ট্যাক্সি একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেল। ড্রাইভার বলল, জিয়ার আমলে করা।
মির্জা সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দীর্ঘ সময় পর ড্রাইভার প্রশ্নের জবাব দিল। এতক্ষণ কি সে এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিল? মনে করতে পারছিল না—কার আমলে রাস্তা হয়েছে? হয়ত বা।
পলিন চুপচাপ আছে। চোখ বন্ধ। ঘুমুচ্ছে হয়ত। জ্বর আসে নি তো? তিনি পলিনের গায়ে হাত দিলেন। গা গরম লাগছে। বেশ গরম।
মেয়েটির এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ফার্গস ফলস্ এলাকা থেকে বেরুলেই শরীর খারাপ। যতক্ষণ সে ফার্গস ফল্স-এ আছে ততক্ষণ ভালো। স্কুলে যাচ্ছে, খেলছে, পড়াশোনা করছে শহরের গণ্ডি পেরুলেই জ্বর।
মির্জা সাহেব একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের সাথে কথা বলেছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট একগাদা থিওরি কপচিয়েছেন। সেই সব থিওরির মূল কথা হচ্ছে-পলিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিজের বাড়ির কাছাকাছি যখন থাকে তখন এটা কম থাকে। বাইরে গেলেই বেড়ে যায়। ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটা খুব দেখা যায়। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, অনেক ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের আমি দেখেছি। তাদের কারোর মধ্যে এই ব্যাপার কিন্তু দেখি না।
সবার মানসিক গঠন তো এক রকম নয়। এক জন মানুষ যে অন্য এক জন মানুষের চাইতে কত আলাদা তা আমরা সবচে ভালো জানি।
স্যার আসছি। নামেন।
মির্জা সাহেব ড্রাইভারের এই কথায় খুব অপ্ৰস্তুত বোধ করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার তিনি নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হোটেলের গাড়ি-বারান্দায় ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা। রাজা-বাদশাদের মতো জমকালো পোশাকপুরা হোটেলের দারোয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তিনি এবং তাঁর কন্যা—দুজনই গভীর ঘুমে।
বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। বাতাসও দিচ্ছে। এত অল্প সময়ে আবহাওয়ার একি পরিবর্তন! হোটেলের ভেতর ঢুকতেই সব আবার অন্যরকম হয়ে গেল। কে বলবে বাইরে এমন দুর্যোগ?
ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর একটা মজা আছে। দেশের সঙ্গে এদের কোনো যোগ থাকে না। সব একরকম। হোটেলগুললই যেন আলাদা একটা জগৎ। বাংলাদেশের একটা হোটেলের ভেতরটায় যে গন্ধ ভেসে বেড়ায় সেই একই গন্ধ পাওয়া যায় লস এঞ্জেলস্-এর হোটলে। রিসিপশনিস্টরা মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখে ধাতব গলায়। কথা বলে। সব মানুষের ভেতরই এক জন রোবট থাকে। বড় হোটলগুলো সেই সব রোবটদের বের করে নিয়ে আসে।
স্যার আপনাদের কি রিজার্ভেশন আছে?
হ্যাঁ আছে।
আপনাদের পাসপোর্টগুলো কি দেখতে পারি?
অবশ্যই পারেন। তার আগে দয়া করে এক জন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবেন? আমার মেয়েটি অসুস্থ।
আপনারা ঘরে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার যাবেন। রুম নাম্বার দুশ এগার।
ধন্যবাদ।
হোটেলের রুমে ঢুকে প্রথম যে জিনিসটা দেখতে ইচ্ছা করে সেটা হচ্ছে—বাথরুম। বাথরুম দেখা হবার পর ইচ্ছা করে জানালার পর্দা সরিয়ে শহর দেখতে। মির্জা সাহেব প্রথমটা করলেন না তবে জানালার পর্দা সরিয়ে শহর দেখতে চেষ্টা করলেন। কিছুই দেখতে পেলেন না। গোটা শহর ঘন অন্ধকারে ঢাকা। এই হোটেলের নিশ্চয়ই নিজেদের পাওয়ার জেনারেটার আছে।
বাইরে হাওয়ার মাতামাতির কিছুই এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। এয়ার কুলারের শব্দে সব ঢাকা পড়েছে। এয়ার কুলার বন্ধ করে জানালার একটা পাট কি খুলে ফেলা। যায়?
হোটেলের ডাক্তার বিদেশি। চেহারা দেখে মনে হয় হংকং বা থাইল্যান্ডের কেউ হবেন। এরা কি বাংলাদেশি কোনো ডাক্তার খুঁজে পায় নি?
ডাক্তার সাহেব ঔষধপত্র কিছুই দিলেন না। গরম স্যুপ খেয়ে পলিনকে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। ডাক্তারের ধারণা ভ্রমণের ক্লান্তিতে এমন হয়েছে। বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে।
ডাবল রুম।
পাশের খাটে পলিন অঘোরে ঘমচ্ছে। গলা পর্যন্ত চাদর টানা। ধবধবে সাদা রঙের চাদর। সাদা চাদরে ঢাকা একটি বালিকার মুখ দেখতে ভালো লাগে না। সাদা চাদরের সঙ্গে কোথায় যেন মৃত্যুর সম্পর্ক আছে। সাদা কফিনের দীর্ঘ সংস্কার কাটানো মুশকিল। মির্জা সাহেব খুব সাবধানে নীলরঙ একটা উলের চাদর মেয়েটির গায়ে দিয়ে দিলেন। ঘুমের মধ্যেই পলিন একটু যেন চমকাল।
ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। রাত এগারটা পাঁচ। রাস্তায় নামলেই বাংলাদেশ দেখা যাবে। বাইশ বছরে কী হল দেশটার ববাঝা যাবে। তাতে তাঁর কিছু কি আসে যায়? না আসে যায় না। কিছুই আসে যায় না।
মির্জা সাহেব রুম সার্ভিসকে খবর দিয়ে একটা স্যান্ডউইচ এবং গরম এক কাপ কফি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। কফি খেলে বেশিরভাগ লোকই ঘুমুতে পারে না। তাঁর ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। ঝিমুনি আসে। ঘুমুতে ইচ্ছা করে।
কফি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেই হল। আজও যে সে রকম হবে তেমন কথা নেই। জেট লেগ হয়েছে। শরীরের নির্দিষ্ট ঘুমের সাইকেলে গণ্ডগোেল হয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে হয়ত জেগে থাকতে হবে।
তাঁর একটু শীতশীত লাগছে। আরামদায়ক শীত যা ঘুম নিয়ে আসে। গায়ের উপর চাদর টেনে বাতি নিভিয়ে দিলেন। বাতি নেভানোর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম কেটে গেছে। মাথা দপদপ করতে লাগল। ইনসমনিয়ার পূর্ব লক্ষণ। এখন তৃষ্ণা পাবে। পানি খাবার সঙ্গে-সঙ্গে বাথরুমে যেতে হবে। আবার তৃষ্ণা পাবে। আবার পানি। আবার বাথরুম।
তিনি বাতি জ্বালাতেই পলিন বলল, বাবা।
ঘুম ভেঙে গেছে?
হুঁ।
শরীর কেমন?
শরীর ভালো। ক্ষিধে পেয়েছে বাবা।
ক্ষিধে পেলে বুঝতেই হবে শরীর ভালো। কী ভাবে? স্যান্ডউইচ ছাড়া তো আর কিছু পাওয়া যাবে না।