাত্র শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের অধিকারী না হইয়া ভালোলাগা মন্দলাগার আয়ত্তাধীন হইয়া আসিলেন।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হারানবাবুকে যে ভাবটা পূর্বে দূর হইতে সুচরিতার ভক্তি আকর্ষণ করিয়াছিল সেই ভাবটাই নিকটে আসিয়া তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যাহা-কিছু সত্য মঙ্গল ও সুন্দর আছে হারানবাবু তাহার অভিভাবকস্বরূপ হইয়া তাহার রক্ষকতার ভার লওয়াতে তাঁহাকে অত্যন্ত অসংগতরূপে ছোটো দেখিতে হইল। সত্যের সঙ্গে মানুষের যথার্থ সম্বন্ধ ভক্তির সম্বন্ধ– তাহাতে মানুষকে স্বভাবতই বিনয়ী করিয়া তোলে। তাহা না করিয়া যেখানে মানুষকে উদ্ধত ও অহংকৃত করে সেখানে মানুষ আপনার ক্ষুদ্রতাকে সেই সত্যের তুলনাতেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করে। এইখানেই পরেশবাবুর সঙ্গে হারানের প্রভেদ সুচরিতা মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরেশবাবু ব্রাহ্মসমাজের নিকট হইতে যাহা লাভ করিয়াছেন তাহার সম্মুখে তাঁহার মাথা যেন সর্বদা নত হইয়া আছে– সে সম্বন্ধে তাঁহার লেশমাত্র প্রগল্‌ভতা নাই– তাহার গভীরতার মধ্যে তিনি নিজের জীবনকে তলাইয়া দিয়াছেন। পরেশবাবুর শান্ত মুখচ্ছবি দেখিলে তিনি যে সত্যকে হৃদয়ে বহন করিয়াছেন তাহারই মহত্ত্ব চোখে পড়ে। কিন্তু হারানবাবুর সেরূপ নহে– তাঁহার ব্রাহ্মত্ব বলিয়া একটা উগ্র আত্মপ্রকাশ অন্য সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার সমস্ত কথায় ও কাজে অশোভনরূপে বাহির হইয়া থাকে। ইহাতে সম্প্রদায়ের কাছে তাঁহার আদর বাড়িয়াছিল; কিন্তু সুচরিতা পরেশের শিক্ষাগুণে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হইতে পারে নাই বলিয়া হারানবাবুর একান্ত ব্রাহ্মিকতা সুচরিতার স্বাভাবিক মানবত্বকে যেন পীড়া দিত। হারানবাবু মনে করিতেন, ধর্মসাধনার ফলে তাঁহার দৃষ্টিশক্তি এমন আশ্চর্য স্বচ্ছ হইয়াছে যে, অন্য সকল লোকেরই ভালোমন্দ ও সত্যাসত্য তিনি অতি অনায়াসেই বুঝিতে পারেন। এইজন্য সকলকেই তিনি সর্বদাই বিচার করিতে উদ্যত। বিষয়ী লোকেরাও পরনিন্দা পরচর্চা করিয়া থাকে, কিন্তু যাহারা ধার্মিকতার ভাষায় এই কাজ করে তাহাদের সেই নিন্দার সঙ্গে আধ্যাত্মিক অহংকার মিশ্রিত হইয়া সংসারে একটা অত্যন্ত সুতীব্র উপদ্রবের সৃষ্টি করে। সুচরিতা তাহা একেবারেই সহিতে পারিত না। ব্রাহ্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে সুচরিতার মনে যে কোনো গর্ব ছিল না তাহা নহে, তথাপি ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যাঁহারা বড়োলোক তাঁহারা যে ব্রাহ্ম হওয়ারই দরুন বিশেষ একটা শক্তি লাভ করিয়া বড়ো হইয়াছেন এবং ব্রাহ্মসমাজের বাহিরে যাহারা চরিত্রভ্রষ্ট তাহারা যে ব্রাহ্ম না হওয়ারই কারণে বিশেষভাবে শক্তিহীন হইয়া নষ্ট হইয়াছে এ কথা লইয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার অনেক বার তর্ক হইয়া গিয়াছে।

হারানবাবু ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ করিয়া যখন বিচারে পরেশবাবুকেও অপরাধী করিতে ছাড়িলেন না তখনই সুচরিতা যেন আহত ফণিনীর মতো অসহিষ্ণু হইয়া উঠিত। সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরেজিশিক্ষিত দলের মধ্যে ভগবদ্‌গীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীতা পড়িতেন– কালীসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। হারানবাবুর কাছে তাহা ভালো লাগে নাই। এ-সমস্ত গ্রন্থ তিনি ব্রাহ্মপরিবার হইতে নির্বাসিত করিবার পক্ষপাতী। তিনি নিজেও এগুলি পড়েন নাই। রামায়ণ-মহাভারত-ভগবদ্‌গীতাকে তিনি হিন্দুদের সামগ্রী বলিয়া স্বতন্ত্র রাখিতে চাহিতেন। ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বাইব্‌ল্‌ই তাঁহার একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরেশবাবু যে তাঁহার শাস্ত্রচর্চা এবং ছোটোখাটো নানা বিষয়ে ব্রাহ্ম-অব্রাহ্মের সীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন না, তাহাতে হারানের গায়ে যেন কাঁটা বিঁধিত। পরেশের আচরণে প্রকাশ্যে বা মনে মনে কেহ কোনোপ্রকার দোষারোপ করিবে এমন স্পর্ধা সুচরিতা কখনোই সহিতে পারে না। এবং এইরূপ স্পর্ধা প্রকাশ হইয়া পড়াতেই হারানবাবু সুচরিতার কাছে খাটো হইয়া গেছেন।

এইরূপে নানা কারণে হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে দিনে দিনে নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছেন। বরদাসুন্দরীও যদিচ ব্রাহ্ম-অব্রাহ্মের ভেদরক্ষায় হারানবাবুর অপেক্ষা কোনো অংশে কম উৎসাহী নহেন এবং তিনিও তাঁহার স্বামীর আচরণে অনেক সময় লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন, তথাপি হারানবাবুকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। হারানবাবুর সহস্র দোষ তাঁহার চোখে পড়িত।

হারানবাবুর সাম্প্রদায়িক উৎসাহের অত্যাচারে এবং সংকীর্ণ নীরসতায় যদিও সুচরিতার মন ভিতরে ভিতরে প্রতিদিন তাঁহার উপর হইতে বিমুখ হইতেছিল, তথাপি হারানবাবুর সঙ্গেই যে তাহার বিবাহ হইবে এ সম্বন্ধে কোনো পক্ষের মনে কোনো তর্ক বা সন্দেহ ছিল না। ধর্মসামাজিক দোকানে যে ব্যক্তি নিজের উপরে খুব বড়ো অক্ষরে উচ্চ মূল্যের টিকিট মারিয়া রাখে অন্য লোকেও ক্রমে ক্রমে তাহার দুর্মূল্যতা স্বীকার করিয়া লয়। এইজন্য হারানবাবু তাঁহার মহৎসংকল্পের অনুবর্তী হইয়া যথোচিত পরীক্ষা-দ্বারা সুচরিতাকে পছন্দ করিয়া লইলেই যে সকলেই তাহা মাথা পাতিয়া লইবে, এ সম্বন্ধে হারানবাবুর এবং অন্য কাহারো মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। এমন-কি, পরেশবাবুও হারানবাবুর দাবি মনে মনে অগ্রাহ্য করেন নাই। সকলেই হারানবাবুকে ব্রাহ্মসমাজের ভাবী অবলম্বনস্বরূপ জ্ঞান করিত, তিনিও বিরুদ্ধ বিচার না করিয়া তাহাতে সায় দিতেন। এজন্য হারানবাবুর মতো লোকের পক্ষে সুচরিতা যথেষ্ট হইবে কি না ইহাই তাঁহার চিন্তার বিষয় ছিল; সুচরিতার পক্ষে হারানবাবু কী পর্যন্ত উপাদেয় হইবে তাহা তাঁহার মনেও হয় নাই।

এই বিবাহপ্রস্তাবে কেহই যেমন সুচরিতার কথাটা ভাবা আবশ্যক বোধ করে নাই, সুচরিতাও তেমনি নিজের কথা ভাবে নাই। ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেরই মতো সেও ধরিয়া লইয়াছিল যে হারানবাবু যেদিন বলিবেন “আমি এই কন্যাকে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি’ সেই দিনই সে এই বিবাহরূপ তাহার মহৎকর্তব্য স্বীকার করিয়া লইবে।

এই ভাবেই চলিয়া আসিতেছিল। এমন সময় সেদিন গোরাকে উপলক্ষ করিয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার যে দুই চারিটি উষ্ণবাক্যের আদানপ্রদান হইয়া গেল তাহার সুর শুনিয়াই পরেশের মনে সংশয় উপস্থিত হইল যে, সুচরিতা হারানবাবুকে হয়তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে না– হয়তো উভয়ের স্বভাবের মধ্যে মিল না হইবার কারণ আছে। এইজন্যই বরদাসুন্দরী যখন বিবাহের জন্য তাগিদ দিতেছিলেন তখন পরেশ তাহাতে পূর্বের মতো সায় দিতে পারিলেন না। সেই দিনই বরদাসুন্দরী সুচরিতাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “তুমি যে তোমার বাবাকে ভাবিয়ে তুলেছ।”

শুনিয়া সুচরিতা চমকিয়া উঠিল– সে যে ভুলিয়াও পরেশবাবুর উদ্‌বেগের কারণ হইয়া উঠিবে ইহা অপেক্ষা কষ্টের বিষয় তাহার পক্ষে কিছুই হইতে পারে না। সে মুখ বিবর্ণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, আমি কী করেছি?”

বরদাসুন্দরী। কী জানি বাছা! তাঁর মনে হয়েছে যে, তুমি পানুবাবুকে পছন্দ কর না। ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেই জানে পানুবাবুর সঙ্গে তোমার বিবাহ একরকম স্থির– এ অবস্থায় যদি তুমি–

সুচরিতা। কই, মা, আমি তো এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কাউকে বলি নি!

সুচরিতার আশ্চর্য হইবার কারণ ছিল। সে হারানবাবুর ব্যবহারে বারবার বিরক্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু বিবাহপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে সে কোনোদিন মনেও কোনো চিন্তা করে নাই। এই বিবাহে সে সুখী হইবে কি না-হইবে সে তর্কও তাহার মনে কোনোদিন উদিত হয় নাই, কারণ, এ বিবাহ যে সুখদুঃখের দিক দিয়া বিচার্য নহে ইহাই সে জানিত।

তখন তাহার মনে পড়িল সেদিন পরেশবাবুর সামনেই পানুবাবুর প্রতি সে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছিল। ইহাতেই তিনি উদ্‌বিগ্ন হইয়াছেন মনে করিয়া তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগিল। এমন অসংযম তো সে পূর্বে কোনোদিন প্রকাশ করে নাই, পরেও কখনো করিবে না বলিয়া মনে মনে সংকল্প করিল।

এ দিকে হারানবাবুও সেই দিনই অনতিকাল পরেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার মনও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। এতদিন তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে সুচরিতা তাঁহাকে মনে মনে পূজা করে; এই পূজার অর্ঘ্য তাঁহার ভাগে আরো সম্পূর্ণতর হইত যদি বৃদ্ধ পরেশবাবুর প্রতি সুচরিতার অন্ধসংস্কারবশত একটি অসংগত ভক্তি না থাকিত। পরেশবাবু জীবনে নানা অসম্পূর্ণতা দেখাইয়া দিলেও তাঁহাকে সুচরিতা যেন দেবতা বলিয়াই জ্ঞান করিত। ইহাতে হারানবাবু মনে মনে হাস্যও করিয়াছেন, ক্ষুণ্নও হইয়াছেন, তথাপি তাঁহার আশা ছিল কালক্রমে উপযুক্ত অবসরে এই অযথা ভক্তিকে যথাপথে একাগ্রধারায় প্রবাহিত করিতে পারিবেন।

যাহা হউক, হারানবাবু যতদিন নিজেকে সুচরিতার ভক্তির পাত্র বলিয়া জ্ঞান করিতেন ততদিন তাহার ছোটোখাটো কাজ ও আচরণ লইয়া কেবল সমালোচনা করিয়াছেন এবং তাহাকে সর্বদা উপদেশ দিয়া গড়িয়া তুলিতেই প্রবৃত্ত ছিলেন– বিবাহ সম্বন্ধে কোনো কথা স্পষ্ট করিয়া উত্থাপন করেন নাই। সেদিন সুচরিতার দুই-একটি কথা শুনিয়া যখন হঠাৎ তিনি বুঝিতে পারিলেন সেও তাঁহাকে বিচার করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতে অবিচলিত গাম্ভীর্য ও স্থৈর্য রক্ষা করা তাঁহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। ইতিমধ্যে যে দুই-একবার সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছে পূর্বের ন্যায় নিজের গৌরব তিনি অনুভব ও প্রকাশ করিতে পারেন নাই। সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার কথায় ও আচরণে একটা কলহের ভাব দেখা দিয়াছে। তাহাকে লইয়া অকারণে বা ছোটো ছোটো উপলক্ষ ধরিয়া খুঁতখুঁত করিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও সুচরিতার অবিচলিত ঔদাসীন্যে তাঁহাকে মনে মনে হার মানিতে হইয়াছে এবং নিজের মর্যাদাহানিতে বাড়িতে আসিয়া পরিতাপ করিয়াছেন।

যাহা হউক, সুচরিতার শ্রদ্ধাহীনতার দুই-একটা লক্ষণ দেখিয়া হারানবাবুর পক্ষে তাঁহার পরীক্ষকের উচ্চ আসনে দীর্ঘকাল স্থির হইয়া বসিয়া থাকা শক্ত হইয়া উঠিল। পূর্বে এত ঘন ঘন পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করিতেন না– সুচরিতার প্রেমে তিনি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন, পাছে তাঁহাকে এইরূপ কেহ সন্দেহ করে এই আশঙ্কায় তিনি সপ্তাহে কেবল একবার করিয়া আসিতেন এবং সুচরিতা যেন তাঁহার ছাত্রী এমনিভাবে নিজের ওজন রাখিয়া চলিতেন। কিন্তু এই কয়দিন হঠাৎ কী হইয়াছে– হারানবাবু তুচ্ছ একটা ছুতা লইয়া দিনে একাধিক বারও আসিয়াছেন এবং ততোধিক তুচ্ছ ছুতা ধরিয়া সুচরিতার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আলাপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। পরেশবাবুও এই উপলক্ষে উভয়কে ভালো করিয়া পর্যবেক্ষণ করিবার অবকাশ পাইয়াছেন এবং তাঁহার সন্দেহও ক্রমে ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে।

আজ হারানবাবু আসিতেই বরদাসুন্দরী তাঁহাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “আচ্ছা, পানুবাবু, আপনি আমাদের সুচরিতাকে বিবাহ করবেন এই কথা সকলেই বলে, কিন্তু আপনার মুখ থেকে তো কোনোদিন কোনো কথা শুনতে পাই নে। যদি সত্যিই আপনার এরকম অভিপ্রায় থাকে তা হলে স্পষ্ট করে বলেন না কেন?”

হারানবাবু আর বিলম্ব করিতে পারিলেন না। এখন সুচরিতাকে তিনি কোনোমতে বন্দী করিতে পারিলেই নিশ্চিন্ত হন– তাঁহার প্রতি ভক্তি ও ব্রাহ্মসমাজের হিতকল্পে যোগ্যতার পরীক্ষা পরে করিলেও চলিবে। হারানবাবু বরদাসুন্দরীকে কহিলেন, “এ কথা বলা বাহুল্য বলেই বলি নি। সুচরিতার আঠারো বছর বয়সের জন্যই প্রতীক্ষা করছিলেম।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনার আবার একটু বাড়াবাড়ি আছে। আমরা তো চোদ্দ বছর হলেই যথেষ্ট মনে করি!”

সেদিন চা খাইবার সময় পরেশবাবু সুচরিতার ভাব দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। সুচরিতা হারানবাবুকে এত যত্ন-অভ্যর্থনা অনেক দিন করে নাই। এমন-কি, হারানবাবু যখন চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিলেন তখন তাঁহাকে লাবণ্যের নূতন একটা শিল্পকলার পরিচয় দিবার উপলক্ষে আরো একটু বসিয়া থাকিতে অনুরোধ করিয়াছিল।

পরেশবাবুর মন নিশ্চিন্ত হইল। তিনি ভাবিলেন, তিনি ভুল করিয়াছেন। এমন-কি,তিনি মনে মনে একটু হাসিলেন। ভাবিলেন, এই দুইজনের মধ্যে হয়তো নিগূঢ় একটা প্রণয়কলহ ঘটিয়াছিল, আবার সেটা মিটমাট হইয়া গেছে।

সেই দিন বিদায় হইবার সময় হারান পরেশবাবুর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাড়িলেন। জানাইলেন, এ সম্বন্ধে বিলম্ব করিতে তাঁহার ইচ্ছা নাই।

পরেশবাবু একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কিন্তু আপনি যে আঠারো বছরের কমে মেয়েদের বিয়ে হওয়া অন্যায় বলেন। এমন-কি, আপনি কাগজেও সে কথা লিখেছেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতার সম্বন্ধে এ কথা খাটে না। কারণ, ওর মনের যেরকম পরিণতি হয়েছে অনেক বড়ো বয়সের মেয়েরও এমন দেখা যায় না।”

পরেশবাবু প্রশান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কহিলেন, “তা হোক পানুবাবু। যখন বিশেষ কোনো অহিত দেখা যাচ্ছে না তখন আপনার মত অনুসারে রাধারানীর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই কর্তব্য।”

হারানবাবু নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ায় লজ্জিত হইয়া কহিলেন, “নিশ্চয়ই কর্তব্য। কেবল আমার ইচ্ছা এই যে, একদিন সকলকে ডেকে ঈশ্বরের নাম করে সম্বন্ধটা পাকা করা হোক।”

পরেশবাবু কহিলেন, “সে অতি উত্তম প্রস্তাব।”

 গোরা ১৭

১৭

ঘণ্টা দুই-তিন নিদ্রার পর যখন গোরা ঘুম ভাঙিয়া পাশে চাহিয়া দেখিল বিনয় ঘুমাইতেছে তখন তাহার হৃদয় আনন্দে ভরিয়া উঠিল। স্বপ্নে একটা প্রিয় জিনিস হারাইয়া জাগিয়া উঠিয়া যখন দেখা যায় তাহা হারায় নাই তখন যেমন আরাম বোধ হয় গোরার সেইরূপ হইল। বিনয়কে ত্যাগ করিলে গোরার জীবনে যে কতখানি পঙ্গু হইয়া পড়ে আজ নিদ্রাভঙ্গে বিনয়কে পাশে দেখিয়া তাহা সে অনুভব করিতে পারিল। এই আনন্দের আঘাতে চঞ্চল হইয়া গোরা ঠেলাঠেলি করিয়া বিনয়কে জাগাইয়া দিল এবং কহিল, “চলো, একটা কাজ আছে।”

গোরার প্রত্যহ সকালবেলায় একটা নিয়মিত কাজ ছিল। সে পাড়ার নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘরে যাতায়াত করিত। তাহাদের উপকার করিবার বা উপদেশ দিবার জন্য নহে– নিতান্তই তাহাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যই যাইত। শিক্ষিত দলের মধ্যে তাহার এরূপ যাতায়াতের সম্বন্ধ ছিল না বলিলেই হয়। গোরাকে ইহারা দাদাঠাকুর বলিত এবং কড়িবাঁধা হুঁকা দিয়া অভ্যর্থনা করিত। কেবলমাত্র ইহাদের আতিথ্য গ্রহণ করিবার জন্যই গোরা জোর করিয়া তামাক খাওয়া ধরিয়াছিল।

এই দলের মধ্যে নন্দ গোরার সর্বপ্রধান ভক্ত ছিল। নন্দ ছুতারের ছেলে। বয়স বাইশ। সে তাহার বাপের দোকানে কাঠের বাক্স তৈয়ারি করিত। ধাপার মাঠে শিকারির দলে নন্দর মতো অব্যর্থ বন্দুকের লক্ষ কাহারো ছিল না। ক্রিকেট খেলায় গোলা ছুঁড়িতেও সে অদ্বিতীয় ছিল।

গোরা তাহার শিকার ও ক্রিকেটের দলে ভদ্র ছাত্রদের সঙ্গে এই-সকল ছুতার-কামারের ছেলেদের একসঙ্গে মিলাইয়া লইয়াছিল। এই মিশ্রিত দলের মধ্যে নন্দ সকলপ্রকার খেলায় ও ব্যায়ামে সকলের সেরা ছিল। ভদ্র ছাত্রেরা কেহ কেহ তাহার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল, কিন্তু গোরার শাসনে সকলেরই তাহাকে দলপতি বলিয়া স্বীকার করিতে হইত।

এই নন্দর পায়ে কয়েক দিন হইল একটা বাটালি পড়িয়া গিয়া ক্ষত হওয়ায় সে খেলার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল। বিনয়কে লইয়া এই কয়দিন গোরার মন বিকল ছিল, সে তাহাদের বাড়িতে যাইতে পারে নাই। আজ প্রভাতেই বিনয়কে সঙ্গে করিয়া সে ছুতারপাড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল।

নন্দদের দোতলা খোলার ঘরের দ্বারের কাছে আসিতেই ভিতর হইতে মেয়েদের কান্নার শব্দ শোনা গেল। নন্দর বাপ বা অন্য পুরুষ অভিভাবক বাড়িতে নাই। পাশে একটি তামাকের দোকান ছিল তাহার কর্তা আসিয়া কহিল, “নন্দ আজ ভোরবেলায় মারা পড়িয়াছে, তাহাকে দাহ করিতে লইয়া গেছে।”

নন্দ মারা গিয়াছে! এমন স্বাস্থ্য, এমন শক্তি, এমন তেজ, এমন হৃদয়, এত অল্প বয়স– সেই নন্দ আজ ভোরবেলায় মারা গিয়াছে। সমস্ত শরীর শক্ত করিয়া গোরা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। নন্দ একজন সামান্য ছুতারের ছেলে– তাহার অভাবে ক্ষণকালের জন্য সংসারে যেটুকু ফাঁক পড়িল তাহা অতি অল্প লোকেরই চোখে পড়িবে, কিন্তু আজ গোরার কাছে নন্দর মৃত্যু নিদারুণরূপে অসংগত ও অসম্ভব বলিয়া ঠেকিল। গোরা যে দেখিয়াছে তাহার প্রাণ ছিল– এত লোক তো বাঁচিয়া আছে, কিন্তু তাহার মতো এত প্রচুর প্রাণ কোথায় দেখিতে পাওয়া যায়।

কী করিয়া তাহার মৃত্যু হইল খবর লইতে গিয়া শোনা গেল যে, তাহার ধনুষ্টঙ্কার হইয়াছিল। নন্দর বাপ ডাক্তার আনিবার প্রস্তাব করিয়াছিল, কিন্তু নন্দর মা জোর করিয়া বলিল তাহার ছেলেকে ভূতে পাইয়াছে। ভূতের ওঝা কাল সমস্ত রাত তাহার গায়ে ছেঁকা দিয়াছে, তাহাকে মারিয়াছে এবং মন্ত্র পড়িয়াছে। ব্যামোর আরম্ভে গোরাকে খবর দিবার জন্য নন্দ একবার অনুরোধ করিয়াছিল– কিন্তু পাছে গোরা আসিয়া ডাক্তারি মতে চিকিৎসা করিবার জন্য জেদ করে এই ভয়ে নন্দর মা কিছুতেই গোরাকে খবর পাঠাইতে দেয় নাই।

সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় বিনয় কহিল, “কী মূঢ়তা, আর তার কী ভয়ানক শাস্তি!”

গোরা কহিল, “এই মূঢ়তাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে তুমি নিজে এর বাইরে আছ মনে করে সান্ত্বনা লাভ কোরো না বিনয়। এই মূঢ়তা যে কত বড়ো আর এর শাস্তি যে কতখানি তা যদি স্পষ্ট করে দেখতে পেতে, তা হলে ঐ একটা আক্ষেপোক্তি মাত্র প্রকাশ করে ব্যাপারটাকে নিজের কাছ থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করতে না।”

মনের উত্তেজনার সঙ্গে গোরার পদক্ষেপ ক্রমশই দ্রুত হইতে লাগিল। বিনয় তাহার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া তাহার সঙ্গে সমান পা রাখিয়া চলিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল।

গোরা বলিতে লাগিল, “সমস্ত জাত মিথ্যার কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়ে রেখেছে। দেবতা, অপদেবতা, পেঁচো, হাঁচি, বৃহস্পতিবার, ত্র৻হস্পর্শ– ভয় যে কত তার ঠিকানা নেই– জগতে সত্যের সঙ্গে কী রকম পৌরুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তা এরা জানবে কী করে? আর তুমি-আমি মনে করছি যে আমরা যখন দু-পাতা বিজ্ঞান পড়েছি তখন আমরা আর এদের দলে নেই। কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জেনো চার দিকের হীনতার আকর্ষণ থেকে অল্প লোক কখনোই নিজেকে বই-পড়া বিদ্যার দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। এরা যতদিন পর্যন্ত জগদ্‌ব্যাপারের মধ্যে নিয়মের আধিপত্যকে বিশ্বাস না করবে, যতদিন পর্যন্ত মিথ্যা ভয়ের দ্বারা জড়িত হয়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষিত লোকেরাও এর প্রভাব ছাড়াতে পারবে না।”

বিনয় কহিল, “শিক্ষিত লোকেরা ছাড়াতে পারলেই বা তাতে কী! কজনই বা শিক্ষিত লোক! শিক্ষিত লোকদের উন্নত করবার জন্যেই যে অন্য লোকদের উন্নত হতে হবে তা নয়– বরঞ্চ অন্য লোকদের বড়ো করবার জন্যেই শিক্ষিত লোকদের শিক্ষার গৌরব।”

গোরা বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “আমি তো ঠিক ঐ কথাই বলতে চাই। কিন্তু তোমরা নিজেদের ভদ্রতা ও শিক্ষার অভিমানে সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে দিব্য নিশ্চিন্ত হতে পারো এটা আমি বারবার দেখেছি বলেই তোমাদের আমি সাবধান করে দিতে চাই যে, নীচের লোকদের নিষ্কৃতি না দিলে কখনোই তোমাদের যথার্থ নিষ্কৃতি নেই। নৌকার খোলে যদি ছিদ্র থাকে তবে নৌকার মাস্তুল কখনোই গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াতে পারবে না, তা তিনি যতই উচ্চে থাকুন-না কেন।”

বিনয় নিরুত্তরে গোরার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল।

গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “না, বিনয়, এ আমি কিছুতেই সহজে সহ্য করতে পারব না। ঐ-যে ভূতের ওঝা এসে আমার নন্দকে মেরে গেছে তার মার আমাকে লাগছে, আমার সমস্ত দেশকে লাগছে। আমি এই-সব ব্যাপারকে এক-একটা ছোটো এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কোনোমতেই দেখতে পারি নে।”

তথাপি বিনয়কে নিরুত্তর দেখিয়া গোরা গর্জিয়া উঠিল, “বিনয়, আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি মনে মনে কী ভাবছ। তুমি ভাবছ এর প্রতিকার নেই কিম্বা প্রতিকারের সময় উপস্থিত হতে অনেক বিলম্ব আছে। তুমি ভাবছ, এই যে-সমস্ত ভয় এবং মিথ্যা সমস্ত ভারতবর্ষকে চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভারতবর্ষের এ বোঝা হিমাচলের মতো বোঝা, একে ঠেলে টলাতে পারবে কে? কিন্তু আমি এরকম করে ভাবতে পারি নে, যদি ভাবতুম তা হলে বাঁচতে পারতুম না। যা-কিছু আমার দেশকে আঘাত করছে তার প্রতিকার আছেই, তা সে যতবড়ো প্রবল হোক এবং একমাত্র আমাদের হাতেই তার প্রতিকার আছে এই বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় আছে বলেই আমি চারি দিকের এত দুঃখ দুর্গতি অপমান সহ্য করতে পারছি।”

বিনয় কহিল, “এতবড়ো দেশজোড়া প্রকাণ্ড দুর্গতির সামনে বিশ্বাসকে খাড়া করে রাখতে আমার সাহসই হয় না।”

গোরা কহিল, “অন্ধকার প্রকাণ্ড আর প্রদীপের শিখা ছোটো। সেই এতবড়ো অন্ধকারের চেয়ে এতটুকু শিখার উপরে আমি বেশি আস্থা রাখি। দুর্গতি চিরস্থায়ী হতে পারে এ কথা আমি কোনোক্রমেই বিশ্বাস করতে পারি নে। সমস্ত বিশ্বের জ্ঞানশক্তি প্রাণশক্তি তাকে ভিতরে বাহিরে কেবলই আঘাত করছে, আমরা যে যতই ছোটো হই সেই জ্ঞানের দলে প্রাণের দলে দাঁড়াব, দাঁড়িয়ে যদি মরি তবু এ কথা নিশ্চয় মনে রেখে মরব যে আমাদেরই দলের জিত হবে– দেশের জড়তাকেই সকলের চেয়ে বড়ো এবং প্রবল মনে করে তারই উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকব না। আমি তো বলি– জগতে শয়তানের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা আর ভূতের ভয় করা ঠিক একই কথা; ওতে ফল হয় এই যে, রোগের সত্যকার চিকিৎসায় প্রবৃত্তিই হয় না। যেমন মিথ্যা ভয় তেমনি মিথ্যা ওঝা– দুয়ে মিলেই আমাদের মারতে থাকে। বিনয়, আমি তোমাকে বার বার বলছি, এ কথা এক মুহূর্তের জন্যে স্বপ্নেও অসম্ভব বলে মনে কোরো না যে আমাদের এই দেশ মুক্ত হবেই, অজ্ঞান তাকে চিরদিন জড়িয়ে থাকবে না এবং ইংরেজ তাকে আপনার বাণিজ্যতরীর পিছনে চিরকাল শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে বেড়াতে পারবে না। এই কথা মনে দৃঢ় রেখে প্রতিদিনই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার জন্য ভবিষ্যতের কোন্‌-এক তারিখে লড়াই আরম্ভ হবে তোমরা তারই উপর বরাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছ। আমি বলছি, লড়াই আরম্ভ হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে লড়াই চলছে, এ সময়ে যদি তোমরা নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারো তা হলে তার চেয়ে কাপুরুষতা তোমাদের কিছুই হতে পারে না।”

বিনয় কহিল, “দেখো গোরা, তোমার সঙ্গে আমাদের একটা প্রভেদ আমি এই দেখতে পাই যে, পথে ঘাটে আমাদের দেশে প্রতিদিন যা ঘটছে এবং অনেক দিন ধরেই যা ঘটে আসছে তুমি প্রত্যহই তাকে যেন নূতন চোখে দেখতে পাও। নিজের নিশ্বাসপ্রশ্বাসকে আমরা যেমন ভুলে থাকি এগুলোও আমাদের কাছে তেমনি– এতে আমাদের আশাও দেয় না হতাশও করে না, এতে আমাদের আনন্দ নেই দুঃখও নেই– দিনের পর দিন অত্যন্ত শূন্যভাবে চলে যাচ্ছে, চারি দিকের মধ্যে নিজেকে এবং নিজের দেশকে অনুভবমাত্র করছি নে।”

হঠাৎ গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া তাহার কপালের শিরাগুলা ফুলিয়া উঠিল– সে দুই হাত মুঠা করিয়া রাস্তার মাঝখানে এক জুড়িগাড়ির পিছনে ছুটিতে লাগিল এবং বজ্রগর্জনে সমস্ত রাস্তার লোককে চকিত করিয়া চীৎকার করিল, “থামাও গাড়ি!” একটা মোটা ঘড়ির চেন-পরা বাবু গাড়ি হাঁকাইতেছিল, সে একবার পিছন ফিরিয়া দেখিয়া দুই তেজস্বী ঘোড়াকে চাবুক কষাইয়া মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।

একজন বৃদ্ধ মুসলমান মাথায় এক-ঝাঁকা ফল সবজি আণ্ডা রুটি মাখন প্রভৃতি আহার্যসামগ্রী লইয়া কোনো ইংরেজ প্রভুর পাকশালার অভিমুখে চলিতেছিল। চেনপরা বাবুটি তাহাকে গাড়ির সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার জন্য হাঁকিয়াছিল, বৃদ্ধ শুনিতে না পাওয়াতে গাড়ি প্রায় তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। কোনোমতে তাহার প্রাণ বাঁচিল কিন্তু ঝাঁকাসমেত জিনিসগুলা রাস্তায় গড়াগড়ি গেল এবং ক্রুদ্ধ বাবু কোচবাক্স হইতে ফিরিয়া তাহাকে “ড্যাম শুয়ার’ বলিয়া গালি দিয়া তাহার মুখের উপর সপাং করিয়া চাবুক বসাইয়া দিতে তাহার কপালে রক্তের রেখা দেখা দিল। বৃদ্ধ “আল্লা’ বলিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া যে জিনিসগুলা নষ্ট হয় নাই তাহাই বাছিয়া ঝাঁকায় তুলিতে প্রবৃত্ত হইল। গোরা ফিরিয়া আসিয়া বিকীর্ণ জিনিসগুলা নিজে কুড়াইয়া তাহার ঝাঁকায় উঠাইতে লাগিল। মুসলমান মুটে ভদ্রলোক পথিকের এই ব্যবহারে অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া কহিল, “আপনি কেন কষ্ট করছেন বাবু, এ আর কোনো কাজে লাগবে না।” গোরা এ কাজের অনাবশ্যকতা জানিত এবং সে ইহাও জানিত যাহার সাহায্য করা হইতেছে, সে লজ্জা অনুভব করিতেছে– বস্তুত সাহায্য হিসাবে এরূপ কাজের বিশেষ মূল্য নাই– কিন্তু এক ভদ্রলোক যাহাকে অন্যায় অপমান করিয়াছে আর-এক ভদ্রলোক সেই অপমানিতের সঙ্গে নিজেকে সমান করিয়া ধর্মের ক্ষুব্ধ ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য আনিতে চেষ্টা করিতেছে এ কথা রাস্তার লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ঝাঁকা ভর্তি হইলে গোরা তাহাকে বলিল, “যা লোকসান গেছে সে তো তোমার সইবে না। চলো, আমাদের বাড়ি চলো, আমি সমস্ত পুরো দাম দিয়ে কিনে নেব। কিন্তু বাবা, একটা কথা তোমাকে বলি, তুমি কথাটি না বলে যে অপমান সহ্য করলে আল্লা তোমাকে এজন্য মাপ করবেন না।”

মুসলমান কহিল, “যে দোষী আল্লা তাকেই শাস্তি দেবেন, আমাকে কেন দেবেন?”

গোরা কহিল, “যে অন্যায় সহ্য করে সেও দোষী, কেননা সে জগতে অন্যায়ের সৃষ্টি করে। আমার কথা বুঝবে না, তবু মনে রেখো, ভালোমানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্মপ্রচার করেন নি।”

সেখান হইতে গোরাদের বাড়ি নিকট নয় বলিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিনয়ের বাসায় লইয়া গেল। বিনয়ের দেরাজের সামনে দাঁড়াইয়া বিনয়কে কহিল, “টাকা বের করো।”

বিনয় কহিল, “তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন, বোসোগে-না, আমি দিচ্ছি।”

বলিয়া হঠাৎ চাবি খুঁজিয়া পাইল না। অধীর গোরা এক টান দিতেই দুর্বল দেরাজ বদ্ধ চাবির বাধা না মানিয়া খুলিয়া গেল।

দেরাজ খুলিতেই পরেশবাবুর পরিবারের সকলের একত্রে তোলা একটা বড়ো ফোটোগ্রাফ সর্বাগ্রে চোখে পড়িল। এটি বিনয় তাহার বালক বন্ধু সতীশের নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছিল।

টাকা সংগ্রহ করিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিদায় করিল, কিন্তু ফোটোগ্রাফ সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিল না। গোরাকে এ সম্বন্ধে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিনয়ও কোনো কথা তুলিতে পারিল না– অথচ দুই-চারিটা কথা হইয়া গেলে বিনয়ের মন সুস্থ হইত।

গোরা হঠাৎ বলিল, “চললুম।”

বিনয় কহিল, “বাঃ, তুমি একলা যাবে কি! মা যে আমাকে তোমাদের ওখানে খেতে বলেছেন। অতএব আমিও চললুম।”

দুইজনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। বাকি পথ গোরা আর কোনো কথা কহিল না। ডেস্কের মধ্যে ঐ ছবিখানি দেখিয়া গোরাকে আবার সহসা স্মরণ করাইয়া দিল যে, বিনয়ের চিত্তের একটা প্রধান ধারা এমন একটা পথে চলিয়াছে যে পথের সঙ্গে গোরার জীবনের কোনো সম্পর্ক নাই। ক্রমে বন্ধুত্বের আদিগঙ্গা নির্জীব হইয়া ঐ দিকেই মূল ধারাটা বহিতে পারে এ আশঙ্কা অব্যক্তভাবে গোরার হৃদয়ের গভীরতম তলদেশে একটা অনির্দেশ্য ভারের মতো চাপিয়া পড়িল। সমস্ত-চিন্তায় ও কর্মে এতদিন দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ছিল না– এখন আর তাহা রক্ষা করা কঠিন হইতেছে– বিনয় এক জায়গায় স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতেছে।

গোরা যে কেন চুপ করিয়া গেল বিনয় তাহা বুঝিল। কিন্তু এই নীরবতার বেড়া গায়ে পড়িয়া ঠেলিয়া ভাঙিতে তাহার সংকোচ বোধ হইল। গোরার মনটা যে জায়গায় আসিয়া ঠেকিতেছে সেখানে একটা সত্যকার ব্যবধান আছে ইহা বিনয় নিজেও অনুভব করে।

বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিতেই দেখা গেল মহিম পথের দিকে চাহিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। দুই বন্ধুকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “ব্যাপারখানা কী! কাল তো তোমাদের সমস্ত রাত না ঘুমিয়েই কেটেছে– আমি ভাবছিলুম দুজনে বুঝি বা ফুটপাথের উপরে কোথাও আরামে ঘুমিয়ে পড়েছ! বেলা তো কম হয় নি। যাও বিনয়, নাইতে যাও।”

বিনয়কে তাগিদ করিয়া নাহিতে পাঠাইয়া মহিম গোরাকে লইয়া পড়িলেন; কহিলেন, “দেখো গোরা, তোমাকে যে কথাটা বলেছিলুম সেটা একটু বিবেচনা করে দেখো। বিনয়কে যদি তোমার অনাচারী বলে সন্দেহ হয় তা হলে আজকালকার বাজারে হিন্দু পাত্র পাব কোথায়? শুধু হিঁদুয়ানি হলেও তো চলবে না– লেখা-পড়াও তো চাই! ঐ লেখাপড়াতে হিঁদুয়ানিতে মিললে যে পদার্থটা হয় সেটা আমাদের হিন্দুমতে ঠিক শাস্ত্রীয় জিনিস নয় বটে, কিন্তু মন্দ জিনিসও নয়। যদি তোমার মেয়ে থাকত তা হলে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে তোমার মতের ঠিক মিল হয়ে যেত।”

গোরা কহিল, “তা, বেশ তো– বিনয় বোধ হয় আপত্তি করবে না।”

মহিম কহিল, “শোনো একবার! বিনয়ের আপত্তির জন্য কে ভাবছে। তোমার আপত্তিকেই তো ডরাই। তুমি নিজের মুখে একবার বিনয়কে অনুরোধ করো, আমি আর কিছু চাই নে– তাতে যদি ফল না হয় তো না হবে।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা।”

মহিম মনে মনে কহিল “এইবার ময়রার দোকানে সন্দেশ এবং গয়লার দোকানে দই-ক্ষীর ফরমাশ দিতে পারি।’

গোরা অবসরক্রমে বিনয়কে কহিল, “শশিমুখীর সঙ্গে তোমার বিবাহের জন্য দাদা ভারি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করেছেন। এখন তুমি কী বল?”

বিনয়। আগে তোমার কী ইচ্ছা সেইটে বলো।

গোরা। আমি তো বলি মন্দ কী!

বিনয়। আগে তো তুমি মন্দই বলতে! আমরা দুজনের কেউ বিয়ে করব না এ তো একরকম ঠিক হয়েই ছিল।

গোরা। এখন ঠিক করা গেল তুমি বিয়ে করবে আর আমি করব না।

বিনয়। কেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?

গোরা। পৃথক ফল হবার ভয়েই এই ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। বিধাতা কোনো কোনো মানুষকে সহজেই বেশি ভারগ্রস্ত করে গড়ে থাকেন, কেউ বা সহজেই দিব্য ভারহীন– এই উভয় জীবকে একত্রে জুড়ে চালাতে গেলে এদের একটির উপর বাইরে থেকে বোঝা চাপিয়ে দুজনের ওজন সমান করে নিতে হয়। তুমি বিবাহ করে একটু দায়গ্রস্ত হলে পর তোমার আমাতে সমান চালে চলতে পারব।

বিনয় একটু হাসিল এবং কহিল, “যদি সেই মতলব হয় তবে এই দিকেই বাটখারাটি চাপাও।”

গোরা। বাটখারাটি সম্বন্ধে আপত্তি নেই তো?

বিনয়। ওজন সমান করবার জন্যে যা হাতের কাছে আসে তাতেই কাজ চালানো যেতে পারে। ও পাথর হলেও হয়, ঢেলা হলেও হয়, যা খুশি।

গোরা যে বিবাহ-প্রস্তাবে কেন উৎসাহ প্রকাশ করিল তাহা বিনয়ের বুঝিতে বাকি রহিল না। পাছে বিনয় পরেশবাবুর পরিবারের মধ্যে বিবাহ করিয়া বসে গোরার মনে এই সন্দেহ হইয়াছে অনুমান করিয়া বিনয় মনে মনে হাসিল। এরূপ বিবাহের সংকল্প ও সম্ভাবনা তাহার মনে এক মুহূর্তের জন্যও উদিত হয় নাই। এ যে হইতেই পারে না। যাই হোক, শশিমুখীকে বিবাহ করিলে এরূপ অদ্ভুত আশঙ্কার একেবারে মূল উৎপাটিত হইয়া যাইবে এবং তাহা হইলেই উভয়ের বন্ধুত্বসম্বন্ধ পুনরায় সুস্থ ও শান্ত হইবে ও পরেশবাবুদের সঙ্গে মেলামেশা করিতেও তাহার কোনো দিক হইতে কোনো সংকোচের কারণ থাকিবে না, এই কথা চিন্তা করিয়া সে শশিমুখীর সহিত বিবাহে সহজেই সম্মতি দিল। মধ্যাহ্নে আহারান্তে রাত্রের নিদ্রার ঋণশোধ করিতে দিন কাটিয়া গেল। সেদিন দুই বন্ধুর মধ্যে আর কোনো কথা হইল না, কেবল জগতের উপর সন্ধ্যার অন্ধকার পর্দা পড়িলে প্রণয়ীদের মধ্যে যখন মনের পর্দা উঠিয়া যায় সেই সময় বিনয় ছাতের উপর বসিয়া সিধা আকাশের দিকে তাকাইয়া বলিল, “দেখো, গোরা, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই। আমার মনে হয় আমাদের স্বদেশপ্রেমের মধ্যে একটা গুরুতর অসম্পূর্ণতা আছে। আমরা ভারতবর্ষকে আধখানা করে দেখি।”

গোরা। কেন বলো দেখি?

বিনয়। আমরা ভারতবর্ষকে কেবল পুরুষের দেশ বলেই দেখি, মেয়েদের একেবারেই দেখি নে।

গোরা। তুমি ইংরেজদের মতো মেয়েদের বুঝি ঘরে বাইরে, জলে স্থলে শূন্যে, আহারে আমোদে কর্মে, সর্বত্রই দেখতে চাও? তাতে ফল হবে এই যে, পুরুষের চেয়ে মেয়েকেই বেশি করে দেখতে থাকবে– তাতেও দৃষ্টির সামঞ্জস্য নষ্ট হবে।

বিনয়। না না, তুমি আমার কথাটাকে ওরকম করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। ইংরেজের মতো করে দেখব কি না-দেখব সে কথা কেন তুলছ! আমি বলছি এটা সত্য যে, স্বদেশের মধ্যে মেয়েদের অংশকে আমাদের চিন্তার মধ্যে আমরা যথাপরিমাণে আনি নে। তোমার কথাই আমি বলতে পারি, তুমি মেয়েদের সম্বন্ধে এক মূহূর্তও ভাব না– দেশকে তুমি যেন নারীহীন করে জান– সেরকম জানা কখনোই সত্য জানা নয়।

গোরা। আমি যখন আমার মাকে দেখেছি, মাকে জেনেছি, তখন আমার দেশের সমস্ত স্ত্রীলোককে সেই এক জায়গায় দেখেছি এবং জেনেছি।

বিনয়। ওটা তুমি নিজেকে ভোলাবার জন্যে একটা সাজিয়ে কথা বললে মাত্র। ঘরের কাজের মধ্যে ঘরের লোকে ঘরের মেয়েদের অতিপরিচিত ভাবে দেখলে তাতে যথার্থ দেখাই হয় না। নিজেদের গার্হস্থ্য প্রয়োজনের বাইরে আমরা দেশের মেয়েদের যদি দেখতে পেতুম তা হলে আমাদের স্বদেশের সৌন্দর্য এবং সম্পূর্ণতাকে আমরা দেখতুম, দেশের এমন একটি মূর্তি দেখা যেত যার জন্য প্রাণ দেওয়া সহজ হত– অন্তত, তা হলে দেশের মেয়েরা যেন কোথাও নেই এরকম ভুল আমাদের কখনোই ঘটতে পারত না। জানি ইংরেজের সমাজের সঙ্গে কোনোরকম তুলনা করতে গেলেই তুমি আগুন হয়ে উঠবে– আমি তা করতে চাই নে– আমি জানি নে ঠিক কতটা পরিমাণে এবং কি রকম ভাবে আমাদের মেয়েরা সমাজে প্রকাশ পেলে তাদের মর্যাদা লঙ্ঘন হয় না, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, মেয়েরা প্রচ্ছন্ন থাকাতে আমাদের স্বদেশ আমাদের কাছে অর্ধসত্য হয়ে আছে– আমাদের হৃদয়ে পূর্ণপ্রেম এবং পূর্ণশক্তি দিতে পারছে না।

গোরা। তুমি এ কথাটা সম্প্রতি হঠাৎ আবিষ্কার করলে কী করে?

বিনয়। হাঁ, সম্প্রতিই আবিষ্কার করেছি এবং হঠাৎ আবিষ্কারই করেছি। এতবড়ো সত্য আমি এতদিন জানতুম না। জানতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করছি। আমরা যেমন চাষাকে কেবলমাত্র তার চাষবাস, তাঁতিকে তার কাপড় তৈরির মধ্যে দেখি বলে তাদের ছোটোলোক বলে অবজ্ঞা করি, তারা সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের চোখে পড়ে না, এবং ছোটোলোক-ভদ্রলোকের সেই বিচ্ছেদের দ্বারাই দেশ দুর্বল হয়েছে, ঠিক সেইরকম কারণেই দেশের মেয়েদের কেবল তাদের রান্নাবান্না বাটনা-বাটার মধ্যে আবদ্ধ করে দেখছি বলেই মেয়েদের মেয়েমানুষ বলে অত্যন্ত খাটো করে দেখি– এতে করে আমাদের সমস্ত দেশই খাটো হয়ে গেছে।

গোরা। দিন আর রাত্রি, সময়ের এই যেমন দুটো ভাগ– পুরুষ এবং মেয়েও তেমনি সমাজের দুই অংশ। সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় স্ত্রীলোক রাত্রির মতোই প্রচ্ছন্ন– তার সমস্ত কাজ নিগূঢ় এবং নিভৃত। আমাদের কর্মের হিসাব থেকে আমরা রাতকে বাদ দিই। কিন্তু বাদ দিই বলে তার যে গভীর কর্ম তার কিছুই বাদ পড়ে না। সে গোপন বিশ্রামের অন্তরালে আমাদের ক্ষতিপূরণ করে, আমাদের পোষণের সহায়তা করে। যেখানে সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থা সেখানে রাতকে জোর করে দিন করে তোলে– সেখানে গ্যাস জ্বালিয়ে কল চালানো হয়, বাতি জ্বালিয়ে সমস্ত রাত নাচ-গান হয়– তাতে ফল কী হয়! ফল এই হয় যে, রাত্রির যে স্বাভাবিক নিভৃত কাজ তা নষ্ট হয়ে যায়, ক্লান্তি বাড়তে থাকে, ক্ষতিপূরণ হয় না, মানুষ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মেয়েদেরও যদি তেমনি আমরা প্রকাশ্য কর্মক্ষেত্রে টেনে আনি তা হলে তাদের নিগূঢ় কর্মের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়– তাতে সমাজের স্বাস্থ্য ও শান্তি-ভঙ্গ হয়, সমাজে একটা মত্ততা প্রবেশ করে। সেই মত্ততাকে হঠাৎ শক্তি বলে ভ্রম হয়, কিন্তু সে শক্তি বিনাশ করবারই শক্তি। শক্তির দুটো অংশ আছে– এক অংশ ব্যক্ত আর-এক অংশ অব্যক্ত, এক অংশ উদ্যোগ আর-এক অংশ বিশ্রাম, এক অংশ প্রয়োগ আর-এক অংশ সম্বরণ– শক্তির এই সামঞ্জস্য যদি নষ্ট কর তা হলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু সে ক্ষোভ মঙ্গলকর নয়। নরনারী সমাজশক্তির দুই দিক; পুরুষই ব্যক্ত, কিন্তু ব্যক্ত বলেই যে মস্ত তা নয়– নারী অব্যক্ত, এই অব্যক্ত শক্তিকে যদি কেবলই ব্যক্ত করবার চেষ্টা করা হয় তা হলে সমস্ত মূলধন খরচ করে ফেলে সমাজকে দ্রুতবেগে দেউলে করবার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইজন্যে বলছি আমরা পুরুষরা যদি থাকে যজ্ঞের ক্ষেত্রে, মেয়েরা যদি থাকেন ভাঁড়ার আগলে, তা হলেই মেয়েরা অদৃশ্য থাকলেও যজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে। সব শক্তিকেই একই দিকে একই জায়গায় একই রকমে খরচ করতে চায় যারা তারা উন্মত্ত।

বিনয়। গোরা, তুমি যা বললে আমি তার প্রতিবাদ করতে চাই নে– কিন্তু আমি যা বলছিলুম তুমিও তার প্রতিবাদ কর নি। আসল কথা–

গোরা। দেখো বিনয়, এর পরে এ কথাটা নিয়ে আর অধিক যদি বকাবকি করা যায় তা হলে সেটা নিতান্ত তর্ক হয়ে দাঁড়াবে। আমি স্বীকার করছি, তুমি সম্প্রতি মেয়েদের সম্বন্ধে যতটা সচেতন হয়ে উঠেছ আমি ততটা হই নি– সুতরাং তুমি যা অনুভব করছ আমাকেও তাই অনুভব করাবার চেষ্টা করা কখনো সফল হবে না। অতএব এ সম্বন্ধে আপাতত আমাদের মতভেদ রইল বলেই মেনে নেওয়া যাক-না।

গোরা কথাটাকে উড়াইয়া দিল। কিন্তু বীজকে উড়াইয়া দিলেও সে মাটিতে পড়ে এবং মাটিতে পড়িলে সুযোগমত অঙ্কুরিত হইতে বাধা থাকে না। এ পর্যন্ত জীবনের ক্ষেত্র হইতে গোরা স্ত্রীলোককে একেবারেই সরাইয়া রাখিয়াছিল– সেটাকে একটা অভাব বা ক্ষতি বলিয়া সে কখনো স্বপ্নেও অনুভব করে নাই। আজ বিনয়ের অবস্থান্তর দেখিয়া সংসারে স্ত্রীজাতির বিশেষ সত্তা ও প্রভাব তাহার কাছে গোচর হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু ইহার স্থান কোথায়, ইহার প্রয়োজন কী, তাহা সে কিছুই স্থির করিতে পারে নাই, এইজন্য বিনয়ের সঙ্গে এ কথা লইয়া তর্ক করিতে তাহার ভালো লাগে না। বিষয়টাকে সে অস্বীকার করিতেও পারে না, আয়ত্ত করিতেও পারিতেছে না, এইজন্য ইহাকে আলোচনার বাহিরে রাখিতে চায়।

রাত্রে বিনয় যখন বাসায় ফিরিতেছিল তখন আনন্দময়ী তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “শশিমুখীর সঙ্গে বিনয় তোমার বিবাহ নাকি ঠিক হয়ে গেছে?”

বিনয় সলজ্জ হাস্যের সহিত কহিল, “হাঁ মা, গোরা এই শুভকর্মের ঘটক।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখী মেয়েটি ভালো, কিন্তু বাছা, ছেলেমানুষি কোরো না। আমি তোমার মন জানি বিনয়– একটু দোমনা হয়েছ বলেই তাড়াতাড়ি এ কাজ করে ফেলছ। এখনো বিবেচনা করে দেখবার সময় আছে; তোমার বয়স হয়েছে বাবা– এতবড়ো একটা কাজ অশ্রদ্ধা করে কোরো না।”

বলিয়া বিনয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া দিলেন। বিনয় কোনো কথা না বলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল।

গোরা ১৮

১৮

বিনয় আনন্দময়ীর কথা কয়টি ভাবিতে ভাবিতে বাসায় গেল। আনন্দময়ীর মুখের একটি কথাও এপর্যন্ত বিনয়ের কাছে কোনোদিন উপেক্ষিত হয় নাই। সে রাত্রে তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া রহিল।

পরদিন সকালে উঠিয়া সে যেন একটা মুক্তির ভাব অনুভব করিল। তাহার মনে হইল গোরার বন্ধুত্বকে সে একটা খুব বড়ো দাম দিয়া চুকাইয়া দিয়াছে। এক দিকে শশিমুখীকে বিবাহ করিতে রাজি হইয়া সে জীবনব্যাপী যে-একটা বন্ধন স্বীকার করিয়াছে ইহার পরিবর্তে আর-এক দিকে তাহার বন্ধন আলগা দিবার অধিকার হইয়াছে। বিনয় সমাজ ছাড়িয়া ব্রাহ্মপরিবারে বিবাহ করিবার জন্য লুব্ধ হইয়াছে, গোরা তাহার প্রতি এই-যে অত্যন্ত অন্যায় সন্দেহ করিয়াছিল– এই মিথ্যা সন্দেহের কাছে সে শশিমুখীর বিবাহকে চিরন্তন জামিন-স্বরূপে রাখিয়া নিজেকে খালাস করিয়া লইল। ইহার পরে বিনয় পরেশের বাড়িতে নিঃসংকোচে এবং ঘন ঘন যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিল।

যাহাদিগকে ভালো লাগে তাহাদের ঘরের লোকের মতো হইয়া উঠা বিনয়ের পক্ষে কিছুমাত্র শক্ত নহে। সে যেই গোরার দিকের সংকোচ তাহার মন হইতে দূর করিয়া দিল অমনি দেখিতে দেখিতে অল্প কালের মধ্যেই পরেশবাবুর ঘরের সকলের কাছেই যেন বহুদিনের আত্মীয়ের মতো হইয়া উঠিল।

কেবল ললিতার মনে যে-কয়দিন সন্দেহ ছিল যে সুচরিতার মন হয়তো বা বিনয়ের দিকে কিছু ঝুঁকিয়াছে সেই কয়দিন বিনয়ের বিরুদ্ধে তাহার মন যেন অস্ত্রধারণ করিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু যখন সে স্পষ্ট বুঝিল যে সুচরিতা বিনয়ের প্রতি বিশেষভাবে পক্ষপাতী নহে তখন তাহার মনের বিদ্রোহ দূর হইয়া সে ভারি আরাম বোধ করিল এবং বিনয়বাবুকে অসামান্য ভালো লোক বলিয়া মনে করিতে তাহার কোনো বাধা রহিল না।

হারানবাবুও বিনয়ের প্রতি বিমুখ হইলেন না– তিনি একটু যেন বেশি করিয়া স্বীকার করিলেন যে বিনয়ের ভদ্রতাজ্ঞান আছে। গোরার যে সেটা নাই ইহাই এই স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত।

বিনয় কখনো হারানবাবুর সম্মুখে কোনো তর্কের বিষয় তুলিত না এবং সুচরিতারও চেষ্টা ছিল যাহাতে না তোলা হয়– এইজন্য বিনয়ের দ্বারা ইতিমধ্যে চায়ের টেবিলের শান্তিভঙ্গ হইতে পায় নাই।

কিন্তু হারানের অনুপস্থিতিতে সুচরিতা নিজে চেষ্টা করিয়া বিনয়কে তাহার সামাজিক মতের আলোচনায় প্রবৃত্ত করিত। গোরা এবং বিনয়ের মতো শিক্ষিত লোক কেমন করিয়া যে দেশের প্রাচীন কুসংস্কারগুলি সমর্থন করিতে পারে ইহা জানিবার কৌতূহল কিছুতেই তাহার নিবৃত্তি হইত না। গোরা ও বিনয়কে সে যদি না জানিত তবে এ-সকল মত কেহ স্বীকার করে জানিলে সুচরিতা দ্বিতীয় কোনো কথা না শুনিয়া তাহাকে অবজ্ঞার যোগ্য বলিয়া স্থির করিত। কিন্তু গোরাকে দেখিয়া অবধি গোরাকে সে কোনোমতে মন হইতে অশ্রদ্ধা করিয়া দূর করিতে পারিতেছে না। তাই সুযোগ পাইলেই ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়ের সঙ্গে সে গোরার মত ও জীবনের আলোচনা উত্থাপন করে এবং প্রতিবাদের দ্বারা সকল কথা শেষ পর্যন্ত টানিয়া বাহির করিতে থাকে। পরেশ সুচরিতাকে সকল সম্প্রদায়ের মত শুনিতে দেওয়াই তাহার সুশিক্ষার উপায় বলিয়া জানিতেন, এইজন্য তিনি এ-সকল তর্কে কোনোদিন শঙ্কা অনুভব বা বাধা প্রদান করেন নাই।

একদিন সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, গৌরমোহনবাবু কি সত্যই জাতিভেদ মানেন, না ওটা দেশানুরাগের একটা বাড়াবাড়ি?”

বিনয় কহিল, “আপনি কি সিঁড়ির ধাপগুলোকে মানেন? ওগুলোও তো সব বিভাগ– কোনোটা উপরে কোনোটা নীচে।”

সুচরিতা। নীচে থেকে উপরে উঠতে হয় বলেই মানি– নইলে মানবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সমান জায়গায় সিঁড়িকে না মানলেও চলে।

বিনয়। ঠিক বলেছেন– আমাদের সমাজ একটা সিঁড়ি– এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হচ্ছে নীচে থেকে উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মানবজীবনের একটা পরিণামে নিয়ে যাওয়া। যদি সমাজকে সংসারকেই পরিণাম বলে জানতুম তা হলে কোনো বিভাগব্যবস্থার প্রয়োজনই ছিল না– তা হলে য়ুরোপীয় সমাজের মতো প্রত্যেকে অন্যের চেয়ে বেশি দখল করবার জন্যে কাড়াকাড়ি মারামারি করে চলতুম; সংসারে যে কৃতকার্য হ’ত সেই মাথা তুলত, যার চেষ্টা নিষ্ফল হত সে একেবারেই তলিয়ে যেত। আমরা সংসারের ভিতর দিয়ে সংসারকে পার হতে চাই বলেই সংসারের কর্তব্যকে প্রবৃত্তি ও প্রতিযোগিতার উপরে প্রতিষ্ঠিত করি নি– সংসার-কর্মকে ধর্ম বলে স্থির করেছি, কেননা কর্মের দ্বারা অন্য কোনো সফলতা নয়, মুক্তি লাভ করতে হবে, সেইজন্য এক দিকে সংসারের কাজ, অন্য দিকে সংসার-কাজের পরিণাম, উভয় দিকে তাকিয়ে আমাদের সমাজ বর্ণভেদ অর্থাৎ বৃত্তিভেদ স্থাপন করেছেন।

সুচরিতা। আমি যে আপনার কথা খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছি তা নয়। আমার প্রশ্ন এই যে, যে উদ্দেশ্যে সমাজের বর্ণভেদ প্রচলিত হয়েছে আপনি বলছেন সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন?

বিনয়। পৃথিবীতে সফলতার চেহারা দেখতে পাওয়া বড়ো শক্ত। গ্রীসের সফলতা আজ গ্রীসের মধ্যে নেই, সেজন্যে বলতে পারি নে গ্রীসের সমস্ত আইডিয়াই ভ্রান্ত এবং ব্যর্থ। গ্রীসের আইডিয়া এখনো মানবসমাজের মধ্যে নানা আকারে সফলতা লাভ করছে। ভারতবর্ষ যে জাতিভেদ বলে সামাজিক সমস্যার একটা বড়ো উত্তর দিয়েছিলেন, সে উত্তরটা এখনো মরে নি– সেটা এখনো পৃথিবীর সামনে রয়েছে। য়ুরোপও সামাজিক সমস্যার অন্য কোনো সদুত্তর এখনো দিতে পারে নি, সেখানে কেবলই ঠেলাঠেলি হাতাহাতি চলছে– ভারতবর্ষের এই উত্তরটা মানবসমাজে এখনো সফলতার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে– আমরা একে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অন্ধতাবশত উড়িয়ে দিলেই যে এ উড়ে যাবে তা মনেও করবেন না। আমরা ছোটো ছোটো সম্প্রদায়েরা জলবিম্বের মতো সমুদ্রে মিশিয়ে যাব, কিন্তু ভারতবর্ষের সহজ প্রতিভা হতে এই-যে একটা প্রকাণ্ড মীমাংসা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এর কাজ না হবে ততক্ষণ এ স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে।

সুচরিতা সংকুচিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি রাগ করবেন না, কিন্তু সত্যি করে বলুন, এ-সমস্ত কথা কি আপনি গৌরমোহনবাবুর প্রতিধ্বনির মতো বলছেন, না এ আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছেন?”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য করেই বলছি, গোরার মতো আমার বিশ্বাসের জোর নেই। জাতিভেদের আবর্জনা ও সমাজের বিকারগুলো যখন দেখতে পাই তখন আমি অনেক সময়েই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি– কিন্তু গোরা বলে, বড়ো জিনিসকে ছোটো করে দেখলেই সন্দেহ জন্মে– গাছের ভাঙা ডাল ও শুকনো পাতাকেই গাছের চরম প্রকৃতি বলে দেখা বুদ্ধির অসহিষ্ণুতা– ভাঙা ডালকে প্রশংসা করতে বলি নে, কিন্তু বনস্পতিকে সমগ্র করে দেখো এবং তার তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করো।”

সুচরিতা। গাছের শুকনো পাতাটা নাহয় নাই ধরা গেল, কিন্তু গাছের ফলটা তো দেখতে হবে। জাতিভেদের ফলটা আমাদের দেশের পক্ষে কী রকম?

বিনয়। যাকে জাতিভেদের ফল বলছেন সেটা অবস্থার ফল, শুধু জাতিভেদের নয়। নড়া দাঁত দিয়ে চিবোতে গেলে ব্যথা লাগে, সেটা দাঁতের অপরাধ নয়, নড়া দাঁতেরই অপরাধ। নানা কারণে আমাদের মধ্যে বিকার ও দুর্বলতা ঘটেছে বলেই ভারতবর্ষের আইডিয়াকে আমরা সফল না করে বিকৃত করছি– সে বিকার আইডিয়ার মূলগত নয়। আমাদের ভিতর প্রাণ ও স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য ঘটলেই সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে। গোরা সেইজন্যে বার বার বলে যে, মাথা ধরে বলে মাথাটাকে উড়িয়ে দিলে চলবে না– সুস্থ হও, সবল হও।

সুচরিতা। আচ্ছা, তা হলে আপনি ব্রাহ্মণ জাতকে নরদেবতা বলে মানতে বলেন? আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলোয় মানুষ পবিত্র হয়?

বিনয়। পৃথিবীতে অনেক সম্মানই তো আমাদের নিজের সৃষ্টি। রাজাকে যতদিন যে কারণেই হোক দরকার থাকে ততদিন মানুষ তাকে অসামান্য বলে প্রচার করে। কিন্তু রাজা তো সত্যি অসামান্য নয়। অথচ নিজের সামান্যতার বাধা ভেদ করে তাকে অসামান্য হয়ে উঠতে হবে, নইলে সে রাজত্ব করতে পারবেই না। আমরা রাজার কাছে থেকে উপযুক্তরূপ রাজত্ব পাবার জন্যে তাকে অসামান্য করে গড়ে তুলি– আমাদের সেই সম্মানের দাবি রাজাকে রক্ষা করতে হয়, তাকে অসামান্য হতে হয়। মানুষের সকল সম্বন্ধের মধ্যেই এই কৃত্রিমতা আছে। এমন-কি, বাপ-মার যে আদর্শ আমরা সকলে মিলে খাড়া করে রেখেছি তাতে করেই সমাজে বাপ-মাকে বিশেষভাবে বাপ-মা করে রেখেছে, কেবলমাত্র স্বাভাবিক স্নেহে নয়। একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো ভাই ছোটো ভাইয়ের জন্য অনেক সহ্য ও অনেক ত্যাগ করে– কেন করে? আমাদের সমাজে দাদাকে বিশেষভাবে দাদা করে তুলেছে, অন্য সমাজে তা করে নি। ব্রাহ্মণকেও যদি যথার্থভাবে ব্রাহ্মণ করে গড়ে তুলতে পারি তা হলে সে কি সমাজের পক্ষে সামান্য লাভ! আমরা নরদেবতা চাই– আমরা নরদেবতাকে যদি যথার্থই সমস্ত অন্তরের সঙ্গে বুদ্ধিপূর্বক চাই তা হলে নরদেবতাকে পাব। আর যদি মূঢ়ের মতো চাই তা হলে যে-সমস্ত অপদেবতা সকল রকম দুষ্কর্ম করে থাকে এবং আমাদের মাথার উপরে পায়ের ধুলো দেওয়া যাদের জীবিকার উপায় তাদের দল বাড়িয়ে ধরণীর ভার বৃদ্ধি করা হবে।

সুচরিতা। আপনার সেই নরদেবতা কি কোথাও আছে?

বিনয়। বীজের মধ্যে যেমন গাছ আছে তেমনি আছে, ভারতবর্ষের আন্তরিক অভিপ্রায় এবং প্রয়োজনের মধ্যে আছে। অন্য দেশ ওয়েলিংটনের মতো সেনাপতি, নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিক, রথ্‌চাইল্ডের মতো লক্ষপতি চায়, আমাদের দেশ ব্রাহ্মণকে চায়। ব্রাহ্মণ,যার ভয় নেই, লোভকে যে ঘৃণা করে, দুঃখকে যে জয় করে, অভাবকে যে লক্ষ করে না, যে “পরমে ব্রহ্মণি যোজিতচিত্তঃ’। যে অটল, যে শান্ত, যে মুক্ত সেই ব্রাহ্মণকে ভারতবর্ষ চায়– সেই ব্রাহ্মণকে যথার্থভাবে পেলে তবেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। আমাদের সমাজের প্রত্যেক বিভাগকে প্রত্যেক কর্মকে সর্বদাই একটি মুক্তির সুর জোগাবার জন্যই ব্রাহ্মণকে চাই– রাঁধবার জন্যে এবং ঘণ্টা নাড়বার জন্যে নয়। সমাজের সার্থকতাকে সমাজের চোখের সামনে সর্বদা প্রত্যক্ষ করে রাখবার জন্যে ব্রাহ্মণকে চাই। এই ব্রাহ্মণের আদর্শকে আমরা যত বড়ো করে অনুভব করব ব্রাহ্মণের সম্মানকে তত বড়ো করে তুলতে হবে। সে সম্মান রাজার সম্মানের চেয়ে অনেক বেশি– সে সম্মান দেবতারই সম্মান। এ দেশে ব্রাহ্মণ যখন সেই সম্মানের যথার্থ অধিকারী হবে তখন এ দেশকে কেউ অপমানিত করতে পারবে না। আমরা কি রাজার কাছে মাথা হেঁট করি, অত্যাচারীর বন্ধন গলায় পরি? নিজের ভয়ের কাছে আমাদের মাথা নত, নিজের লোভের জালে আমরা জড়িয়ে আছি, নিজের মূঢ়তার কাছে আমরা দাসানুদাস। ব্রাহ্মণ তপস্যা করুন; সেই ভয় থেকে, লোভ থেকে, মূঢ়তা থেকে আমাদের মুক্ত করুন। আমরা তাঁদের কাছ থেকে যুদ্ধ চাই নে, বাণিজ্য চাই নে, আর কোনো প্রয়োজন চাই নে– তাঁরা আমাদের সমাজের মাঝখানে মুক্তির সাধনাকে সত্য করে তুলুন।

পরেশবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, “ভারতবর্ষকে যে আমি জানি তা বলতে পারি নে এবং ভারতবর্ষ যে কী চেয়েছিলেন এবং কোনোদিন তা পেয়েছিলেন কি না তা আমি নিশ্চয় জানি নে, কিন্তু যে দিন চলে গেছে সেই দিনে কি কখনো ফিরে পাওয়া যায়? বর্তমানে যা সম্ভব তাই আমাদের সাধনার বিষয়–অতীতের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলে কি কোনো কাজ হবে?”

বিনয় কহিল, “আপনি যেমন বলেছেন আমিও ঐরকম করে ভেবেছি এবং অনেক বার বলেওছি–গোরা বলে যে, অতীতকে বলে বরখাস্ত করে বসে আছি বলেই কি সে অতীত? বর্তমানের হাঁকডাকের আড়ালে পড়ে সে আমাদের দৃষ্টির অতীত হয়েছে বলেই অতীত নয়–সে ভারতবর্ষের মজ্জার মধ্যে রয়েছে। কোনো সত্য কোনোদিনই অতীত হতে পারে না। সেইজন্যই ভারতবর্ষের এই সত্য আমাদের আঘাত করতে আরম্ভ করেছে। একদিন একে যদি আমাদের একজনও সত্য বলে চিনতে ও গ্রহণ করতে পারে তা হলেই আমাদের শক্তির খনির দ্বারে প্রবেশের পথ খুলে যাবে–অতীতের ভাণ্ডার বর্তমানের সামগ্রী হয়ে উঠবে। আপনি কি মনে করছেন ভারতবর্ষের কোথাও সেরকম সার্থকজন্মা লোকের আবির্ভাব হয় নি?”

সুচরিতা কহিল, “আপনি যেরকম করে এ-সব কথা বলছেন ঠিক সাধারণ লোকে এরকম করে বলে না–সেইজন্যে আপনাদের মতকে সমস্ত দেশের জিনিস বলে ধরে নিতে মনে সংশয় হয়।”

বিনয় কহিল, “দেখুন, সূর্যের উদয় ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকেরা একরকম করে ব্যাখ্যা করে, আবার সাধারণ লোকে আর-এক রকম করে ব্যাখ্যা করে। তাতে সূর্যের উদয়ের বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। তবে কিনা সত্যকে ঠিকমতো করে জানার দরুন আমাদের একটা লাভ আছে। দেশের যে-সকল সত্যকে আমরা খণ্ডিত করে বিক্ষিপ্ত করে দেখি গোরা তার সমস্তকে এক করে সংশ্লিষ্ট করে দেখতে পায়, গোরার সেই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে–কিন্তু সেইজন্যই কি গোরার সেই দেখাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে মনে করবেন? আর যারা ভেঙে চুরে দেখে তাদের দেখাটাই সত্য?”

সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। বিনয় কহিল, “আমাদের দেশে সাধারণত যে-সকল লোক নিজেকে পরম হিন্দু বলে অভিমান করে আমার বন্ধু গোরাকে আপনি সে দলের লোক বলে মনে করবেন না। আপনি যদি ওর বাপ কৃষ্ণদয়ালবাবুকে দেখতেন তা হলে বাপ ও ছেলের তফাত বুঝতে পারতেন। কৃষ্ণদয়ালবাবু সর্বদাই কাপড় ছেড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে নিজেকে সুপবিত্র করে রাখবার জন্যে অহরহ ব্যস্ত হয়ে আছেন–রান্না সম্বন্ধে খুব ভালো বামুনকেও তিনি বিশ্বাস করেন না, পাছে তার ব্রাহ্মণত্বে কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে–গোরাকে তাঁর ঘরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেন না–কখনো যদি কাজের খাতিরে তাঁর স্ত্রীর মহলে আসতে হয়, তা হলে ফিরে গিয়ে নিজেকে শোধন করে নেন; পৃথিবীতে দিনরাত অত্যন্ত আলগোছে আছেন পাছে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে কোনো দিক থেকে নিয়মভঙ্গের কণামাত্র ধুলো তাঁকে স্পর্শ করে–ঘোর বাবু যেমন রোদ কাটিয়ে, ধুলো বাঁচিয়ে, নিজের রঙের জেল্লা, চুলের বাহার, কাপড়ের পারিপাট্য রক্ষা করতে সর্বদা ব্যস্ত হয়ে থাকে সেইরকম। গোরা এরকমই নয়। সে হিঁদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না, কিন্তু সে অমন খুঁটে খুঁটে চলতে পারে না–সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এবং খুব বড়ো রকম করে দেখে, সে কোনোদিন মনেও করে না যে হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতান্ত শৌখিন প্রাণ–অল্প একটু ছোঁয়াছুঁয়িতেই শুকিয়ে যায়, ঠোকাঠেকিতেই মারা পড়ে।”

সুচরিতা। কিন্তু তিনি তো খুব সাবধানে ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলেন বলেই মনে হয়।

বিনয়। তার ঐ সতর্কতাটা একটা অদ্ভুত জিনিস। তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় সে তখনই বলে হাঁ, আমি এ-সমস্তই মানি–ছুঁলে জাত যায়, খেলে পাপ হয়, এ-সমস্তই অভ্রান্ত সত্য। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, এ কেবল ওর গায়ের জোরের কথা–এ-সব কথা যতই অসংগত হয় ততই ও যেন সকলকে শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলে। পাছে বর্তমান হিন্দুয়ানির সামান্য কথাটাকেও অস্বীকার করলে অন্য মূঢ় লোকের কাছে হিন্দুয়ানির বড়ো জিনিসেরও অসম্মান ঘটে এবং যারা হিন্দুয়ানিকে অশ্রদ্ধা করে তারা সেটাকে নিজের জিত বলে গণ্য করে, এইজন্যে গোরা নির্বিচারে সমস্তই মেনে চলতে চায়–আমার কাছেও এ সম্বন্ধে কোনো শৈথিল্য প্রকাশ করতে চায় না।

পরেশবাবু কহিলেন, “ব্রাহ্মদের মধ্যেও এরকম লোক অনেক আছে। তারা হিন্দুয়ানির সমস্ত সংস্রবই নির্বিচারে পরিহার করতে চায়, পাছে বাইরের কোনো লোক ভুল করে যে তারা হিন্দুধর্মের কুপ্রথাকেও স্বীকার করে। এ-সকল লোক পৃথিবীতে বেশ সহজভাবে চলতে পারে না–এরা হয় ভান করে, নয় বাড়াবাড়ি করে; মনে করে সত্য দুর্বল, এবং সত্যকে কেবল কৌশল করে কিম্বা জোর করে রক্ষা করা যেন কর্তব্যের অঙ্গ। “আমার উপরে সত্য নির্ভর করছে, সত্যের উপরে আমি নির্ভর করছি নে’ এইরকম যাদের ধারণা তাদেরই বলে গোঁড়া। সত্যের জোরকে যারা বিশ্বাস করে নিজেদের জবরদস্তিকে তারা সংযত রাখে। বাইরের লোকে দু-দিন দশ-দিন ভুল বুঝলে সামান্যই ক্ষতি, কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র সংকোচে সত্যকে স্বীকার না করতে পারলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি। আমি ঈশ্বরের কাছে সর্বদাই এই প্রার্থনা করি যে, ব্রাহ্মের সভাতেই হোক আর হিন্দুর চণ্ডীমণ্ডপেই হোক আমি যেন সত্যকে সর্বত্রই নতশিরে অতি সহজেই বিনা বিদ্রোহে প্রণাম করতে পারি– বাইরের কোনো বাধা আমাকে যেন আটক করে না রাখতে পারে।”

এই বলিয়া পরেশবাবু স্তব্ধ হইয়া আপনার মনকে যেন আপনার অন্তরে ক্ষণকালের জন্য সমাধান করিলেন। পরেশবাবু মৃদুস্বরে এই-যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা এতক্ষণের সমস্ত আলোচনার উপরে যেন একটা বড়ো সুর আনিয়া দিল–সে সুর যে ঐ কয়টি কথার সুর তাহা নহে, তাহা পরেশবাবুর নিজের জীবনের একটি প্রশান্ত গভীরতার সুর। সুচরিতার এবং ললিতার মুখে একটি আনন্দিত ভক্তির দীপ্তি আলো ফেলিয়া গেল। বিনয় চুপ করিয়া রহিল। সেও মনে মনে জানিত গোরার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জবরদস্তি আছে–সত্যের বাহকদের বাক্যে মনে ও কর্মে যে একটি সহজ ও সরল শান্তি থাকা উচিত তাহা গোরার নাই–পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে কথা তাহার মনে যেন আরো স্পষ্ট করিয়া আঘাত করিল। অবশ্য, বিনয় এতদিন গোরার পক্ষে এই বলিয়া মনে মনে তর্ক করিয়াছে যে, সমাজের অবস্থা যখন টলমল, বাহিরের দেশকালের সঙ্গে যখন বিরোধ বাধিয়াছে, তখন সত্যের সৈনিকরা স্বাভাবিকতা রক্ষা করিতে পারে না– তখন সাময়িক প্রয়োজনের আকর্ষণে সত্যের মধ্যেও ভাঙচুর আসিয়া পড়ে। আজ পরেশবাবুর কথায় বিনয় ক্ষণকালের জন্য মনে প্রশ্ন করিল যে, সাময়িক প্রয়োজন-সাধনের লুব্ধতায় সত্যকে ক্ষুব্ধ করিয়া তোলা সাধারণ লোকের পক্ষেই স্বাভাবিক, কিন্তু তাহার গোরা কি সেই সাধারণ লোকের দলে?

সুচরিতা রাত্রে বিছানায় আসিয়া শুইলে পর ললিতা তাহার খাটের এক ধারে আসিয়া বসিল। সুচরিতা বুঝিল, ললিতার মনের ভিতর একটা কোনো কথা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কথাটা যে বিনয়ের সম্বন্ধে তাহাও সুচরিতা বঝিয়াছিল।

সেইজন্য সুচরিতা আপনি কথা পাড়িল, “বিনয়বাবুকে কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে।”

ললিতা কহিল, “তিনি কিনা কেবলই গৌরবাবুর কথাই বলেন, সেইজন্য তোমার ভালো লাগে।”

সুচরিতা এ কথাটার ভিতরকার ইঙ্গিতটা বুঝিয়াও বুঝিল না। সে একটা সরল ভাব ধারণ করিয়া কহিল, “তা সত্য, ওঁর মুখ থেকে গৌরবাবুর কথা শুনতে আমার ভারি আনন্দ হয়। আমি যেন তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাই।”

ললিতা কহিল, “আমার তো কিছু ভালো লাগে না–আমার রাগ ধরে।”

সুচরিতা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “কেন?”

ললিতা কহিল, “গোরা, গোরা, গোরা, দিনরাত্রি কেবল গোরা! ওঁর বন্ধু গোরা হয়তো খুব মস্ত লোক, বেশ তো, ভালোই তো–কিন্তু উনিও তো মানুষ।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “তা তো বটেই, কিন্তু তার ব্যাঘাত কি হয়েছে?”

ললিতা। ওঁর বন্ধু ওঁকে এমনি ঢেকে ফেলেছেন যে উনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। যেন কাঁচপোকায় তেলাপোকাকে ধরেছে–ওরকম অবস্থায় কাঁচপোকার উপরেও আমার রাগ ধরে, তেলাপোকার উপরেও আমার শ্রদ্ধা হয় না।

ললিতার কথার ঝাঁজ দেখিয়া সুচরিতা কিছু না বলিয়া হাসিতে লাগিল।

ললিতা কহিল, “দিদি, তুমি হাসছ, কিন্ত আমি তোমাকে বলছি, আমাকে যদি কেউ ওরকম করে চাপা দিতে চেষ্টা করত আমি তাকে একদিনের জন্যেও সহ্য করতে পারতুম না। এই মনে করো, তুমি–লোকে যাই মনে করুক তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখ নি–তোমার সেরকম প্রকৃতিই নয়–সেইজন্যেই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। আসল, বাবার কাছে থেকে তোমার ঐ শিক্ষা হয়েছে–তিনি সব লোককেই তার জায়গাটুকু ছেড়ে দেন।”

এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতা এবং ললিতা পরেশবাবুর পরম ভক্ত–বাবা বলিতেই তাহাদের হৃদয় যেন স্ফীত হইয়া উঠে।

সুচরিতা কহিল, “বাবার সঙ্গে কি আর কারো তুলনা হয়? কিন্তু যাই বল ভাই, বিনয়বাবু ভারি চমৎকার করে বলতে পারেন।”

ললিতা। ওগুলো ঠিক ওঁর মনের কথা নয় বলেই অত চমৎকার করে বলেন। যদি নিজের কথা বলতেন তা হলে বেশ দিব্যি সহজ কথা হত; মনে হত না যে ভেবে ভেবে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। চমৎকার কথার চেয়ে সে আমার ঢের ভালো লাগে।

সুচরিতা। তা, রাগ করিস কেন ভাই? গৌরমোহনবাবুর কথাগুলো ওঁর নিজেরই কথা হয়ে গেছে।

ললিতা। তা যদি হয় তো সে ভারি বিশ্রী–ঈশ্বর কি বুদ্ধি দিয়েছেন পরের কথা ব্যাখ্যা করবার আর মুখ দিয়েছেন পরের কথা চমৎকার করে বলবার জন্যে? অমন চমৎকার কথায় কাজ নেই।

সুরচিতা। কিন্তু এটা তুই বুঝছিস নে কেন যে বিনয়বাবু গৌরমোহনবাবুকে ভালোবাসেন–তাঁর সঙ্গে ওঁর মনের সত্যিকার মিল আছে।

ললিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, না, না, সম্পূর্ণ মিল নেই। গৌরমোহনবাবুকে মেনে চলা ওঁর অভ্যাস হয়ে গেছে–সেটা দাসত্ব, সে ভালোবাসা নয়। অথচ উনি জোর করে মনে করতে চান যে তাঁর সঙ্গে ওঁর ঠিক এক মত, সেইজন্যেই তাঁর মতগুলিকে উনি অত চেষ্টা করে চমৎকার করে বলে নিজেকে ও অন্যকে ভোলাতে ইচ্ছা করেন। উনি কেবলই নিজের মনের সন্দেহকে বিরোধকে চাপা দিয়ে চলতে চান, পাছে গৌরমোহনবাবুকে না মানতে হয়। তাঁকে না মানবার সাহস ওঁর নেই। ভালোবাসা থাকলে মতের সঙ্গে না মিললেও মানা যেতে পারে–অন্ধ না হয়েও নিজেকে ছেড়ে দেওয়া যায়–ওঁর তো তা নয়–উনি গৌরমোহনবাবুকে মানছেন হয়তো ভালোবাসা থেকে, অথচ কিছুতে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না। ওঁর কথা শুনলেই সেটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। আচ্ছা দিদি, তুমি বোঝ নি? সত্যি বলো।”

সুচরিতা ললিতার মতো এ কথা এমন করিয়া ভাবেই নাই। কারণ, গোরাকে সম্পূর্ণরূপে জানিবার জন্যই তাহার কৌতূহল ব্যগ্র হইয়াছিল–বিনয়কে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিবার জন্য তাহার আগ্রহই ছিল না। সুচরিতা ললিতার প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, তোর কথাই মেনে নেওয়া গেল–তা কী করতে হবে বল্‌।”

ললিতা। আমার ইচ্ছা করে ওঁর বন্ধুর বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওঁকে স্বাধীন করে দিতে।

সুচরিতা। চেষ্টা করে দেখ্‌-না ভাই।

ললিতা। আমার চেষ্টায় হবে না–তুমি একটু মনে করলেই হয়।

সুচরিতা যদিও ভিতরে ভিতরে বুঝিয়াছিল যে, বিনয় তাহার প্রতি অনুরক্ত তবু সে ললিতার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিল।

ললিতা কহিল, “গৌরমোহনবাবুর শাসন কাটিয়েও উনি যে তোমার কাছে এমন করে ধরা দিতে আসছেন তাতেই আমার ওঁকে ভালো লাগে; ওঁর অবস্থার কেউ হলে ব্রাহ্ম-মেয়েদের গাল দিয়ে নাটক লিখত–ওঁর মন এখনো খোলসা আছে, তোমাকে ভালোবাসেন আর বাবাকে ভক্তি করেন এই তার প্রমাণ। বিনয়বাবুকে ওঁর নিজের ভাবে খাড়া করিয়ে দিতে হবেই দিদি। উনি যে কেবলই গৌরমোহনবাবুকে প্রচার করতে থাকেন সে আমার অসহ্য বোধ হয়।”

এমন সময় “দিদি দিদি” করিয়া সতীশ ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিনয় তাহাকে আজ গড়ের মাঠে সার্কাস দেখাইতে লইয়া গিয়াছিল। যদিও অনেক রাত্রি হইয়াছিল তবু তাহার এই প্রথম সার্কাস দেখার উৎসাহ সে সম্বরণ করিতে পারিতেছিল না। সার্কাসের বর্ণনা করিয়া সে কহিল, “বিনয়বাবুকে আজ আমার বিছানায় ধরে আনছিলুম। তিনি বাড়িতে ঢুকেছিলেন, তার পরে আবার চলে গেলেন। বললেন কাল আসবেন। দিদি, আমি তাঁকে বলেছি তোমাদের একদিন সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতে।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি তাতে কী বললেন?”

সতীশ কহিল, “তিনি বললেন, মেয়েরা বাঘ দেখলে ভয় করবে। আমার কিন্তু কিছু ভয় হয় নি।” বলিয়া সতীশ পৌরুষ-অভিমানে বুক ফুলাইয়া বসিল।

ললিতা কহিল, “তা বৈকি! তোমার বন্ধু বিনয়বাবুর সাহস যে কত বড়ো তা বেশ বুঝতে পারছি। না ভাই দিদি, আমাদের সঙ্গে করে ওঁকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতেই হবে।”

সতীশ কহিল, “কাল যে দিনের বেলায় সার্কাস হবে।”

ললিতা কহিল, “সেই তো ভালো। দিনের বেলাতেই যাব।”

পরদিন বিনয় আসিতেই ললিতা বলিয়া উঠিল, “এই-যে ঠিক সময়েই বিনয়বাবু এসেছেন। চলুন।”

বিনয়। কোথায় যেতে হবে?

ললিতা। সার্কাসে।

সার্কাসে! দিনের বেলায় এক-তাঁবু লোকের সামনে মেয়েদের লইয়া সার্কাসে যাওয়া! বিনয় তো হতবুদ্ধি হইয়া গেল।

ললিতা কহিল, “গৌরমোহনবাবু বুঝি রাগ করবেন?”

ললিতার এই প্রশ্নে বিনয় একটু চকিত হইয়া উঠিল।

ললিতা আবার কহিল, “সার্কাসে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া সম্বন্ধে গৌরমোহনবাবুর একটা মত আছে?”

বিনয় কহিল, “নিশ্চয় আছে।”

ললিতা। সেটা কী রকম আপনি ব্যাখ্যা করে বলুন। আমি দিদিকে ডেকে নিয়ে আসি, তিনিও শুনবেন!

বিনয় খোঁচা খাইয়া হাসিল। ললিতা কহিল, “হাসছেন কেন বিনয়বাবু। আপনি কাল সতীশকে বলেছিলেন মেয়েরা বাঘকে ভয় করে–আপনি কাউকে ভয় করেন না নাকি?”

ইহার পরে সেদিন মেয়েদের লইয়া বিনয় সার্কাসে গিয়াছিল। শুধু তাই নয়, গোরার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটা ললিতার এবং সম্ভবত এ বাড়ির অন্য মেয়েদের কাছে কিরূপ ভাবে প্রতিভাত হইয়াছে সে কথাটাও বার বার তাহার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল।

তাহার পরে যেদিন বিনয়ের সঙ্গে দেখা হইল ললিতা যেন নিরীহ কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিল, “গৌরমোহনবাবুকে সেদিনকার সার্কাসের গল্প বলেছেন?

এ প্রশ্নের খোঁচা বিনয়কে গভীর করিয়া বাজিল–কেননা তাহাকে কর্ণমূল রক্তবর্ণ করিয়া বলিতে হইল, “না, এখনো বলা হয় নি।”

লাবণ্য আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “বিনয়বাবু আসুন-না।”

ললিতা কহিল, “কোথায়? সার্কাসে নাকি?”

লাবণ্য কহিল, “বাঃ, আজ আবার সার্কাস কোথায়? আমি ডাকছি আমার রুমালের চার ধারে পেন্‌সিল দিয়ে একটা পাড় এঁকে দিতে–আমি সেলাই করব। বিনয়বাবু কী সুন্দর আঁকতে পারেন!”

লাবণ্য বিনয়কে ধরিয়া লইয়া গেল।

 গোরা ১৯

১৯

সকালবেলায় গোরা কাজ করিতেছিল। বিনয় খামকা আসিয়া অত্যন্ত খাপছাড়াভাবে কহিল, “সেদিন পরেশবাবুর মেয়েদের নিয়ে আমি সার্কাস দেখতে গিয়েছিলুম।”

গোরা লিখিতে লিখিতেই বলিল, “শুনেছি।”

বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “তুমি কার কাছে শুনলে?”

গোরা। অবিনাশের কাছে। সেও সেদিন সার্কাস দেখতে গিয়েছিল।

গোরা আর কিছু না বলিয়া লিখিতে লাগিল। গোরা এ খবরটা আগেই শুনিয়াছে, সেও আবার অবিনাশের কাছ হইতে শুনিয়াছে, সুতরাং তাহাতে বর্ণনা ও ব্যাখ্যার কোনো অভাব ঘটে নাই–ইহাতে তাহার চিরসংস্কারবশত বিনয় মনের মধ্যে ভারি একটা সংকোচ বোধ করিল। সার্কাসে যাওয়া এবং এ কথাটা এমন করিয়া লোকসমাজে না উঠিলেই সে খুশি হইত।

এমন সময়ে তাহার মনে পড়িয়া গেল কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত না ঘুমাইয়া সে মনে মনে ললিতার সঙ্গে ঝগড়া করিয়াছে। ললিতা মনে করে সে গোরাকে ভয় করে এবং ছোটো ছেলে যেমন করিয়া মাস্টারকে মানে তেমনি করিয়াই সে গোরাকে মানিয়া চলে। এমন অন্যায় করিয়াও মানুষকে মানুষ ভুল বুঝিতে পারে! গোরা বিনয় যে একাত্মা; অসামান্যতাগুণে গোরার উপরে তাহার একটা ভক্তি আছে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া ললিতা যে-রকমটা মনে করিয়াছে সেটা গোরার প্রতিও অন্যায় বিনয়ের প্রতিও অন্যায়। বিনয় নাবালক নয় এবং গোরাও নাবলকের অছি নহে।

গোরা নিঃশব্দে লিখিয়া যাইতে লাগিল, আর ললিতার মুখের সেই তীক্ষ্ণগ্র গুটি দুই-তিন প্রশ্ন বার বার বিনয়ের মনে পড়িল। বিনয় তাহাকে সহজে বরখাস্ত করিতে পারিল না।

দেখিতে দেখিতে বিনয়ের মনে একটা বিদ্রোহ মাথা তুলিয়া উঠিল। “সার্কাস দেখিতে গিয়াছি তো কী হইয়াছে! অবিনাশ কে, যে, সে সেই কথা লইয়া গোরার সঙ্গে আলোচনা করিতে আসে–এবং গোরাই বা কেন আমার গতিবিধি সম্বন্ধে সেই অকালকুষ্মাণ্ডের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেয়! আমি কি গোরার নজরবন্দী! কাহার সঙ্গে মিশিব, কোথায় যাইব, গোরার কাছে তাহার জবাবদিহি করিতে হইবে! বন্ধুত্বের প্রতি এ যে বিষম উপদ্রব।’

গোরা ও অবিনাশের উপর বিনয়ের এত রাগ হইত না যদি সে নিজের ভীরুতাকে নিজের মধ্যে সহসা স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি না করিত। গোরার কাছে যে সে কোনো কথা ক্ষণকালের জন্যও ঢাকাঢাকি করিতে বাধ্য হইয়াছে সেজন্য সে আজ মনে মনে যেন গোরাকেই অপরাধী করিতে চেষ্টা করিতেছে। সার্কাসে যাওয়া লইয়া গোরা যদি বিনয়ের সঙ্গে দুটো ঝগড়ার কথা বলিত তাহা হইলেও সেটাতে বন্ধুত্বের সাম্য রক্ষিত হইত এবং বিনয় সান্ত্বনা পাইত–কিন্তু গোরা যে গম্ভীর হইয়া মস্ত বিচারক সাজিয়া মৌনর দ্বারা বিনয়কে অবজ্ঞা করিবে ইহাতে ললিতার কথার কাঁটা তাহাকে পুনঃপুনঃ বিঁধিতে লাগিল।

এই সময় মহিম হুঁকা হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ডিবা হইতে ভিজা ন্যাকড়ার আবরণ তুলিয়া একটা পান বিনয়ের হাতে দিয়া কহিলেন, “বাবা বিনয়, এ দিকে তো সমস্ত ঠিক–এখন তোমার খুড়োমশায়ের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেলেই যে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তাঁকে তুমি চিঠি লিখেছ তো?”

এই বিবাহের তাগিদ আজ বিনয়কে অত্যন্ত খারাপ লাগিল, অথচ সে জানিত মহিমের কোনো দোষ নাই–তাঁহাকে কথা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এই কথা দেওয়ার মধ্যে সে একটা দীনতা অনুভব করিল। আনন্দময়ী তো তাহাকে একপ্রকার বারণ করিয়াছিলেন–তাহার নিজেরও তো এ বিবাহের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না–তবে গোলেমালে ক্ষণকালের মধ্যেই এ কথাটা পাকিয়া উঠিল কী করিয়া? গোরা যে ঠিক তাড়া লাগাইয়াছিল তাহা তো বলা যায় না। বিনয় যদি একটু মনের সঙ্গে আপত্তি করিত তাহা হইলেও যে গোরা পীড়াপীড়ি করিত তাহা নহে। কিন্তু তবু! সেই তবুটুকুর উপরেই ললিতার খোঁচা আসিয়া বিঁধিতে লাগিল। সেদিনকার কোনো বিশেষ ঘটনা নহে, কিন্তু অনেক দিনের প্রভুত্ব ইহার পশ্চাতে আছে। বিনয় নিতান্তই কেবল ভালোবাসিয়া এবং একান্ত ভালোমানুষি-বশত গোরার আধিপত্য অনায়াসে সহ্য করিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। সেইজন্যেই এই প্রভুত্বের সম্বন্ধই বন্ধুত্বের মাথার উপর চড়িয়া বসিয়াছে। এতদিন বিনয় ইহা অনুভব করে নাই, কিন্তু আর তো ইহাকে অস্বীকার করিয়া চলে না। তবে শশিমুখীকে কি বিবাহ করিতেই হইবে?

বিনয় কহিল, “না, খুড়োমশায়কে এখনো চিঠি লেখা হয় নি।”

মহিম কহিলেন, “ওটা আমারই ভুল হয়েছে। এ চিঠি তো তোমার লেখবার কথা নয়–ও আমিই লিখব। তাঁর পুরো নামটা কী বলো তো বাবা।”

বিনয় কহিল, “আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আশ্বিন-কার্তিকে তো বিবাহ হতেই পারবে না। এক অঘ্রান মাস–কিন্তু তাতেও গোল আছে। আমাদের পরিবারের ইতিহাসে বহুপূর্বে অঘ্রান মাসে কবে কার কী দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অবধি আমাদের বংশে অঘ্রানে বিবাহ প্রভৃতি সমস্ত শুভকর্ম বন্ধ আছে।”

মহিম হুঁকোটা ঘরের কোণের দেয়ালে ঠেস দিয়া রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়, তোমরা যদি এ-সমস্ত মানবে তবে লেখাপড়া শেখাটা কি কেবল পড়া মুখস্থ করে মরা? একে তো পোড়া দেশে শুভদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না, তার পরে আবার ঘরে ঘরে প্রাইভেট পাঁজি খুলে বসলে কাজকর্ম চলবে কী করে?”

বিনয় কহিল, “আপনি ভাদ্র-আশ্বিন মাসই বা মানেন কেন?”

মহিম কহিলেন, “আমি মানি বুঝি! কোনোকালেই না। কী করব বাবা–এ মুলুকে ভগবানকে না মানলেও বেশ চলে যায়, কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিন বৃহস্পতি-শনি তিথি-নক্ষত্র না মানলে যে কোনোমতে ঘরে টিকতে দেয় না। আবার তাও বলি–মানি নে বলছি বটে, কিন্তু কাজ করবার বেলা দিন-ক্ষণের অন্যথা হলেই মনটা অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে– দেশের হাওয়ায় যেমন ম্যালেরিয়া হয় তেমনি ভয়ও হয়, ওটা কাটিয়ে উঠতে পারলুম না।”

বিনয়। আমাদের বংশে অঘ্রানের ভয়টাও কাটবে না। অন্তত খুড়িমা কিছুতেই রাজি হবেন না।

এমনি করিয়া সেদিনকার মতো বিনয় কোনোমতে কথাটা চাপা দিয়া রাখিল।

বিনয়ের কথার সুর শুনিয়া গোরা বুঝিল, বিনয়ের মনে একটা দ্বিধা উপস্থিত হইয়াছে। কিছুদিন হইতে বিনয়ের দেখাই পাওয়া যাইতেছিল না। গোরা বুঝিয়াছিল বিনয় পরেশবাবুর বাড়ি পূর্বের চেয়েও আরো ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছে। তাহার পরে আজ এই বিবাহের প্রস্তাবে পাশ কাটাইবার চেষ্টায় গোরার মনে খটকা বাধিল।

সাপ যেমন কাহাকেও গিলিতে আরম্ভ করিলে তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িতে পারে না। গোরা তেমনি তাহার কোনো সংকল্প ছাড়িয়া দিতে বা তাহার একটু-আধটু বাদ দিতে একেবারে অক্ষম বলিলেই হয়। অপর পক্ষ হইতে কোনো বাধা অথবা শৈথিল্য উপস্থিত হইলে তাহার জেদ আরো চড়িয়া উঠিতে থাকে। দ্বিধাগ্রস্ত বিনয়কে সবলে ধরিয়া রাখিবার জন্য গোরার সমস্ত অন্তঃকরণ উদ্যত হইয়া উঠিল।

গোরা তাহার লেখা ছাড়িয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “বিনয়, একবার যখন তুমি দাদাকে কথা দিয়েছ তখন কেন ওঁকে অনিশ্চিতের মধ্যে রেখে মিথ্যে কষ্ট দিচ্ছে?”

বিনয় হঠাৎ অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “আমি কথা দিয়েছি–না তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে কথা কেড়ে নেওয়া হয়েছে?”

গোরা বিনয়ের এই অকস্মাৎ বিদ্রোহের লক্ষণ দেখিয়া বিস্মিত এবং কঠিন হইয়া উঠিয়া কহিল, “কথা কে কেড়ে নিয়েছিল?”

বিনয় কহিল, “তুমি।”

গোরা। আমি! তোমার সঙ্গে এ সম্বন্ধে আমার পাঁচ-সাতটার বেশি কথাই হয় নি–তাকে বলে কথা কেড়ে নেওয়া!

বস্তুত বিনয়ের পক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ কিছুই ছিল না–গোরা যাহা বলিতেছে তাহা সত্য– কথা অল্পই হইয়াছিল এবং তাহার মধ্যে এমন কিছু বেশি তাগিদ ছিল না যাহাকে পীড়াপীড়ি বলা চলে–তবুও এ কথা সত্য, গোরাই বিনয়ের কাছ হইতে তাহার সম্মতি যেন লুঠ করিয়া লইয়াছিল। যে কথার বাহ্য প্রমাণ অল্প সেই অভিযোগ সম্বন্ধে মানুষের ক্ষোভও কিছু বেশি হইয়া থাকে। তাই বিনয় কিছু অসংগত রাগের সুরে বলিল, “কেড়ে নিতে বেশি কথার দরকার করে না।”

গোরা টেবিল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “নাও, তোমার কথা ফিরিয়ে দাও। তোমার কাছ থেকে ভিক্ষে করেই নেব না দস্যুবৃত্তি করেই নেব এতবড়ো মহামূল্য কথা এটা নয়।”

পাশের ঘরেই মহিম ছিলেন–গোরা বজ্রস্বরে তাঁহাকে ডাকিল, “দাদা!”

মহিম শশব্যস্ত হইয়া ঘরে আসিতেই গোরা কহিল, “দাদা, আমি তোমাকে গোড়াতেই বলি নি যে শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ হতে পারে না–আমার তাতে মত নেই!”

মহিম। নিশ্চয় বলেছিলে। তুমি ছাড়া এমন কথা আর কেউ বলতে পারত না। অন্য কোনো ভাই হলে ভাইঝির বিবাহপ্রস্তাবে প্রথম থেকেই উৎসাহ প্রকাশ করত।

গোরা। তুমি কেন আমাকে দিয়ে বিনয়ের কাছে অনুরোধ করালে?

মহিম। মনে করেছিলুম তাতে কাজ পাওয়া যাবে, আর কোনো কারণ নেই।

গোরা মুখ লাল করিয়া বলিল, “আমি এ-সবের মধ্যে নেই। বিবাহের ঘটকালি করা আমার ব্যবসায় নয়, আমার অন্য কাজ আছে।”

এই বলিয়া গোরা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হতবুদ্ধি মহিম বিনয়কে এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করিবার পূর্বেই সেও একেবারে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। মহিম দেওয়ালের কোণ হইতে হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া টান দিতে লাগিলেন।

গোরার সঙ্গে বিনয়ের ইতিপূর্বে অনেক দিন অনেক ঝগড়া হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এমন আকস্মিক প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের মতো ব্যাপার আর কখনো হয় নাই। বিনয় নিজের কৃত কর্মে প্রথমটা স্তম্ভিত হইয়া গেল। তাহার পরে বাড়ি গিয়া তাহার বুকের মধ্যে শেল বিঁধিতে লাগিল। এই ক্ষণকালের মধ্যেই গোরাকে সে যে কত বড়ো একটা আঘাত দিয়াছে তাহা মনে করিয়া তাহার আহারে বিশ্রামে রুচি রহিল না। বিশেষত এ ঘটনায় গোরাকে দোষী করা যে নিতান্তই অদ্ভুত ও অসংগত হইয়াছে ইহাই তাহাকে দগ্ধ করিতে লাগিল; সে বার বার বলিল, “অন্যায়, অন্যায়, অন্যায়!”

বেলা দুইটার সময় আনন্দময়ী সবে যখন আহার সারিয়া সেলাই লইয়া বসিয়াছেন এমন সময় বিনয় আসিয়া তাঁহার কাছে বসিল। আজ সকালবেলাকার কতকটা খবর তিনি মহিমের কাছ হইতে পাইয়াছিলেন। আহারের সময় গোরার মুখ দেখিয়াও তিনি বুঝিয়াছিলেন, একটা ঝড় হইয়া গেছে।

বিনয় আসিয়াই কহিল, “মা, আমি অন্যায় করেছি। শশিমুখীর সঙ্গে বিবাহের কথা নিয়ে আমি আজ সকালে গোরাকে যা বলেছি তার কোনো মানে নেই।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হোক বিনয়–মনের মধ্যে কোনো একটা ব্যথা চাপতে গেলে ঐরকম করেই বেরিয়ে পড়ে। ও ভালোই হয়েছে। এ ঝগড়ার কথা দুদিন পরে তুমিও ভুলবে, গোরাও ভুলে যাবে।”

বিনয়। কিন্তু, মা, শশিমুখীর সঙ্গে আমার বিবাহে কোনো আপত্তি নেই, সেই কথা আমি তোমাকে জানাতে এসেছি।

আনন্দময়ী। বাছা, তাড়াতাড়ি ঝগড়া মেটাবার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার একটা ঝঞ্ঝাটে পোড়ো না। বিবাহটা চিরকালের জিনিস, ঝগড়া দুদিনের।

বিনয় কোনোমতেই শুনিল না। সে এ প্রস্তাব লইয়া এখনই গোরার কাছে যাইতে পারিল না। মহিমকে গিয়া জানাইল– বিবাহের প্রস্তাবে কোনো বিঘ্ন নাই–মাঘ মাসেই কার্য সম্পন্ন হইবে–খুড়ামহাশয়ের যাহাতে কোনো অমত না হয় সে ভার বিনয় নিজেই লইবে।

মহিম কহিলেন, “পানপত্রটা হয়ে যাক-না।”

বিনয় কহিল, “তা বেশ, সেটা গোরার সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন।”

মহিম ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “আবার গোরার সঙ্গে পরামর্শ!”

বিনয় কহিল, “না, তা না হলে চলবে না।”

মহিম কহিলেন, “না যদি চলে তা হলে তো কথাই নেই–কিন্তু–”

বলিয়া একটা পান লইয়া মুখে পুরিলেন।

গোরা ২০

২০

মহিম সেদিন গোরাকে কিছু না বলিয়া তাহার পরের দিন তাহার ঘরে গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন গোরাকে পুনর্বার রাজি করাইতে বিস্তর লড়ালড়ি করিতে হইবে। কিন্তু তিনি যেই আসিয়া বলিলেন যে বিনয় কাল বিকালে আসিয়া বিবাহ সম্বন্ধে পাকা কথা দিয়া গেছে ও পানপত্র সম্বন্ধে গোরার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে বলিয়াছে, গোরা তখনই নিজের সম্মতি প্রকাশ করিয়া বলিল, “বেশ তো, পানপত্র হয়ে যাক্‌-না।”

মহিম আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “এখন তো বলছ “বেশ তো’। এর পরে আবার বাগড়া দেবে না তো?”

গোরা কহিল, “আমি তো বাধা দিয়ে বাগড়া দিই নি, অনুরোধ করেই বাগড়া দিয়েছি।”

মহিম। অতএব তোমার কাছে আমার মিনতি এই যে, তুমি বাধাও দিয়ো না, অনুরোধও কোরো না। কুরুপক্ষে নারায়ণী সেনাতেও আমার কাজ নেই, আর পাণ্ডবপক্ষে নারায়ণেও আমার দরকার দেখি নে। আমি একলা যা পারি সেই ভালো– ভুল করেছিলুম– তোমার সহায়তাও যে এমন বিপরীত তা আমি পূর্বে জানতুম না। যা হোক, কাজটা হয় এটাতে তোমার ইচ্ছা আছে তো?

গোরা। হাঁ, ইচ্ছা আছে।

মহিম। তা হলে ইচ্ছাই থাক্‌, কিন্তু চেষ্টায় কাজ নেই।

গোরা রাগ করে বটে এবং রাগের মুখে সবই করিতে পারে সেটাও সত্য– কিন্তু সেই রাগকে পোষণ করিয়া নিজের সংকল্প নষ্ট করা তাহার স্বভাব নয়। বিনয়কে যেমন করিয়া হউক সে বাঁধিতে চায়, এখন অভিমানের সময় নহে। গতকল্যকার ঝগড়ার প্রতিক্রিয়ার দ্বারাতেই যে বিবাহের কথাটা পাকা হইল, বিনয়ের বিদ্রোহই যে বিনয়ের বন্ধনকে দৃঢ় করিল, সে কথা মনে করিয়া গোরা কালিকার ঘটনায় মনে মনে খুশি হইল। বিনয়ের সঙ্গে তাহাদের চিরন্তন স্বাভাবিক সম্বন্ধ স্থাপন করিতে গোরা কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। কিন্তু এবার দুজনকার মাঝখানে তাহাদের একান্ত সহজ ভাবের একটুখানি ব্যতিক্রম ঘটিল।

গোরা এবার বুঝিয়াছে দূর হইতে বিনয়কে টানিয়া রাখা শক্ত হইবে– বিপদের ক্ষেত্র যেখানে সেইখানেই পাহারা দেওয়া চাই। গোরা মনে ভাবিল, আমি যদি পরেশবাবুদের বাড়িতে সর্বদা যাতায়াত রাখি তাহা হইলে বিনয়কে ঠিক গণ্ডির মধ্যে ধরিয়া রাখিতে পারিব।

সেই দিনই অর্থাৎ ঝগড়ার পরদিন অপরাহ্নে গোরা বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আজই গোরা আসিবে বিনয় কোনোমতেই এমন আশা করে নাই। সেইজন্যই সে মনে মনে যেমন খুশি তেমনি আশ্চর্য হইয়া উঠিল।

আরো আশ্চর্যের বিষয় গোরা পরেশবাবুদের মেয়েদের কথাই পাড়িল, অথচ তাহার মধ্যে কিছুমাত্র বিরূপতা ছিল না। এই আলোচনায় বিনয়কে উত্তেজিত করিয়া তুলিতে বেশি চেষ্টার প্রয়োজন করে না।

সুচরিতার সঙ্গে বিনয় যে-সকল কথার আলোচনা করিয়াছে তাহা আজ সে বিস্তারিত করিয়া গোরাকে বলিতে লাগিল। সুচরিতা যে বিশেষ আগ্রহের সহিত এ-সকল প্রসঙ্গ আপনি উত্থাপিত করে এবং যতই তর্ক করুক-না কেন মনের অলক্ষ্য দেশে সে যে ক্রমশই অল্প অল্প করিয়া সায় দিতেছে, এ কথা জানাইয়া গোরাকে বিনয় উৎসাহিত করিবার চেষ্টা করিল।

বিনয় গল্প করিতে করিতে কহিল, “নন্দর মা ভূতের ওঝা এনে নন্দকে কী করে মেরে ফেলেছে এবং তাই নিয়ে তোমার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল তাই যখন বলছিলুম তখন তিনি বললেন, “আপনারা মনে করেন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে মেয়েদের রাঁধতে-বাড়তে আর ঘর নিকোতে দিলেই তাদের সমস্ত কর্তব্য হয়ে গেল। এক দিকে এমনি করে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি সমস্ত খাটো করে রেখে দেবেন, তার পরে যখন তারা ভূতের ওঝা ডাকে তখনো আপনারা রাগ করতে ছাড়বেন না। যাদের পক্ষে দুটি-একটি পরিবারের মধ্যেই সমস্ত বিশ্বজগৎ তারা কখনোই সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারে না– এবং তারা মানুষ না হলেই পুরুষের সমস্ত বড়ো কাজকে নষ্ট করে অসম্পূর্ণ করে পুরুষকে তারা নীচের দিকে ভারাক্রান্ত করে নিজেদের দুর্গতির শোধ তুলবেই। নন্দর মাকে আপনারা এমন করে গড়েছেন এবং এমন জায়গায় ঘিরে রেখেছেন যে, আজ প্রাণের দায়েও আপনারা যদি তাকে সুবুদ্ধি দিতে চান তো সেখানে গিয়ে পৌঁছবেই না।’ আমি এ নিয়ে তর্ক করবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সত্য বলছি গোরা, মনে মনে তাঁর সঙ্গে মতের মিল হওয়াতে আমি জোরের সঙ্গে তর্ক করতে পারি নি। তাঁর সঙ্গে তবু তর্ক চলে, কিন্তু ললিতার সঙ্গে তর্ক করতে আমার সাহস হয় না। ললিতা যখন ভ্রূ তুলে বললেন, “আপনারা মনে করেন, জগতের কাজ আপনারা করবেন, আর আপনাদের কাজ আমরা করব! সেটি হবার জো নেই। জগতের কাজ হয় আমরাও চালাব, নয় আমরা বোঝা হয়ে থাকব; আমরা যদি বোঝা হই– তখন রাগ করে বলবেন : পথে নারী বিবর্জিতা! কিন্তু নারীকেও যদি চলতে দেন, তা হলে পথেই হোক আর ঘরেই হোক নারীকে বিবর্জন করার দরকার হয় না।’ তখন আমি আর কোনো উত্তর না করে চুপ করে রইলুম। ললিতা সহজে কথা কন না, কিন্তু যখন কন তখন খুব সাবধানে উত্তর দিতে হয়। যাই বল গোরা, আমারও মনে খুব বিশ্বাস হয়েছে যে আমাদের মেয়েরা যদি চীন-রমণীদের পায়ের মতো সংকুচিত হয়ে থাকে তা হলে আমাদের কোনো কাজ এগোবে না।”

গোরা। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হবে না, এমন কথা তো আমি কোনোদিন বলি নে।

বিনয়। চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়ালেই বুঝি শিক্ষা দেওয়া হয়?

গোরা। আচ্ছা, এবার থেকে বিনয়বোধ প্রথম ভাগ ধরানো যাবে।

সেদিন দুই বন্ধুতে ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবলই পরেশবাবুর মেয়েদের কথা হইতে হইতে রাত হইয়া গেল।

গোরা একলা বাড়ি ফিরিবার পথে ঐ-সকল কথাই মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল এবং ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ ঘুম না আসিল পরেশবাবুর মেয়েদের কথা মন হইতে তাড়াইতে পারিল না। গোরার জীবনে এ উপসর্গ কোনোকালেই ছিল না, মেয়েদের কথা সে কোনোদিন চিন্তামাত্রই করে নাই। জগদ্‌ব্যাপারে এটাও যে একটা কথার মধ্যে, এবার বিনয় তাহা প্রমাণ করিয়া দিল। ইহাকে উড়াইয়া দিলে চলিবে না, ইহার সঙ্গে হয় আপস নয় লড়াই করিতে হইবে।

পরদিন বিনয় যখন গোরাকে কহিল, “পরেশবাবুর বাড়িতে একবার চলোই-না–অনেকদিন যাও নি– তিনি তোমার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন”, তখন গোরা বিনা আপত্তিতে রাজি হইল। শুধু রাজি হওয়া নহে, তাহার মনের মধ্যে পূর্বের মতো নিরুৎসুক ভাব ছিল না। প্রথমে সুচরিতা ও পরেশবাবুর কন্যাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে গোরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল, তাহার পরে মধ্যে অবজ্ঞাপূর্ণ বিরুদ্ধ ভাব তাহার মনে জন্মিয়াছিল, এখন তাহার মনে একটা কৌতূহলের উদ্রেক হইয়াছে। বিনয়ের চিত্তকে কিসে যে এত করিয়া আকর্ষণ করিতেছে তাহা জানিবার জন্য তাহার মনে একটা বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছে।

উভয়ে যখন পরেশবাবুর বাড়ি গিয়া পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। দোতলার ঘরে একটা তেলের শেজ জ্বালাইয়া হারান তাহার একটা ইংরেজি লেখা পরেশবাবুকে শুনাইতেছিলেন। এ স্থলে পরেশবাবু বস্তুত উপলক্ষমাত্র ছিলেন– সুচরিতাকে শোনানোই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। সুচরিতা টেবিলের দূরপ্রান্তে চোখের উপর হইতে আলো আড়াল করিবার জন্য মুখের সামনে একটা তালপাতার পাখা তুলিয়া ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। সে আপন স্বাভাবিক বাধ্যতাবশত প্রবন্ধটি শুনিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু থাকিয়া থাকিয়া তাহার মন কেবলই অন্য দিকে যাইতেছিল।

এমন সময় চাকর আসিয়া যখন গোরা ও বিনয়ের আগমন-সংবাদ জ্ঞাপন করিল তখন সুচরিতা হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে চৌকি ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই পরেশবাবু কহিলেন, “রাধে, যাচ্ছ কোথায়? আর কেউ নয়, আমাদের বিনয় আর গৌর এসেছে।”

সুচরিতা সংকুচিত হইয়া আবার বসিল। হারানের সুদীর্ঘ ইংরেজি রচনা-পাঠে ভঙ্গ ঘটাতে সুচরিতার আরাম বোধ হইল; গোরা আসিয়াছে শুনিয়া তাহার মনে যে একটা উত্তেজনা হয় নাই তাহাও নহে, কিন্তু হারানবাবুর সম্মুখে গোরার আগমনে তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা অস্বস্তি এবং সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। দুজনে পাছে বিরোধ বাধে এই মনে করিয়া, অথবা কী যে তাহার কারণ তাহা বলা শক্ত।

গৌরের নাম শুনিয়াই হারানবাবুর মনের ভিতরটা একেবারে বিমুখ হইয়া উঠিল। গৌরের নমস্কারে কোনোমতে প্রতিনমস্কার করিয়া তিনি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। হারানকে দেখিবামাত্র গোরার সংগ্রাম করিবার প্রবৃত্তি সশস্ত্রে উদ্যত হইয়া উঠিল।

বরদাসুন্দরী তাঁহার তিন মেয়েকে লইয়া নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন; কথা ছিল সন্ধ্যার সময় পরেশবাবু গিয়া তাঁহাদিগকে ফিরাইয়া আনিবেন। পরেশবাবুর যাইবার সময় হইয়াছে। এমন সময় গোরা ও বিনয় আসিয়া পড়াতে তাঁহার বাধা পড়িল। কিন্তু আর বিলম্ব করা উচিত হইবে না জানিয়া তিনি হারান ও সুচরিতাকে কানে কানে বলিয়া গেলেন, “তোমরা এঁদের নিয়ে একটু বোসো, আমি যত শীঘ্র পারি ফিরে আসছি।”

দেখিতে দেখিতে গোরা এবং হারানবাবুর মধ্যে তুমুল তর্ক বাধিয়া গেল। যে প্রসঙ্গ লইয়া তর্ক তাহা এই– কলিকাতার অনতিদূরবর্তী কোনো জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউন্‌লো সাহেবের সহিত ঢাকায় থাকিতে পরেশবাবুদের আলাপ হইয়াছিল। পরেশবাবুর স্ত্রীকন্যারা অন্তঃপুর হইতে বাহির হইতেন বলিয়া সাহেব এবং তাঁহার স্ত্রী ইঁহাদিগকে বিশেষ খাতির করিতেন। সাহেব তাঁহার জন্মদিনে প্রতি বৎসরে কৃষিপ্রদর্শনী মেলা করিয়া থাকেন। এবারে বরদাসুন্দরী ব্রাউন্‌লো সাহেবের স্ত্রীর সহিত দেখা করিবার সময় ইংরেজি কাব্যসাহিত্য প্রভৃতিতে নিজের কন্যাদের বিশেষ পারদর্শিতার কথা উত্থাপন করাতে মেমসাহেব সহসা কহিলেন, “এবার মেলায় লেফ্‌টেনান্ট্‌ গবর্নর সস্ত্রীক আসিবেন, আপনার মেয়েরা যদি তাঁহাদের সম্মুখে একটা ছোটোখাটো ইংরেজি কাব্যনাট্য অভিনয় করেন তো বড়ো ভালো হয়।’ এই প্রস্তাবে বরদাসুন্দরী অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছেন। আজ তিনি মেয়েদের রিহার্সাল দেওয়াইবার জন্যই কোনো বন্ধুর বাড়িতে লইয়া গিয়াছেন। এই মেলার গোরার উপস্থিত থাকা সম্ভবপর হইবে কি না জিজ্ঞাসা করায় গোরা কিছু অনাবশ্যক উগ্রতার সহিত বলিয়াছিল– না। এই প্রসঙ্গে এ দেশে ইংরেজ-বাঙালির সম্বন্ধ ও পরস্পর সামাজিক সম্মিলনের বাধা লইয়া দুই তরফে রীতিমত বিতণ্ডা উপস্থিত হইল।

হারান কহিলেন, “বাঙালিরই দোষ। আমাদের এত কুসংস্কার ও কুপ্রথা যে, আমরা ইংরেজের সঙ্গে মেলবার যোগ্যই নই।”

গোরা কহিল, “যদি তাই সত্য হয় তবে সেই অযোগ্যতাসত্ত্বেও ইংরেজের সঙ্গে মেলবার জন্যে লালায়িত হয়ে বেড়ানো আমাদের পক্ষে লজ্জাকর।”

হারান কহিলেন, “কিন্তু যাঁরা যোগ্য হয়েছেন তাঁরা ইংরেজের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়ে থাকেন– যেমন এঁরা সকলে।”

গোরা। একজনের সমাদরের দ্বারা অন্য সকলের অনাদরটা যেখানে বেশি করে ফুটে ওঠে সেখানে এরকম সমাদরকে আমি অপমান বলে গণ্য করি।

দেখিতে দেখিতে হারানবাবু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন, এবং গোরা তাঁহাকে রহিয়া রহিয়া বাক্যশেলে বিদ্ধ করিতে লাগিল।

দুই পক্ষে এইরূপে যখন তর্ক চলিতেছে সুচরিতা টেবিলের প্রান্তে বসিয়া পাখার আড়াল হইতে গোরাকে একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। কী কথা হইতেছে তাহা তাহার কানে আসিতেছিল বটে, কিন্তু তাহাতে তাহার মন ছিল না। সুচরিতা যে গোরাকে অনিমেষনেত্রে দেখিতেছে সে সম্বন্ধে তাহার নিজের যদি চেতনা থাকিত তবে সে লজ্জিত হইত, কিন্তু সে যেন আত্মবিস্মৃত হইয়াই গোরাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। গোরা তাহার বলিষ্ঠ দুই বাহু টেবিলের উপরে রাখিয়া সম্মুখে ঝুঁকিয়া বসিয়াছিল; তাহার প্রশস্ত শুভ্র ললাটের উপর বাতির আলো পড়িয়াছে; তাহার মুখে কখনো অবজ্ঞার হাস্য কখনো বা ঘৃণার ভ্রূকুটি তরঙ্গিত হইয়া উঠিতেছে; তাহার মুখের প্রত্যেক ভাবলীলায় একটা আত্মমর্যাদার গৌরব লক্ষিত হইতেছে; সে যাহা বলিতেছে তাহা যে কেবলমাত্র সাময়িক বিতর্ক বা আক্ষেপের কথা নহে, প্রত্যেক কথা যে তাহার অনেক দিনের চিন্তা এবং ব্যবহারের দ্বারা নিঃসন্দিগ্ধরূপে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার মধ্যে যে কোনোপ্রকার দ্বিধা-দুর্বলতা বা আকস্মিকতা নাই তাহা কেবল তাহার কণ্ঠস্বরে নহে, তাহার মুখে এবং তাহার সমস্ত শরীরেই যেন সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ পাইতেছে। সুচরিতা তাহাকে বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিল। সুচরিতা তাহার জীবনে এত দিন পরে এই প্রথম একজনকে একটি বিশেষ মানুষ একটি বিশেষ পুরুষ বলিয়া যেন দেখিতে পাইল। তাহাকে আর দশজনের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে পারিল না। এই গোরার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া হারানবাবু অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়িলেন। তাঁহার শরীরের এবং মুখের আকৃতি, তাঁহার হাব-ভাব-ভঙ্গি, এমন-কি, তাঁহার জামা এবং চাদরখানা পর্যন্ত যেন তাঁহাকে ব্যঙ্গ করিতে লাগিল। এতদিন বারম্বার বিনয়ের সঙ্গে গোরার সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া সুচরিতা গোরাকে একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ মতের অসামান্য লোক বলিয়া মনে করিয়াছিল, তাহার দ্বারা দেশের একটা কোনো বিশেষ মঙ্গল-উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে এইমাত্র সে কল্পনা করিয়াছিল– আজ সুচরিতা তাহার মুখের দিকে একমনে চাহিতে চাহিতে সমস্ত দল, সমস্ত মত, সমস্ত উদ্দেশ্য হইতে পৃথক করিয়া গোরাকে কেবল গোরা বলিয়াই যেন দেখিতে লাগিল। চাঁদকে সমুদ্র যেমন সমস্ত প্রয়োজন সমস্ত ব্যবহারের অতীত করিয়া দেখিয়াই অকারণে উদ্‌বেল হইয়া উঠিতে থাকে, সুচরিতার অন্তঃকরণ আজ তেমনি সমস্ত ভুলিয়া, তাহার সমস্ত বুদ্ধি ও সংস্কার, তাহার সমস্ত জীবনকে অতিক্রম করিয়া যেন চতুর্দিকে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। মানুষ কী, মানুষের আত্মা কী, সুচরিতা এই তাহা প্রথম দেখিতে পাইল এবং এই অপূর্ব অনুভূতিতে সে নিজের অস্তিত্ব একেবারে বিস্মৃত হইয়া গেল।

হারানবাবু সুচরিতার এই তদগত ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাহাতে তাঁহার তর্কের যুক্তিগুলি জোর পাইতেছিল না। অবশেষে এক সময় নিতান্ত অধীর হইয়া তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং সুচরিতাকে নিতান্ত আত্মীয়ের মতো ডাকিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, একবার এ ঘরে এসো, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”

সুচরিতা একেবারে চমকিয়া উঠিল। তাহাকে কে যেন মারিল। হারানবাবুর সহিত তাহার যেরূপ সম্বন্ধ তাহাতে তিনি যে কখনো তাহাকে এরূপ আহ্বান করিতে পারেন না তাহা নহে। অন্য সময় হইলে সে কিছু মনেই করিত না; কিন্তু আজ গোরা ও বিনয়ের সম্মুখে সে নিজেকে অপমানিত বোধ করিল। বিশেষত গোরা তাহার মুখের দিকে এমন একরকম করিয়া চাহিল যে, সে হারানবাবুকে ক্ষমা করিতে পারিল না। প্রথমটা, সে যেন কিছুই শুনিতে পায় নাই এমনিভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। হারানবাবু তখন কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “শুনছ সুচরিতা? আমার একটা কথা আছে, একবার এ ঘরে আসতে হবে।”

সুচরিতা তাঁহার মুখের দিকে না তাকাইয়াই কহিল, “এখন থাক্‌– বাবা আসুন, তার পরে হবে।”

বিনয় উঠিয়া কহিল, “আমরা নাহয় যাচ্ছি।”

সুচরিতা তাড়াতাড়ি কহিল, “না বিনয়বাবু, উঠবেন না। বাবা আপনাদের থাকতে বলেছেন। তিনি এলেন বলে।” তাহার কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুল অনুনয়ের ভাব প্রকাশ পাইল। হরিণীকে যেন ব্যাধের হাতে ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাব হইয়াছিল।

“আমি আর থাকতে পারছি নে, আমি তবে চললুম” বলিয়া হারানবাবু দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। রাগের মাথায় বাহির হইয়া আসিয়া পরক্ষণেই তাঁহার অনুতাপ হইতে লাগিল, কিন্তু তখন ফিরিবার আর কোনো উপলক্ষ খুঁজিয়া পাইলেন না।

হারানবাবু চলিয়া গেলে সুচরিতা একটা কোন্‌ সুগভীর লজ্জায় মুখ যখন রক্তিম ও নত করিয়া বসিয়া ছিল, কী করিবে কী বলিবে কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, সেই সময়ে গোরা তাহার মুখের দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া লইবার অবকাশ পাইয়াছিল। গোরা শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য, যে প্রগল্‌ভতা কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল, সুচরিতার মুখশ্রীতে তাহার আভাসমাত্র কোথায়! তাহার মুখে বুদ্ধির একটা উজ্জ্বলতা নিঃসন্দেহ প্রকাশ পাইতেছিল, কিন্তু নম্রতা ও লজ্জার দ্বারা তাহা কী সুন্দর কোমল হইয়া আজ দেখা দিয়াছে! মুখের ডৌলটি কী সুকুমার! ভ্রূযুগলের উপরে ললাটটি যেন শরতের আকাশখণ্ডের মতো নির্মল ও স্বচ্ছ। ঠোঁট দুটি চুপ করিয়া আছে, কিন্তু অনুচ্চারিত কথার মাধুর্য সেই দুটি ঠোঁটের মাঝখানে যেন কোমল একটি কুঁড়ির মতো রহিয়াছে। নবীনা রমণীর বেশভূষার প্রতি গোরা পূর্বে কোনোদিন ভালো করিয়া চাহিয়া দেখে নাই এবং না দেখিয়াই সে-সমস্তের প্রতি তাহার একটা ধিক্‌কারভাব ছিল– আজ সুচরিতার দেহে তাহার নূতন ধরনের শাড়ি পরার ভঙ্গি তাহার একটু বিশেষভাবে ভালো লাগিল; সুচরিতার একটি হাত টেবিলের উপরে ছিল– তাহার জামার আস্তিনের কুঞ্চিত প্রান্ত হইতে সেই হাতখানি আজ গোরার চোখে কোমল হৃদয়ের একটি কল্যাণপূর্ণ বাণীর মতো বোধ হইল। দীপালোকিত শান্ত সন্ধ্যায় সুচরিতাকে বেষ্টন করিয়া সমস্ত ঘরটি তাহার আলো, তাহার দেয়ালের ছবি, তাহার গৃহসজ্জা, তাহার পারিপাট্য লইয়া একটি যেন বিশেষ অখণ্ড রূপ ধারণ করিয়া দেখা দিল। তাহা যে গৃহ, তাহা যে সেবাকুশলা নারীর যত্নে স্নেহে সৌন্দর্যে মণ্ডিত, তাহা যে দেয়াল ও কড়ি বরগা ছাদের চেয়ে অনেক বেশি– ইহা আজ গোরার কাছে মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল। গোরা আপনার চতুর্দিকের আকাশের মধ্যে একটা সজীব সত্তা অনুভব করিল– তাহার হৃদয়কে চারি দিক হইতেই একটা হৃদয়ের হিল্লোল আসিয়া আঘাত করিতে লাগিল, একটা কিসের নিবিড়তা তাহাকে যেন বেষ্টন করিয়া ধরিল। এরূপ অপূর্ব উপলব্ধি তাহার জীবনে কোনোদিন ঘটে নাই। দেখিতে দেখিতে ক্রমশই সুচরিতার কপালের ভ্রষ্ট কেশ হইতে তাহার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়টুকু পর্যন্ত অত্যন্ত সত্য এবং অত্যন্ত বিশেষ হইয়া উঠিল। একই কালে সমগ্রভাবে সুচরিতা এবং সুচরিতার প্রত্যেক অংশ স্বতন্ত্রভাবে গোরার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ কেহ কোনো কথা কহিতে না পারিয়া সকলেই একপ্রকার কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। তখন বিনয় সুচরিতার দিকে চাহিয়া কহিল “সেদিন আমাদের কথা হচ্ছিল”– বলিয়া একটা কথা উত্থাপন করিয়া দিল।

সে কহিল, “আপনাকে তো বলেইছি, আমার এমন একদিন ছিল যখন আমার মনে বিশ্বাস ছিল, আমাদের দেশের জন্যে, সমাজের জন্যে, আমাদের কিছুই আশা করবার নেই– চিরদিনই আমরা নাবালকের মতো কাটাব এবং ইংরেজ আমাদের অছি নিযুক্ত হয়ে থাকবে– যেখানে যা যেমন আছে সেইরকমই থেকে যাবে– ইংরেজের প্রবল শক্তি এবং সমাজের প্রবল জড়তার বিরুদ্ধে আমাদের কোথাও কোনো উপায়মাত্র নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকেরই এইরকম মনের ভাব। এমন অবস্থায় মানুষ, হয় নিজের স্বার্থ নিয়েই থাকে নয় উদাসীনভাবে কাটায়। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত লোকেরা এই কারণেই চাকরির উন্নতি ছাড়া আর-কোনো কথা ভাবে না, ধনী লোকেরা গবর্মেন্টের খেতাব পেলেই জীবন সার্থক বোধ করে– আমাদের জীবনের যাত্রাপথটা অল্প একটু দূরে গিয়েই, বাস্‌, ঠেকে যায়– সুতরাং সুদূর উদ্দেশ্যের কল্পনাও আমাদের মাথায় আসে না, আর তার পাথেয়-সংগ্রহও অনাবশ্যক বলে মনে করি। আমিও এক সময়ে ঠিক করেছিলুম গোরার বাবাকে মুরুব্বি ধরে একটা চাকরির জোগাড় করে নেব। এমন সময় গোরা আমাকে বললে– না, গবর্মেন্টের চাকরি তুমি কোনোমতেই করতে পারবে না।”

গোরা এই কথায় সুচরিতার মুখে একটুখানি বিস্ময়ের আভাস দেখিয়া কহিল, “আপনি মনে করবেন না গবর্মেন্টের উপর রাগ করে আমি এমন কথা বলছি। গবর্মেন্টের কাজ যারা করে তারা গবর্মেন্টের শক্তিকে নিজের শক্তি বলে একটা গর্ব বোধ করে এবং দেশের লোকের থেকে একটা ভিন্ন শ্রেণীর হয়ে ওঠে– যত দিন যাচ্ছে আমাদের এই ভাবটা ততই বেড়ে উঠছে। আমি জানি আমার একটি আত্মীয় সাবেক কালের ডেপুটি ছিলেন– এখন তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁকে ডিস্ট্রিক্ট্‌ ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করেছিলেন– বাবু, তোমার বিচারে এত বেশি লোক খালাস পায় কেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন– সাহেব, তার একটি কারণ আছে; তুমি যাদের জেলে দাও তারা তোমার পক্ষে কুকুর-বিড়াল মাত্র, আর আমি যাদের জেলে দিই তারা যে আমার ভাই হয়। এত বড়ো কথা বলতে পারে এমন ডেপুটি তখনো ছিল এবং শুনতে পারে এমন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটেরও অভাব ছিল না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে চাকরির দড়াদড়ি অঙ্গের ভূষণ হয়ে উঠছে এবং এখনকার ডেপুটির কাছে তাঁর দেশের লোক ক্রমেই কুকুর-বিড়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং এমনি করে পদের উন্নতি হতে হতে তাঁদের যে কেবলই অধোগতি হচ্ছে এ কথার অনুভূতি পর্যন্ত তাঁদের চলে যাচ্ছে। পরের কাঁধে ভর দিয়ে নিজের লোকদের নিচু করে দেখব এবং নিচু করে দেখবামাত্রই তাদের প্রতি অবিচার করতে বাধ্য হব, এতে কোনো মঙ্গল হতে পারে না।”

বলিয়া গোরা টেবিলে একটা মুষ্টি আঘাত করিল; তেলের শেজটা কাঁপিয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “গোরা, এ টেবিলটা গবর্মেন্টের নয়, আর এই শেজটা পরেশবাবুদের।”

শুনিয়া গোরা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। তাহার হাস্যের প্রবল ধ্বনিতে সমস্ত বাড়িটা পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ঠাট্টা শুনিয়া গোরা যে ছেলেমানুষের মতো এমন প্রচুরভাবে হাসিয়া উঠিতে পারে ইহাতে সুচরিতা আশ্চর্য বোধ করিল এবং তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা আনন্দ হইল। যাহারা বড়ো কথার চিন্তা করে তাহারা যে প্রাণ খুলিয়া হাসিতে পারে এ কথা তাহার জানা ছিল না।

গোরা সেদিন অনেক কথাই বলিল। সুচরিতা যদিও চুপ করিয়া ছিল কিন্তু তাহার মুখের ভাবে গোরা এমন একটা সায় পাইল যে, উৎসাহে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। শেষকালে সুচরিতাকেই যেন বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া কহিল, “দেখুন, একটি কথা মনে রাখবেন– যদি এমন ভুল সংস্কার আমাদের হয় যে, ইংরেজরা যখন প্রবল হয়ে উঠেছে তখন আমরাও ঠিক ইংরেজটি না হলে কোনোমতে প্রবল হতে পারব না, তা হলে সে অসম্ভব কোনোদিন সম্ভব হবে না এবং কেবলই নকল করতে করতে আমরা দুয়ের বার হয়ে যাব। এ কথা নিশ্চয় জানবেন ভারতের একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সার্থক হবে, ভারত রক্ষা পাবে। ইংরেজের ইতিহাস পড়ে এইটে যদি আমরা না শিখে থাকি তবে সমস্তই ভুল শিখেছি। আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ, আপনি ভারতবর্ষের ভিতরে আসুন, এর সমস্ত ভালোমন্দের মাঝখানেই নেবে দাঁড়ান,– যদি বিকৃতি থাকে, তবে ভিতর থেকে সংশোধন করে তুলুন, কিন্তু একে দেখুন, বুঝুন, ভাবুন, এর দিকে মুখ ফেরান, এর সঙ্গে এক হোন– এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, বাইরে থেকে খৃস্টানি সংস্কারে বাল্যকাল হতে অস্থিমজ্জায় দীক্ষিত হয়ে, একে আপনি বুঝতেই পারবেন না, একে কেবলই আঘাত করতেই থাকবেন, এর কোনো কাজেই লাগবেন না।”

গোরা বলিল বটে “আমার অনুরোধ’; কিন্তু এ তো অনুরোধ নয়, এ যেন আদেশ। কথার মধ্যে এমন একটা প্রচণ্ড জোর যে, তাহা অন্যের সম্মতির অপেক্ষাই করে না। সুচরিতা মুখ নত করিয়াই সমস্ত শুনিল। এমন একটা প্রবল আগ্রহের সঙ্গে গোরা যে তাহাকেই বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া এই কথা কয়টি কহিল তাহাতে সুচরিতার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত করিয়া দিল। সে আন্দোলন যে কিসের তখন তাহা ভাবিবার সময় ছিল না। ভারতবর্ষ বলিয়া যে একটা বৃহৎ প্রাচীন সত্তা আছে সুচরিতা সে কথা কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও ভাবে নাই। এই সত্তা যে দূর অতীত ও সুদূর ভবিষ্যৎকে অধিকারপূর্বক নিভৃতে থাকিয়া মানবের বিরাট ভাগ্যজালে একটা বিশেষ রঙের সুতা একটা বিশেষ ভাবে বুনিয়া চলিয়াছে; সেই সুতা যে কত সূক্ষ্ণ, কত বিচিত্র এবং কত সুদূর সার্থকতার সহিত তাহার কত নিগূঢ় সম্বন্ধ– সুচরিতা আজ তাহা গোরার প্রবল কণ্ঠের কথা শুনিয়া যেন হঠাৎ একরকম করিয়া উপলব্ধি করিল। প্রত্যেক ভারতবাসীর জীবন যে এত বড়ো একটা সত্তার দ্বারা বেষ্টিত, অধিকৃত, তাহা সচেতনভাবে অনুভব না করিলে আমরা যে কতই ছোটো হইয়া এবং চারি দিক সম্বন্ধে কতই অন্ধ হইয়া কাজ করিয়া যাই নিমেষের মধ্যেই তাহা যেন সুচরিতার কাছে প্রকাশ পাইল। সেই অকস্মাৎ চিত্ত-স্ফূর্তির আবেগে সুচরিতা তাহার সমস্ত সংকোচ দূর করিয়া দিয়া অত্যন্ত সহজ বিনয়ের সহিত কহিল, “আমি দেশের কথা কখনো এমন করে, বড়ো করে, সত্য করে ভাবি নি। কিন্তু একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি– ধর্মের সঙ্গে দেশের যোগ কী? ধর্ম কি দেশের অতীত নয়?”

গোরার কানে সুচরিতার মৃদু কণ্ঠের এই প্রশ্ন বড়ো মধুর লাগিল। সুচরিতার বড়ো বড়ো দুইটি চোখের মধ্যে এই প্রশ্নটি আরো মধুর করিয়া দেখা দিল। গোরা কহিল, “দেশের অতীত যা, দেশের চেয়ে যা অনেক বড়ো, তাই দেশের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়। ঈশ্বর এমনি করে বিচিত্র ভাবে আপনার অনন্ত স্বরূপকেই ব্যক্ত করছেন। যাঁরা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটিমাত্র রূপই সত্য– তাঁরা, সত্য যে এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অন্তহীন সে সত্যটা মানতে চান না। অন্তহীন-এক অন্তহীন অনেকে আপনাকে প্রকাশ করেন– জগতে সেই লীলাই তো দেখছি। সেইজন্যেই ধর্মমত বিচিত্র হয়ে সেই ধর্মরাজকে নানা দিক দিয়ে উপলব্ধি করাচ্ছে। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, ভারতবর্ষের খোলা জানলা দিয়ে আপনি সূর্যকে দেখতে পাবেন– সেজন্যে সমুদ্রপারে গিয়ে খৃস্টান গির্জার জানলায় বসবার কোনো দরকার হবে না।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি বলতে চান, ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়। সেই বিশেষত্বটি কী?”

গোরা কহিল, “সেটা হচ্ছে এই যে, ব্রহ্ম যিনি নির্বিশেষ তিনি বিশেষের মধ্যেই ব্যক্ত। কিন্তু তাঁর বিশেষের শেষ নেই। জল তাঁর বিশেষ, স্থল তাঁর বিশেষ, বায়ু তাঁর বিশেষ, অগ্নি তাঁর বিশেষ, প্রাণ তাঁর বিশেষ, বুদ্ধি প্রেম সমস্তই তাঁর বিশেষ– গণনা করে কোথাও তাঁর অন্ত পাওয়া যায় না– বিজ্ঞান তাই নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে মরছে। যিনি নিরাকার তাঁর আকারের অন্ত নেই– হ্রস্বদীর্ঘ-স্থূলসূক্ষ্ণের অনন্ত প্রবাহই তাঁর। যিনি অনন্তবিশেষ তিনিই নির্বিশেষ, যিনি অনন্তরূপ তিনিই অরূপ। অন্যান্য দেশে ঈশ্বরকে ন্যূনাধিক পরিমাণে কোনো একটিমাত্র বিশেষের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেছে– ভারতবর্ষেও ঈশ্বরকে বিশেষের মধ্যে দেখবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু সেই বিশেষকেই ভারতবর্ষ একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করে না। ঈশ্বর যে সেই বিশেষকেও অনন্তগুণে অতিক্রম করে আছেন এ কথা ভারতবর্ষের কোনো ভক্ত কোনোদিন অস্বীকার করেন না।”

সুচরিতা কহিল, “জ্ঞানী করেন না, কিন্তু অজ্ঞানী?”

গোরা কহিল, “আমি তো পূর্বেই বলেছি অজ্ঞানী সকল দেশেই সকল সত্যকেই বিকৃত করবে।”

সুচরিতা কহিল, “কিন্তু আমাদের দেশে সেই বিকার কি বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছয় নি?”

গোরা কহিল, “তা হতে পারে। কিন্তু তার কারণ ধর্মের স্থূল ও সূক্ষ্ণ, অন্তর ও বাহির, শরীর ও আত্মা, এই দুটো অঙ্গকেই ভারতবর্ষ পূর্ণভাবে স্বীকার করতে চায় বলেই যারা সূক্ষ্ণকে গ্রহণ করতে পারে না তারা স্থূলটাকেই নেয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা সেই স্থূলের মধ্যে নানা অদ্ভুত বিকার ঘটাতে থাকে। কিন্তু যিনি রূপেও সত্য অরূপেও সত্য, স্থূলেও সত্য সূক্ষ্ণেও সত্য, ধ্যানেও সত্য প্রত্যক্ষেও সত্য, তাঁকে ভারতবর্ষ সর্বতোভাবে দেহে মনে কর্মে উপলব্ধি করবার যে আশ্চর্য বিচিত্র ও প্রকাণ্ড চেষ্টা করেছে তাকে আমরা মূঢ়ের মতো অশ্রদ্ধা করে য়ুরোপের অষ্টাদশ শতাব্দীর নাস্তিকতায়-আস্তিকতায় মিশ্রিত একটা সংকীর্ণ নীরস অঙ্গহীন ধর্মকেই একমাত্র ধর্ম বলে গ্রহণ করব এ হতেই পারে না। আমি যা বলছি তা আপনাদের আশৈশবের সংস্কারবশত ভালো করে বুঝতেই পারবেন না, মনে করবেন এ লোকটার ইংরেজি শিখেও শিক্ষার কোনো ফল হয় নি; কিন্তু ভারতবর্ষের সত্য প্রকৃতি ও সত্য সাধনার প্রতি যদি আপনার কোনোদিন শ্রদ্ধা জন্মে, ভারতবর্ষ নিজেকে সহস্র বাধা ও বিকৃতির ভিতর দিয়েও যেরকম করে প্রকাশ করছে সেই প্রকাশের গভীর অভ্যন্তরে যদি প্রবেশ করতে পারেন, তা হলে– তা হলে, কী আর বলব, আপনার ভারতবর্ষীয় স্বভাবকে শক্তিকে ফিরে পেয়ে আপনি মুক্তি লাভ করবেন।”

সুচরিতা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল দেখিয়া গোরা কহিল, “আমাকে আপনি একটা গোঁড়া ব্যক্তি বলে মনে করবেন না। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে গোঁড়া লোকেরা, বিশেষত যারা হঠাৎ নতুন গোঁড়া হয়ে উঠেছে, তারা যে ভাবে কথা কয় আমার কথা সে ভাবে গ্রহণ করবেন না। ভারতবর্ষের নানাপ্রকার প্রকাশে এবং বিচিত্র চেষ্টার মধ্যে আমি একটা গভীর ও বৃহৎ ঐক্য দেখতে পেয়েছি, সেই ঐক্যের আনন্দে আমি পাগল। সেই ঐক্যের আনন্দেই, ভারতবর্ষের মধ্যে যারা মূঢ়তম তাদের সঙ্গে এক দলে মিশে ধুলোয় গিয়ে বসতে আমার মনে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ হয় না। ভারতবর্ষের এই বাণী কেউ বা বোঝে, কেউ বা বোঝে না– তা নাই হল– আমি আমার ভারতবর্ষের সকলের সঙ্গে এক– তারা আমার সকলেই আপন– তাদের সকলের মধ্যেই চিরন্তন ভারতবর্ষের নিগূঢ় আবির্ভাব নিয়ত কাজ করছে, সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই।”

গোরার প্রবল কণ্ঠের এই কথাগুলি ঘরের দেয়ালে টেবিলে, সমস্ত আসবাবপত্রেও যেন কাঁপিতে লাগিল।

এ-সমস্ত কথা সুচরিতার পক্ষে খুব স্পষ্ট বুঝিবার কথা নহে– কিন্তু অনুভূতির প্রথম অস্পষ্ট সঞ্চারেরও বেগ অত্যন্ত প্রবল। জীবনটা যে নিতান্তই চারটে দেয়ালের মধ্যে বা একটা দলের মধ্যে বদ্ধ নহে, এই উপলব্ধিটা সুচরিতাকে যেন পীড়া দিতে লাগিল।

এমন সময় সিঁড়ির কাছ হইতে মেয়েদের উচ্চহাস্যমিশ্রিত দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল। বরদাসুন্দরী ও মেয়েদের লইয়া পরেশবাবু ফিরিয়াছেন। সুধীর সিঁড়ি দিয়া উঠিবার সময় মেয়েদের উপর কী একটা উৎপাত করিতেছে, তাহাই লইয়া এই হাস্যধ্বনির সৃষ্টি।

লাবণ্য ললিতা ও সতীশ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়াই গোরাকে দেখিয়া সংযত হইয়া দাঁড়াইল। লাবণ্য ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল– সতীশ বিনয়ের চৌকির পাশে দাঁড়াইয়া কানে কানে তাহার সহিত বিশ্রম্ভালাপ শুরু করিয়া দিল। ললিতা সুচরিতার পশ্চাতে চৌকি টানিয়া তাহার আড়ালে অদৃশ্যপ্রায় হইয়া বসিল।

পরেশ আসিয়া কহিলেন, “আমার ফিরতে বড়ো দেরি হয়ে গেল। পানুবাবু বুঝি চলে গেছেন?”

সুচরিতা তাহার কোনো উত্তর দিল না; বিনয় কহিল, “হাঁ, তিনি থাকতে পারলেন না।”

গোরা উঠিয়া কহিল, “আজ আমরাও আসি।”

বলিয়া পরেশবাবুকে নত হইয়া নমস্কার করিল।

পরেশবাবু কহিলেন, “আজ আর তোমাদের সঙ্গে আলাপ করবার সময় পেলুম না। বাবা, যখন তোমার অবকাশ হবে মাঝে মাঝে এসো।”

গোরা ও বিনয় ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় বরদাসুন্দরী আসিয়া পড়িলেন। উভয়ে তাঁহাকে নমস্কার করিল। তিনি কহিলেন, “আপনারা এখনই যাচ্ছেন নাকি?”

গোরা কহিল, “হাঁ।”

বরদাসুন্দরী বিনয়কে কহিলেন, “কিন্তু বিনয়বাবু, আপনি যেতে পারছেন না– আপনাকে আজ খেয়ে যেতে হবে। আপনার সঙ্গে একটা কাজের কথা আছে।”

সতীশ লাফাইয়া উঠিয়া বিনয়ের হাত ধরিল এবং কহিল, “হাঁ মা, বিনয়বাবুকে যেতে দিয়ো না, উনি আজ রাত্রে আমার সঙ্গে থাকবেন।”

বিনয় কিছু কুণ্ঠিত হইয়া উত্তর দিতে পারিতেছিল না দেখিয়া বরদাসুন্দরী গোরাকে কহিলেন, “বিনয়বাবুকে কি আপনি নিয়ে যেতে চান? ওঁকে আপনার দরকার আছে?”

গোরা কহিল, “কিছু না। বিনয় তুমি থাকো-না– আমি আসছি।”

বলিয়া গোরা দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

বিনয়ের থাকা সম্বন্ধে বরদাসুন্দরী যখনই গোরার সম্মতি লইলেন সেই মুহূর্তেই বিনয় ললিতার মুখের দিকে না চাহিয়া থাকিতে পারিল না। ললিতা মুখ টিপিয়া হাসিয়া মুখ ফিরাইল।

ললিতার এই ছোটোখাটো হাসি-বিদ্রূপের সঙ্গে বিনয় ঝগড়া করিতেও পারে না, অথচ ইহা তাহাকে কাঁটার মতো বেঁধে। বিনয় ঘরে আসিয়া বসিতেই ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু, আজ আপনি পালালেই ভালো করতেন।”

বিনয় কহিল, “কেন?”

ললিতা। মা আপনাকে বিপদে ফেলবার মতলব করছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের মেলায় যে অভিনয় হবে তাতে একজন লোক কম পড়ছে– মা আপনাকে ঠিক করেছেন।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কী সর্বনাশ! এ কাজ আমার দ্বারা হবে না।”

ললিতা হাসিয়া কহিল, “সে আমি মাকে আগেই বলেছি। এ অভিনয়ে আপনার বন্ধু কখনোই আপনাকে যোগ দিতে দেবেন না।”

বিনয় খোঁচা খাইয়া কহিল, “বন্ধুর কথা রেখে দিন। আমি সাত জন্মে কখনো অভিনয় করি নি– আমাকে কেন?”

ললিতা কহিল, “আমরাই বুঝি জন্মজন্মান্তর অভিনয় করে আসছি?”

এই সময় বরদাসুন্দরী ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিলেন। ললিতা কহিল, “মা, তুমি অভিনয়ে বিনয়বাবুকে মিথ্যা ডাকছ। আগে ওঁর বন্ধুকে যদি রাজি করাতে পার তা হলে–”

বিনয় কাতর হইয়া কহিল, “বন্ধুর রাজি হওয়া নিয়ে কথাই হচ্ছে না। অভিনয় তো করলেই হয় না– আমার যে ক্ষমতাই নেই।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সেজন্যে ভাববেন না– আমরা আপনাকে শিখিয়ে ঠিক করে নিতে পারব। ছোটো ছোটো মেয়েরা পারবে, আর আপনি পারবেন না!”

বিনয়ের উদ্ধারের আর কোনো উপায় রহিল না।

» গোরা ২১

২১

গোরা তাহার স্বাভাবিক দ্রুতগতি পরিত্যাগ করিয়া অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিল। বাড়ি যাইবার সহজ পথ ছাড়িয়া সে অনেকটা ঘুরিয়া গঙ্গার ধারের রাস্তা ধরিল। তখন কলিকাতার গঙ্গা ও গঙ্গার ধার বণিক্‌-সভ্যতার লাভলোলুপ কুশ্রীতায় জলে স্থলে আক্রান্ত হইয়া তীরে রেলের লাইন ও নীরে ব্রিজের বেড়ি পরে নাই। তখনকার শীতসন্ধ্যায় নগরের নিশ্বাসকালিমা আকাশকে এমন নিবিড় করিয়া আচ্ছন্ন করিত না। নদী তখন বহুদূর হিমালয়ের নির্জন গিরিশৃঙ্গ হইতে কলিকাতার ধূলিলিপ্ত ব্যস্ততার মাঝখানে শান্তির বার্তা বহন করিয়া আনিত।

প্রকৃতি কোনোদিন গোরার মনকে আকর্ষণ করিবার অবকাশ পায় নাই। তাহার মন নিজের সচেষ্টতার বেগে নিজে কেবলই তরঙ্গিত হইয়া ছিল; যে জল স্থল আকাশ অব্যবহিতভাবে তাহার চেষ্টার ক্ষেত্র নহে তাহাকে সে লক্ষ্যই করে নাই।

আজ কিন্তু নদীর উপরকার ঐ আকাশ আপনার নক্ষত্রালোকে অভিষিক্ত অন্ধকার-দ্বারা গোরার হৃদয়কে বারম্বার নিঃশব্দে স্পর্শ করিতে লাগিল। নদী নিস্তরঙ্গ। কলিকাতার তীরের ঘাটে কতকগুলি নৌকায় আলো জ্বলিতেছে আর কতকগুলি দীপহীন নিস্তব্ধ। ও পারের নিবিড় গাছগুলির মধ্যে কালিমা ঘনীভূত। তাহারই ঊর্ধ্বে বৃহস্পতিগ্রহ অন্ধকারের অন্তর্যামীর মতো তিমিরভেদী অনিমেষদৃষ্টিতে স্থির হইয়া আছে।

আজ এই বৃহৎ নিস্তব্ধ প্রকৃতি গোরার শরীর-মনকে যেন অভিভূত করিয়া দিল। গোরার হৃৎপিণ্ডের সমান তালে আকাশের বিরাট অন্ধকার স্পন্দিত হইতে লাগিল। প্রকৃতি এতকাল ধৈর্য ধরিয়া স্থির হইয়া ছিল– আজ গোরার অন্তঃকরণের কোন্‌ দ্বারটা খোলা পাইয়া সে মুহূর্তের মধ্যে এই অসতর্ক দুর্গটিকে আপনার করিয়া লইল। এতদিন নিজের বিদ্যা বুদ্ধি চিন্তা ও কর্ম লইয়া গোরা অত্যন্ত স্বতন্ত্র ছিল– আজ কী হইল! আজ কোন্‌খানে সে প্রকৃতিকে স্বীকার করিল এবং করিবামাত্রই এই গভীর কালো জল, এই নিবিড় কালো তট, ঐ উদার কালো আকাশ তাহাকে বরণ করিয়া লইল! আজ প্রকৃতির কাছে কেমন করিয়া গোরা ধরা পড়িয়া গেছে।

পথের ধারে সদাগরের আপিসের বাগানে কোন্‌ বিলাতি লতা হইতে একটা অপরিচিত ফুলের মৃদুকোমল গন্ধ গোরার ব্যাকুল হৃদয়ের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। নদী তাহাকে লোকালয়ের অশ্রান্ত কর্মক্ষেত্র হইতে কোন্‌ অনির্দেশ্য সুদূরের দিকে আঙুল দেখাইয়া দিল; সেখানে নির্জন জলের ধারে গাছগুলি শাখা মিলাইয়া কী ফুল ফুটাইয়াছে! কী ছায়া ফেলিয়াছে! সেখানে নির্মল নীলাকাশের নীচে দিনগুলি যেন কাহার চোখের উন্মীলিত দৃষ্টি এবং রাতগুলি যেন কাহার চোখের আনত পল্লবের লজ্জাজড়িত ছায়া! চারি দিক হইতে মাধুর্যের আবর্ত আসিয়া হঠাৎ গোরাকে যে-একটা অতলস্পর্শ অনাদি শক্তির আকর্ষণে টানিয়া লইয়া চলিল পূর্বে কোনোদিন সে তাহার কোনো পরিচয় জানিত না। ইহা একই কালে বেদনায় এবং আনন্দে তাহার সমস্ত মনকে এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে অভিহত করিতে লাগিল। আজ এই হেমন্তের রাত্রে, নদীর তীরে, নগরের অব্যক্ত কোলাহলে এবং নক্ষত্রের অপরিস্ফুট আলোকে গোরা বিশ্বব্যাপিনী কোন্‌ অবগুন্ঠিতা মায়াবিনীর সম্মুখে আত্মবিস্মৃত হইয়া দণ্ডায়মান হইল! এই মহারানীকে সে এতদিন নতমস্তকে স্বীকার করে নাই বলিয়াই আজ অকস্মাৎ তাহার শাসনের ইন্দ্রজাল আপন সহস্রবর্ণের সূত্রে গোরাকে জলস্থল আকাশের সঙ্গে চারি দিক হইতে বাঁধিয়া ফেলিল। গোরা নিজের সম্বন্ধে নিজেই বিস্মিত হইয়া নদীর জনশূন্য ঘাটের একটা পঁইঠায় বসিয়া পড়িল। বার বার সে নিজেকে প্রশ্ন করিতে লাগিল যে, তাহার জীবনে এ কিসের আবির্ভাব এবং ইহার কী প্রয়োজন! যে সংকল্প-দ্বারা সে আপনার জীবনকে আগাগোড়া বিধিবদ্ধ করিয়া মনে মনে সাজাইয়া লইয়াছিল তাহার মধ্যে ইহার স্থান কোথায়? ইহা কি তাহার বিরুদ্ধ? সংগ্রাম করিয়া ইহাকে কি পরাস্ত করিতে হইবে? এই বলিয়া গোরা মুষ্টি দৃঢ় করিয়া যখনই বদ্ধ করিল অমনি বুদ্ধিতে উজ্জ্বল, নম্রতায় কোমল, কোন্‌ দুইটি স্নিগ্ধ চক্ষুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাহার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল– কোন্‌ অনিন্দ্যসুন্দর হাতখানির আঙুলগুলির স্পর্শসৌভাগ্যের অনাস্বাদিত অমৃত তাহার ধ্যানের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল; গোরার সমস্ত শরীরে পুলকের বিদ্যুৎ চকিত হইয়া উঠিল। একাকী অন্ধকারের মধ্যে এই প্রগাঢ় অনুভূতি তাহার সমস্ত প্রশ্নকে, সমস্ত দ্বিধাকে একেবারে নিরস্ত করিয়া দিল। সে তাহার এই নূতন অনুভূতিকে সমস্ত দেহ মন দিয়া উপভোগ করিতে লাগিল– ইহাকে ছাড়িয়া সে উঠিতে ইচ্ছা করিল না।

অনেক রাত্রে যখন গোরা বাড়ি গেল তখন আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত রাত করলে যে বাবা, তোমার খাবার যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

গোরা কহিল, “কী জানি মা, আজ কী মনে হল, অনেকক্ষণ গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলুম।”

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনয় সঙ্গে ছিল বুঝি?”

গোরা কহিল, “না, আমি একলাই ছিলুম।”

আনন্দময়ী মনে মনে কিছু আশ্চর্য হইলেন। বিনা প্রয়োজনে গোরা যে এত রাত পর্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসিয়া ভাবিবে এমন ঘটনা কখনোই হয় নাই। চুপ করিয়া বসিয়া ভাবা তাহার স্বভাবই নহে। গোরা যখন অন্যমনস্ক হইয়া খাইতেছিল আনন্দময়ী লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন তাহার মুখে যেন একটা কেমনতরো উতলা ভাবের উদ্দীপনা।

আনন্দময়ী কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ বুঝি বিনয়ের বাড়ি গিয়েছিলে?”

গোরা কহিল, “না, আজ আমরা দুজনেই পরেশবাবুর ওখানে গিয়েছিলুম।”

শুনিয়া আনন্দময়ী চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওঁদের সকলের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?”

গোরা কহিল, “হাঁ, হয়েছে।”

আনন্দময়ী। ওঁদের মেয়েরা বুঝি সকলের সাক্ষাতেই বেরোন?

গোরা। হাঁ, ওঁদের কোনো বাধা নেই।

অন্য সময় হইলে এরূপ উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা প্রকাশ পাইত, আজ তাহার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া আনন্দময়ী আবার চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

পরদিন সকালে উঠিয়া গোরা অন্য দিনের মতো অবিলম্বে মুখ ধুইয়া দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হইতে গেল না। সে অন্যমনস্কভাবে তাহার শোবার ঘরের পূর্ব দিকের দরজা খুলিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। তাহাদের গলিটা পূর্বের দিকে একটা বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে; সেই বড়ো রাস্তার পূর্বপ্রান্তে একটা ইস্কুল আছে; সেই ইস্কুলের সংলগ্ন জমিতে একটা পুরাতন জাম গাছের মাথার উপরে পাতলা একখণ্ড সাদা কুয়াশা ভাসিতেছিল এবং তাহার পশ্চাতে আসন্ন সূর্যোদয়ের অরুণরেখা ঝাপসা হইয়া দেখা দিতেছিল। গোরা চুপ করিয়া অনেকক্ষণ সেই দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সেই ক্ষীণ কুয়াশাটুকু মিশিয়া গেল, উজ্জ্বল রৌদ্র গাছের শাখার ভিতর দিয়া যেন অনেকগুলো ঝক্‌ঝকে সঙিনের মতো বিঁধিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং দেখিতে দেখিতে কলিকাতার রাস্তা জনতায় ও কোলাহলে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

এমন সময় হঠাৎ গলির মোড়ে অবিনাশের সঙ্গে আর-কয়েকটি ছাত্রকে তাহার বাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া গোরা তাহার এই আবেশের জালকে যেন এক প্রবল টানে ছিন্ন করিয়া ফেলিল; সে নিজের মনকে একটা প্রচণ্ড আঘাত করিয়া বলিল– না, এ-সব কিছু নয়; এ কোনোমতেই চলিবে না। বলিয়া দ্রুতবেগে শোবার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। গোরার বাড়িতে তাহার দলবল আসিয়াছে অথচ গোরা তাহার অনেক পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া নাই, এমন ঘটনা ইহার পূর্বে আর একদিনও ঘটিতে পায় নাই। এই সামান্য ত্রুটিতেই গোরাকে ভারি একটা ধিক্‌কার দিল; সে মনে মনে স্থির করিল আর সে পরেশবাবুর বাড়ি যাইবে না এবং বিনয়ের সঙ্গেও যাহাতে কিছুদিন দেখা না হইয়া এই-সমস্ত আলোচনা বন্ধ থাকে সেইরূপ চেষ্টা করিবে।

সেদিন নীচে গিয়া এই পরামর্শ হইল যে, গোরা তাহার দলের দুই-তিন জনকে সঙ্গে করিয়া পায়ে হাঁটিয়া গ্রাণ্ড্‌ ট্রাঙ্ক্‌ রোড দিয়া ভ্রমণে বাহির হইবে; পথের মধ্যে গৃহস্থবাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করিবে, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছুই লইবে না।

এই অপূর্ব সংকল্প মনে লইয়া গোরা হঠাৎ কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সমস্ত বন্ধন ছেদন করিয়া এইরূপ খোলা রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িবার একটা প্রবল আনন্দ তাহাকে পাইয়া বসিল। ভিতরে ভিতরে তাহার হৃদয় যে একটা জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে, এই বাহির হইবার কল্লনাতেই সেটা যেন ছিন্ন হইয়া গেল বলিয়া তাহার মনে হইল। এই-সমস্ত ভাবের আবেশ যে মায়ামাত্র এবং কর্মই যে সত্য সেই কথাটা খুব জোরের সহিত নিজের মনের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করিয়া লইয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইবার জন্য ইস্কুল-ছুটির বালকের মতো গোরা তাহার একতলার বসিবার ঘর ছাড়িয়া প্রায় ছুটিয়া বাহির হইল। সেই সময় কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে করিতে ঘরে চলিয়াছিলেন। গোরা একেবারে তাঁহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। লজ্জিত হইয়া গোরা তাড়াতাড়ি তাঁহার পা ছুঁইয়া প্রণাম করিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া “থাক্‌ থাক্‌’ বলিয়া সসংকোচে চলিয়া গেলেন। পূজায় বসিবার পূর্বে গোরার স্পর্শে তাঁহার গঙ্গাস্নানের ফল মাটি হইল। কৃষ্ণদয়াল যে গোরার সংস্পর্শই বিশেষ করিয়া এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিতেন গোরা তাহা ঠিক বুঝিত না; সে মনে করিত শুচিবায়ুগ্রস্ত বলিয়া সর্বপ্রকারে সকলেরই সংস্রব বাঁচাইয়া চলাই অহরহ তাঁহার সতর্কতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল; আনন্দময়ীকে তো তিনি ম্লেচ্ছ বলিয়া দূরে পরিহার করিতেন– মহিম কাজের লোক, মহিমের সঙ্গে তাঁহার দেখা সাক্ষাতেরই অবকাশ ঘটিত না। সমস্ত পরিবারের মধ্যে কেবল মহিমের কন্যা শশিমুখীকে তিনি কাছে লইয়া তাহাকে সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্থ করাইতেন এবং পূজার্চনাবিধিতে দীক্ষিত করিতেন।

কৃষ্ণদয়াল গোরাকর্তৃক তাঁহার পাদস্পর্শে ব্যস্ত হইয়া পলায়ন করিলে পর তাঁহার সংকোচের কারণ সম্বন্ধে গোরার চেতনা হইল এবং সে মনে মনে হাসিল। এইরূপে পিতার সহিত গোরার সমস্ত সম্বন্ধ প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং মাতার অনাচারকে সে যতই নিন্দা করুক এই আচারদ্রোহিনী মাকেই গোরা তাহার জীবনের সমস্ত ভক্তি সমর্পণ করিয়া পূজা করিত।

আহারান্তে গোরা একটি ছোটো পুঁটলিতে গোটাকয়েক কাপড় লইয়া সেটা বিলাতি পর্যটকদের মতো পিঠে বাঁধিয়া মার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “মা, আমি কিছুদিনের মতো বেরোব।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কোথায় যাবে বাবা?”

গোরা কহিল, “সেটা আমি ঠিক বলতে পারছি নে।”

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো কাজ আছে?”

গোরা কহিল, “কাজ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নয়– এই যাওয়াটাই একটা কাজ।”

আনন্দময়ীকে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া গোরা কহিল, “মা, দোহাই তোমার, আমাকে বারণ করতে পারবে না। তুমি তো আমাকে জানই, আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব এমন ভয় নেই। আমি মাকে ছেড়ে বেশি দিন কোথাও থাকতে পারি নে।”

মার প্রতি তাহার ভালোবাসা গোরা কোনোদিন মুখে এমন করিয়া বলে নাই– তাই আজ কথাটা বলিয়াই সে লজ্জিত হইল।

পুলকিত আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি তাহার লজ্জাটা চাপা দিয়া কহিলেন, “বিনয় সঙ্গে যাবে বুঝি?”

গোরা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না মা, বিনয় যাবে না। ঐ দেখো, অমনি মার মনে ভাবনা হচ্ছে, বিনয় না গেলে তাঁর গোরাকে পথে ঘাটে রক্ষা করবে কে? বিনয়কে যদি তুমি আমার রক্ষক মনে কর সেটা তোমার একটা কুসংস্কার– এবার নিরাপদে ফিরে এলে ঐ সংস্কারটা তোমার ঘুচবে।”

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝে মাঝে খবর পাব তো?”

গোরা কহিল, “খবর পাবে না বলেই ঠিক করে রাখো– তার পরে যদি পাও তো খুশি হবে। ভয় কিছুই নেই; তোমার গোরাকে কেউ নেবে না। মা, তুমি আমার যতটা মূল্য কল্পনা কর আর-কেউ ততটা করে না। তবে এই বোঁচকাটির উপর যদি কারো লোভ হয় তবে এটি তাকে দান করে দিয়ে চলে আসব; এটা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দান করব না– সে নিশ্চয়।”

গোরা আনন্দময়ীর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল, তিনি তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া হাত চুম্বন করিলেন, কোনোপ্রকার নিষেধমাত্র করিলেন না। নিজের কষ্ট হইবে বলিয়া অথবা কল্পনায় অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়া আনন্দময়ী কখনো কাহাকেও নিষেধ করিতেন না। নিজের জীবনে তিনি অনেক বাধাবিপদের মধ্য দিয়া আসিয়াছেন, বাহিরের পৃথিবী তাঁহার কাছে অপরিচিত নহে; তাঁহার মনে ভয় বলিয়া কিছু ছিল না। গোরা যে কোনো বিপদে পড়িবে সে ভয় তিনি মনে আনেন নাই– কিন্তু গোরার মনের মধ্যে যে কী একটা বিপ্লব ঘটিয়াছে সেই কথাই তিনি কাল হইতে ভাবিতেছেন। আজ হঠাৎ গোরা অকারণে ভ্রমণ করিতে চলিল শুনিয়া তাঁহার সেই ভাবনা আরো বাড়িয়া উঠিয়াছে।

গোরা পিঠে বোঁচকা বাঁধিয়া রাস্তায় যেই পা দিয়াছে এমন সময় হাতে ঘনরক্ত বসোরা গোলাপ-যুগল সযত্নে লইয়া বিনয় তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোরা কহিল, “বিনয়, তোমার দর্শনে অযাত্রা কি সুযাত্রা এবারে তার পরীক্ষা হবে।”

বিনয় কহিল, “বেরোচ্ছ নাকি?”

গোরা কহিল, “হাঁ।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায়?”

গোরা কহিল, “প্রতিধ্বনি উত্তর করিল “কোথায়’।”

বিনয়। প্রতিধ্বনির চেয়ে ভালো উত্তর নেই না কি?

গোরা। না। তুমি মার কাছে যাও, সব শুনতে পাবে। আমি চললুম।

বলিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেল।

বিনয় অন্তঃপুরে গিয়া আনন্দময়ীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ‘পরে গোলাপ ফুল দুইটি রাখিল।

আনন্দময়ী ফুল তুলিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কোথায় পেলে বিনয়?”

বিনয় তাহার ঠিক স্পষ্ট উত্তরটি না দিয়া কহিল, “ভালো জিনিসটি পেলেই আগে মায়ের পুজোর জন্যে সেটি দিতে ইচ্ছা করে।”

তার পরে আনন্দময়ীর তক্তপোশের উপর বসিয়া বিনয় কহিল, “মা, তুমি কিন্তু অন্যমনস্ক আছ।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কেন বলো দেখি।”

বিনয় কহিল, “আজ আমার বরাদ্দ পানটা দেবার কথা ভুলেই গেছ।”

আনন্দময়ী লজ্জিত হইয়া বিনয়কে পান আনিয়া দিলেন।

তাহার পরে সমস্ত দুপুরবেলা ধরিয়া দুইজনে কথাবার্তা হইতে লাগিল। গোরার নিরুদ্দেশ-ভ্রমণের অভিপ্রায় সম্বন্ধে বিনয় কোনো পরিষ্কার খবর বলিতে পারিল না।

আনন্দময়ী কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল বুঝি তুমি গোরাকে নিয়ে পরেশবাবুর ওখানে গিয়েছিলে?”

বিনয় গতকল্যকার সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া বলিল। আনন্দময়ী প্রত্যেক কথাটি সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়া শুনিলেন।

যাইবার সময় বিনয় কহিল, “মা, পূজা তো সাঙ্গ হল, এবার তোমার চরণের প্রসাদী ফুল দুটো মাথায় করে নিয়ে যেতে পারি?”

আনন্দময়ী হাসিয়া গোলাপ ফুল দুইটি বিনয়ের হাতে দিলেন এবং মনে মনে ভাবিলেন, এ গোলাপ দুইটি যে কেবল সৌন্দর্যের জন্যই আদর পাইতেছে তাহা নহে– নিশ্চয় উদ্ভিদ্‌তত্ত্বের অতীত আরো অনেক গভীর তত্ত্ব ইহার মধ্যে আছে।

বিকালবেলায় বিনয় চলিয়া গেলে তিনি কতই ভাবিতে লাগিলেন। ভগবানকে ডাকিয়া বার বার প্রার্থনা করিলেন– গোরাকে যেন অসুখী হইতে না হয় এবং বিনয়ের সঙ্গে তাহার বিচ্ছেদের যেন কোনো কারণ না ঘটে।

গোরা ২২

২২

গোলাপ ফুলের একটু ইতিহাস আছে।

কাল রাত্রে গোরা তো পরেশবাবুর বাড়ি হইতে চলিয়া আসিল, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে সেই অভিনয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব লইয়া বিনয়কে বিস্তর কষ্ট পাইতে হইয়াছিল।

এই অভিনয়ে ললিতার যে কোনো উৎসাহ ছিল তাহা নহে, সে বরঞ্চ এ-সব ব্যাপার ভালোই বাসিত না। কিন্তু কোনোমতে বিনয়কে এই অভিনয়ে জড়িত করিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে যেন একটা জেদ চাপিয়া গিয়াছিল। যে-সমস্ত কাজ গোরার মতবিরুদ্ধ, বিনয়কে দিয়া তাহা সাধন করাইবার জন্য তাহার একটা রোখ জন্মিয়াছিল। বিনয় যে গোরার অনুবর্তী, ইহা ললিতার কাছে কেন এত অসহ্য ইহয়াছিল তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছিল না। যেমন করিয়া হোক সমস্ত বন্ধন কাটিয়া বিনয়কে স্বাধীন করিয়া দিতে পারিলে সে যেন বাঁচে, এমনি হইয়া উঠিয়াছে।

ললিতা তাহার বেণী দুলাইয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “কেন মশায়, অভিনয়ে দোষটা কী?”

বিনয় কহিল, “অভিনয়ে দোষ না থাকতে পারে, কিন্তু ঐ ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে অভিনয় করতে যাওয়া আমার মনে ভালো লাগছে না।”

ললিতা। আপনি নিজের মনের কথা বলছেন, না আর কারো?

বিনয়। অন্যের মনের কথা বলবার ভার আমার উপরে নেই, বলাও শক্ত। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন না, আমি নিজের মনের কথাটাই বলে থাকি– কখনো নিজের জবানিতে, কখনো বা অন্যের জবানিতে।

ললিতা এ কথার কোনো জবাব না দিয়া একটুখানি মুচকিয়া হাসিল মাত্র। একটু পরে কহিল, “আপনার বন্ধু গৌরবাবু বোধ হয় মনে করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করলেই খুব একটা বীরত্ব হয়, ওতেই ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করার ফল হয়।”

বিনয় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমার বন্ধু হয়তো না মনে করতে পারেন, কিন্তু আমি মনে করি । লড়াই নয় তো কী? যে লোক আমাকে গ্রাহ্যই করে না, মনে করে আমাকে কড়ে আঙুল তুলে ইশারায় ডাক দিলেই আমি কৃতার্থ হয়ে যাব, তার সেই উপেক্ষার সঙ্গে উপেক্ষা দিয়েই যদি লড়াই না করি তা হলে আত্মসম্মানকে বাঁচাব কী করে?”

ললিতা নিজে অভিমানী স্বভাবের লোক, বিনয়ের মুখের এই অভিমানবাক্য তাহার ভালোই লাগিল। কিন্তু সেইজন্যেই তাহার নিজের পক্ষের যুক্তিকে দুর্বল অনুভব করিয়াই ললিতা অকারণ বিদ্রূপের খোঁচায় বিনয়কে কথায় কথায় আহত করিতে লাগিল।

শেষকালে বিনয় কহিল, “দেখুন, আপনি তর্ক করছেন কেন? আপনি বলুন-না কেন, “আমার ইচ্ছা, আপনি অভিনয়ে যোগ দেন।’ তা হলে আমি আপনার অনুরোধ-রক্ষার খাতিরে নিজের মতটাকে বিসর্জন দিয়ে একটা সুখ পাই।”

ললিতা কহিল, “বাঃ, তা আমি কেন বলব? সত্যি যদি আপনার কোনো মত থাকে তা হলে সেটা আমার অনুরোধে কেন ত্যাগ করতে যাবেন? কিন্তু সেটা সত্যি হওয়া চাই।”

বিনয় কহিল, “আচ্ছা, সেই কথাই ভালো। আমার সত্যিকার কোনো মত নেই। আপনার অনুরোধে নাই হল, আপনার তর্কেই পরাস্ত হয়ে আমি অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হলুম।”

এমন সময় বরদাসুন্দরী ঘরে প্রবেশ করিবামাত্রই বিনয় উঠিয়া গিয়া তাঁহাকে কহিল, “অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হলে আমাকে কী করতে হবে বলে দেবেন।”

বরদাসুন্দরী সগর্বে কহিলেন, “সেজন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমরা আপনাকে ঠিক তৈরি করে নিতে পারব। কেবল অভ্যাসের জন্য রোজ আপনাকে নিয়মিত আসতে হবে।”

বিনয় কহিল, “আচ্ছা। আজ তবে আসি।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে কী কথা? আপনাকে খেয়ে যেতে হচ্ছে।”

বিনয় কহিল, “আজ নাই খেলুম।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, সে হবে না।”

বিনয় খাইল, কিন্তু অন্য দিনের মতো তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ছিল না। আজ সুচরিতাও কেমন অন্যমনস্ক হইয়া চুপ করিয়া ছিল। যখন ললিতার সঙ্গে বিনয়ের লড়াই চলিতেছিল তখন সে বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছিল। আজ রাত্রে কথাবার্তা আর জমিল না।

বিদায়ের সময় বিনয় ললিতার গম্ভীর মুখ লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আমি হার মানলুম, তবু আপনাকে খুশি করতে পারলুম না।”

ললিতা কোনো জবাব না দিয়া চলিয়া গেল।

ললিতা সহজে কাঁদিতে জানে না, কিন্তু আজ তাহার চোখ দিয়া জল যেন ফাটিয়া বাহির হইতে চাহিল। কী হইয়াছে? কেন সে বিনয়বাবুকে বার বার এমন করিয়া খোঁচা দিতেছে এবং নিজে ব্যথা পাইতেছে?

বিনয় যতক্ষণ অভিনয়ে যোগ দিতে নারাজ ছিল ললিতার জেদও ততক্ষণ কেবলই চড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু যখনই সে রাজি হইল তখনই তাহার সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। যোগ না-দিবার পক্ষে যতগুলি তর্ক, সমস্ত তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিল। তখন তাহার মন পীড়িত হইয়া বলিতে লাগিল, “কেবল আমার অনুরোধ রাখিবার জন্য বিনয়বাবুর এমন করিয়া রাজি হওয়া উচিত হয় নাই। অনুরোধ! কেন অনুরোধ রাখিবেন? তিনি মনে করেন, অনুরোধ রাখিয়া তিনি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করিতেছেন। তাঁহার এই ভদ্রতাটুকু পাইবার জন্য আমার যেন অত্যন্ত মাথাব্যথা!’

কিন্তু এখন অমন করিয়া স্পর্ধা করিলে চলিবে কেন? সত্যই যে সে বিনয়কে অভিনয়ের দলে টানিবার জন্য ক্রমাগত নির্বন্ধ প্রকাশ করিয়াছে। বিনয় ভদ্রতার দায়ে তাহার এত জেদের অনুরোধ রাখিয়াছে বলিয়া রাগ করিলেই বা চলিবে কেন? এই ঘটনায় ললিতার নিজের উপরে এমনই তীব্র ঘৃণা ও লজ্জা উপস্থিত হইল যে স্বভাবত এতটা হইবার কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিন হইলে তাহার মনের চাঞ্চল্যের সময় সে সুচরিতার কাছে যাইত। আজ গেল না এবং কেন যে তাহার বুকটাকে ঠেলিয়া তুলিয়া তাহার চোখ দিয়া এমন করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল তাহা সে নিজেই ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না।

পরদিন সকালে সুধীর লাবণ্যকে একটি তোড়া আনিয়া দিয়াছিল। সেই তোড়ায় একটি বোঁটায় দুইটি বিকচোন্মুখ বসোরা-গোলাপ ছিল। ললিতা সেটি তোড়া হইতে খুলিয়া লইল। লাবণ্য কহিল, “ও কী করছিস?”

ললিতা কহিল, “তোড়ায় অনেকগুলো বাজে ফুল-পাতার মধ্যে ভালো ফুলকে বাঁধা দেখলে আমার কষ্ট হয়, ওরকম দড়ি দিয়ে সব জিনিসকে এক শ্রেণীতে জোর করে বাঁধা বর্বরতা।”

এই বলিয়া সমস্ত ফুলকে বন্ধনমুক্ত করিয়া ললিতা সেগুলিকে ঘরের এ দিকে, ও দিকে পৃথক করিয়া সাজাইল; কেবল গোলাপ দুটিকে হাতে করিয়া লইয়া গেল।

সতীশ ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “দিদি, ফুল কোথায় পেলে?”

ললিতা তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “আজ তোর বন্ধুর বাড়িতে যাবি নে?”

বিনয়ের কথা এতক্ষণ সতীশের মনে ছিল না, কিন্তু তাহার উল্লেখমাত্রেই লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “হাঁ যাব।” বলিয়া তখনই যাইবার জন্য অস্থির হইয়া উঠিল।

ললিতা তাহাকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করি, “সেখানে গিয়ে কী করিস?”

সতীশ সংক্ষেপে কহিল, “গল্প করি।”

ললিতা কহিল, “তিনি তোকে এত ছবি দেন, তুই তাঁকে কিছু দিস নে কেন?”

বিনয় ইংরেজি কাগজ প্রভৃতি হইতে সতীশের জন্য নানাপ্রকার ছবি কাটিয়া রাখিত। একটা খাতা করিয়া সতীশ এই ছবিগুলি তাহাতে গঁদ দিয়া আঁটিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এইরূপে পাতা পুরাইবার জন্য তাহার নেশা এতই চড়িয়া গিয়াছে যে ভালো বই দেখিলেও তাহা হইতে ছবি কাটিয়া লইবার জন্য তাহা মন ছট্‌ফট্‌ করিত। এই লোলুপতার অপরাধে তাহার দিদিদের কাছে তাহাকে বিস্তর তাড়না সহ্য করিতে হইয়াছে।

সংসারে প্রতিদান বলিয়া যে একটা দায় আছে সে কথাটা হঠাৎ আজ সতীশের সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে সে বিশেষ চিন্তিত হইয়া উঠিল। ভাঙা টিনের বাক্সটির মধ্যে তাহার নিজের বিষয়সম্পত্তি যাহা-কিছু সঞ্চিত হইয়াছে, তাহার কোনোটারই আসক্তিবন্ধন ছেদন করা তাহার পক্ষে সহজ নহে। সতীশের উদ্‌্‌বিগ্ন মুখ দেখিয়া ললিতা হাসিয়া তাহার গাল টিপিয়া দিয়া কহিল, “থাক্‌ থাক্‌, তোকে আর অত ভাবতে হবে না। আচ্ছা, এই গোলাপ ফুল দুটো তাঁকে দিস।”

এত সহজে সমস্যার মীমাংসা হইল দেখিয়া সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। এবং ফুল দুটি লইয়া তখনই সে তাহার বন্ধুঋণ শোধ করিবার জন্য চলিল।

রাস্তায় বিনয়ের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। “বিনয়বাবু বিনয়বাবু’ করিয়া দূর হইতে তাঁহাকে ডাক দিয়া সতীশ তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং জামার মধ্যে ফুল লুকাইয়া কহিল, “আপনার জন্যে কী এনেছি বলুন দেখি।”

বিনয়কে হার মানাইয়া গোলাপ ফুল দুইটি বাহির করিল। বিনয় কহিল, “বাঃ, কী চমৎকার! কিন্তু সতীশবাবু এটি তো তোমার নিজের জিনিস নয়। চোরাই মাল নিয়ে শেষকালে পুলিসের হাতে পড়ব না তো?”

এই ফুল দুটিকে ঠিক নিজের জিনিস বলা যায় কি না, সে সম্বন্ধে সতীশের হঠাৎ ধোঁকা লাগিল। সে একটু ভাবিয়া কহিল, “না, বাঃ, ললিতাদিদি আমাকে দিলেন যে আপনাকে দিতে!”

এই কথাটার এইখানেই নিষ্পত্তি হইল এবং বিকালে তাহাদের বাড়ি যাইবে বলিয়া আশ্বাস দিয়া বিনয় সতীশকে বিদায় দিল।

কাল রাত্রে ললিতার কথার খোঁচা খাইয়া বিনয় তাহার বেদনা ভুলিতে পারিতেছিল না। বিনয়ের সঙ্গে কাহারো প্রায় বিরোধ হয় না। সেইজন্য এইপ্রকার তীব্র আঘাত সে কাহারো কাছে প্রত্যাশাই করে না। ইতিপূর্বে ললিতাকে বিনয় সুচরিতার পশ্চাদ্‌বর্তিনী করিয়াই দেখিয়াছিল। কিন্তু অঙ্কুশাহত হাতি যেমন তাহার মাহুতকে ভুলিবার সময় পায় না, কিছুদিন হইতে ললিতা সম্বন্ধে বিনয়ের সেই দশা হইয়াছিল। কী করিয়া ললিতাকে একটুখানি প্রসন্ন করিবে এবং শান্তি পাইবে বিনয়ের এই চিন্তাই প্রধান হইয়া উঠিয়াছিল। সন্ধ্যার সময় বাসায় আসিয়া ললিতার তীব্রহাস্যদিগ্ধ জ্বালাময় কথাগুলি একটার পর একটা কেবলই তাহার মনে বাজিয়া উঠিত এবং তাহার নিদ্রা দূর করিয়া রাখিত। “আমি গোরার ছায়ার মতো, আমার নিজের কোনো পদার্থ নাই, ললিতা এই বলিয়া অবজ্ঞা করেন, কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য।’ ইহার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার যুক্তি সে মনের মধ্যে জড়ো করিয়া তুলিত। কিন্তু এ-সমস্ত যুক্তি তাহার কোনো কাজে লাগিত না। কারণ ললিতা তো স্পষ্ট করিয়া এ অভিযোগ তাহার বিরুদ্ধে আনে নাই–এ কথা লইয়া তর্ক করিবার অবকাশই তাহাকে দেয় নাই। বিনয়ের জবাব দিবার এত কথা ছিল, তবু সেগুলো ব্যবহার করিতে না পারিয়া তাহার মনে ক্ষোভ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে কাল রাত্রে হারিয়াও যখন ললিতার মুখ সে প্রসন্ন দেখিল না তখন বাড়িতে আসিয়া সে নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল। মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সত্যই কি আমি এতই অবজ্ঞার পাত্র?

এইজন্যই সতীশের কাছে যখন সে শুনিল যে, ললিতাই তাহাকে গোলাপ ফুল দুটি সতীশের হাত দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছে তখন সে অত্যন্ত একটা উল্লাস বোধ করিল। সে ভাবিল, অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হওয়াতেই সন্ধির নিদর্শনস্বরূপ ললিতা তাহাকে খুশি হইয়া এই গোলাপ দুটি দিয়াছে। প্রথমে মনে করিল “ফুল দুটি বাড়িতে রাখিয়া আসি’; তাহার পরে ভাবিল, “না, এই শান্তির ফুল মায়ের পায়ে দিয়া ইহাকে পবিত্র করিয়া আনি।’

সেদিন বিকালে বিনয় যখন পরেশবাবুর বাড়িতে গেল তখন সতীশ ললিতার কাছে তাহার ইস্কুলের পড়া বলিয়া লইতেছে। বিনয় ললিতাকে কহিল, “যুদ্ধেরই রঙ লাল, অতএব সন্ধির ফুল সাদা হওয়া উচিত ছিল।”

ললিতা কথাটা বুঝিতে না পারিয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। বিনয় তখন একটি গুচ্ছ শ্বেতকরবী চাদরের মধ্য হইতে বাহির করিয়া ললিতার সম্মুখে ধরিয়া কহিল, “আপনার ফুল দুটি যতই সুন্দর হোক, তবু তাতে ক্রোধের রঙটুকু আছে। আমার এ ফুল সৌন্দর্যে তার কাছে দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু শান্তির শুভ্র রঙের নম্রতা স্বীকার করে আপনার কাছে হাজির হয়েছে।”

ললিতা কর্ণমূল রাঙা করিয়া কহিল, “আমার ফুল আপনি কাকে বলছেন?”

বিনয় কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তো ভুল বুঝেছি। সতীশবাবু, কার ফুল কাকে দিলে?”

সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, ললিতাদিদি যে দিতে বললে!”

বিনয়। কাকে দিতে বললেন?

সতীশ। আপনাকে।

ললিতা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়া সতীশের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “তোর মতো বোকা তো আমি দেখি নি। বিনয়বাবুর ছবির বদলে তুই তাঁকে ফুল দিতে চাইলি নে?”

সতীশ হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, “হাঁ, তাই তো, কিন্তু তুমিই আমাকে দিতে বললে না?”

সতীশের সঙ্গে তকরার করিতে গিয়া ললিতা আরো বেশি করিয়া জালে জড়াইয়া পড়িল। বিনয় স্পষ্ট বুঝিল ফুল দুটি ললিতাই দিয়াছে, কিন্তু বেনামিতেই কাজ করা তাহার অভিপ্রায় ছিল। বিনয় কহিল, “আপনার ফুলের দাবি আমি ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে আমার এই ফুলের মধ্যে ভুল কিছুই নেই। আমাদের বিবাদনিষ্পত্তির শুভ উপলক্ষে এই ফুল কয়টি–”

ললিতা মাথা নাড়িয়া কহিল, “আমাদের বিবাদই বা কী, আর তার নিষ্পত্তিই বা কিসের?”

বিনয় কহিল, “একেবারে আগাগোড়া সমস্তই মায়া? বিবাদও ভুল, ফুলও তাই, নিষ্পত্তিও মিথ্যা? শুধু শুক্তিতে রজতভ্রম নয়, শুক্তিটা-সুদ্ধই ভ্রম? ঐ-যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে অভিনয়ের একটা কথা হচ্ছিল সেটা–”

ললিতা কহিল, “সেটা ভ্রম নয়। কিন্তু তা নিয়ে ঝগড়া কিসের? আপনি কেন মনে করছেন আপনাকে এইটেতে রাজি করবার জন্যে আমি মস্ত একটা লড়াই বাধিয়ে দিয়েছি, আপনি সম্মত হওয়াতেই আমি কৃতার্থ হয়েছি! আপনার কাছে অভিনয় করাটা যদি অন্যায় বোধ হয় কারো কথা শুনে কেনই বা তাতে রাজি হবেন?”

এই বলিয়া ললিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সমস্তই উল্‌টা ব্যাপার হইল। আজ ললিতা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল যে, সে বিনয়ের কাছে নিজের হার স্বীকার করিবে এবং যাহাতে অভিনয়ে বিনয় যোগ না দেয় তাহাকে সেই অনুরোধ করিবে। কিন্তু এমন করিয়া কথাটা উঠিল এবং এমন ভাবে তাহার পরিণতি হইল যে, ফল ঠিক উল্‌টা দাঁড়াইল। বিনয় মনে করিল, সে যে অভিনয় সম্বন্ধে এতদিন বিরুদ্ধতা প্রকাশ করিয়াছিল তাহারই প্রতিঘাতের উত্তেজনা এখনো ললিতার মনে রহিয়া গেছে। বিনয় যে কেবল বাহিরে হার মানিয়াছে, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার বিরোধ রহিয়াছে, এইজন্য ললিতার ক্ষোভ দূর হইতেছে না। ললিতা এই ব্যাপারটাতে যে এতটা আঘাত পাইয়াছে ইহাতে বিনয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। সে মনে মনে স্থির করিল, এই কথাটা লইয়া সে আর কোনো আলোচনা উপহাসচ্ছলেও করিবে না এবং এমন নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে এই কাজটাকে সম্পন্ন করিয়া তুলিবে যে কেহ তাহার প্রতি ঔদাসীন্যের অপরাধ আরোপ করিতে পারিবে না।

সুচরিতা আজ প্রাতঃকাল হইতে নিজের শোবার ঘরে নিভৃতে বসিয়া “খৃস্টের অনুকরণ’ নামক একটি ইংরেজি ধর্মগ্রন্থ পড়িবার চেষ্টা করিতেছে। আজ সে তাহার অন্যান্য নিয়মিত কর্মে যোগ দেয় নাই। মাঝে মাঝে গ্রন্থ হইতে মন ভ্রষ্ট হইয়া পড়াতে বইয়ের লেখাগুলি তাহার কাছে ছায়া হইয়া পড়িতেছিল–আবার পরক্ষণে নিজের উপর রাগ করিয়া বিশেষ বেগের সহিত চিত্তকে গ্রন্থের মধ্যে আবদ্ধ করিতেছিল, কোনোমতেই হার মানিতে চাহিতেছিল না।

এক সময়ে দূর হইতে কণ্ঠস্বর শুনিয়া মনে হইল, বিনয়বাবু আসিয়াছেন; তখনই চমকিয়া উঠিয়া বই রাখিয়া বাহিরের ঘরে যাইবার জন্য মন ব্যস্ত হইয়া উঠিল। নিজের এই ব্যস্ততাতে নিজের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া সুচরিতা আবার চৌকির উপর বসিয়া বই লইয়া পড়িল। পাছে কানে শব্দ যায় বলিয়া দুই কান চাপিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

এমন সময় ললিতা তাহার ঘরে আসিল। সুচরিতা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “তোর কী হয়েছে বল্‌ তো।”

ললিতা তীব্র ভাবে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “কিছু না।”

সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় ছিলি?”

ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু এসেছেন, তিনি বোধ হয় তোমার সঙ্গে গল্প করতে চান।”

বিনয়বাবুর সঙ্গে আর কেহ আসিয়াছে কিনা, এ প্রশ্ন সুচরিতা আজ উচ্চারণ করিতেও পারিল না। যদি আর কেহ আসিত তবে নিশ্চয় ললিতা তাহার উল্লেখ করিত, কিন্তু তবু মন নিঃসংশয় হইতে পারিল না। আর সে নিজেকে দমনের চেষ্টা না করিয়া গৃহাগত অতিথির প্রতি কর্তব্যের উপলক্ষে বাহিরের ঘরের দিকে চলিল। ললিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই যাবি নে?”

ললিতা একটু অধৈর্যের স্বরে কহিল, “তুমি যাও-না, আমি পরে যাচ্ছি।”

সুচরিতা বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, বিনয় সতীশের সঙ্গে গল্প করিতেছে।

সুচরিতা কহিল, “বাবা বেরিয়ে গেছেন, এখনই আসবেন। মা আপনাদের সেই অভিনয়ের কবিতা মুখস্থ করাবার জন্যে লাবণ্য ও লীলাকে নিয়ে মাস্টারমশায়ের বাড়িতে গেছেন–ললিতা কোনোমতেই গেল না। তিনি বলে গেছেন, আপনি এলে আপনাকে বসিয়ে রাখতে–আপনার আজ পরীক্ষা হবে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি এর মধ্যে নেই?”

সুচরিতা কহিল, “সবাই অভিনেতা হলে জগতে দর্শক হবে কে?”

বরদাসুন্দরী সুচরিতাকে এ-সকল ব্যাপারে যথাসম্ভব বাদ দিয়া চলিতেন। তাই তাহার গুণপনা দেখাইবার জন্য এবারও ডাক পড়ে নাই।

অন্য দিন এই দুই ব্যক্তি একত্র হইলে কথার অভাব হইত না। আজ উভয় পক্ষেই এমন বিঘ্ন ঘটিয়াছে যে, কোনোমতেই কথা জমিতে চাহিল না। সুচরিতা গোরার প্রসঙ্গ তুলিবে না পণ করিয়া আসিয়াছিল। বিনয়ও পূর্বের মতো সহজে গোরার কথা তুলিতে পারে না। তাহাকে ললিতা এবং হয়তো এ বাড়ির সকলেই গোরার একটি ক্ষুদ্র উপগ্রহ বলিয়া মনে করে, ইহাই কল্পনা করিয়া গোরার কথা তুলিতে সে বাধা পায়।

অনেক দিন এমন হইয়াছে বিনয় আগে আসিয়াছে, গোরা তাহার পরে আসিয়াছে–আজও সেইরূপ ঘটিতে পারে ইহাই মনে করিয়া সুচরিতা যেন একপ্রকার সচকিত অবস্থায় রহিল। গোরা পাছে আসিয়া পড়ে এই তাহার একটা ভয় ছিল এবং পাছে না আসে এই আশঙ্কাও তাহাকে বেদনা দিতেছিল।

বিনয়ের সঙ্গে ছাড়া-ছাড়া ভাবে দুই-চারটে কথা হওয়ার পর সুচরিতা আর কোনো উপায় না দেখিয়া সতীশের ছবির খাতাখানা লইয়া সতীশের সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে ছবি সাজাইবার ত্রুটি ধরিয়া নিন্দা করিয়া সতীশকে রাগাইয়া তুলিল। সতীশ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বাদানুবাদ করিতে লাগিল। আর বিনয় টেবিলের উপর তাহার প্রত্যাখ্যাত করবীগুচ্ছের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া লজ্জায় ও ক্ষোভে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল যে, অত্যন্ত ভদ্রতার খাতিরেও আমার এই ফুল কয়টা ললিতার লওয়া উচিত ছিল।

হঠাৎ একটা পায়ের শব্দে চমকিয়া সুচরিতা পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, হারানবাবু ঘরে প্রবেশ করিতেছেন। তাহার চমকটা অত্যন্ত সুগোচর হওয়াতে সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল। হারানবাবু একটা চৌকিতে বসিয়া কহিলেন, “কই, আপনাদের গৌরবাবু আসেন নি?”

বিনয় হারানবাবুর এরূপ অনাবশ্যক প্রশ্নে বিরক্ত হইয়া কহিল, “কেন, তাঁকে কোনো প্রয়োজন আছে?”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনি আছেন অথচ তিনি নেই, এ তো প্রায় দেখা যায় না; তাই জিজ্ঞাসা করছি।”

বিনয়ের মনে বড়ো রাগ হইল– পাছে তাহা প্রকাশ পায় এইজন্য সংক্ষেপে কহিল, “তিনি কলকাতায় নেই।”

হারান। প্রচারে গেছেন বুঝি?

বিনয়ের রাগ বাড়িয়া উঠিল, কোনো জবাব করিল না। সুচরিতাও কোনো কথা না বলিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। হারানবাবু দ্রুতপদে সুচরিতার অনুবর্তন করিলেন, কিন্তু তাহাকে ধরিয়া উঠিতে পারিলেন না। হারানবাবু দূর হইতে কহিলেন, “সুচরিতা, একটা কথা আছে।”

সুচরিতা কহিল, “আজ আমি ভালো নেই।’

বলিতে বলিতেই তাহার শয়নগৃহে কপাট পড়িল।

এমন সময় বরদাসুন্দরী আসিয়া অভিনয়ের পালা দিবার জন্য যখন বিনয়কে আর-একটা ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন তাহার অনতিকাল পরেই অকস্মাৎ ফুলগুলিকে আর সেই টেবিলের উপরে দেখা যায় নাই। সে রাত্রে ললিতাও বরদাসুন্দরীর অভিনয়ের আখড়ায় দেখা দিল না এবং সুচরিতা “খৃস্টের অনুকরণ’ বইখানি কোলের উপর মুড়িয়া ঘরের বাতিটাকে এক কোণে আড়াল করিয়া দিয়া অনেক রাত পর্যন্ত দ্বারের বহির্বর্তী অন্ধকার রাত্রির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। তাহার সম্মুখে যেন একটা কোন্‌ অপরিচিত অপূর্ব দেশ মরীচিকার মতো দেখা দিয়াছিল; জীবনের এতদিনকার সমস্ত জানাশুনার সঙ্গে সেই দেশের একটা কোথায় একান্ত বিচ্ছেদ আছে; সেইজন্য সেখানকার বাতায়নে যে আলোগুলি জ্বলিতেছে তাহা তিমিরনিশীথিনীর নক্ষত্রমালার মতো একটা সুদূরতার রহস্যে মনকে ভীত করিতেছে; অথচ মনে হইতেছে, “জীবন আমার তুচ্ছ, এতদিন যাহা নিশ্চয় বলিয়া জানিয়াছি তাহা সংশয়াকীর্ণ এবং প্রত্যহ যাহা করিয়া আসিতেছি তাহা অর্থহীন–ঐখানেই হয়তো জ্ঞান সম্পূর্ণ হইবে, কর্ম মহৎ হইয়া উঠিবে এবং জীবনের সার্থকতা লাভ করিতে পারিব। ঐ অপূর্ব অপরিচিত ভয়ংকর দেশের অজ্ঞাত সিংহদ্বারের সম্মুখে কে আমাকে দাঁড় করাইয়া দিল? কেন আমার হদয় এমন করিয়া কাঁপিতেছে, কেন আমার পা অগ্রসর হইতে গিয়া এমন করিয়া স্তব্ধ হইয়া আছে?’

গোরা ২৩

২৩

অভিনয়ের অভ্যাস উপলক্ষে বিনয় প্রত্যহই আসে। সুচরিতা তাহার দিকে একবার চাহিয়া দেখে, তাহার পরে হাতের বইটার দিকে মন দেয় অথবা নিজের ঘরে চলিয়া যায়। বিনয়ের একলা আসার অসম্পূর্ণতা প্রত্যহই তাহাকে আঘাত করে, কিন্তু সে কোনো প্রশ্ন করে না। অথচ দিনের পর দিন এমনিভাবে যতই যাইতে লাগিল, গোরার বিরুদ্ধে সুচরিতার মনের একটা অভিযোগ প্রতিদিন যেন তীব্রতর হইয়া উঠিতে লাগিল। গোরা যেন আসিবে বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছিল, এমনি একটা ভাব যেন সেদিন ছিল।

অবশেষে সুচরিতা যখন শুনিল গোরা নিতান্তই অকারণে কিছু দিনের জন্য কোথায় বেড়াইতে বাহির হইয়াছে তাহার ঠিকানা নাই, তখন কথাটাকে সে একটা সামান্য সংবাদের মতো উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিল–কিন্তু কথাটা তাহার মনে বিঁধিয়াই রহিল। কাজ করিতে করিতে হঠাৎ এই কথটা মনে পড়ে–অন্যমনস্ক হইয়া আছে, হঠাৎ দেখে এই কথাটাই সে মনে মনে ভাবিতেছিল।

গোরার সঙ্গে সেদিনকার আলোচনার পর তাহার এরূপ হঠাৎ অন্তর্ধান সুচরিতা একেবারেই আশা করে নাই। গোরার মতের সঙ্গে নিজের সংস্কারের এতদূর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেদিন তাহার অন্তঃকরণে বিদ্রোহের উজান হাওয়া কিছুমাত্র ছিল না; সেদিন সে গোরার মতগুলি স্পষ্ট বুঝিতেছিল কিনা বলা যায় না, কিন্তু গোরা মানুষটাকে সে যেন একরকম করিয়া বুঝিয়াছিল। গোরার মত যাহাই থাক্‌-না সে মতে যে মানুষকে ক্ষুদ্র করে নাই, অবজ্ঞার যোগ্য করে নাই, বরঞ্চ তাহার চিত্তের বলিষ্ঠতাকে যেন প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিয়াছে–ইহা সেদিন সে প্রবলভাবে অনুভব করিয়াছে। এ-সকল কথা আর-কাহারো মুখে সে সহ্য করিতেই পারিত না, রাগ হইত, সে লোকটাকে মূঢ় মনে করিত, তাহাকে শিক্ষা দিয়া সংশোধন করিবার জন্য মনে চেষ্টার উত্তেজনা হইত। কিন্তু সেদিন গোরার সম্বন্ধে তাহার কিছুই হইল না; গোরার চরিত্রের সঙ্গে, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার সঙ্গে, অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসের দৃঢ়তার সঙ্গে এবং মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরের মর্মভেদী প্রবলতার সঙ্গে তাহার কথাগুলি মিলিত হইয়া একটা সজীব ও সত্য আকার ধারণ করিয়াছিল। এ সমস্ত মত সুচরিতা নিজে গ্রহণ না করিতে পারে, কিন্তু আর-কেহ যদি ইহাকে এমনভাবে সমস্ত বুদ্ধি-বিশ্বাস সমস্ত জীবন দিয়া গ্রহণ করে তবে তাহাকে ধিক্‌কার দিবার কিছুই নাই, এমন-কি বিরুদ্ধ সংস্কার অতিক্রম করিয়াও তাহাকে শ্রদ্ধা করা যাইতে পারে–এই ভাবটা সুচরিতাকে সেদিন সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল। মনের এই অবস্থাটা সুচরিতার পক্ষে একেবারে নূতন। মতের পার্থক্য সম্বন্ধে সে অত্যন্ত অসহিষ্ণু ছিল; পরেশবাবুর একপ্রকার নির্লিপ্ত সমাহিত শান্ত জীবনের দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও সে সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বাল্যকাল হইতে বেষ্টিত ছিল বলিয়া মত জিনিসটাকে অতিশয় একান্ত করিয়া দেখিত–সেইদিনই প্রথম সে মানুষের সঙ্গে মতের সঙ্গে সম্মিলিত করিয়া দেখিয়া একটা যেন সজীব সমগ্র পদার্থের রহস্যময় সত্তা অনুভব করিল। মানবসমাজকে কেবল আমার পক্ষ এবং অন্য পক্ষ এই দুই সাদা কালো ভাগে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার যে ভেদদৃষ্টি তাহাই সেদিন সে ভুলিয়াছিল এবং ভিন্ন মতের মানুষকে মুখ্যভাবে মানুষ বলিয়া এমন করিয়া দেখিতে পাইয়াছিল যে, ভিন্ন মতটা তাহার কাছে গৌণ হইয়া গিয়াছিল।

সেদিন সুচরিতা অনুভব করিয়াছিল যে, তাহার সঙ্গে আলাপ করিতে গোরা একটা আনন্দ বোধ করিতেছে। সে কি কেবলমাত্র নিজের মত প্রকাশ করিবারই আনন্দ? সেই আনন্দদানে সুচরিতারও কি কোনো হাত ছিল না? হয়তো ছিল না। হয়তো গোরার কাছে কোনো মানুষের কোনো মূল্য নাই, সে নিজের মত এবং উদ্দেশ্য লইয়াই একেবারে সকলের নিকট হইতে সুদূর হইয়া আছে–মানুষরা তাহার কাছে মত প্রয়োগ করিবার উপলক্ষমাত্র।

সুচরিতা এ কয়দিন বিশেষ করিয়া উপাসনায় মন দিয়াছিল। সে যেন পূর্বের চেয়েও পরেশবাবুকে বেশি করিয়া আশ্রয় করিবার চেষ্টা করিতেছিল। একদিন পরেশবাবু তাঁহার ঘরে একলা বসিয়া পড়িতেছিলেন, এমন সময় সুচরিতা তাঁহার কাছে চুপ করিয়া আসিয়া বসিল।

পরেশবাবু বই টেবিলের উপর রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রাধে?”

সুচরিতা কহিল, “কিছু না।”

বলিয়া তাঁহার টেবিলের উপরে যদিচ বই-কাগজ প্রভৃতি গোছানোই ছিল তবু সেগুলিকে নাড়িয়া-চাড়িয়া অন্যরকম করিয়া গুছাইতে লাগিল।

একটু পরে বলিয়া উঠিল, “বাবা, আগে তুমি আমাকে যেরকম পড়াতে এখন সেইরকম করে পড়াও না কেন?”

পরেশবাবু সস্নেহে একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “আমার ছাত্রী যে আমার ইস্কুল থেকে পাস করে বেরিয়ে গেছে। এখন তো তুমি নিজে পড়েই বুঝতে পার।”

সুচরিতা কহিল, “না, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারি নে, আমি আগের মতো তোমার কাছে পড়ব।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, কাল থেকে পড়াব।”

সুচরিতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বাবা, সেদিন বিনয়বাবু জাতিভেদের কথা অনেক বললেন, তুমি আমাকে সে সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়ে বল না কেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “মা, তুমি তো জানই, তোমরা আপনি ভেবে বুঝতে চেষ্টা করবে, আমার বা আর-কারো মত কেবল অভ্যস্ত কথার মতো ব্যবহার করবে না, আমি বরাবর তোমাদের সঙ্গে সেইরকম করেই ব্যবহার করেছি। প্রশ্নটা ঠিকমত মনে জেগে ওঠবার পূর্বেই সে সম্বন্ধে কোনো উপদেশ দিতে যাওয়া আর ক্ষুধা পাবার পূর্বেই খাবার খেতে দেওয়া একই, তাতে কেবল অরুচি এবং অপাক হয়। তুমি আমাকে যখনই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে আমি যা বুঝি বলব।”

সুচরিতা কহিল, “আমি তোমাকে প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করছি, আমরা জাতিভেদকে নিন্দা করি কেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “একটা বিড়াল পাতের কাছে বসে ভাত খেলে কোনো দোষ হয় না অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়, মানুষের প্রতি মানুষের এমন অপমান এবং ঘৃণা যে জাতিভেদে জন্মায় সেটাকে অধর্ম না বলে কী বলব? মানুষকে যারা এমন ভয়ানক অবজ্ঞা করতে পারে তারা কখনোই পৃথিবীতে বড়ো হতে পারে না, অন্যের অবজ্ঞা তাদের সইতেই হবে।”

সুচরিতা গোরার মুখে শোনা কথার অনুসরণ করিয়া কহিল, “এখনকার সমাজে যে বিকার উপস্থিত হয়েছে তাতে অনেক দোষ থাকতে পারে; সে দোষ তো সমাজের সকল জিনিসেই ঢুকেছে, তাই বলে আসল জিনিসটাকে দোষ দেওয়া যায় কি?”

পরেশবাবু তাঁহার স্বাভাবিক শান্তস্বরে কহিলেন, “আসল জিনিসটা কোথায় আছে জানলে বলতে পারতুম। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে মানুষ মানুষকে অসহ্য ঘৃণা করছে এবং তাতে আমাদের সকলকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, এমন অবস্থায় একটা কাল্পনিক আসল জিনিসের কথা চিন্তা করে মন সান্ত্বনা মানে কই?”

সুচরিতা পুনশ্চ গোরাদের কথার প্রতিধ্বনি-স্বরূপে কহিল, “আচ্ছা, সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখাই তো আমাদের দেশের চরমতত্ত্ব ছিল।”

পরেশবাবু কহিলেন, “সমদৃষ্টতে দেখা জ্ঞানের কথা, হৃদয়ের কথা নয়। সমদৃষ্টির মধ্যে প্রেমও নেই, ঘৃণাও নেই–সমদৃষ্টি রাগদ্বেষের অতীত। মানুষের হৃদয় এমনতরো হৃদয়ধর্মবিহীন জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেইজন্যে আমাদের দেশে এরকম সাম্যতত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও নীচ জাতকে দেবালয়ে পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। যদি দেবতার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে সাম্য না থাকে তবে দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সে তত্ত্ব থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?”

সুচরিতা পরেশবাবুর কথা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে বুঝিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। অবশেষে কহিল, “আচ্ছা বাবা, তুমি বিনয়বাবুদের এ-সব কথা বোঝাবার চেষ্টা কর না কেন?”

পরেশবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “বিনয়বাবুদের বুদ্ধি কম বলে যে এ-সব কথা বোঝেন না তা নয়, বরঞ্চ তাঁদের বুদ্ধি বেশি বলেই তাঁরা বুঝতে চান না, কেবল বোঝাতেই চান। তাঁরা যখন ধর্মের দিক থেকে অর্থাৎ সকলের চেয়ে বড়ো সত্যের দিক থেকে এ-সব কথা অন্তরের সঙ্গে বুঝতে চাইবেন তখন তোমার বাবার বুদ্ধির জন্যে তাঁদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে না। এখন তাঁরা অন্য দিক থেকে দেখছেন, এখন আমার কথা তাঁদের কোনো কাজেই লাগবে না।”

গোরাদের কথা যদিও সুচরিতা শ্রদ্ধার সহিত শুনিতেছিল, তবু তাহা তাহার সংস্কারের সহিত বিবাদ বাধাইয়া তাহার অন্তরের মধ্যে বেদনা দিতেছিল। সে শান্তি পাইতেছিল না। আজ পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিয়া সেই বিরোধ হইতে সে ক্ষণকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল। গোরা বিনয় বা আর কেহই যে পরেশবাবুর চেয়ে কোনো বিষয়ে ভালো বুঝে, এ কথা সুচরিতা কোনোমতেই মনে স্থান দিতে চায় না। পরেশবাবুর সঙ্গে যাহার মতের অনৈক্য হইয়াছে সুচরিতা তাহার উপর রাগ না করিয়া থাকিতে পারে নাই। সম্প্রতি গোরার সঙ্গে আলাপের পর গোরার কথা একেবারে রাগ বা অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দিতে পারিতেছিল না বলিয়াই সুচরিতা এমন একটা কষ্ট বোধ করিতেছিল। সেই কারণেই আবার শিশুকালের মতো করিয়া পরেশবাবুকে তাঁহার ছায়াটির ন্যায় নিয়ত আশ্রয় করিবার জন্য তাহার হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলতা উপস্থিত হইয়াছিল। চৌকি হইতে উঠিয়া দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া সুচরিতা পরেশবাবুর পিছনে তাঁহার চৌকির পিঠের উপর হাত রাখিয়া কহিল, “বাবা, আজ বিকালে আমাকে নিয়ে উপাসনা কোরো।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা।”

তাহার পরে নিজের শোবার ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া সুচরিতা গোরার কথাকে একেবারে অগ্রাহ্য করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু গোরার সেই বুদ্ধি ও বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুখ তাহার চোখের সম্মুখে জাগিয়া রহিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, গোরার কথা শুধু কথা নহে, সে যেন গোরা স্বয়ং; সে কথার আকৃতি আছে, গতি আছে, প্রাণ আছে– তাহা বিশ্বাসের বলে এবং স্বদেশপ্রেমের বেদনায় পরিপূর্ণ। তাহা মত নয় যে তাহাকে প্রতিবাদ করিয়াই চুকাইয়া দেওয়া যাইবে– তাহা যে সম্পূর্ণ মানুষ– এবং সে মানুষ সামান্য মানুষ নহে। তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিতে যে হাত ওঠে না। অত্যন্ত একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়িয়া সুচরিতার কান্না আসিতে লাগিল। কেহ যে তাহাকে এত বড়ো একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলিয়া দিয়া সম্পূর্ণ উদাসীনের মতো অনায়াসে দূরে চলিয়া যাইতে পারে এই কথা মনে করিয়া তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে চাহিল, অথচ কষ্ট পাইতেছে বলিয়াও ধিক্‌কারের সীমা রহিল না।

গোরা ২৪

২৪

এইরূপ স্থির হইয়াছিল যে, ইংরেজ কবি ড্রাইডেনের রচিত সংগীত-বিষয়ক একটি কবিতা বিনয় ভাবব্যক্তির সহিত আবৃত্তি করিয়া যাইবে এবং মেয়েরা অভিনয়মঞ্চে উপযুক্ত সাজে সজ্জিত হইয়া কাব্যলিখিত ব্যাপারের মূক অভিনয় করিতে থাকিবে। এ ছাড়া মেয়েরাও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি এবং গান প্রভৃতি করিবে।

বরদাসুন্দরী বিনয়কে অনেক ভরসা দিয়াছিলেন যে, তাহাকে তাঁহারা কোনোপ্রকারে তৈরি করিয়া লইবেন। তিনি নিজে ইংরেজি অতি সামান্যই শিখিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার দলের দুই-এক জন পণ্ডিতের প্রতি তাঁহার নির্ভর ছিল।

কিন্তু যখন আখড়া বসিল, বিনয় তাহার আবৃত্তির দ্বারা বরদাসুন্দরীর পণ্ডিতসমাজকে বিস্মিত করিয়া দিল। তাঁহাদের মণ্ডলীবহির্ভূত এই ব্যক্তিকে গড়িয়া লইবার সুখ হইতে বরদাসুন্দরী বঞ্চিত হইলেন। পূর্বে যাহারা বিনয়কে বিশেষ কেহ বলিয়া খাতির করে নাই তাহারা, বিনয় এমন ভালো ইংরেজি পড়ে বলিয়া তাহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা না করিয়া থাকিতে পারিল না। এমন-কি, হারানবাবুও তাঁহার কাগজে মাঝে মাঝে লিখিবার জন্য তাহাকে অনুরোধ করিলেন। এবং সুধীর তাহাদের ছাত্রসভায় মাঝে মাঝে ইংরেজি বক্তৃতা করিবার জন্য বিনয়কে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল।

ললিতার অবস্থাটা ভারি অদ্ভুত-রকম হইল। বিনয়কে যে কোনো সাহায্য কাহাকেও করিতে হইল না সেজন্য সে খুশিও হইল, আবার তাহাতে তাহার মনের মধ্যে একটা অসন্তোষও জন্মিল। বিনয় যে তাহাদের কাহারো অপেক্ষা ন্যূন নহে, বরঞ্চ তাহাদের সকলের চেয়ে ভালো, সে যে মনে মনে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করিবে এবং তাহাদের নিকট হইতে কোনোপ্রকার শিক্ষার প্রত্যাশা করিবে না, ইহাতে তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। বিনয়ের সম্বন্ধে সে যে কী চায়, কেমনটা হইলে তাহার মন বেশ সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল না। মাঝে হইতে তাহার অপ্রসন্নতা কেবলই ছোটোখাটো বিষয়ে তীব্রভাবে প্রকাশ পাইয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়কেই লক্ষ্য করিতে লাগিল। বিনয়ের প্রতি ইহা যে সুবিচার নহে এবং শিষ্টতাও নহে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল; বুঝিয়া সে কষ্ট পাইল এবং নিজেকে দমন করিতে যথেষ্ট চেষ্টা করিল, কিন্তু অকস্মাৎ অতি সামান্য উপলক্ষেই কেন যে তাহার একটা অসংগত অন্তর্‌জ্বালা সংযমের শাসন লঙ্ঘন করিয়া বাহির হইয়া পড়িত তাহা সে বুঝিতে পারিত না। পূর্বে যে ব্যাপারে যোগ দিবার জন্য সে বিনয়কে অবিশ্রাম উত্তেজিত করিয়াছে এখন তাহা হইতে নিরস্ত করিবার জন্যই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কিন্তু এখন সমস্ত আয়োজনকে বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া বিনয় অকারণে পলাতক হইবে কী বলিয়া? সময়ও আর অধিক নাই; এবং নিজের একটা নূতন নৈপুণ্য আবিষ্কার করিয়া সে নিজেই এই কাজে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে।

অবশেষে ললিতা বরদাসুন্দরীকে কহিল, “আমি এতে থাকব না।”

বরদাসুন্দরী তাঁহার মেজো মেয়েকে বেশ চিনিতেন, তাই নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”

ললিতা কহিল, “আমি যে পারি নে।”

বস্তুত যখন হইতে বিনয়কে আর আনাড়ি বলিয়া গণ্য করিবার উপায় ছিল না, তখন হইতেই ললিতা বিনয়ের সম্মুখে কোনোমতেই আবৃত্তি বা অভিনয় অভ্যাস করিতে চাহিত না। সে বলিত, “আমি আপনি আলাদা অভ্যাস করিব।’ ইহাতে সকলেরই অভ্যাসে বাধা পড়িত, কিন্তু ললিতাকে কিছুতেই পারা গেল না। অবশেষে, হার মানিয়া অভ্যাসক্ষেত্রে ললিতাকে বাদ দিয়াই কাজ চালাইতে হইল।

কিন্তু যখন শেষ অবস্থায় ললিতা একেবারেই ভঙ্গ দিতে চাহিল তখন বরদাসুন্দরীর মাথায় বজ্রাঘাত হইল। তিনি জানিতেন যে তাঁহার দ্বারা ইহার প্রতিকার হইতেই পারিবে না। তখন তিনি পরেশবাবুর শরণাপন্ন হইলেন। পরেশবাবু সামান্য বিষয়ে কখনোই তাঁহার মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাঁহারা প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, সেই অনুসারে সে পক্ষও আয়োজন করিয়াছেন, সময়ও অত্যন্ত সংকীর্ণ, এই-সমস্ত বিবেচনা করিয়া পরেশবাবু ললিতাকে ডাকিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “ললিতা, এখন তুমি ছেড়ে দিলে যে অন্যায় হবে।”

ললিতা রুদ্ধরোদন কণ্ঠে কহিল, “বাবা, আমি যে পারি নে। আমার হয় না।”

পরেশ কহিলেন, “তুমি ভালো না পারলে তোমার অপরাধ হবে না, কিন্তু না করলে অন্যায় হবে।”

ললিতা মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; পরেশবাবু কহিলেন, “মা, যখন তুমি ভার নিয়েছ তখন তোমাকে তো সম্পন্ন করতেই হবে। পাছে অহংকারে ঘা লাগে বলে আর তো পালাবার সময় নেই। লাগুক-না ঘা, সেটাকে অগ্রাহ্য করেও তোমাকে কর্তব্য করতে হবে। পারবে না মা?”

ললিতা পিতার মুখের দিকে মুখ তুলিয়া কহিল, “পারব।”

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ করিয়া বিনয়ের সম্মুখেই সমস্ত সংকোচ সম্পূর্ণ দূর করিয়া সে যেন একটা অতিরিক্ত বলের সঙ্গে, যেন স্পর্ধা করিয়া নিজের কর্তব্যে প্রবৃত্ত হইল। বিনয় এতদিন তাহার আবৃত্তি শোনে নাই। আজ শুনিয়া আশ্চর্য হইল। এমন সুস্পষ্ট সতেজ উচ্চারণ, কোথাও কিছুমাত্র জড়িমা নাই, এবং ভাব-প্রকাশের মধ্যে এমন একটা নিঃসংশয় বল যে, শুনিয়া বিনয় প্রত্যাশাতীত আনন্দ লাভ করিল। এই কণ্ঠস্বর তাহার কানে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল।

কবিতা-আবৃত্তিতে ভালো আবৃত্তিকারকের সম্বন্ধে শ্রোতার মনে একটা বিশেষ মোহ উৎপন্ন করে। সেই কবিতার ভাবটি তাহার পাঠককে মহিমা দান করে– সেটা যেন তাহার কণ্ঠস্বর, তাহার মুখশ্রী, তাহার চরিত্রের সঙ্গে জড়িত হইয়া দেখা দেয়। ফুল যেমন গাছের শাখায় তেমনি কবিতাটিও আবৃত্তিকারকের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়া তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে।

ললিতাও বিনয়ের কাছে কবিতায় মণ্ডিত হইয়া উঠিতে লাগিল। ললিতা এতদিন তাহার তীব্রতার দ্বারা বিনয়কে অনবরত উত্তেজিত করিয়া রাখিয়াছিল। যেখানে ব্যথা সেইখানেই কেবলই যেমন হাত পড়ে, বিনয়ও তেমনি কয়দিন ললিতার উষ্ণ বাক্য এবং তীক্ষ্ণ হাস্য ছাড়া আর কিছু ভাবিতেই পারে নাই। কেন যে ললিতা এমন করিল, তেমন বলিল, ইহাই তাহাকে বারংবার আলোচনা করিতে হইয়াছে; ললিতার অসন্তোষের রহস্য যতই সে ভেদ করিতে না পারিয়াছে ততই ললিতার চিন্তা তাহার মনকে অধিকার করিয়াছে। হঠাৎ ভোরের বেলা ঘুম হইতে জাগিয়া সে কথা তাহার মনে পড়িয়াছে, পরেশবাবুর বাড়িতে আসিবার সময় প্রত্যহই তাহার মনে বিতর্ক উপস্থিত হইয়াছে আজ না জানি ললিতাকে কিরূপভাবে দেখা যাইবে। যেদিন ললিতা লেশমাত্র প্রসন্নতা প্রকাশ করিয়াছে সেদিন বিনয় যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে এবং এই ভাবটি কী করিলে স্থায়ী হয় সেই চিন্তাই করিয়াছে, কিন্তু এমন কোনো উপায় খুঁজিয়া পায় নাই যাহা তাহার আয়ত্তাধীন।

এ কয়দিনের এই মানসিক আলোড়নের পর ললিতার কাব্য-আবৃত্তির মাধুর্য বিনয়কে বিশেষ করিয়া এবং প্রবল করিয়া বিচলিত করিল। তাহার এত ভালো লাগিল যে, কী বলিয়া প্রশংসা করিবে ভাবিয়া পাইল না। ললিতার মুখের সামনে ভালোমন্দ কোনো কথাই বলিতে তাহার সাহস হয় না– কেননা তাহাকে ভালো বলিলেই যে সে খুশি হইবে, মনুষ্যচরিত্রের এই সাধারণ নিয়ম ললিতার সম্বন্ধে না খাটিতে পারে– এমন-কি, সাধারণ নিয়ম বলিয়াই হয়তো খাটিবে না– এই কারণে বিনয় উচ্ছ্বসিত হৃদয় লইয়া বরদাসুন্দরীর নিকট ললিতার ক্ষমতার অজস্র প্রশংসা করিল। ইহাতে বিনয়ের বিদ্যা ও বুদ্ধির প্রতি বরদাসুন্দরীর শ্রদ্ধা আরো দৃঢ় হইল।

আর-একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল। ললিতা যখনই নিজে অনুভব করিল তাহার আবৃত্তি ও অভিনয় অনিন্দনীয় হইয়াছে, সুগঠিত নৌকা ঢেউয়ের উপর দিয়া যেমন করিয়া চলিয়া যায় সেও যখন তেমনি সুন্দর করিয়া তাহার কর্তব্যের দুরূহতার উপর দিয়া চলিয়া গেল, তখন হইতে বিনয়ের সম্বন্ধে তাহার তীব্রতাও দূর হইল। বিনয়কে বিমুখ করিবার জন্য তাহার চেষ্টামাত্র রহিল না। এই কাজটাতে তাহার উৎসাহ বাড়িয়া উঠিল এবং রিহার্সাল ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে তাহার যোগ ঘনিষ্ঠ হইল। এমন-কি, আবৃত্তি অথবা অন্য কিছু সম্বন্ধে বিনয়ের কাছে উপদেশ লইতে তাহার কিছুমাত্র আপত্তি রহিল না।

ললিতার এই পরিবর্তনে বিনয়ের বুকের উপর হইতে যেন একটা পাথরের বোঝা নামিয়া গেল। এত আনন্দ হইল যে, যখন-তখন আনন্দময়ীর কাছে গিয়া বালকের মতো ছেলেমানুষি করিতে লাগিল। সুচরিতার কাছে বসিয়া অনেক কথা বকিবার জন্য তাহার মনে কথা জমিতে থাকিল, কিন্তু আজকাল সুচরিতার সঙ্গে তাহার দেখাই হয় না। সুযোগ পাইলেই ললিতার সঙ্গে আলাপ করিতে বসিত, কিন্তু ললিতার কাছে তাহাকে বিশেষ সাবধান হইয়াই কথা বলিতে হইত; ললিতা যে মনে মনে তাহাকে এবং তাহার সকল কথাকে তীক্ষ্ণভাবে বিচার করে ইহা জানিত বলিয়া ললিতার সম্মুখে তাহার কথার স্রোতে স্বাভাবিক বেগ থাকিত না। ললিতা মাঝে মাঝে বলিত, “আপনি যেন বই পড়ে এসে কথা বলছেন, এমন করে বলেন কেন?”

বিনয় উত্তর করিত, “আমি যে এত বয়স পর্যন্ত কেবল বই পড়েই এসেছি, সেইজন্য মনটা ছাপার বইয়ের মতো হয়ে গেছে।”

ললিতা বলিত, “আপনি খুব ভালো করে বলবার চেষ্টা করবেন না– নিজের কথাটা ঠিক করে বলে যাবেন। আপনি এমন চমৎকার করে বলেন যে, আমার সন্দেহ হয় আপনি আর-কারো কথা ভেবে সাজিয়ে বলছেন।”

এই কারণে, স্বাভাবিক ক্ষমতাবশত একটা কথা বেশ সুসজ্জিত হইয়া বিনয়ের মনে আসিলে ললিতাকে বলিবার চেষ্টা করিয়া বিনয়কে তাহা সাদা করিয়া এবং স্বল্প করিয়া বলিতে হইত। কোনো একটা অলংকৃত বাক্য তাহার মুখে হঠাৎ আসিলে সে লজ্জিত হইয়া পড়িত।

ললিতার মনের ভিতর হইতে একটা যেন অকারণ মেঘ কাটিয়া গিয়া তাহার হৃদয় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বরদাসুন্দরীও তাহার পরিবর্তন দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। সে এখন পূর্বের ন্যায় কথায় কথায় আপত্তি প্রকাশ করিয়া বিমুখ হইয়া বসে না, সকল কাজে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয়। আগামী অভিনয়ের সাজসজ্জা ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাহার মনে প্রত্যহ নানাপ্রকার নূতন নূতন কল্পনার উদয় হইতে লাগিল, তাহাই লইয়া সে সকলকে অস্থির করিয়া তুলিল। এ সম্বন্ধে বরদাসুন্দরীর উৎসাহ যতই বেশি হউক তিনি খরচের কথাটাও ভাবেন– সেইজন্য, ললিতা যখন অভিনয়-ব্যাপারে বিমুখ ছিল তখনো যেমন তাঁহার উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়াছিল এখন তাহার উৎসাহিত অবস্থাতেও তেমনি তাঁহার সংকট উপস্থিত হইল। কিন্তু ললিতার উত্তেজিত কল্পনাবৃত্তিকে আঘাত করিতেও সাহস হয় না, যে কাজে সে উৎসাহ বোধ করে সে কাজের কোথাও লেশমাত্র অসম্পূর্ণতা ঘটিলে সে একেবারে দমিয়া যায়, তাহাতে যোগ দেওয়াই তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে।

ললিতা তাহার মনের এই উচ্ছ্বসিত অবস্থায় সুচরিতার কাছে অনেকবার ব্যগ্র হইয়া গিয়াছে। সুচরিতা হাসিয়াছে, কথা কহিয়াছে বটে, কিন্তু ললিতা তাহার মধ্যে বারংবার এমন একটা বাধা অনুভব করিয়াছে যে, সে মনে মনে রাগ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।

একদিন সে পরেশবাবুর কাছে গিয়া কহিল, “বাবা, সুচিদিদি যে কোণে বসে বসে বই পড়বে, আর আমরা অভিনয় করতে যাব, সে হবে না। ওকেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।”

পরেশবাবুও কয়দিন ভাবিতেছিলেন, সুচরিতা তাহার সঙ্গিনীদের নিকট হইতে কেমন যেন দূরবর্তিনী হইয়া পড়িতেছে। এরূপ অবস্থা তাহার চরিত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নহে বলিয়া তিনি আশঙ্কা করিতেছিলেন। ললিতার কথা শুনিয়া আজ তাহার মনে হইল, আমোদপ্রমোদে সকলের সঙ্গে যোগ দিতে না পারিলে সুচরিতার এইরূপ পার্থক্যের ভাব প্রশ্রয় পাইয়া উঠিবে। পরেশবাবু ললিতাকে কহিলেন, “তোমার মাকে বলো গে।”

ললিতা কহিল, “মাকে আমি বলব, কিন্তু সুচিদিদিকে রাজি করাবার ভার তোমাকে নিতে হবে।”

পরেশবাবু যখন বলিলেন তখন সুচরিতা আর আপত্তি করিতে পারিল না– সে আপন কর্তব্য পালন করিতে অগ্রসর হইল।

সুচরিতা কোণ হইতে বাহির হইয়া আসিতেই বিনয় তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় আলাপ জমাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু এই কয়দিনে কী একটা হইয়াছে, ভালো করিয়া সুচরিতার যেন নাগাল পাইল না। তাহার মুখশ্রীতে, তাহার দৃষ্টিপাতে, এমন একটা সুদূরত্ব প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহার কাছে অগ্রসর হইতে সংকোচ উপস্থিত হয়। পূর্বেও মেলামেশা ও কাজকর্মের মধ্যে সুচরিতার একটা নির্লিপ্ততা ছিল, এখন সেইটে অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। সে যে অভিনয়-কার্যের অভ্যাসে যোগ দিয়াছিল তাহার মধ্যেও তাহার স্বাতন্ত্র৻ নষ্ট হয় নাই। কাজের জন্য তাহাকে যতটুকু দরকার সেইটুকু সারিয়াই সে চলিয়া যাইত। সুচরিতার এইরূপ দূরত্ব প্রথমে বিনয়কে অত্যন্ত আঘাত দিল। বিনয় মিশুক লোক, যাহাদের সঙ্গে তাহার সৌহৃদ্য তাহাদের নিকট হইতে কোনোপ্রকার বাধা পাইলে বিনয়ের পক্ষে তাহা অত্যন্ত কঠিন হয়। এই পরিবারে সুচরিতার নিকট হইতেই এতদিন সে বিশেষভাবে সমাদর লাভ করিয়া আসিয়াছে, এখন হঠাৎ বিনা কারণে প্রতিহত হইয়া বড়োই বেদনা পাইল। কিন্তু যখন বুঝিতে পারিল এই একই কারণে সুচরিতার প্রতি ললিতার মনেও অভিমানের উদয় হইয়াছে তখন বিনয় সান্ত্বনালাভ করিল এবং ললিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ আরো ঘনিষ্ঠ হইল। তাহার নিকট হইতে সুচরিতাকে এড়াইয়া চলিবার অবকাশও সে দিল না, সে আপনিই সুচরিতার নিকট-সংস্রব পরিত্যাগ করিল এবং এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে সুচরিতা বিনয়ের নিকট হইতে বহুদূরে চলিয়া গেল।

এবারে কয়দিন গোরা উপস্থিত না থাকাতে বিনয় অত্যন্ত অবাধে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে সকল রকম করিয়া মিশিয়া যাইতে পারিয়াছিল। বিনয়ের স্বভাব এইরূপ অবারিতভাবে প্রকাশ পাওয়াতে পরেশবাবুর বাড়ির সকলেই একটা বিশেষ তৃপ্তি অনুভব করিল। বিনয়ও নিজের এইরূপ বাধামুক্ত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করিয়া যেরূপ আনন্দ পাইল এমন আর কখনো পায় নাই। তাহাকে যে ইঁহাদের সকলেরই ভালো লাগিতেছে ইহাই অনুভব করিয়া তাহার ভালো লাগাইবার শক্তি আরো বাড়িয়া উঠিল।

প্রকৃতির এই প্রসারণের সময়ে, নিজেকে স্বতন্ত্র শক্তিতে অনুভব করিবার দিনে, বিনয়ের কাছ হইতে সুচরিতা দূরে চলিয়া গেল। এই ক্ষতি এই আঘাত অন্য সময় হইলে দুঃসহ হইত, কিন্তু এখন সেটা সে সহজেই উত্তীর্ণ হইয়া গেল। আশ্চর্য এই যে, ললিতাও সুচরিতার ভাবান্তর উপলক্ষ করিয়া তাহার প্রতি পূর্বের ন্যায় অভিমান প্রকাশ করে নাই। আবৃত্তি ও অভিনয়ের উৎসাহই কি তাহাকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল?

এ দিকে সুচরিতাকে অভিনয়ে যোগ দিতে দেখিয়া হঠাৎ হারানবাবুও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তিনি “প্যারাডাইস লস্ট্‌’ হইতে এক অংশ আবৃত্তি করিবেন এবং ড্রাইডেনের কাব্য-আবৃত্তির ভূমিকাস্বরূপে সংগীতের মোহিনী শক্তি সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিবেন বলিয়া স্বয়ং প্রস্তাব করিলেন। ইহাতে বরদাসুন্দরী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন, ললিতাও সন্তুষ্ট হইল না। হারানবাবু নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করিয়া এই প্রস্তাব পূর্বেই পাকা করিয়া আসিয়াছিলেন। ললিতা যখন বলিল ব্যাপারটাকে এত সুদীর্ঘ করিয়া তুলিলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো আপত্তি করিবেন তখন হারানবাবু পকেট হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক পত্র বাহির করিয়া ললিতার হাতে দিয়া তাকে নিরুত্তর করিয়া দিলেন।

গোরা বিনা কাজে ভ্রমণে বাহির হইয়াছে, কবে ফিরিবে তাহা কেহ জানিত না। যদিও সুচরিতা এ সম্বন্ধে কোনো কথা মনে স্থান দিবে না ভাবিয়াছিল তবু প্রতিদিনই তাহার মনের ভিতরে আশা জন্মিত যে আজ হয়তো গোরা আসিবে। এ আশা কিছুতেই সে মন হইতে দমন করিতে পারিত না। গোরার ঔদাসীন্য এবং নিজের মনের এই অবাধ্যতায় যখন সে নিরতিশয় পীড়া বোধ করিতেছিল, যখন কোনোমতে এই জাল ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার জন্য তাহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময় হারানবাবু একদিন বিশেষভাবে ঈশ্বরের নাম করিয়া সুচরিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ পাকা করিবার জন্য পরেশবাবুকে পুনর্বার অনুরোধ করিলেন। পরেশবাবু কহিলেন, “এখন তো বিবাহের বিলম্ব আছে, এত শীঘ্র আবদ্ধ হওয়া কি ভালো?”

হারানবাবু কহিলেন, “বিবাহের পূর্বে কিছুকাল এই আবদ্ধ অবস্থায় যাপন করা উভয়ের মনের পরিণতির পক্ষে বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। প্রথম পরিচয় এবং বিবাহের মাঝখানে এইরকম একটা আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, যাতে সাংসারিক দায়িত্ব নেই অথচ বন্ধন আছে– এটা বিশেষ উপকারী।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, সুচরিতাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।”

হারানবাবু কহিলেন, “তিনি তো পূর্বেই মত দিয়েছেন।”

হারানবাবুর প্রতি সুচরিতার মনের ভাব সম্বন্ধে পরেশবাবুর এখনো সন্দেহ ছিল, তাই তিনি নিজে সুচরিতাকে ডাকিয়া তাহার নিকট হারানবাবুর প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। সুচরিতা নিজের দ্বিধাগ্রস্ত জীবনকে একটা কোথাও চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করিতে পারিলে বাঁচে– তাই সে এমন অবিলম্বে এবং নিশ্চিতভাবে সম্মতি দিল যে পরেশবাবুর সমস্ত সন্দেহ দূর হইয়া গেল। বিবাহের এত পূর্বে আবদ্ধ হওয়া কর্তব্য কি না তাহা তিনি ভালোরূপ বিবেচনা করিবার জন্য সুচরিতাকে অনুরোধ করিলেন– তৎসত্ত্বেও সুচরিতা এ প্রস্তাবে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না।

ব্রাউন্‌লো সাহেবের নিমন্ত্রণ সারিয়া আসিয়া একটি বিশেষ দিনে সকলকে ডাকিয়া ভাবী দম্পতির সম্বন্ধ পাকা করা হইবে এইরূপ স্থির হইল।

সুচরিতার ক্ষণকালের জন্য মনে হইল তাহার মন যেন রাহুর গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে মনে মনে স্থির করিল, হারানবাবুকে বিবাহ করিয়া ব্রাহ্মসমাজের কাজে যোগ দিবার জন্য সে মনকে কঠোরভাবে প্রস্তুত করিবে। হারানবাবুর নিকট হইতেই সে প্রত্যহ খানিকটা করিয়া ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে ইংরেজি বই পড়িয়া তাঁহারই নির্দেশমত চলিতে থাকিবে এইরূপ সংকল্প করিল। তাহার পক্ষে যাহা দুরূহ, এমন-কি অপ্রিয়, তাহাই গ্রহণ করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া সে মনের মধ্যে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিল।

হারানবাবুর সম্পাদিত ইংরেজি কাগজ কিছুকাল ধরিয়া সে পড়ে নাই। আজ সেই কাগজ ছাপা হইবামাত্র তাহা হাতে আসিয়া পড়িল। বোধ করি হারানবাবু বিশেষ করিয়াই পাঠাইয়া দিয়াছেন।

সুচরিতা কাগজখানি ঘরে লইয়া গিয়া স্থির হইয়া বসিয়া পরম কর্তব্যের মতো তাহার প্রথম লাইন হইতে পড়িতে আরম্ভ করিল। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে নিজেকে ছাত্রীর মতো জ্ঞান করিয়া এই পত্রিকা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিতে লাগিল।

জাহাজ পালে চলিতে চলিতে হঠাৎ পাহাড়ে ঠেকিয়া কাত হইয়া পড়িল। এই সংখ্যায় “সেকেলে বায়ুগ্রস্ত’-নামক একটি প্রবন্ধ আছে, তাহাতে বর্তমান কালের মধ্যে বাস করিয়াও যাহারা সেকালের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে তাহাদিগকে আক্রমণ করা হইয়াছে। যুক্তিগুলি যে অসংগত তাহা নহে, বস্তুত এরূপ যুক্তি সুচরিতা সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু প্রবন্ধটি পড়িবা মাত্রই সে বুঝিতে পারিল যে এই আক্রমণের লক্ষ্য গোরা। অথচ তাহার নাম নাই, অথবা তাহার লিখিত কোনো প্রবন্ধের উল্লেখ নাই। বন্দুকের প্রত্যেক গুলির দ্বারা একটা করিয়া মানুষ মারিয়া সৈনিক যেমন খুশি হয় এই প্রবন্ধের প্রত্যেক বাক্যে তেমনি কোনো-একটি সজীব পদার্থ বিদ্ধ হইতেছে বলিয়া যেন একটা হিংসার আনন্দ ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

এই প্রবন্ধ সুচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল। ইহার প্রত্যেক যুক্তি প্রতিবাদের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে তাহার ইচ্ছা হইল। সে মনে মনে কহিল, গৌরমোহনবাবু যদি ইচ্ছা করেন তবে এই প্রবন্ধকে তিনি ধুলায় লুটাইয়া দিতে পারেন। গোরার উজ্জ্বল মুখ তাহার চোখের সামনে জ্যোতির্ময় হইয়া জাগিয়া উঠিল এবং তাহার প্রবল কণ্ঠস্বর সুচরিতার বুকের ভিতর পর্যন্ত ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সেই মুখের ও বাক্যের অসামান্যতার কাছে এই প্রবন্ধ ও প্রবন্ধলেখকের ক্ষুদ্রতা এমনই তুচ্ছ হইয়া উঠিল যে সুচরিতা কাগজখানাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল।

অনেক কাল পরে সুচরিতা আপনি সেদিন বিনয়ের কাছে আসিয়া বসিল এবং তাহাকে কথায় কথায় বলিল, “আচ্ছা, আপনি যে বলেছিলেন যে-সব কাগজে আপনাদের লেখা বেরিয়েছে আমাকে পড়তে এনে দেবেন, কই দিলেন না?”

বিনয় এ কথা বলিল না যে ইতিমধ্যে সুচরিতার ভাবান্তর দেখিয়া সে আপন প্রতিশ্রুতি পালন করিতে সাহস করে নাই– সে কহিল, “আমি সেগুলো একত্র সংগ্রহ করে রেখেছি, কালই এনে দেব।”

বিনয় পরদিন পুস্তিকা ও কাগজের এক পুঁটুলি আনিয়া সুচরিতাকে দিয়া গেল। সুচরিতা সেগুলি হাতে পাইয়া আর পড়িল না, বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিল। পড়িতে অত্যন্ত ইচ্ছা করিল বলিয়াই পড়িল না। চিত্তকে কোনোমতেই বিক্ষিপ্ত হইতে দিবে না প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজের বিদ্রোহী চিত্তকে পুনর্বার হারানবাবুর শাসনাধীনে সমর্পণ করিয়া আর-একবার সে সান্ত্বনা অনুভব করিল

গোরা ২৫

২৫

রবিবার দিন সকালে আনন্দময়ী পান সাজিতেছিলেন, শশিমুখী তাঁহার পাশে বসিয়া সুপারি কাটিয়া স্তূপাকার করিতেছিল। এমন সময় বিনয় আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিতেই শশিমুখী তাহার কোলের আঁচল হইতে সুপারি ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল। আনন্দময়ী একটুখানি মুচ্‌কিয়া হাসিলেন।

বিনয় সকলেরই সঙ্গে ভাব করিতে পারিত। শশিমুখীর সঙ্গে এতদিন তাহার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। উভয় পক্ষেই পরস্পরের প্রতি খুব উপদ্রব চলিত। শশিমুখী বিনয়ের জুতা লুকাইয়া রাখিয়া তাহার নিকট হইতে গল্প আদায় করিবার উপায় বাহির করিয়াছিল। বিনয় শশিমুখীর জীবনের দুই-একটা সামান্য ঘটনা অবলম্বন করিয়া তাহাতে যথেষ্ট রঙ ফলাইয়া দুই-একটা গল্প বানাইয়া রাখিয়াছিল। তাহারই অবতারণা করিলে শশিমুখী বড়োই জব্দ হইত। প্রথমে সে বক্তার প্রতি মিথ্যা ভাষণের অপবাদ দিয়া উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদের চেষ্টা করিত; তাহাতে হার মানিলে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিত। সেও বিনয়ের জীবনচরিত বিকৃত করিয়া পাল্‌টা গল্প বানাইবার চেষ্টা করিয়াছে– কিন্তু রচনাশক্তিতে সে বিনয়ের সমকক্ষ না হওয়াতে এ সম্বন্ধে বড়ো একটা সফলতা লাভ করিতে পারে নাই।

যাহা হউক, বিনয় এ বাড়িতে আসিলেই সব কাজ ফেলিয়া শশিমুখী তাহার সঙ্গে গোলমাল করিবার জন্য ছুটিয়া আসিত। এক-এক দিন এত উৎপাত করিত যে আনন্দময়ী তাহাকে ভর্ৎসনা করিতেন, কিন্তু দোষ তো তাহার একলার ছিল না, বিনয় তাহাকে এমনি উত্তেজিত করিয়া তুলিত যে আত্মসংবরণ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইত। সেই শশিমুখী আজ যখন বিনয়কে দেখিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল তখন আনন্দময়ী হাসিলেন, কিন্তু সে হাসি সুখের হাসি নহে।

বিনয়কেও এই ক্ষুদ্র ঘটনায় এমন আঘাত করিল যে, সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয়ের পক্ষে শশিমুখীকে বিবাহ করা যে কতখানি অসংগত তাহা এইরূপ ছোটোখাটো ব্যাপারেই ফুটিয়া উঠে। বিনয় যখন সম্মতি দিয়াছিল তখন সে কেবল গোরার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্বের কথাই চিন্তা করিয়াছিল, ব্যাপারটাকে কল্পনার দ্বারা অনুভব করে নাই। তা ছাড়া আমাদের দেশে বিবাহটা যে প্রধানত ব্যক্তিগত নহে, তাহা পারিবারিক, এই কথা লইয়া বিনয় গৌরব করিয়া কাগজে অনেক প্রবন্ধ লিখিয়াছে; নিজেও এ সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা বিতৃষ্ণাকে মনে স্থানও দেয় নাই। আজ শশিমুখী যে বিনয়কে দেখিয়া আপনার বর বলিয়া জিব কাটিয়া পলাইয়া গেল ইহাতে শশিমুখীর সঙ্গে তাহার ভাবী সম্বন্ধের একটা চেহারা তাহার কাছে দেখা দিল। মুহূর্তের মধ্যে তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। গোরা যে তাহার প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাহাকে কতদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতেছিল ইহা মনে করিয়া গোরার উপরে তাহার রাগ হইল, নিজের উপরে ধিক্কার জন্মিল, এবং আনন্দময়ী যে প্রথম হইতেই এই বিবাহে নিষেধ করিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া তাঁহার সূক্ষ্ণদর্শিতায় তাঁহার প্রতি বিনয়ের মন বিস্ময়মিশ্রিত ভক্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

আনন্দময়ী বিনয়ের মনের ভাবটা বুঝিলেন। তিনি অন্য দিকে তাহার মনকে ফিরাইবার জন্য বলিলেন, “কাল গোরার চিঠি পেয়েছি বিনয়।”

বিনয় একটু অন্যমনস্ক ভাবেই কহিল, “কি লিখেছে?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের খবর বড়ো একটা কিছু দেয় নি। দেশের ছোটোলোকদের দুর্দশা দেখে দুঃখ করে লিখেছে। ঘোষপাড়া বলে কোন্‌-এক গ্রামে ম্যাজিস্ট্রেট কী সব অন্যায় করেছে তারই বর্ণনা করেছে।”

গোরার প্রতি একটা বিরুদ্ধ ভাবের উত্তেজনা হইতেই অসহিষ্ণু হইয়া বিনয় বলিয়া উঠিল, “গোরার ঐ পরের দিকেই দৃষ্টি, আর আমরা সমাজের বুকের উপরে বসে প্রতিদিন যে-সব অত্যাচার করছি তা কেবলই মার্জনা করতে হবে, আর বলতে হবে এমন সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না।”

হঠাৎ গোরার উপরে এইরূপ দোষারোপ করিয়া বিনয় যেন অন্য পক্ষ বলিয়া নিজেকে দাঁড় করাইল দেখিয়া আনন্দময়ী হাসিলেন।

বিনয় কহিল, “মা, তুমি হাসছ, মনে করছ হঠাৎ বিনয় এমন রাগ করে উঠল কেন? কেন রাগ হয় তোমাকে বলি। সুধীর সেদিন আমাকে তাদের নৈহাটি স্টেশনে তার এক বন্ধুর বাগানে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা শেয়ালদা ছাড়তেই বৃষ্টি আরম্ভ হল। সোদপুর স্টেশনে যখন গাড়ি থামল দেখি, একটি সাহেবি-কাপড়-পরা বাঙালি নিজে মাথায় দিব্যি ছাতা দিয়ে তার স্ত্রীকে গাড়ি থেকে নাবালে। স্ত্রীর কোলে একটি শিশু ছেলে; গায়ের মোটা চাদরটা দিয়ে সেই ছেলেটিকে কোনোমতে ঢেকে খোলা স্টেশনের এক ধারে দাঁড়িয়ে সে বেচারি শীতে ও লজ্জায় জড়সড় হয়ে ভিজতে লাগল– তার স্বামী জিনিসপত্র নিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁকডাক বাধিয়ে দিলে। আমার এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, সমস্ত বাংলাদেশে কি রৌদ্রে কি বৃষ্টিতে কি ভদ্র কি অভদ্র কোনো স্ত্রীলোকের মাথায় ছাতা নেই। যখন দেখলুম স্বামীটা নির্লজ্জভাবে মাথায় ছাতা দিয়েছে, আর তার স্ত্রী গায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে নীরবে ভিজছে, এই ব্যবহারটাকে মনে মনেও নিন্দা করছে না এবং স্টেশনসুদ্ধ কোনো লোকের মনে এটা কিছুমাত্র অন্যায় বলে বোধ হচ্ছে না, তখন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি– আমরা স্ত্রীলোকদের অত্যন্ত সমাদর করি– তাদের লক্ষ্ণী বলে, দেবী বলে জানি, এ-সমস্ত অলীক কাব্যকথা আর কোনোদিন মুখেও উচ্চারণ করব না। আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি, কিন্তু দেশের সেই নারীমূর্তির মহিমা দেশের স্ত্রীলোকের মধ্যে যদি প্রত্যক্ষ না করি– বুদ্ধিতে, শক্তিতে, কর্তব্যবোধের ঔদার্যে আমাদের মেয়েদের যদি পূর্ণ পরিণত সতেজ সবল ভাবে আমরা না দেখি– ঘরের মধ্যে দুর্বলতা সংকীর্ণতা এবং অপরিণতি যদি দেখতে পাই– তা হলে কখনোই দেশের উপলব্ধি আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না।”

নিজের উৎসাহে হঠাৎ লজ্জিত হইয়া বিনয় স্বাভাবিক সুরে কহিল, “মা, তুমি ভাবছ বিনয় মাঝে মাঝে এইরকম বড়ো বড়ো কথায় বক্তৃতা করে থাকে– আজও তাকে বক্তৃতায় পেয়েছে। অভ্যাসবশত আমার কথাগুলো বক্তৃতার মতো হয়ে পড়ে, আজ এ আমার কিন্তু বক্তৃতা নয়। দেশের মেয়েরা যে দেশের কতখানি আগে আমি তো ভালো করে বুঝতেই পারি নি, কখনো চিন্তাও করি নি। মা, আর বেশি বকব না। আমি বেশি কথা কই বলে আমার কথাকে কেউ আমারই মনের কথা বলে বিশ্বাস করে না। এবার থেকে কথা কমাব।”

বলিয়া বিনয় আর বিলম্ব না করিয়া উৎসাহদীপ্ত চিত্তে প্রস্থান করিল।

আনন্দময়ী মহিমকে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাবা, বিনয়ের সঙ্গে আমাদের শশিমুখীর বিবাহ হবে না।”

মহিম। কেন? তোমার অমত আছে?

আনন্দময়ী। এ সম্বন্ধে শেষ পর্যন্ত টিঁকবে না বলেই আমার অমত, নইলে অমত করব কেন?

মহিম। গোরা রাজি হয়েছে, বিনয়ও রাজি, তবে টিঁকবে না কেন? অবশ্য, তুমি যদি মত না দাও তা হলে বিনয় এ কাজ করবে না সে আমি জানি।

আনন্দময়ী। আমি বিনয়কে তোমার চেয়ে ভালো জানি।

মহিম। গোরার চেয়েও?

আনন্দময়ী। হাঁ, গোরার চেয়েও ভালো জানি, সেইজন্যেই সকল দিক ভেবে আমি মত দিতে পারছি নে।

মহিম। আচ্ছা, গোরা ফিরে আসুক।

আনন্দময়ী। মহিম, আমার কথা শোনো। এ নিয়ে যদি বেশি পীড়াপীড়ি কর তা হলে শেষকালে একটা গোলমাল হবে। আমার ইচ্ছা নয় যে, গোরা বিনয়কে এ নিয়ে কোনো কথা বলে।

“আচ্ছা দেখা যাবে” বলিয়া মহিম মুখে একটা পান লইয়া রাগ করিয়া ঘর হইতে চলিয়া গেল।

গোরা ২৬

২৬

গোরা যখন ভ্রমণে বাহির হইল তখন তাহার সঙ্গে অবিনাশ মতিলাল বসন্ত এবং রমাপতি এই চারজন সঙ্গী ছিল। কিন্তু গোরার নির্দয় উৎসাহের সঙ্গে তাহারা তাল রাখিতে পারিল না। অবিনাশ এবং বসন্ত অসুস্থ শরীরের ছুতা করিয়া চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল। নিতান্তই গোরার প্রতি ভক্তিবশত মতিলাল ও রমাপতি তাহাকে একলা ফেলিয়া চলিয়া যাইতে পারিল না। কিন্তু তাহাদের কষ্টের সীমা ছিল না; কারণ, গোরা চলিয়াও শ্রান্ত হয় না, আবার কোথাও স্থির হইয়া বাস করিতেও তাহার বিরক্তি নাই। গ্রামের যে-কোনো গৃহস্থ গোরাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া ভক্তি করিয়া ঘরে রাখিয়াছে তাহার বাড়িতে আহার ব্যবহারের যতই অসুবিধা হউক, দিনের পর দিন সে কাটাইয়াছে। তাহার আলাপ শুনিবার জন্য সমস্ত গ্রামের লোক তাহার চারি দিকে সমাগত হইত, তাহাকে ছাড়িতে চাহিত না।

ভদ্রসমাজ শিক্ষিতসমাজ ও কলিকাতা-সমাজের বাহিরে আমাদের দেশটা যে কিরূপ গোরা তাহা এই প্রথম দেখিল। এই নিভৃত প্রকাণ্ড গ্রাম্য ভারতবর্ষ যে কত বিচ্ছিন্ন, কত সংকীর্ণ, কত দুর্বল– সে নিজের শক্তি সম্বন্ধে যে কিরূপ নিতান্ত অচেতন এবং মঙ্গল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও উদাসীন– প্রত্যেক পাঁচ-সাত ক্রোশের ব্যবধানে তাহার সামাজিক পার্থক্য যে কিরূপ একান্ত– পৃথিবীর বৃহৎ কর্মক্ষেত্রে চলিবার পক্ষে সে যে কতই স্বরচিত ও কাল্পনিক বাধায় প্রতিহত– তুচ্ছতাকে যে সে কতই বড়ো করিয়া জানে এবং সংস্কারমাত্রেই যে তাহার কাছে কিরূপ নিশ্চলভাবে কঠিন– তাহার মন যে কতই সুপ্ত, প্রাণ যে কতই স্বল্প, চেষ্টা যে কতই ক্ষীণ– তাহা গোরা গ্রামবাসীদের মধ্যে এমন করিয়া বাস না করিলে কোনোমতেই কল্পনা করিতে পারিত না। গোরা গ্রামে বাস করিবার সময় একটা পাড়ায় আগুন লাগিয়াছিল। এত বড়ো একটা সংকটেও সকলে দলবদ্ধ হইয়া প্রাণপণ চেষ্টায় বিপদের বিরুদ্ধে কাজ করিবার শক্তি যে তাহাদের কত অল্প তাহা দেখিয়া গোরা আশ্চর্য হইয়া গেল। সকলেই গোলমাল দৌড়াদৌড়ি কান্নাকাটি করিতে লাগিল, কিন্তু বিধিবদ্ধভাবে কিছুই করিতে পারিল না। সে পাড়ার নিকটে জলাশয় ছিল না; মেয়েরা দূর হইতে জল বহিয়া আনিয়া ঘরের কাজ চালায়, অথচ প্রতিদিনেরই সেই অসুবিধা লাঘব করিবার জন্য ঘরে একটা স্বল্পব্যয়ে কূপ খনন করিয়া রাখে সংগতিপন্ন লোকেরও সে চিন্তাই ছিল না। পূর্বেও এ পাড়ায় মাঝে মাঝে আগুন লাগিয়াছে, তাহাকে দৈবের উৎপাত বলিয়াই সকলে নিরুদ্যম হইয়া আছে, নিকটে কোনোপ্রকার জলের ব্যবস্থা করিয়া রাখিবার জন্য তাহাদের কোনোরূপ চেষ্টাই জন্মে নাই। পাড়ার নিতান্ত প্রয়োজন সম্বন্ধেও যাহাদের বোধশক্তি এমন আশ্চর্য অসাড় তাহাদের কাছে সমস্ত দেশের আলোচনা করা গোরার কাছে বিদ্রূপ বলিয়া বোধ হইল। সকলের চেয়ে গোরার কাছে আশ্চর্য এই লাগিল যে, মতিলাল ও রমাপতি এই-সমস্ত দৃশ্যে ও ঘটনায় কিছুমাত্র বিচলিত হইত না, বরঞ্চ গোরার ক্ষোভকে তাহারা অসংগত বলিয়াই মনে করিত। ছোটোলোকেরা তো এইরকম করিয়াই থাকে, তাহারা এমনি করিয়াই ভাবে, এই-সকল কষ্টকে তাহারা কষ্টই মনে করে না। ছোটোলোকদের পক্ষে এরূপ ছাড়া আর-যে কিছু হইতেই পারে, তাহাই কল্পনা করা তাহারা বাড়াবাড়ি বলিয়া বোধ করে। এই অজ্ঞতা জড়তা ও দুঃখের বোঝা যে কী ভয়ংকর প্রকাণ্ড এবং এই ভার যে আমাদের শিক্ষিত-অশিক্ষিত ধনী-দরিদ্র সকলেরই কাঁধের উপর চাপিয়া রহিয়াছে, প্রত্যেককেই অগ্রসর হইতে দিতেছে না, এই কথা আজ স্পষ্ট করিয়া বুঝিয়া গোরার চিত্ত রাত্রিদিন ক্লিষ্ট হইতে লাগিল।

মতিলাল বাড়ি হইতে পীড়ার সংবাদ পাইয়াছে বলিয়া বিদায় হইল; গোরার সঙ্গে কেবল রমাপতি অবশিষ্ট রহিল।

উভয়ে চলিতে চলিতে এক জায়গায় নদীর চরে এক মুসলমান-পাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আতিথ্যগ্রহণের প্রত্যাশায় খুঁজিতে খুঁজিতে সমস্ত গ্রামের মধ্যে কেবল একটি ঘর মাত্র হিন্দু নাপিতের সন্ধান পাওয়া গেল। দুই ব্রাহ্মণ তাহারই ঘরে আশ্রয় লইতে গিয়া দেখিল, বৃদ্ধ নাপিত ও তাহার স্ত্রী একটি মুসলমানের ছেলেকে পালন করিতেছে। রমাপতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সে তো ব্যাকুল হইয়া উঠিল। গোরা নাপিতকে তাহার অনাচারের জন্য ভর্ৎসনা করাতে সে কহিল, “ঠাকুর, আমরা বলি হরি, ওরা বলে আল্লা, কোনো তফাত নেই।”

তখন রৌদ্র প্রখর হইয়াছে– বিস্তীর্ণ বালুচর, নদী বহুদূর। রমাপতি পিপাসায় ক্লিষ্ট হইয়া কহিল, “হিন্দুর পানীয় জল পাই কোথায়?”

নাপিতের ঘরে একটা কাঁচা কূপ আছে– কিন্তু ভ্রষ্টাচারের সে কূপ হইতে রমাপতি জল খাইতে না পারিয়া মুখ বিমর্ষ করিয়া বসিয়া রহিল।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ছেলের কি মা-বাপ নেই?”

নাপিত কহিল, “দু’ই আছে, কিন্তু না থাকারই মতো।”

গোরা কহিল, “সে কী রকম?”

নাপিত যে ইতিহাসটা বলিল, তাহার মর্ম এই–

যে জমিদারিতে ইহারা বাস করিতেছে তাহা নীলকর সাহেবদের ইজারা। চরে নীলের জমি লইয়া প্রজাদের সহিত নীলকুঠির বিরোধের অন্ত নাই। অন্য সমস্ত প্রজা বশ মানিয়াছে, কেবল এই চর-ঘোষপুরের প্রজাদিগকে সাহেবরা শাসন করিয়া বাধ্য করিতে পারে নাই। এখানকার প্রজারা সমস্তই মুসলমান এবং ইহাদের প্রধান ফরুসর্দার কাহাকেও ভয় করে না। নীলকুঠির উৎপাত উপলক্ষে দুই বার পুলিসকে ঠেঙাইয়া সে জেল খাটিয়া আসিয়াছে; তাহার এমন অবস্থা হইয়াছে যে, তাহার ঘরে ভাত নাই বলিলেই হয়, কিন্তু সে কিছুতেই দমিতে জানে না। এবারে নদীর কাঁচি চরে চাষ দিয়া এ গ্রামের লোকেরা কিছু বোরো ধান পাইয়াছিল– আজ মাসখানেক হইল নীলকুঠির ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং আসিয়া লাঠিয়ালসহ প্রজার ধান লুঠ করে। সেই উৎপাতের সময় ফরুসর্দার সাহেবের ডান হাতে এমন এক লাঠি বসাইয়াছিল যে ডাক্তারখানায় লইয়া গিয়া তাহার সেই হাত কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছিল। এত বড়ো দুঃসাহসিক ব্যাপার এ অঞ্চলে আর কখনো হয় নাই। ইহার পর হইতে পুলিসের উৎপাত পাড়ায় পাড়ায় যেন আগুনের মতো লাগিয়াছে– প্রজাদের কাহারো ঘরে কিছু রাখিল না, ঘরের মেয়েদের ইজ্জত আর থাকে না। ফরুসর্দার এবং বিস্তর লোককে হাজতে রাখিয়াছে, গ্রামের বহুতর লোক পলাতক হইয়াছে। ফরুর পরিবার আজ নিরন্ন, এমন-কি তাহার পরনের একখানি মাত্র কাপড়ের এমন দশা হইয়াছে যে, ঘর হইতে সে বাহির হইতে পারিত না; তাহার একমাত্র বালক পুত্র তামিজ, নাপিতের স্ত্রীকে গ্রামসম্পর্কে মাসি বলিয়া ডাকিত; সে খাইতে পায় না দেখিয়া নাপিতের স্ত্রী তাহাকে নিজের বাড়িতে আনিয়া পালন করিতেছে। নীলকুঠির একটা কাছারি ক্রোশ-দেড়েক তফাতে, দারোগা এখনো তাহার দলবল লইয়া সেখানে আছে, তদন্ত উপলক্ষে গ্রামে যে কখন আসে এবং কী করে তাহার ঠিকানা নাই। গতকল্য নাপিতের প্রতিবেশী বৃদ্ধ নাজিমের ঘরে পুলিসের আবির্ভাব হইয়াছিল। নাজিমের এক যুবক শ্যালক, ভিন্ন এলেকা হইতে তাহার ভগিনীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল– দারোগা নিতান্তই বিনা কারণে “বেটা তো জোয়ান কম নয়, দেখেছ বেটার বুকের ছাতি’ বলিয়া হাতের লাঠিটা দিয়া তাহাকে এমন একটা খোঁচা মারিল যে তাহার দাঁত ভাঙিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল, তাহার ভগিনী এই অত্যাচার দেখিয়া ছুটিয়া আসিতেই সেই বৃদ্ধাকে এক ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দিল। পূর্বে পুলিস এ পাড়ায় এমনতরো উপদ্রব করিতে সাহস করিত না, কিন্তু এখন পাড়ার বলিষ্ঠ যুবাপুরুষমাত্রই হয় গ্রেফতার নয় পলাতক হইয়াছে। সেই পলাতকদিগকে সন্ধানের উপলক্ষ করিয়াই পুলিস গ্রামকে এখনো শাসন করিতেছে। কবে এ গ্রহ কাটিয়া যাইবে তাহা কিছুই বলা যায় না।

গোরা তো উঠিতে চায় না, ও দিকে রমাপতির প্রাণ বাহির হইতেছে। সে নাপিতের মুখের ইতিবৃত্ত শেষ না হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুর পাড়া কত দূরে আছে?”

নাপিত কহিল, “ক্রোশ দেড়েক দূরে যে নীলকুঠির কাছারি, তার তহসিলদার ব্রাহ্মণ, নাম মাধব চাটুজ্জে।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “স্বভাবটা?”

নাপিত কহিল, “যমদূত বললেই হয়। এত বড়ো নির্দয় অথচ কৌশলী লোক আর দেখা যায় না। এই যে কদিন দারোগাকে ঘরে পুষছে তার সমস্ত খরচা আমাদেরই কাছ থেকে আদায় করবে– তাতে কিছু মুনফাও থাকবে।”

রমাপতি কহিল, “গৌরবাবু, চলুন আর তো পারা যায় না।” বিশেষত নাপিত-বউ যখন মুসলমান ছেলেটিকে তাহাদের প্রাঙ্গণের কুয়াটার কাছে দাঁড় করাইয়া ঘটিতে করিয়া জল তুলিয়া স্নান করাইয়া দিতে লাগিল তখন তাহার মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল এবং এ বাড়িতে বসিয়া থাকিতে তাহার প্রবৃত্তিই হইল না।

গোরা যাইবার সময় নাপিতকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই উৎপাতের মধ্যে তুমি যে এ পাড়ায় এখনো টিঁকে আছে? আর কোথাও তোমার আত্মীয় কেউ নেই?”

নাপিত কহিল, “অনেক দিন আছি, এদের উপর আমার মায়া পড়ে গেছে। আমি হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ার পুরুষ বলতে আর বড়ো কেউ নেই, আমি যদি যাই তা হলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া করে আবার আমি আসব।”

দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের সুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল। বেটারা প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোঁয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নির্বুদ্ধিতার চরম বলিয়া তাহার কাছে মনে হইল। যথোচিত শাসনের দ্বারা ইহাদের এই ঔদ্ধত্য চূর্ণ হইলেই যে ভালো হয় ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না। এই প্রকারের লক্ষ্ণীছাড়া বেটাদের প্রতি পুলিসের উৎপাত ঘটিয়াই থাকে এবং ঘটিতেই বাধ্য এবং ইহারাই সেজন্য প্রধানত দায়ী এইরূপ তাহার ধারণা। মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া লইলেই তো হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন রহিল কোথায়? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল।

মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে গোরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল না। অবশেষে গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চালা যখন কিছুদূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাৎ গোরা আসিয়া কহিল, “রমাপতি, তুমি খেতে যাও, আমি সেই নাপিতের বাড়ি চললুম।”

রমাপতি কহিল, “সে কী কথা! আপনি খাবেন না? চাটুজ্জের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে তার পরে যাবেন।”

গোরা কহিল, “আমার কর্তব্য আমি করব, এখন তুমি খাওয়া-দাওয়া সেরে কলকাতায় চলে যেয়ো– ঐ ঘোষপুর-চরে আমাকে বোধ হয় কিছুদিন থেকে যেতে হবে– তুমি সে পারবে না।”

রমাপতির শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। গোরার মতো ধর্মপ্রাণ হিন্দু ঐ ম্লেচ্ছের ঘরে বাস করিবার কথা কোন্‌ মুখে উচ্চারণ করিল তাই সে ভাবিয়া পাইল না। গোরা কি পানভোজন পরিত্যাগ করিয়া প্রায়োপবেশনের সংকল্প করিয়াছে তাই সে ভাবিতে লাগিল। কিন্তু তখন ভাবিবার সময় নহে, এক-এক মুহূর্ত তাহার কাছে এক-এক যুগ বলিয়া বোধ হইতেছে; গোরার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় পলায়নের জন্য তাহাকে অধিক অনুরোধ করিতে হইল না। ক্ষণকালের জন্য রমাপতি চাহিয়া দেখিল, গোরার সুদীর্ঘ দেহ একটি খর্ব ছায়া ফেলিয়া মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে জনশূন্য তপ্ত বালুকার মধ্য দিয়া একাকী ফিরিয়া চলিয়াছে।

ক্ষুধায় তৃষ্ণায় গোরাকে অভিভূত করিয়াছিল, কিন্তু দুর্‌বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের অন্ন খাইয়া তবে জাত বাঁচাইতে হইবে, এ কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল ততই তাহার অসহ্য বোধ হইল। তাহার মুখ-চোখ লাল ও মাথা গরম হইয়া মনের মধ্যে বিষম একটা বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। সে ভাবিল, “পবিত্রতাকে বাহিরের জিনিস করিয়া তুলিয়া ভারতবর্ষে আমরা এ কী ভয়ংকর অধর্ম করিতেছি। উৎপাত ডাকিয়া আনিয়া মুসলমানকে যে লোক পীড়ন করিতেছে তাহারই ঘরে আমার জাত থাকিবে আর উৎপাত স্বীকার করিয়া মুসলমানের ছেলেকে যে রক্ষা করিতেছে এবং সমাজের নিন্দাও বহন করিতে প্রস্তুত হইয়াছে তাহারই ঘরে আমার জাত নষ্ট হইবে! যাই হোক, এই আচারবিচারের ভালোমন্দের কথা পরে ভাবিব, কিন্তু এখন তো পারিলাম না।’

নাপিত গোরাকে একলা ফিরিতে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। গোরা প্রথমে আসিয়া নাপিতের ঘটি নিজের হাতে ভালো করিয়া মাজিয়া কূপ হইতে জল তুলিয়া খাইল এবং কহিল– ঘরে যদি কিছু চাল ডাল থাকে তো দাও আমি রাঁধিয়া খাইব। নাপিত ব্যস্ত হইয়া রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিল। গোরা আহার সারিয়া কহিল, “আমি তোমার এখানে দু-চার দিন থাকব।”

নাপিত ভয় পাইয়া হাত জোড় করিয়া কহিল, “আপনি এই অধমের এখানে থাকবেন তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার আর কিছুই নেই। কিন্তু দেখুন, আমাদের উপরে পুলিসের দৃষ্টি পড়েছে, আপনি থাকলে কী ফেসাদ ঘটবে তা বলা যায় না।”

গোরা কহিল, “আমি এখানে উপস্থিত থাকলে পুলিস কোনো উৎপাত করতে সাহস করবে না। যদি করে, আমি তোমাদের রক্ষা করব।”

নাপিত কহিল, “দোহাই আপনার, রক্ষা করবার যদি চেষ্টা করেন তা হলে আমাদের আর রক্ষা থাকবে না। ও বেটারা ভাববে আমিই চক্রান্ত করে আপনাকে ডেকে এনে ওদের বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করে দিয়েছি। এতদিন কোনোপ্রকারে টিঁকে ছিলুম, আর টিঁকতে পারব না। আমাকে সুদ্ধ যদি এখান থেকে উঠতে হয় তা হলে গ্রাম পয়মাল হয়ে যাবে।”

গোরা চিরদিন শহরে থাকিয়াই মানুষ হইয়াছে, নাপিত কেন যে এত ভয় পাইতেছে তাহা তাহার পক্ষে বুঝিতে পারাই শক্ত। সে জানিত ন্যায়ের পক্ষে জোর করিয়া দাঁড়াইলেই অন্যায়ের প্রতিকার হয়। বিপন্ন গ্রামকে অসহায় রাখিয়া চলিয়া যাইতে কিছুতেই তাহার কর্তব্যবুদ্ধি সম্মত হইল না। তখন নাপিত তাহার পায়ে ধরিয়া কহিল, “দেখুন, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার পুণ্যবলে আমার বাড়িতে অতিথি হয়েছেন, আপনাকে যেতে বলছি এতে আমার অপরাধ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রতি আপনার দয়া আছে জেনেই বলছি, আপনি আমার এই বাড়িতে বসে পুলিসের অত্যাচারে যদি কোনো বাধা দেন তা হলে আমাকে বড়োই বিপদে ফেলবেন।”

নাপিতের এই ভয়কে অমূলক কাপুরুষতা মনে করিয়া গোরা কিছু বিরক্ত হইয়াই অপরাহ্নে তাহার ঘর ছাড়িয়া বাহির হইল। এই ম্লেচ্ছাচারীর ঘরে আহারাদি করিয়াছে মনে করিয়া তাহার মনের মধ্যে একটা অপ্রসন্নতাও জন্মিতে লাগিল। ক্লান্তশরীরে এবং উত্ত্যক্তচিত্তে সন্ধ্যার সময়ে সে নীলকুঠির কাছারিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। আহার সারিয়া রমাপতি কলিকাতায় রওনা হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব করে নাই, তাই সেখানে তাহার দেখা পাওয়া গেল না। মাধব চাটুজ্জে বিশেষ খাতির করিয়া গোরাকে আতিথ্যে আহ্বান করিল। গোরা একেবারেই আগুন হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনার এখানে আমি জলগ্রহণও করব না।”

মাধব বিস্মিত হইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিতেই গোরা তাহাকে অন্যায়কারী অত্যাচারী বলিয়া কটুক্তি করিল, এবং আসন গ্রহণ না করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দারোগা তক্তপোশে বসিয়া তাকিয়া আশ্রয় করিয়া গুড়গুড়িতে তামাক টানিতেছিল। সে খাড়া হইয়া বসিল এবং রূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে হে তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়?”

গোরা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া কহিল, “তুমি দারোগা বুঝি? তুমি ঘোষপুরের চরে যে-সমস্ত উৎপাত করেছ আমি তার সমস্ত খবর নিয়েছি। এখনো যদি সাবধান না হও তা হলে–”

দারোগা। ফাঁসি দেবে না কি? তাই তো, লোকটা কম নয় তো দেখছি। ভেবেছিলেম ভিক্ষে নিতে এসেছে, এ যে চোখ রাঙায়। ওরে তেওয়ারি!

মাধব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দারোগার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “আরে কর কী, ভদ্রলোক, অপমান কোরো না।”

দারোগা গরম হইয়া কহিল, “কিসের ভদ্রলোক! উনি যে তোমাকে যা-খুশি-তাই বললেন, সেটা বুঝি অপমান নয়?”

মাধব কহিল, “যা বলেছেন সে তো মিথ্যে বলেন নি, তা রাগ করলে চলবে কী করে? নীলকুঠির সাহেবের গোমস্তাগিরি করে খাই, তার চেয়ে আর তো কিছু বলবার দরকার করে না। রাগ কোরো না দাদা, তুমি যে পুলিসের দারোগা, তোমাকে যমের পেয়াদা বললে কি গাল হয়? বাঘ মানুষ মেরে খায়, সে বোষ্টম নয়, সে তো জানা কথা। কী করবে, তাকে তো খেতে হবে।”

বিনা প্রয়োজনে মাধবকে রাগ প্রকাশ করিতে কেহ কোনোদিন দেখে নাই। কোন্‌ মানুষের দ্বারা কখন কী কাজ পাওয়া যায়, অথবা বক্র হইলে কাহার দ্বারা কী অপকার হইতে পারে তাহা বলা যায় কি? কাহারো অনিষ্ট বা অপমান সে খুব হিসাব করিয়াই করিত– রাগ করিয়া পরকে আঘাত করিবার ক্ষমতার বাজে খরচ করিত না।

দারোগা তখন গোরাকে কহিল, “দেখো বাপু, আমরা এখানে সরকারের কাজ করতে এসেছি; এতে যদি কোনো কথা বল বা গোলমাল কর তা হলে মুশকিলে পড়বে।”

গোরা কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। মাধব তাড়াতাড়ি তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, “মশায়, যা বলছেন সে কথাটা ঠিক– আমাদের এ কসাইয়ের কাজ– আর ঐ-যে বেটা দারোগা দেখছেন ওর সঙ্গে এক বিছানায় বসলে পাপ হয়– ওকে দিয়ে কত যে দুষ্কর্ম করিয়েছি তা মুখে উচ্চারণ করতেও পারি নে। আর বেশি দিন নয়– বছর দুত্তিন কাজ করলেই মেয়ে-কটার বিয়ে দেবার সম্বল করে নিয়ে তার পরে স্ত্রী-পুরুষে কাশীবাসী হব। আর ভালো লাগে না মশায়, এক-এক সময় ইচ্ছা হয় গলায় দড়ি দিয়ে মরি! যা হোক, আজ রাত্রে যাবেন কোথায়? এইখানেই আহারাদি করে শয়ন করবেন। ও দারোগা বেটার ছায়া মাড়াতেও হবে না, আপনার জন্যে সমস্ত আলাদা বন্দোবস্ত করে দেব।”

গোরার ক্ষুধা সাধারণের অপেক্ষা অধিক– আজ প্রাতে ভালো করিয়া খাওয়াও হয় নাই– কিন্তু তাহার সর্বশরীর যেন জ্বলিতেছিল– সে কোনোমতেই এখানে থাকিতে পারিল না, কহিল, “আমার বিশেষ কাজ আছে।”

মাধব কহিল, “তা, রসুন, একটা লণ্ঠন সঙ্গে দিই।”

গোরা তাহার কোনো জবাব না করিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

মাধব ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “দাদা, ও লোকটা সদরে গেল। এইবেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটা লোক পাঠাও।”

দারোগা কহিল, “কেন, কী করতে হবে?”

মাধব কহিল, “আর কিছু নয়, একবার কেবল জানিয়ে আসুক, একজন ভদ্রলোক কোথা থেকে এসে সাক্ষী ভাঙাবার জন্যে চেষ্টা করে বেড়াচ্ছে।”

গোরা ২৭

২৭

ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউন্‌লো সাহেব দিবাবসানে নদীর ধারের রাস্তায় পদব্রজে বেড়াইতেছেন, সঙ্গে হারানবাবু রহিয়াছেন। কিছু দূরে গাড়িতে তাঁহার মেম পরেশবাবুর মেয়েদের লইয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন।

ব্রাউন্‌লো সাহেব গার্ড্‌ন-পার্টিতে মাঝে মাঝে বাঙালি ভদ্রলোকদিগকে তাঁহার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করিতেন। জিলার এন্‌ট্রেন্স স্কুলে প্রাইজ বিতরণ উপলক্ষে তিনিই সভাপতির কাজ করিতেন। কোনো সম্পন্ন লোকের বাড়িতে বিবাহাদি ক্রিয়াকর্মে তাঁহাকে আহ্বান করিলে তিনি গৃহকর্তার অভ্যর্থনা গ্রহণ করিতেন। এমন-কি, যাত্রাগানের মজলিসে আহূত হইয়া তিনি একটা বড়ো কেদারায় বসিয়া কিছুক্ষণের জন্য ধৈর্যসহকারে গান শুনিতে চেষ্টা করিতেন। তাঁহার আদালতে গবর্মেন্ট্‌ প্লীডারের বাড়িতে গত পূজার দিন যাত্রায় যে দুই ছোকরা ভিস্তি ও মেথরানি সাজিয়াছিল তাহাদের অভিনয়ে তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার অনুরোধক্রমে একাধিক বার তাহাদের অংশ তাঁহার সম্মুখে পুনরাবৃত্ত হইয়াছিল।

তাঁহার স্ত্রী মিশনরির কন্যা ছিলেন। তাঁহার বাড়িতে মাঝে মাঝে মিশনরি মেয়েদের চা-পান সভা বসিত। জেলায় তিনি একটি মেয়ে-ইস্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন এবং যাহাতে সে স্কুলে ছাত্রীর অভাব না হয় সেজন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন। পরেশবাবুর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার চর্চা দেখিয়া তিনি তাহাদিগকে সর্বদা উৎসাহ দিতেন; দূরে থাকিলেও মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চালাইতেন ও ক্রিস্‌মাসের সময় তাহাদিগকে ধর্মগ্রন্থ উপহার পাঠাইতেন।

মেলা বসিয়াছে। তদুপলক্ষে হারানবাবু সুধীর ও বিনয়ের সঙ্গে বরদাসুন্দরী ও মেয়েরা সকলেই আসিয়াছেন– তাঁহাদিগকে ইনস্পেক্‌শন-বাংলায় স্থান দেওয়া হইয়াছে। পরেশবাবু এই-সমস্ত গোলমালের মধ্যে কোনোমতেই থাকিতে পারেন না, এইজন্য তিনি একলা কলিকাতাতেই রহিয়া গিয়াছেন। সুচরিতা তাঁহার সঙ্গরক্ষার জন্য তাঁহার কাছে থাকিতে অনেক চেষ্টা পাইয়াছিল, কিন্তু পরেশ ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণে কর্তব্যপালনের জন্য সুচরিতাকে বিশেষ উপদেশ দিয়াই পাঠাইয়া দিলেন। আগামী পরশ্ব কমিশনর সাহেব ও সস্ত্রীক ছোটোলাটের সম্মুখে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে ডিনারের পরে ঈভ্‌নিং পার্টিতে পরেশবাবুর মেয়েদের দ্বারা অভিনয় আবৃত্তি প্রভৃতি হইবার কথা স্থির হইয়াছে। সেজন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনেক ইংরেজ বন্ধু জেলা ও কলিকাতা হইতে আহূত হইয়াছেন। কয়েকজন বাছা বাছা বাঙালি ভদ্রলোকেরও উপস্থিত হইবার আয়োজন হইয়াছে। তাঁহাদের জন্য বাগানে একটি তাঁবুতে ব্রাহ্মণ পাচক-কর্তৃক প্রস্তুত জলযোগেরও ব্যবস্থা হইবে এইরূপ শুনা যাইতেছে।

হারানবাবু অতি অল্পকালের মধ্যেই উচ্চভাবের আলাপে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বিশেষ সন্তুষ্ট করিতে পারিয়াছিলেন। খৃস্টান ধর্মশাস্ত্রে হারানবাবুর অসামান্য অভিজ্ঞতা দেখিয়া সাহেব আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলেন এবং খৃস্টান ধর্ম গ্রহণে তিনি অল্প একটুমাত্র বাধা কেন রাখিয়াছেন এই প্রশ্নও হারানবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন।

আজ অপরাহ্নে নদীতীরের পথে হারানবাবুর সঙ্গে তিনি ব্রাহ্মসমাজের কার্যপ্রণালী ও হিন্দুসমাজের সংস্কারসাধন সম্বন্ধে গভীরভাবে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন। এমন সময় গোরা “গুড ঈভনিং সার” বলিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

কাল সে ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত দেখা করিবার চেষ্টা করিতে গিয়া বুঝিয়াছে যে সাহেবের চৌকাঠ উত্তীর্ণ হইতে গেলে তাঁহার পেয়াদার মাশুল জোগাইতে হয়। এরূপ দণ্ড ও অপমান স্বীকার করিতে অসম্মত হইয়া আজ সাহেবের হাওয়া খাইবার অবকাশে সে তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে। এই সাক্ষাৎকালে হারানবাবু ও গোরা উভয় পক্ষ হইতেই পরিচয়ের কোনো লক্ষণ প্রকাশ হইল না।

লোকটাকে দেখিয়া সাহেব কিছু বিস্মিত হইয়া গেলেন। এমন ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, হাড়-মোটা, মজবুত মানুষ তিনি বাংলা দেশে পূর্বে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। ইহার দেহের বর্ণও সাধারণ বাঙালির মতো নহে। গায়ে একখানা খাকি রঙের পাঞ্জাবি জামা, ধুতি মোটা ও মলিন, হাতে একগাছা বাঁশের লাঠি, চাদরখানাকে মাথায় পাগড়ির মতো বাঁধিয়াছে।

গোরা ম্যাজিস্ট্রেটকে কহিল, “আমি চর-ঘোষপুর হইতে আসিতেছি।”

ম্যাজিস্ট্রেট একপ্রকার বিস্ময়সূচক শিস দিলেন। ঘোষপুরের তদন্তকার্যে একজন বিদেশী বাধা দিতে আসিয়াছে সে সংবাদ তিনি গতকল্যই পাইয়াছিলেন। তবে এই লোকটাই সে! গোরাকে আপাদমস্তক তীক্ষ্ণভাবে একবার নিরীক্ষণ করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কোন্‌ জাত?”

গোরা কহিল, “আমি বাঙালি ব্রাহ্মণ।”

সাহেব কহিলেন, “ও! খবরের কাগজের সঙ্গে তোমার যোগ আছে বুঝি?”

গোরা কহিল, “না।”

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “তবে ঘোষপুর-চরে তুমি কী করতে এসেছ?”

গোরা কহিল, “ভ্রমণ করতে করতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলুম। পুলিসের অত্যাচারে গ্রামের দুর্গতির চিহ্ন দেখে এবং আরো উপদ্রবের সম্ভাবনা আছে জেনে প্রতিকারের জন্য আপনার কাছে এসেছি।”

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “চর-ঘোষপুরের লোকগুলো অত্যন্ত বদমায়েস সে কথা তুমি জান?”

গোরা কহিল, “তারা বদমায়েস নয়, তারা নির্ভীক, স্বাধীনচেতা– তারা অন্যায় অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে পারে না।”

ম্যাজিস্ট্রেট চটিয়া উঠিলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করিলেন নব্যবাঙালি ইতিহাসের পুঁথি পড়িয়া কতকগুলা বুলি শিখিয়াছে– ইন্‌সাফারেব্‌ল্‌!

“এখানকার অবস্থা তুমি কিছুই জান না” বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট গোরাকে খুব একটা ধমক দিলেন।

“আপনি এখানকার অবস্থা আমার চেয়ে অনেক কম জানেন।” গোরা মেঘমন্দ্রস্বরে জবাব করিল।

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি তুমি যদি ঘোষপুরের ব্যাপার সম্বন্ধে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ কর তা হলে খুব সস্তায় নিষ্কৃতি পাবে না।”

গোরা কহিল, “আপনি যখন অত্যাচারের প্রতিবিধান করবেন না বলে মনস্থির করেছেন এবং গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে আপনার ধারণা যখন বদ্ধমূল, তখন আমার আর-কোনো উপায় নেই– আমি গ্রামের লোকদের নিজের চেষ্টায় পুলিসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যে উৎসাহিত করব।”

ম্যাজিস্ট্রেট চলিতে চলিতে হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইয়া বিদ্যুতের মতো গোরার দিকে ফিরিয়া গর্জিয়া উঠিলেন, “কী! এত বড়ো স্পর্ধা!”

গোরা দ্বিতীয় কোনো কথা না বলিয়া ধীরগমনে চলিয়া গেল।

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “হারানবাবু, আপনাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ-সকল কিসের লক্ষণ দেখা যাইতেছে?”

হারানবাবু কহিলেন, “লেখাপড়া তেমন গভীরভাবে হইতেছে না, বিশেষত দেশে আধ্যাত্মিক ও চারিত্রনৈতিক শিক্ষা একেবারে নাই বলিয়াই এরূপ ঘটিতেছে। ইংরেজি বিদ্যার যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা গ্রহণ করিবার অধিকার ইহাদের হয় নাই। ভারতবর্ষে ইংরেজের রাজত্ব যে ঈশ্বরের বিধান– এই অকৃতজ্ঞরা এখনো তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছে না। তাহার একমাত্র কারণ, ইহারা কেবল পড়া মুখস্থ করিয়াছে, কিন্তু ইহাদের ধর্মবোধ নিতান্তই অপরিণত।”

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “খৃস্টকে স্বীকার না করিলে ভারতবর্ষে এই ধর্মবোধ কখনোই পূর্ণতা লাভ করিবে না।”

হারানবাবু কহিলেন, “সে এক হিসাবে সত্য।” এই বলিয়া খৃস্টকে স্বীকার করা সম্বন্ধে একজন খৃস্টানের সঙ্গে হারানবাবুর মতের কোন্‌ অংশে কতটুকু ঐক্য এবং কোথায় অনৈক্য তাহাই লইয়া হারানবাবু ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সূক্ষ্ণভাবে আলাপ করিয়া তাঁহাকে এই কথাপ্রসঙ্গে এতই নিবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, মেমসাহেব যখন পরেশবাবুর মেয়েদিগকে গাড়ি করিয়া ডাকবাংলায় পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিবার পথে তাঁহার স্বামীকে কহিলেন, “হ্যারি, ঘরে ফিরিতে হইবে”, তিনি চমকিয়া উঠিয়া ঘড়ি খুলিয়া কহিলেন, “বাই জোভ, আটটা বাজিয়া কুড়ি মিনিট।”

গাড়িতে উঠিবার সময় হারানবাবুর কর নিপীড়ন করিয়া বিদায়সম্ভাষণপূর্বক কহিলেন, “আপনার সহিত আলাপ করিয়া আমার সন্ধ্যা খুব সুখে কাটিয়াছে।”

হারানবাবু ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত তাঁহার আলাপের বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। কিন্তু গোরার সহিত সাক্ষাতের কোনো উল্লেখমাত্র করিলেন না।

গোরা ২৮

২৮

কোনোপ্রকার অপরাধ বিচার না করিয়া কেবলমাত্র গ্রামকে শাসন করিবার জন্য সাতচল্লিশ জন আসামিকে হাজতে দেওয়া হইয়াছে।

ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সাক্ষাতের পর গোরা উকিলের সন্ধানে বাহির হইল। কোনো লোকের কাছে খবর পাইল, সাতকড়ি হালদার এখানকার একজন ভালো উকিল। সাতকড়ির বাড়ি যাইতেই সে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, গোরা যে! তুমি এখানে!”

গোরা যা মনে করিয়াছিল তাই বটে– সাতকড়ি গোরার সহপাঠী। গোরা কহিল, চর-ঘোষপুরের আসামিদিগকে জামিনে খালাস করিয়া তাহাদের মকদ্দমা চালাইতে হইবে।

সাতকড়ি কহিল, “জামিন হবে কে?”

গোরা কহিল, “আমি হব।”

সাতকড়ি কহিল, “তুমি সাতচল্লিশ জনের জামিন হবে তোমার এমন কী সাধ্য আছে?”

গোরা কহিল, “যদি মোক্তাররা মিলে জামিন হয় তার ফী আমি দেব।”

সাতকড়ি কহিল, “টাকা কম লাগবে না।”

পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে জামিন-খালাসের দরখাস্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট গতকল্যকার সেই মলিনবস্ত্রধারী পাগড়ি-পরা বীরমূর্তির দিকে একবার কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন এবং দরখাস্ত অগ্রাহ্য করিয়া দিলেন। চৌদ্দ বৎসরের ছেলে হইতে আশি বৎসরের বুড়া পর্যন্ত হাজতে পচিতে লাগিল।

গোরা ইহাদের হইয়া লড়িবার জন্য সাতকড়িকে অনুরোধ করিল। সাতকড়ি কহিল, “সাক্ষী পাবে কোথায়? যারা সাক্ষী হতে পারত তারা সবাই আসামী তার পরে এই সাহেব-মারা মামলার তদন্তের চোটে এ অঞ্চলের লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের ধারণা হয়েছে ভিতরে ভিতরে ভদ্রলোকের যোগ আছে; হয়তো বা আমাকেও সন্দেহ করে, বলা যায় না। ইংরেজি কাগজগুলোতে ক্রমাগত লিখছে দেশী লোক যদি এরকম স্পর্ধা পায় তা হলে অরক্ষিত অসহায় ইংরেজরা আর মফস্বলে বাস করতেই পারবে না। ইতিমধ্যে দেশের লোক দেশে টিঁকতে পারছে না এমনি হয়েছে। অত্যাচার হচ্ছে জানি, কিন্তু কিছু করবার জো নেই।”

গোরা গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “কেন জো নেই?”

সাতকড়ি হাসিয়া কহিল, “তুমি ইস্কুলে যেমনটি ছিলে এখনো ঠিক তেমনটি আছ দেখছি। জো নেই মানে, আমাদের ঘরে স্ত্রীপুত্র আছে– রোজ উপার্জন না করলে অনেকগুলো লোককে উপবাস করতে হয়। পরের দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে মরতে রাজি হয় এমন লোক সংসারে বেশি নেই– বিশেষত যে দেশে সংসার জিনিসটি বড়ো ছোটোখাটো জিনিস নয়। যাদের উপর দশ জন নির্ভর করে তারা সেই দশ জন ছাড়া অন্য দশ জনের দিকে তাকাবার অবকাশই পায় না।”

গোরা কহিল, “তা হলে এদের জন্যে কিছুই করবে না? হাইকোর্টে মোশন করে যদি–”

সাতকড়ি অধীর হইয়া কহিল, “আরে, ইংরেজ মেরেছে যে– সেটা দেখছ না! প্রত্যেক ইংরেজটিই যে রাজা– একটা ছোটো ইংরেজকে মারলেও যে সেটা একটা ছোটোরকম রাজবিদ্রোহ। যেটাতে কিছু ফল হবে না সেটার জন্যে মিথ্যে চেষ্টা করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কোপানলে পড়ব সে আমার দ্বারা হবে না।”

কলিকাতায় গিয়া সেখানকার কোনো উকিলের সাহায্যে কিছু সুবিধা হয় কি না তাহাই দেখিবার জন্য পরদিন সাড়ে দশটার গাড়িতে রওনা হইবার অভিপ্রায়ে গোরা যাত্রা করিয়াছে, এমন সময় বাধা পড়িয়া গেল।

এখানকার মেলা উপলক্ষেই কলিকাতার একদল ছাত্রের সহিত এখানকার স্থানীয় ছাত্রদলের ক্রিকেট-যুদ্ধ স্থির হইয়াছে। হাত পাকাইবার জন্য কলিকাতার ছেলেরা আপন দলের মধ্যেই খেলিতেছিল। ক্রিকেটের গোলা লাগিয়া একটি ছেলের পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে। মাঠের ধারে একটা বড়ো পুষ্করিণী ছিল– আহত ছেলেটিকে দুইটি ছাত্র ধরিয়া সেই পুষ্করিণীর তীরে রাখিয়া চাদর ছিঁড়িয়া জলে ভিজাইয়া তাহার পা বাঁধিয়া দিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ কোথা হইতে একটা পাহারাওয়ালা আসিয়াই একেবারে একজন ছাত্রের ঘাড়ে হাত দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাহাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল। পুষ্করিণীটি পানীয় জলের জন্য রিজার্ভ করা, ইহার জলে নামা নিষেধ,কলিকাতার ছাত্র তাহা জানিত না, জানিলেও অকস্মাৎ পাহারাওয়ালার কাছে এরূপ অপমান সহ্য করা তাহাদের অভ্যাস ছিল না, গায়েও জোর ছিল, তাই অপমানের যথোচিত প্রতিকার আরম্ভ করিয়া দিল। এই দৃশ্য দেখিয়া চার-পাঁচজন কন্‌স্টেব্‌ল্‌ ছুটিয়া আসিল। ঠিক এমন সময়টিতেই সেখানে গোরা আসিয়া উপস্থিত। ছাত্ররা গোরাকে চিনিত– গোরা তাহাদিগকে লইয়া অনেকদিন ক্রিকেট খেলাইয়াছে। গোরা যখন দেখিল ছাত্রদিগকে মারিতে মারিতে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে, সে সহিতে পারিল না, সে কহিল, “খবরদার! মারিস নে!” পাহারাওয়ালার দল তাহাকেও অশ্রাব্য গালি দিতেই গোরা ঘুষি ও লাথি মারিয়া এমন একটা কাণ্ড করিয়া তুলিল যে রাস্তায় লোক জমিয়া গেল। এ দিকে দেখিতে দেখিতে ছাত্রের দল জুটিয়া গেল। গোরার উৎসাহ ও আদেশ পাইয়া তাহারা পুলিসকে আক্রমণ করিতেই পাহারাওয়ালার দল রণে ভঙ্গ দিল। দর্শকরূপে রাস্তার লোকে অত্যন্ত আমোদ অনুভব করিল; কিন্তু বলা বাহুল্য, এই তামাশা গোরার পক্ষে নিতান্ত তামাশা হইল না।

বেলা যখন তিন-চারটে, ডাকবাংলায় বিনয় হারানবাবু এবং মেয়েরা রিহার্সালে প্রবৃত্ত আছে, এমন সময় বিনয়ের পরিচিত দুইজন ছাত্র আসিয়া খবর দিল, গোরাকে এবং কয়জন ছাত্রকে পুলিসে গ্রেফতার করিয়া লইয়া হাজতে রাখিয়াছে, আগামী কাল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে প্রথম এজলাসেই ইহার বিচার হইবে।

গোরা হাজতে! এ কথা শুনিয়া হারানবাবু ছাড়া আর-সকলেই একেবারে চমকিয়া উঠিল। বিনয় তখনই ছুটিয়া প্রথমে তাহাদের সহপাঠী সাতকড়ি হালদারের নিকট গিয়া তাহাকে সমস্ত জানাইল এবং তাহাকে সঙ্গে লইয়া হাজতে গেল।

সাতকড়ি তাহার পক্ষে ওকালতি ও তাহাকে এখনই জামিনে খালাসের চেষ্টা করিবার প্রস্তাব করিল। গোরা বলিল, “না, আমি উকিলও রাখব না, আমাকে জামিনে খালাসেরও চেষ্টা করতে হবে না।”

সে কী কথা! সাতকড়ি বিনয়ের দিকে ফিরিয়া কহিল, “দেখেছ! কে বলবে গোরা ইস্কুল থেকে বেরিয়েছে! ওর বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক সেইরকমই আছে!”

গোরা কহিল, “দৈবাৎ আমার টাকা আছে, বন্ধু আছে বলেই হাজত আর হাতকড়ি থেকে আমি খালাস পাব সে আমি চাই নে। আমাদের দেশের যে ধর্মনীতি তাতে আমরা জানি সুবিচার করার গরজ রাজার; প্রজার প্রতি অবিচার রাজারই অধর্ম। কিন্তু এ রাজ্যে উকিলের কড়ি না জোগাতে পেরে প্রজা যদি হাজতে পচে, জেলে মরে, রাজা মাথার উপরে থাকতে ন্যায়বিচার পয়সা দিয়ে কিনতে যদি সর্বস্বান্ত হতে হয়, তবে এমন বিচারের জন্যে আমি সিকি-পয়সা খরচ করতে চাই নে।”

সাতকড়ি কহিল, “কাজির আমলে যে ঘুষ দিতেই মাথা বিকিয়ে যেত।”

গোরা কহিল, “ঘুষ দেওয়া তো রাজার বিধান ছিল না। সে কাজি মন্দ ছিল সে ঘুষ নিত, এ আমলেও সেটা আছে। কিন্তু এখন রাজদ্বারে বিচারের জন্যে দাঁড়াতে গেলেই, বাদী হোক প্রতিবাদী হোক, দোষী হোক, নির্দোষ হোক, প্রজাকে চোখের জল ফেলতেই হবে। যে পক্ষ নির্ধন, বিচারের লড়াইয়ে জিত-হার দুই তার পক্ষে সর্বনাশ। তার পরে রাজা যখন বাদী আর আমার মতো লোক প্রতিবাদী, তখন তাঁর পক্ষেই উকিল ব্যারিস্টার– আর আমি যদি জোটাতে পারলুম তো ভালো, নইলে অদৃষ্টে যা থাকে! বিচারে যদি উকিলের সাহায্যের প্রয়োজন না থাকে তবে সরকারি উকিল আছে কেন? যদি প্রয়োজন থাকে তো গবর্মেন্টের বিরুদ্ধপক্ষ কেন নিজের উকিল নিজে জোটাতে বাধ্য হবে? এ কি প্রজার সঙ্গে শত্রুতা? এ কী রকমের রাজধর্ম?”

সাতকড়ি কহিল, “ভাই, চট কেন? সিভিলিজেশন সস্তা জিনিস নয়। সূক্ষ্ণ বিচার করতে গেলে সূক্ষ্ণ আইন করতে হয়, সূক্ষ্ণ আইন করতে গেলেই আইনের ব্যবসায়ী না হলে কাজ চলেই না, ব্যাবসা চালাতে গেলেই কেনাবেচা এসে পড়ে– অতএব সভ্যতার আদালত আপনিই বিচার-কেনাবেচার হাট হয়ে উঠবেই– যার টাকা নেই তার ঠকবার সম্ভাবনা থাকবেই। তুমি রাজা হলে কী করতে বলো দেখি।”

গোরা কহিল, “যদি এমন আইন করতুম যে হাজার দেড় হাজার টাকা বেতনের বিচারকের বুদ্ধিতেও তার রহস্য ভেদ হওয়া সম্ভব হত না, তা হলে হতভাগা বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষের জন্য উকিল সরকারি খরচে নিযুক্ত করে দিতুম। বিচার ভালো হওয়ার খরচা প্রজার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সুবিচারের গৌরব করে পাঠান-মোগলদের গাল দিতুম না।”

সাতকড়ি কহিল, “বেশ কথা, সে শুভদিন যখন আসে নি– তুমি যখন রাজা হও নি– সম্প্রতি তুমি যখন সভ্য রাজার আদালতের আসামী– তখন তোমাকে হয় গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে নয় উকিল-বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হবে, নয় তো তৃতীয় গতিটা সদ্‌গতি হবে না।”

গোরা জেদ করিয়া কহিল, “কোনো চেষ্টা না করে যে গতি হতে পারে আমার সেই গতিই হোক। এ রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরুপায়ের যে গতি, আমারও সেই গতি।”

বিনয় অনেক অনুনয় করিল, কিন্তু গোরা তাহাতে কর্ণপাতমাত্র করিল না। সে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি হঠাৎ এখানে কী করে উপস্থিত হলে।?”

বিনয়ের মুখ ঈষৎ রক্তাভ হইয়া উঠিল। গোরা যদি আজ হাজতে না থাকিত তবে বিনয় হয়তো কিছু বিদ্রোহের স্বরেই তাহার এখানে উপস্থিতির কারণটা বলিয়া দিত। আজ স্পষ্ট উত্তরটা তাহার মুখে বাধিয়া গেল; কহিল, “আমার কথা পরে হবে– এখন তোমার–”

গোরা কহিল, “আমি তো আজ রাজার অতিথি। আমার জন্যে রাজা স্বয়ং ভাবছেন, তোমাদের আর কারো ভাবতে হবে না।”

বিনয় জানিত গোরাকে টলানো সম্ভব নয়– অতএব উকিল রাখার চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে হইল। বলিল, “তুমি তো খেতে এখানে পারবে না জানি, বাইরে থেকে কিছু খাবার পাঠাবার জোগাড় করে দিই।”

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনয়, কেন তুমি বৃথা চেষ্টা করছ। বাইরে থেকে আমি কিছুই চাই নে। হাজতে সকলের ভাগ্যে যা জোটে আমি তার চেয়ে কিছু বেশি চাই নে।”

বিনয় ব্যথিত চিত্তে ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিল। সুচরিতা রাস্তার দিকের একটা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া জানালা খুলিয়া বিনয়ের প্রত্যাবর্তন প্রতীক্ষা করিয়া ছিল। কোনোমতেই অন্য সকলের সঙ্গ এবং আলাপ সে সহ্য করিতে পারিতেছিল না।

সুচরিতা যখন দেখিল বিনয় চিন্তিত বিমর্ষমুখে ডাকবাংলার অভিমুখে আসিতেছে তখন আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল। বহু চেষ্টায় সে নিজেকে শান্ত করিয়া একটা বই হাতে করিয়া বসিবার ঘরে আসিল। ললিতা সেলাই ভালোবাসে না, কিন্তু সে আজ চুপ করিয়া কোণে বসিয়া সেলাই করিতেছিল– লাবণ্য সুধীরকে লইয়া ইংরেজি বানানের খেলা খেলিতেছিল, লীলা ছিল দর্শক; হারানবাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আগামী কল্যকার উৎসবের কথা আলোচনা করিতেছিলেন।

আজ প্রাতঃকালে পুলিসের সঙ্গে গোরার বিরোধের ইতিহাস বিনয় সমস্ত বিবৃত করিয়া বলিল। সুচরিতা স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল, ললিতার কোল হইতে সেলাই পড়িয়া গেল এবং মুখ লাল হইয়া উঠিল।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনি কিছু ভাববেন না বিনয়বাবু– আজ সন্ধ্যাবেলায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মেমের কাছে গৌরমোহনবাবুর জন্যে আমি নিজে অনুরোধ করব।”

বিনয় কহিল, “না, আপনি তা করবেন না– গোরা যদি শুনতে পায় তা হলে জীবনে সে আমাকে আর ক্ষমা করবে না।”

সুধীর কহিল, “তাঁর ডিফেন্সের জন্যে তো কোনো বন্দোবস্ত করতে হবে।”

জামিন দিয়া খালাসের চেষ্টা এবং উকিল নিয়োগ সম্বন্ধে গোরা যে-সকল আপত্তি করিয়াছিল বিনয় তাহা সমস্তই বলিল– শুনিয়া হারানবাবু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন, “এ-সমস্ত বাড়াবাড়ি!”

হারানবাবুর প্রতি ললিতার মনের ভাব যাই থাক্‌, সে এ পর্যন্ত তাঁহাকে মান্য করিয়া আসিয়াছে, কখনো তাঁহার সঙ্গে তর্কে যোগ দেয় নাই– আজ সে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়– গৌরবাবু যা করেছেন সে ঠিক করেছেন– ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জব্দ করবে আর আমরা নিজেরা নিজেকে রক্ষা করব! তাদের মোটা মাইনে জোগাবার জন্যে ট্যাক্স জোগাতে হবে, আবার তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে উকিল-ফী গাঁট থেকে দিতে হবে। এমন বিচার পাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া ভালো।”

ললিতাকে হারানবাবু এতটুকু দেখিয়াছেন– তাহার যে একটা মতামত আছে সে কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নাই। সেই ললিতার মুখের তীব্র ভাষা শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন; তাহাকে ভর্ৎসনার স্বরে কহিলেন, “তুমি এ-সব কথার কী বোঝ? যারা গোটাকতক বই মুখস্থ করে পাস করে সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাদের কোনো ধর্ম নেই, ধারণা নেই, তাদের মুখ থেকে দায়িত্বহীন উন্মত্ত প্রলাপ শুনে তোমাদের মাথা ঘুরে যায়!”

এই বলিয়া গতকল্য সন্ধ্যার সময় গোরার সহিত ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষাৎ-বিবরণ এবং সে সম্বন্ধে তাঁহার নিজের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের আলাপের কথা বিবৃত করিলেন। চর-ঘোষপুরের ব্যাপার বিনয়ের জানা ছিল না। শুনিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল; বুঝিল, ম্যাজিস্ট্রেট গোরাকে সহজে ক্ষমা করিবে না।

হারান যে উদ্দেশ্যে এই গল্পটা বলিলেন তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেল। তিনি যে গোরার সহিত তাঁহার দেখা হওয়া সম্বন্ধে এতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নীরব ছিলেন তাহার ভিতরকার ক্ষুদ্রতা সুচরিতাকে আঘাত করিল এবং হারানবাবুর প্রত্যেক কথার মধ্যে গোরার প্রতি যে-একটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা প্রকাশ পাইল তাহাতে গোরার এই বিপদের দিনে তাঁহার প্রতি উপস্থিত প্রত্যেকেরই একটা অশ্রদ্ধা জন্মাইয়া দিল। সুচরিতা এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিল, কী একটা বলিবার জন্য তাহার আবেগ উপস্থিত হইল, কিন্তু সেটা সংবরণ করিয়া সে বই খুলিয়া কম্পিত হস্তে পাতা উল্‌টাইতে লাগিল। ললিতা উদ্ধতভাবে কহিল, “ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত হারানবাবুর মতের যতই মিল থাক্‌, ঘোষপুরের ব্যাপারে গৌরমোহনবাবুর মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।”

গোরা ২৯

২৯

আজ ছোটোলাট আসিবেন বলিয়া ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক সাড়ে দশটায় আদালতে আসিয়া বিচারকার্য সকাল-সকাল শেষ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন।

সাতকড়িবাবু ইস্কুলের ছাত্রদের পক্ষ লইয়া সেই উপলক্ষে তাঁহার বন্ধুকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিলেন। তিনি গতিক দেখিয়া বুঝিয়াছিলেন যে, অপরাধ স্বীকার করাই এ স্থলে ভালো চাল। ছেলেরা দুরন্ত হইয়াই থাকে, তাহারা অর্বাচীন নির্বোধ ইত্যাদি বলিয়া তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ছাত্রদিগকে জেলে লইয়া গিয়া বয়স ও অপরাধের তারতম্য অনুসারে পাঁচ হইতে পঁচিশ বেতের আদেশ করিয়া দিলেন। গোরার উকিল কেহ ছিল না। সে নিজের মামলা নিজে চালাইবার উপলক্ষে পুলিসের অত্যাচার সম্বন্ধে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই ম্যাজিস্ট্রেট তাহাকে তীব্র তিরস্কার করিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন ও পুলিসের কর্মে বাধা দেওয়া অপরাধে তাহাকে এক মাস সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন এবং এইরূপ লঘুদণ্ডকে বিশেষ দয়া বলিয়া কীর্তন করিলেন।

সুধীর ও বিনয় আদালতে উপস্থিত ছিল। বিনয় গোরার মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম হইল, সে তাড়াতাড়ি আদালত-ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। সুধীর তাহাকে ডাকবাংলায় ফিরিয়া গিয়া স্নানাহারের জন্য অনুরোধ করিল– সে শুনিল না, মাঠের রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে গাছের তলায় বসিয়া পড়িল। সুধীরকে কহিল, “তুমি বাংলায় ফিরে যাও, কিছুক্ষণ পরে আমি যাব।” সুধীর চলিয়া গেল।

এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিয়া গেল তাহা সে জানিতে পারিল না। সূর্য মাথার উপর হইতে পশ্চিমের দিকে যখন হেলিয়াছে তখন একটা গাড়ি ঠিক তাহার সম্মুখে আসিয়া থামিল। বিনয় মুখ তুলিয়া দেখিল, সুধীর ও সুচরিতা গাড়ি হইতে নামিয়া তাহার কাছে আসিতেছে। বিনয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। সুচরিতা কাছে আসিয়া স্নেহার্দ্রস্বরে কহিল, “বিনয়বাবু, আসুন।”

বিনয়ের হঠাৎ চৈতন্য হইল যে, এই দৃশ্যে রাস্তার লোকে কৌতুক অনুভব করিতেছে। সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠিয়া পড়িল। সমস্ত পথ কেহ কিছুই কথা কহিতে পারিল না।

ডাকবাংলায় পৌঁছিয়া বিনয় দেখিল সেখানে একটা লড়াই চলিতেছে। ললিতা বাঁকিয়া বসিয়াছে, সে কোনোমতেই আজ ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দিবে না। বরদাসুন্দরী বিষম সংকটে পড়িয়া গিয়াছেন। হারানবাবু ললিতার মতো বালিকার এই অসংগত বিদ্রোহে ক্রোধে অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি বার বার বলিতেছেন আজকালকার ছেলেমেয়েদের এ কিরূপ বিকার ঘটিয়াছে– তাহারা ডিসিপ্লিন মানিতে চাহে না! কেবল যে-সে লোকের সংসর্গে যাহা-তাহা আলোচনা করিয়াই এইরূপ ঘটিতেছে।

বিনয় আসিতেই ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু, আমাকে মাপ করুন। আমি আপনার কাছে ভারি অপরাধ করেছি; আপনি তখন যা বলেছিলেন আমি কিছুই বুঝতে পারি নি; আমরা বাইরের অবস্থা কিছুই জানি নে বলেই এত ভুল বুঝি। পানুবাবু বলেন ভারতবর্ষে ম্যাজিস্ট্রেটের এই শাসন বিধাতার বিধান– তা যদি হয় তবে এই শাসনকে সমস্ত কায়মনোবাক্যে অভিশাপ দেবার ইচ্ছা জাগিয়ে দেওয়াও সেই বিধাতারই বিধান।”

হারানবাবু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ললিতা, তুমি–”

ললিতা হারানবাবুর দিক হইতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “চুপ করুন। আপনাকে আমি কিছু বলছি নে। বিনয়বাবু, আপনি কারো অনুরোধ রাখবেন না। আজ কোনোমতেই অভিনয় হতেই পারে না।”

বরদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি ললিতার কথা চাপা দিয়া কহিলেন, “ললিতা, তুই তো আচ্ছা মেয়ে দেখছি। বিনয়বাবুকে আজ স্নান করতে খেতে দিবি নে? বেলা দেড়টা বেজে গেছে তা জানিস? দেখ্‌ দেখি ওঁর মুখ শুকিয়ে কী রকম চেহারা হয়ে গেছে।”

বিনয় কহিল, “এখানে আমরা সেই ম্যাজিস্ট্রেটের অতিথি–এ বাড়িতে আমি স্নানাহার করতে পারব না।”

বরদাসুন্দরী বিনয়কে বিস্তর মিনতি করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। মেয়েরা সকলেই চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তিনি রাগিয়া বলিলেন, “তোদের সব হল কী? সুচি, তুমি বিনয়বাবুকে একটু বুঝিয়ে বলো-না। আমরা কথা দিয়েছি–লোকজন সব ডাকা হয়েছে, আজকের দিনটা কোনোমতে কাটিয়ে যেতে হবে– নইলে ওরা কী মনে করবে বলো দেখি! আর যে ওদের সামনে মুখ দেখাতে পারব না।”

সুচরিতা চুপ করিয়া মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল।

বিনয় অদূরে নদীতে স্টীমারে চলিয়া গেল। এই স্টীমার আজ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যাত্রী লইয়া কলিকাতায় রওনা হইবে–আগামী কাল আটটা আন্দাজ সময়ে সেখানে পৌঁছিবে।

হারানবাবু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া বিনয় ও গোরাকে নিন্দা করিতে আরম্ভ করিলেন। সুচরিতা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া বেগে দ্বার ভেজাইয়া দিল। একটু পরেই ললিতা দ্বার ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, সুচরিতা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বিছানার উপর পড়িয়া আছে।

ললিতা ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া ধীরে ধীরে সুচরিতার পাশে বসিয়া তাহার মাথায় চুলের মধ্যে আঙুল বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে সুচরিতা যখন শান্ত হইল তখন জোর করিয়া তাহার মুখ হইতে বাহুর আবরণ মুক্ত করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল, “দিদি, আমরা এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাই, আজ তো ম্যাজিস্ট্রেটের ওখানে যেতে পারব না।”

সুচরিতা অনেকক্ষণ এ কথার কোনো উত্তর করিল না। ললিতা যখন বার বার বলিতে লাগিল তখন সে বিছানায় উঠিয়া বসিল, “সে কী করে হবে ভাই? আমার তো একেবারেই আসবার ইচ্ছা ছিল না– বাবা যখন পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন যেজন্যে এসেছি তা না সেরে যেতে পারব না।”

ললিতা কহিল, “বাবা তো এ-সব কথা জানেন না– জানলে কখনোই আমাদের থাকতে বলতেন না।”

সুচরিতা কহিল, “তা কি করে জানব ভাই!”

ললিতা। দিদি, তুই পারবি? কী করে যাবি বল্‌ দেখি! তার পরে আবার সাগগোজ করে স্টেজে দাঁড়িয়ে কবিতা আওড়াতে হবে। আমার তো জিব ফেটে গিয়ে রক্ত পড়বে তবু কথা বের হবে না।

সুচরিতা কহিল, “সে তো জানি বোন! কিন্তু নরকযন্ত্রণাও সইতে হয়। এখন আর কোনো উপায় নেই। আজকের দিন জীবনে আর কখনো ভুলতে পারব না।”

সুচরিতার এই বাধ্যতায় ললিতা রাগ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। মাকে আসিয়া কহিল, “মা, তোমরা যাবে না?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তুই কি পাগল হয়েছিস? রাত্তির নটার পর যেতে হবে।”

ললিতা কহিল, “আমি কলকাতায় যাবার কথা বলছি।”

বরদাসুন্দরী। শোনো একবার মেয়ের কথা শোনো!

ললিতা সুধীরকে কহিল, “সুধীরদা, তুমিও এখানে থাকবে?”

গোরার শাস্তি সুধীরের মনকে বিকল করিয়া দিয়াছিল, কিন্তু বড়ো বড়ো সাহেবের সম্মুখে নিজের বিদ্যা প্রকাশ করিবার প্রলোভন সে ত্যাগ করিতে পারে এমন সাধ্য তাহার ছিল না। সে অব্যক্তস্বরে কী একটা বলিল– বোঝা গেল সে সংকোচ বোধ করিতেছে, কিন্তু সে থাকিয়াই যাইবে।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “গোলমালে বেলা হয়ে গেল। আর দেরি করলে চলবে না। এখন সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বিছানা থেকে কেউ উঠতে পারবে না– বিশ্রাম করতে হবে। নইলে ক্লান্ত হয়ে রাত্রে মুখ শুকিয়ে যাবে– দেখতে বিশ্রী হবে।”

এই বলিয়া তিনি জোর করিয়া সকলকে শয়নঘরে পুরিয়া বিছানায় শোওয়াইয়া দিলেন। সকলেই ঘুমাইয়া পড়িল, কেবল সুচরিতার ঘুম হইল না এবং অন্য ঘরে ললিতা তাহার বিছানার উপরে উঠিয়া বসিয়া রহিল।

স্টীমারে ঘন ঘন বাঁশি বাজিতে লাগিল।

স্টীমার যখন ছাড়িবার উপক্রম করিতেছে, খালাসিরা সিঁড়ি তুলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে, এমন সময় জাহাজের ডেকের উপর হইতে বিনয় দেখিল একজন ভদ্রস্ত্রীলোক জাহাজের অভিমুখে দ্রুতপদে আসিতেছে। তাহার বেশভূষা প্রভৃতি দেখিয়া তাহাকে ললিতা বলিয়াই মনে হইল, কিন্তু বিনয় সহসা তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। অবশেষে ললিতা নিকটে আসিতে আর সন্দেহ রহিল না। একবার মনে করিল ললিতা তাহাকে ফিরাইতে আসিয়াছে, কিন্তু ললিতাই তো ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। ললিতা স্টীমারে উঠিয়া পড়িল– খালাসি সিঁড়ি তুলিয়া লইল। বিনয় শঙ্কিতচিত্তে উপরের ডেক হইতে নীচে নামিয়া ললিতার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। ললিতা কহিল, “আমাকে উপরে নিয়ে চলুন।”

বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “জাহাজ যে ছেড়ে দিচ্ছে।”

ললিতা কহিল, “সে আমি জানি।”

বলিয়া বিনয়ের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই সম্মুখের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের তলায় উঠিয়া গেল। স্টীমার বাঁশি ফুঁকিতে ফুঁকিতে ছাড়িয়া দিল।

বিনয় ললিতাকে ফাস্ট্‌ ক্লাসের ডেকে কেদারায় বসাইয়া নীরব প্রশ্নে তাহার মুখের দিকে চাহিল।

ললিতা কহিল, “আমি কলকাতায় যাব– আমি কিছুতেই থাকতে পারলুম না।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “ওঁরা সকলে?”

ললিতা কহিল, “এখন পর্যন্ত কেউ জানেন না। আমি চিঠি রেখে এসেছি– পড়লেই জানতে পারবেন।”

ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয় স্তম্ভিত হইয়া গেল। সংকোচের সহিত বলিতে আরম্ভ করিল, “কিন্তু–”

ললিতা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিল, “জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে, এখন আর “কিন্তু’ নিয়ে কী হবে! মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই যে সমস্তই চুপ করে সহ্য করতে হবে সে আমি বুঝি নে। আমাদের পক্ষেও ন্যায়-অন্যায় সম্ভব-অসম্ভব আছে। আজকের নিমন্ত্রণে গিয়ে অভিনয় করার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে সহজ।”

বিনয় বুঝিল যা হইবার তা হইয়া গেছে, এখন এ কাজের ভালোমন্দ বিচার করিয়া মনকে পীড়িত করিয়া তোলায় কোনো ফল নাই।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ললিতা কহিল, “দেখুন, আপনার বন্ধু গৌরমোহনবাবুর প্রতি আমি মনে মনে বড়ো অবিচার করেছিলুম। জানি নে, প্রথম থেকেই কেন তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে, আমার মনটা তাঁর বিরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বড়ো বেশি জোর দিয়ে কথা কইতেন, আর আপনারা সকলেই তাতে যেন সায় দিয়ে যেতেন– তাই দেখে আমার একটা রাগ হতে থাকত। আমার স্বভাবই ঐ– আমি যদি দেখি কেউ কথায় বা ব্যবহারে জোর প্রকাশ করছে, সে আমি একেবারেই সইতে পারি নে। কিন্তু গৌরমোহনবাবুর জোর কেবল পরের উপরে নয়, সে তিনি নিজের উপরেও খাটান– এ সত্যিকার জোর– এরকম মানুষ আমি দেখি নি।”

এমনি করিয়া ললিতা বকিয়া যাইতে লাগিল। কেবল যে গোরা সম্বন্ধে সে অনুতাপ বোধ করিতেছিল বলিয়াই এ-সকল কথা বলিতেছিল তাহা নহে। আসলে, ঝোঁকের মাথায় যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার সংকোচ মনের ভিতর হইতে কেবলই মাথা তুলিবার উপক্রম করিতেছিল, কাজটা হয়তো ভালো হয় নাই এই দ্বিধা জোর করিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছিল, বিনয়ের সম্মুখে স্টীমারে এইরূপ একলা বসিয়া থাকা যে এতবড়ো কুণ্ঠার বিষয় তাহা সে পূর্বে মনেও করিতে পারে নাই, কিন্তু লজ্জা প্রকাশ হইলেই জিনিসটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হইয়া উঠিবে এইজন্য সে প্রাণপণে বকিয়া যাইতে লাগিল। বিনয়ের মুখে ভালো করিয়া কথা জোগাইতেছিল না। এক দিকে গোরার দুঃখ ও অপমান, অন্য দিকে সে যে এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি আমোদ করিতে আসিয়াছিল তাহার লজ্জা, তাহার উপরে ললিতার সম্বন্ধে তাহার এই অকস্মাৎ অবস্থাসংকট, সমস্ত একত্র মিশ্রিত হইয়া বিনয়কে বাক্যহীন করিয়া দিয়াছিল।

পূর্বে হইলে ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয়ের মনে তিরস্কারের ভাব উদয় হইত– আজ তাহা কোনোমতেই হইল না। এমন-কি, তাহার মনে যে বিস্ময়ের উদয় হইয়াছিল তাহার সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ছিল– ইহাতে আরো একটি আনন্দ এই ছিল, তাহাদের সমস্ত দলের মধ্যে গোরার অপমানের সামান্য প্রতিকারচেষ্টা কেবল বিনয় এবং ললিতাই করিয়াছে। এজন্য বিনয়কে বিশেষ কিছু দুঃখ পাইতে হইবে না, কিন্তু ললিতাকে নিজের কর্মফলে অনেক দিন ধরিয়া বিস্তর পীড়া ভোগ করিতে হইবে। অথচ এই ললিতাকে বিনয় বরাবর গোরার বিরুদ্ধ বলিয়াই জানিত। যতই ভাবিতে লাগিল ততই ললিতার এই পরিণামবিচারহীন সাহসে এবং অন্যায়ের প্রতি একান্ত ঘৃণায় তাহার প্রতি বিনয়ের ভক্তি জন্মিতে লাগিল। কেমন করিয়া কী বলিয়া যে সে এই ভক্তি প্রকাশ করিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না। বিনয় বার বার ভাবিতে লাগিল, ললিতা যে তাহাকে এত পরমুখাপেক্ষী সাহসহীন বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিয়াছে সে ঘৃণা যথার্থ। সে তো সমস্ত আত্মীয়বন্ধুর নিন্দা প্রশংসা সবলে উপেক্ষা করিয়া এমন করিয়া কোনো বিষয়েই সাহসিক আচরণের দ্বারা নিজের মত প্রকাশ করিতে পারিত না। সে যে অনেক সময়েই গোরাকে কষ্ট দিবার ভয়ে অথবা পাছে গোরা তাহাকে দুর্বল মনে করে এই আশঙ্কায় নিজের স্বভাবের অনুসরণ করে নাই, অনেক সময় সূক্ষ্ণ যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া গোরার মতকে নিজের মত বলিয়াই নিজেকে ভুলাইবার চেষ্টা করিয়াছে, আজ তাহা মনে মনে স্বীকার করিয়া ললিতাকে স্বাধীনবুদ্ধিশক্তিগুণে নিজের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিল। ললিতাকে সে যে পূর্বে অনেকবার মনে মনে নিন্দা করিয়াছে, সে কথা স্মরণ করিয়া তাহার লজ্জা বোধ হইল। এমন-কি, ললিতার কাছে তাহার ক্ষমা চাহিতে ইচ্ছা করিল– কিন্তু কেমন করিয়া ক্ষমা চাহিবে ভাবিয়া পাইল না। ললিতার কমনীয় স্ত্রীমূর্তি আপন অন্তরের তেজে বিনয়ের চক্ষে আজ এমন একটি মহিমায় উদ্দীপ্ত হইয়া দেখা দিল যে, নারীর এই অপূর্ব পরিচয়ে বিনয় নিজের জীবনকে সার্থক বোধ করিল। সে নিজের সমস্ত অহংকার, সমস্ত ক্ষুদ্রতাকে এই মাধুর্যমণ্ডিত শক্তির কাছে আজ একেবারে বিসর্জন দিল।

গোরা ৩০

৩০

ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় পরেশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

ললিতার সম্বন্ধে বিনয়ের মনের ভাবটা কী তাহা স্টীমারে উঠিবার পূর্বে পর্যন্ত বিনয় নিশ্চিত জানিত না। ললিতার সঙ্গে বিরোধেই তাহার মন ব্যাপৃত ছিল। কেমন করিয়া এই দুর্বশ মেয়েটির সঙ্গে কোনোমতে সন্ধিস্থাপন হইতে পারে কিছুকাল হইতে ইহাই তাহার প্রায় প্রতিদিনের চিন্তার বিষয় ছিল। বিনয়ের জীবনে স্ত্রীমাধুর্যের নির্মল দীপ্তি লইয়া সুচরিতাই প্রথম সন্ধ্যাতারাটির মতো উদিত হইয়াছিল। এই আবির্ভাবের অপরূপ আনন্দে বিনয়ের প্রকৃতিকে পরিপূর্ণতা দান করিয়া আছে, ইহাই বিনয় মনে মনে জানিত। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো যে তারা উঠিয়াছে এবং জ্যোতিরূৎসবের ভূমিকা করিয়া দিয়া প্রথম তারাটি যে কখন্‌ ধীরে ধীরে দিগন্তরালে অবতরণ করিতেছিল বিনয় তাহা স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে নাই।

বিদ্রোহী ললিতা যেদিন স্টীমারে উঠিয়া আসিল সেদিন বিনয়ের মনে হইল, ললিতা এবং আমি একপক্ষ হইয়া সমস্ত সংসারের প্রতিকূলে যেন খাড়া হইয়াছি। এই ঘটনায় ললিতা আর-সকলকে ছাড়িয়া তাহারই পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এ কথা বিনয় কিছুতেই ভুলিতে পারিল না। যে-কোনো কারণে যে-কোনো উপলক্ষেই হউক, ললিতার পক্ষে বিনয় আজ অনেকের মধ্যে একজনমাত্র নহে– ললিতার পার্শ্বে সেই একাকী, সেই একমাত্র; সমস্ত আত্মীয়-স্বজন দূরে, সেই নিকটে। এই নৈকট্যের পুলকপূর্ণ স্পন্দন বিদ্যুদ্‌গর্ভ মেঘের মতো তাহার বুকের মধ্যে গুরুগুর করিতে লাগিল। প্রথম শ্রেণীর ক্যাবিনে ললিতা যখন ঘুমাইতে গেল তখন বিনয় তাহার স্বস্থানে শুইতে যাইতে পারিল না– সেই ক্যাবিনের বাহিরে ডেকে সে জুতা খুলিয়া নিঃশব্দে পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। স্টীমারে ললিতার প্রতি কোনো উৎপাত ঘটিবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু বিনয় তাহার অকস্মাৎ নূতনলব্ধ অধিকারটিকে পূরা অনুভব করিবার প্রলোভন অপ্রয়োজনেও না খাটাইয়া থাকিতে পারিল না।

রাত্রি গভীর অন্ধকারময়, মেঘশূন্য নভস্তল তারায় আচ্ছন্ন, তীরে তরুশ্রেণী নিশীথ আকাশের কালিমাঘন নিবিড় ভিত্তির মতো স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, নিম্নে প্রশস্ত নদীর প্রবল ধারা নিঃশব্দে চলিয়াছে, ইহার মাঝখানে ললিতা নিদ্রিত। আর কিছু নয়, এই সুন্দর, এই বিশ্বাসপূর্ণ নিদ্রাটুকুকে ললিতা আজ বিনয়ের হাতে সমর্পণ করিয়া দিয়াছে। এই নিদ্রাটুকুকে বিনয় মহামূল্য রত্নটির মতো রক্ষা করিবার ভার লইয়াছে। পিতামাতা ভাইভগিনী কেহই নাই, একটি অপরিচিত শয্যার উপর ললিতা আপন সুন্দর দেহখানি রাখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে– নিশ্বাসপ্রশ্বাস যেন এই নিদ্রাকাব্যটুকুর ছন্দ পরিমাপ করিয়া অতি শান্তভাবে গতায়াত করিতেছে, সেই নিপুণ কবরীর একটি বেণীও বিস্রস্ত হয় নাই, সেই নারীহৃদয়ের কল্যাণকোমলতায় মণ্ডিত হাত দুইখানি পরিপূর্ণ বিরামে বিছানার উপরে পড়িয়া আছে, কুসুমসুকুমার দুইটি পদতল তাহার সমস্ত রমণীয় গতিচেষ্টাকে উৎসব-অবসানের সংগীতের মতো স্তব্ধ করিয়া বিছানার উপর মেলিয়া রাখিয়াছে– বিশ্রব্ধ বিশ্রামের এই ছবিখানি বিনয়ের কল্পনাকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। শুক্তির মধ্যে মুক্তাটুকু যেমন, গ্রহতারামণ্ডিত নিঃশব্দতিমিরবেষ্টিত এই আকাশমণ্ডলের মাঝখানটিতে ললিতার এই নিদ্রাটুকু, এই সুডোল সুন্দর সম্পূর্ণ বিশ্রামটুকু জগতে তেমনি একটিমাত্র ঐশ্বর্য বলিয়া আজ বিনয়ের কাছে প্রতিভাত হইল। “আমি জাগিয়া আছি’ “আমি জাগিয়া আছি’– এই বাক্য বিনয়ের বিস্ফারিত বক্ষঃকুহর হইতে অভয়শঙ্খধ্বনির মতো উঠিয়া মহাকাশের অনিমেষ জাগ্রত পুরুষের নিঃশব্দবাণীর সহিত মিলিত হইল।

এই কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিতে আরো একটা কথা কেবলই বিনয়কে আঘাত করিতেছিল– আজ রাত্রে গোরা জেলখানায়! আজ পর্যন্ত বিনয় গোরার সকল সুখ-দুঃখেই ভাগ লইয়া আসিয়াছে, এইবার প্রথম তাহার অন্যথা ঘটিল। বিনয় জানিত গোরার মতো মানুষের পক্ষে জেলের শাসন কিছুই নহে, কিন্তু প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে গোরার কোনো যোগ ছিল না– গোরার জীবনের এই একটা প্রধান ঘটনা একেবারেই বিনয়ের সংস্রব ছাড়া। দুই বন্ধুর জীবনের ধারা এই-যে এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে– আবার যখন মিলিবে তখন কি এই বিচ্ছেদের শূন্যতা পূরণ হইতে পারিবে? বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতা কি এবার ভঙ্গ হয় নাই? জীবনের এমন অখণ্ড, এমন দুর্লভ বন্ধুত্ব! আজ একই রাত্রে বিনয় তাহার এক দিকের শূন্যতা এবং আর-এক দিকের পূর্ণতাকে একসঙ্গে অভনুব করিয়া জীবনের সৃজনপ্রলয়ের সন্ধিকালে স্তব্ধ হইয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল।

গোরা যে ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল দৈবক্রমেই বিনয় তাহাতে যোগ দিতে পারে নাই, অথবা গোরা যে জেলে গিয়াছে দৈবক্রমেই সেই কারাদুঃখের ভাগ লওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইয়াছে, এ কথা যদি সত্য হইত তবে ইহাতে বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ন হইতে পারিত না। কিন্তু গোরা ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল এবং বিনয় অভিনয় করিতেছিল ইহা আকস্মিক ব্যাপার নহে। বিনয়ের সমস্ত জীবনের ধারা এমন একটা পথে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহাদের পূর্ব-বন্ধুত্বের পথ নহে, সেই কারণেই এতদিন পরে এই বাহ্য বিচ্ছেদও সম্ভবপর হইয়াছে। কিন্তু আজ আর কোনো উপায় নাই– সত্যকে অস্বীকার করা আর চলে না, গোরার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এক পথ অনন্যমনে আশ্রয় করা বিনয়ের পক্ষে আজ আর সত্য নহে। কিন্তু গোরা ও বিনয়ের চিরজীবনের ভালোবাসা কি এই পথভেদের দ্বারাই ভিন্ন হইবে? এই সংশয় বিনয়ের হৃদয়ে হৃৎকম্প উপস্থিত করিল। সে জানিত গোরা তাহার সমস্ত বন্ধুত্ব এবং সমস্ত কর্তব্যকে এক লক্ষ্যপথে না টানিয়া চলিতে পারে না। প্রচণ্ড গোরা! তাহার প্রবল ইচ্ছা! জীবনের সকল সম্বন্ধের দ্বারা তাহার সেই এক ইচ্ছাকেই মহীয়সী করিয়া সে জয়যাত্রায় চলিবে– বিধাতা গোরার প্রকৃতিতে সেই রাজমহিমা অর্পণ করিয়াছেন।

ঠিকা গাড়ি পরেশবাবুর দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। নামিবার সময় ললিতার যে পা কাঁপিল এবং বাড়িতে প্রবেশ করিবার সময় সে যে জোর করিয়া নিজেকে একটু শক্ত করিয়া লইল তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল। ললিতা ঝোঁকের মাথায় এবার যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার অপরাধ যে কতখানি তাহার ওজন সে নিজে কিছুতেই আন্দাজ করিতে পারিতেছিল না। ললিতা জানিত পরেশবাবু তাহাকে এমন কোনো কথাই বলিবেন না যাহাকে ঠিক ভর্ৎসনা বলা যাইতে পারে– কিন্তু সেইজন্যই পরেশবাবুর চুপ করিয়া থাকাকেই সে সব চেয়ে ভয় করিত।

ললিতার এই সংকোচের ভাব লক্ষ্য করিয়া বিনয় এরূপ স্থলে তাহার কী কর্তব্য ঠিকটি ভাবিয়া পাইল না। সে সঙ্গে থাকিলে ললিতার সংকোচের কারণ অধিক হইবে কি না তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে একটু দ্বিধার স্বরে ললিতাকে কহিল, “তবে এখন যাই।”

ললিতা তাড়াতাড়ি কহিল, “না, চলুন, বাবার কাছে চলুন।”

ললিতার এই ব্যগ্র অনুরোধে বিনয় মনে মনে আনন্দিত হইয়া উঠিল। বাড়িতে পৌঁছিয়া দিবার পর হইতে তাহার যে কর্তব্য শেষ হইয়া যায় নাই, এই একটা আকস্মিক ব্যাপারে ললিতার সঙ্গে তাহার জীবনের যে একটা বিশেষ গ্রন্থিবন্ধন হইয়া গেছে– তাহাই মনে করিয়া বিনয় ললিতার পার্শ্বে যেন একটু বিশেষ জোরের সঙ্গে দাঁড়াইল। তাহার প্রতি ললিতার এই নির্ভর-কল্পনা যেন একটি স্পর্শের মতো তাহার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চার করিতে লাগিল। তাহার মনে হইল ললিতা যেন তাহার ডান হাত চাপিয়া ধরিয়াছে। ললিতার সহিত এই সম্বন্ধে তাহার পুরুষের বক্ষ ভরিয়া উঠিল। সে মনে মনে ভাবিল, পরেশবাবু ললিতার এই অসামাজিক হঠকারিতায় রাগ করিবেন, ললিতাকে ভর্ৎসনা করিবেন, তখন বিনয় যথাসম্ভব সমস্ত দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে লইবে– ভর্ৎসনার অংশ অসংকোচে গ্রহণ করিবে, বর্মের স্বরূপ হইয়া ললিতাকে সমস্ত আঘাত হইতে বাঁচাইতে চেষ্টা করিবে।

কিন্তু ললিতার ঠিক মনের ভাবটা বিনয় বুঝিতে পারে নাই। সে যে ভর্ৎসনার প্রতিরোধক-স্বরূপেই বিনয়কে ছাড়িতে চাহিল না তাহা নহে। আসল কথা, ললিতা কিছুই চাপা দিয়া রাখিতে পারে না। সে যাহা করিয়াছে তাহার সমস্ত অংশই পরেশবাবু চক্ষে দেখিবেন এবং বিচারে যে ফল হয় তাহার সমস্তটাই ললিতা গ্রহণ করিবে এইরূপ তাহার ভাব।

আজ সকাল হইতেই ললিতা বিনয়ের উপর মনে মনে রাগ করিয়া আছে। রাগটা যে অসংগত তাহা সে সম্পূর্ণ জানে– কিন্তু অসংগত বলিয়াই রাগটা কমে না বরং বাড়ে।

স্টীমারে যতক্ষণ ছিল ললিতার মনের ভাব অন্যরূপ ছিল। ছেলেবেলা হইতে সে কখনো রাগ করিয়া কখনো জেদ করিয়া একটা-না-একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু এবারকার ব্যাপারটি গুরুতর। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারে বিনয়ও তাহার সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়াতে সে এক দিকে সংকোচ এবং অন্য দিকে একটা নিগূঢ় হর্ষ অনুভব করিতেছিল। এই হর্ষ যেন নিষেধের সংঘাত-দ্বারাই বেশি করিয়া মথিত হইয়া উঠিতেছিল। একজন বাহিরের পুরুষকে সে আজ এমন করিয়া আশ্রয় করিয়াছে, তাহার এত কাছে আসিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে আত্মীয়সমাজের কোনো আড়াল নাই, ইহাতে কতখানি কুণ্ঠার কারণ ছিল– কিন্তু বিনয়ের স্বাভাবিক ভদ্রতা এমনি সংযমের সহিত একটি আবরু রচনা করিয়া রাখিয়াছিল যে এই আশঙ্কাজনক অবস্থার মাঝখানে বিনয়ের সুকুমার শীলতার পরিচয় ললিতাকে ভারি একটা আনন্দ দান করিতেছিল। যে বিনয় তাহাদের বাড়িতে সকলের সঙ্গে সর্বদা আমোদ-কৌতুক করিত, যাহার কথার বিরাম ছিল না, বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গেও যাহার আত্মীয়তা অবারিত, এ সে বিনয় নহে। সতর্কতার দোহাই দিয়া যেখানে সে অনায়াসেই ললিতার সঙ্গ বেশি করিয়া লইতে পারিত সেখানে বিনয় এমন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিয়াছিল যে তাহাতেই ললিতা হৃদয়ের মধ্যে তাহাকে আরো নিকটে অনুভব করিতেছিল। রাত্রে স্টীমারের ক্যাবিনে নানা চিন্তায় তাহার ভালো ঘুম হইতেছিল না; ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে এক সময় মনে হইল রাত্রি এতক্ষণে প্রভাত হইয়া আসিয়াছে। ধীরে ধীরে ক্যাবিনের দরজা খুলিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল রাত্রিশেষের শিশিরার্দ্র অন্ধকার তখনো নদীর উপরকার মুক্ত আকাশ এবং তীরের বনশ্রেণীকে জড়াইয়া রহিয়াছে– এইমাত্র একটি শীতল বাতাস উঠিয়া নদীর জলে কলধ্বনি জাগাইয়া তুলিয়াছে এবং নীচের তলায় এঞ্জিনের খালাসিরা কাজ আরম্ভ করিবে এমনতরো চাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া যাইতেছে। ললিতা ক্যাবিনের বাহিরে আসিয়াই দেখিল, অনতিদূরে বিনয় একটা গরম কাপড় গায়ে দিয়া বেতের চৌকির উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। দেখিয়াই ললিতার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি বিনয় ঐখানেই বসিয়া পাহারা দিয়াছে! এত নিকটে, তবু এত দূরে! ডেক হইতে তখনই ললিতা কম্পিতপদে ক্যাবিনে আসিল; দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সেই হেমন্তের প্রত্যুষে সেই অন্ধকারজড়িত অপরিচিত নদীদৃশ্যের মধ্যে একাকী নিদ্রিত বিনয়ের দিকে চাহিয়া রহিল। সম্মুখের দিক্‌প্রান্তের তারাগুলি যেন বিনয়ের নিদ্রাকে বেষ্টন করিয়া তাহার চোখে পড়িল; একটি অনির্বচনীয় গাম্ভীর্যে ও মাধুর্যে তাহার সমস্ত হৃদয় একেবারে কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া উঠিল; দেখিতে দেখিতে ললিতার দুই চক্ষু কেন যে জলে ভরিয়া আসিল তাহা সে বুঝিতে পারিল না। তাহার পিতার কাছে সে যে দেবতার উপাসনা করিতে শিখিয়াছে সেই দেবতা যেন দক্ষিণ হস্তে তাহাকে আজ স্পর্শ করিলেন এবং নদীর উপরে এই তরুপল্লবনিবিড় নিদ্রিত তীরে রাত্রির অন্ধকারের সহিত নবীন আলোকের যখন প্রথম নিগূঢ় সম্মিলন ঘটিতেছে সেই পবিত্র সন্ধিক্ষণে পরিপূর্ণ নক্ষত্রসভায় কোন্‌-একটি দিব্যসংগীত অনাহত মহাবীণায় দুঃসহ আনন্দবেদনার মতো বাজিয়া উঠিল।

এমন সময় ঘুমের ঘোরে বিনয় হাতটা একটু নাড়িবামাত্রই ললিতা তাড়াতাড়ি ক্যাবিনের দরজা বন্ধ করিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। তাহার হাত-পায়ের তলদেশ শীতল হইয়া উঠিল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে হৃৎপিণ্ডের চাঞ্চল্য নিবৃত্ত করিতে পারিল না।

অন্ধকার দূর হইয়া গেল। স্টীমার চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। ললিতা মুখ-হাত ধুইয়া প্রস্তুত হইয়া বাহিরে আসিয়া রেল ধরিয়া দাঁড়াইল। বিনয়ও পূর্বেই জাহাজের বাঁশির আওয়াজে জাগিয়া প্রস্তুত হইয়া পূর্বতীরে প্রভাতের প্রথম অভ্যুদয় দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। ললিতা বাহির হইয়া আসিবা মাত্র সে সংকুচিত হইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই ললিতা ডাকিল, “বিনয়বাবু!”

বিনয় কাছে আসিতেই ললিতা কহিল, “আপনার বোধ হয় রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি?”

বিনয় কহিল, “মন্দ হয় নি।”

ইহার পরে দুইজনে আর কথা হইল না। শিশিরসিক্ত কাশবনের পরপ্রান্তে আসন্ন সূর্যোদয়ের স্বর্ণচ্ছটা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ইহারা দুইজনে জীবনে এমন প্রভাত আর কোনোদিন দেখে নাই। আলোক তাহাদিগকে এমন করিয়া কখনো স্পর্শ করে নাই– আকাশ যে শূন্য নহে, তাহা যে বিস্ময়নীরব আনন্দে সৃষ্টির দিকে অনিমেষে চাহিয়া আছে, তাহা ইহারা এই প্রথম জানিল। এই দুইজনের চিত্তে চেতনা এমন করিয়া জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে যে, সমস্ত জগতের অন্তর্নিহিত চৈতন্যের সঙ্গে আজ যেন তাহাদের একেবারে গায়ে গায়ে ঠেকাঠেকি হইল। কেহ কোনো কথা কহিল না।

স্টীমার কলিকাতায় আসিল। বিনয় ঘাটে একটা গাড়ি ভাড়া করিয়া ললিতাকে ভিতরে বসাইয়া নিজে গাড়োয়ানের পাশে গিয়া বসিল। এই দিনের বেলাকার কলিকাতার পথে গাড়ি করিয়া চলিতে চলিতে কেন যে ললিতার মনে উল্‌টা হাওয়া বহিতে লাগিল তাহা কে বলিবে। এই সংকটের সময় বিনয় যে স্টীমারে ছিল, ললিতা যে বিনয়ের সঙ্গে এমন করিয়া জড়িত হইয়া পড়িয়াছে, বিনয় যে অভিভাবকের মতো তাহাকে গাড়ি করিয়া বাড়ি লইয়া যাইতেছে, ইহার সমস্তই তাহাকে পীড়ন করিতে লাগিল। ঘটনাবশত বিনয় যে তাহার উপরে একটা কর্তৃত্বের অধিকার লাভ করিয়াছে ইহা তাহার কাছে অসহ্য হইয়া উঠিল। কেন এমন হইল! রাত্রের সেই সংগীত দিনের কর্মক্ষেত্রের সম্মুখে আসিয়া কেন এমন কঠোর সুরে থামিয়া গেল!

তাই দ্বারের কাছে আসিয়া বিনয় যখন সসংকোচে জিজ্ঞাসা করিল, “আমি তবে যাই”– তখন ললিতার রাগ আরো বাড়িয়া উঠিল। সে ভাবিল, বিনয়বাবু মনে করিতেছেন তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া পিতার কাছে উপস্থিত হইতে আমি কুণ্ঠিত হইতেছি। এ সম্বন্ধে তাহার মনে যে লেশমাত্র সংকোচ নাই ইহাই বলের সহিত প্রমাণ করিবার এবং পিতার নিকট সমস্ত জিনিসটাকে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত করিবার জন্য সে বিনয়কে দ্বারের কাছ হইতে অপরাধীর ন্যায় বিদায় দিতে চাহিল না।

বিনয়ের সঙ্গে সম্বন্ধকে সে পূর্বের ন্যায় পরিষ্কার করিয়া ফেলিতে চায়– মাঝখানে কোনো কুণ্ঠা, কোনো মোহের জড়িমা রাখিয়া সে নিজেকে বিনয়ের কাছে খাটো করিতে চায় না।

গোরা ৩১

৩১

বিনয় ও ললিতাকে দেখিবা মাত্র কোথা হইতে সতীশ ছুটিয়া আসিয়া তাহাদের দুইজনের মাঝখানে দাঁড়াইয়া উভয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “কই, বড়দিদি এলেন না?”

বিনয় পকেট চাপড়াইয়া এবং চারি দিকে চাহিয়া কহিল, “বড়দিদি! তাই তো, কী হল! হারিয়ে গেছেন।”

সতীশ বিনয়কে ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “ইস, তাই তো, কক্‌খনো না। বলো-না ললিতাদিদি!”

ললিতা কহিল, “বড়দিদি কাল আসবেন।”

বলিয়া পরেশবাবুর ঘরের দিকে চলিল।

সতীশ ললিতা ও বিনয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া কহিল, “আমাদের বাড়ি কে এসেছেন দেখবে চলো।”

ললিতা হাত টানিয়া লইয়া কহিল, “তোর যে আসুক এখন বিরক্ত করিস নে। এখন বাবার কাছে যাচ্ছি।”

সতীশ কহিল, “বাবা বেরিয়ে গেছেন, তাঁর আসতে দেরি হবে।”

শুনিয়া বিনয় এবং ললিতা উভয়েই ক্ষণকালের জন্য একটা আরাম বোধ করিল। ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কে এসেছে?”

সতীশ কহিল, “বলব না! আচ্ছা, বিনয়বাবু, বলুন দেখি কে এসেছে? আপনি কক্‌খনোই বলতে পারবেন না। কক্‌খনো না, কক্‌খনো না।”

বিনয় অত্যন্ত অসম্ভব ও অসংগত নাম করিতে লাগিল– কখনো বলিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কখনো বলিল রাজা নবকৃষ্ণ, একবার নন্দকুমারেরও নাম করিল। এরূপ অতিথিসমাগম যে একেবারেই অসম্ভব সতীশ তাহারই অকাট্য কারণ দেখাইয়া উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদ করিল। বিনয় হার মানিয়া নম্রস্বরে কহিল, “তা বটে, সিরাজউদ্দৌলার যে এ বাড়িতে আসার কতকগুলো গুরুতর অসুবিধা আছে সে কথা আমি এপর্যন্ত চিন্তা করে দেখি নি। যা হোক, তোমার দিদি তো আগে তদন্ত করে আসুন, তার পরে যদি প্রয়োজন হয় আমাকে ডাক দিলেই আমি যাব।”

সতীশ কহিল, “না, আপনারা দুজনেই আসুন।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কোন্‌ ঘরে যেতে হবে?”

সতীশ কহিল, “তেতালার ঘরে।”

তেতালার ছাদের কোণে একটি ছোটো ঘর আছে, তাহার দক্ষিণের দিকে রৌদ্র-বৃষ্টি-নিবারণের জন্য একটি ঢালু টালির ছাদ। সতীশের অনুবর্তী দুইজনে সেখানে গিয়া দেখিল ছোটো একটি আসন পাতিয়া সেই ছাদের নীচে একজন প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক চোখে চশমা দিয়া কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেছেন। তাঁহার চশমার এক দিককার ভাঙা দণ্ডে দড়ি বাঁধা, সেই দড়ি তাঁহার কানে জড়ানো। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হইবে। মাথার সামনের দিকে চুল বিরল হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু গৌরবর্ণ মুখ পরিপক্ক ফলটির মতো এখনো প্রায় নিটোল রহিয়াছে; দুই ভ্রূর মাঝে একটি উল্‌কির দাগ– গায়ে অলংকার নাই, বিধবার বেশ। প্রথমে ললিতার দিকে চোখ পড়িতেই তাড়াতাড়ি চশমা খুলিয়া বই ফেলিয়া রাখিয়া, বিশেষ একটা ঔৎসুক্যের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন; পরক্ষণেই তাহার পশ্চাতে বিনয়কে দেখিয়া দ্রুত উঠিয়া দাঁড়াইয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিলেন এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিলেন। সতীশ তাড়াতাড়ি গিয়া তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “মাসিমা, পালাচ্ছ কেন? এই আমাদের ললিতাদিদি, আর ইনি বিনয়বাবু। বড়দিদি কাল আসবেন।”

বিনয়বাবুর এই অতিসংক্ষিপ্ত পরিচয়ই যথেষ্ট হইল; ইতিপূর্বেই বিনয়বাবু সম্বন্ধে আলোচনা যে প্রচুর পরিমাণে হইয়া গিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। পৃথিবীতে সতীশের যে-কয়টি বলিবার বিষয় জমিয়াছে কোনো উপলক্ষ পাইলেই তাহা সতীশ বলে এবং হাতে রাখিয়া বলে না।

মাসিমা বলিতে যে এখানে কাহাকে বুঝায় তাহা না বুঝিতে পারিয়া ললিতা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিনয় এই প্রৌঢ়া রমণীকে প্রণাম করিয়া তাহার পায়ের ধুলা লইতেই ললিতা তাহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিল। মাসিমা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে একটি মাদুর বাহির করিয়া পাতিয়া দিলেন এবং কহিলেন, “বাবা বোসো, মা বোসো।”

বিনয় ও ললিতা বসিলে পর তিনি তাঁহার আসনে বসিলেন এবং সতীশ তাঁহার গা ঘেঁষিয়া বসিল। তিনি সতীশকে ডান হাত দিয়া নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমরা জান না, আমি সতীশের মাসি হই– সতীশের মা আমার আপন দিদি ছিলেন।”

এইটুকু পরিচয়ের মধ্যে বেশি কিছু কথা ছিল না কিন্তু মাসিমার মুখে ও কণ্ঠস্বরে এমন একটি কী ছিল যাহাতে তাঁহার জীবনের সুগভীর শোকের অশ্রুমার্জিত পবিত্র একটি আভাস প্রকাশিত হইয়া পড়িল। “আমি সতীশের মাসি হই’ বলিয়া তিনি যখন সতীশকে বুকের কাছে চাপিয়া ধরিলেন তখন এই রমণীর জীবনের ইতিহাস কিছুই না জানিয়াও বিনয়ের মন করুণায় ব্যথিত হইয়া উঠিল। বিনয় বলিয়া উঠিল, “একলা সতীশের মাসিমা হলে চলবে না; তা হলে এতদিন পরে সতীশের সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে। একে তো সতীশ আমাকে বিনয়বাবু বলে, দাদা বলে না, তার পরে মাসিমা থেকে বঞ্চিত করবে সে তো কোনোমতেই উচিত হবে না।”

মন বশ করিতে বিনয়ের বিলম্ব হইত না। এই প্রিয়দর্শন প্রিয়ভাষী যুবক দেখিতে দেখিতে মাসিমার মনে সতীশের সঙ্গে দখল ভাগ করিয়া লইল।

মাসিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা, তোমার মা কোথায়?”

বিনয় কহিল, “আমার নিজের মাকে অনেক দিন হল হারিয়েছি, কিন্তু আমার মা নেই এমন কথা আমি মুখে আনতে পারব না।”

এই বলিয়া আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিবা মাত্র তাহার দুই চক্ষু যেন ভাবের বাষ্পে আর্দ্র হইয়া আসিল।

দুই পক্ষে কথা খুব জমিয়া উঠিল। ইহাদের মধ্যে আজ যে নূতন পরিচয় সে কথা কিছুতেই মনে হইল না। সতীশ এই কথাবার্তার মাঝখানে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিল এবং ললিতা চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

চেষ্টা করিলেও ললিতা নিজেকে সহজে যেন বাহির করিতে পারে না। প্রথম-পরিচয়ের বাধা ভাঙিতে তাহার অনেক সময় লাগে। তা ছাড়া, আজ তাহার মন ভালো ছিল না। বিনয় যে অনায়াসেই এই অপরিচিতার সঙ্গে আলাপ জুড়িয়া দিল ইহা তাহার ভালো লাগিতেছিল না; ললিতার যে সংকট উপস্থিত হইয়াছে বিনয় তাহার গুরুত্ব মনের মধ্যে গ্রহণ না করিয়া যে এমন নিরুদ্‌বিগ্ন হইয়া আছে ইহাতে বিনয়কে লঘুচিত্ত বলিয়া সে মনে মনে অপবাদ দিল। কিন্তু মুখ গম্ভীর করিয়া বিষণ্নভাবে চুপচাপ বসিয়া থাকিলেই বিনয় যে ললিতার অসন্তোষ হইতে নিষ্কৃতি পাইত তাহা নহে; তাহা হইলে নিশ্চয় ললিতা রাগিয়া মনে মনে এই কথা বলিত, “আমার সঙ্গেই বাবার বোঝাপড়া, কিন্তু বিনয়বাবু এমন ভাব ধারণ করিতেছেন কেন, যেন উহার ঘাড়েই এই দায় পড়িয়াছে!’ আসল কথা, কাল রাত্রে যে আঘাতে সংগীত বাজিয়াছিল আজ দিনের বেলায় তাহাতে ব্যথাই বাজিতেছে– কিছুই ঠিকমত হইতেছে না। আজ তাই ললিতা প্রতি পদে বিনয়ের সঙ্গে মনে মনে ঝগড়াই করিতেছে; বিনয়ের কোনো ব্যবহারেই এ ঝগড়া মিটিতে পারিত না– কোন্‌ মূলে সংশোধন হইলে ইহার প্রতিকার হইতে পারিত তাহা অন্তর্যামীই জানেন।

হায় রে, হৃদয় লইয়াই যাহাদের কারবার সেই মেয়েদের ব্যবহারকে যুক্তিবিরুদ্ধ বলিয়া দোষ দিলে চলিবে কেন? যদি গোড়ায় ঠিক জায়গাটিতে ইহার প্রতিষ্ঠা থাকে তবে হৃদয় এমনি সহজে এমনি সুন্দর চলে যে, যুক্তিতর্ক হার মানিয়া মাথা হেঁট করিয়া থাকে, কিন্তু সেই গোড়ায় যদি লেশমাত্র বিপর্যয় ঘটে তবে বুদ্ধির সাধ্য কী যে কল ঠিক করিয়া দেয়– তখন রাগবিরাগ হাসিকান্না, কী হইতে যে কী ঘটে তাহার হিসাব তলব করিতে যাওয়াই বৃথা।

এ দিকে বিনয়ের হৃদয়যন্ত্রটিও যে বেশ স্বাভাবিকভাবে চলিতেছিল তাহা নহে। তাহার অবস্থা যদি অবিকল পূর্বের মতো থাকিত তবে এই মুহূর্তেই সে ছুটিয়া আনন্দময়ীর কাছে যাইত। গোরার কারাদণ্ডের খবর বিনয় ছাড়া মাকে আর কে দিতে পারে! সে ছাড়া মায়ের সান্ত্বনাই বা আর কে আছে! এই বেদনার কথাটা বিনয়ের মনের তলায় বিষম একটা ভার হইয়া তাহাকে কেবলই পেষণ করিতেছিল–কিন্তু ললিতাকে এখনই ছাড়িয়া চলিয়া যায় ইহা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়াছিল। সমস্ত সংসারের বিরুদ্ধে আজ সেই যে