বুড়ি ছলছলে ঘোলা চোখে তাকাল—কোনো উত্তর দিল না। পলিন জবাবের জন্যে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। কোনো জবাব নেই। পলিনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পলিনের বয়স তের। তের বছরের বালিকারা অল্পতেই আহত হয়।
মির্জা সাহেব ঘটনাটা লক্ষ করলেন কিন্তু তিনি যে লক্ষ করেছেন তা পলিনকে জানতে দিলেন না। রাগে তাঁর শরীর জ্বলছে। তাঁর নিজের দেশে, তাঁর মেয়েকে অপমান করার অধিকার এই বিদেশিনী বৃদ্ধার নেই। কিন্তু এটা কি তাঁর নিজের দেশ? তাঁর পকেটে আমেরিকান নীলরঙ পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট হাতে পাবার আগে কোর্টে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে—মহান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান মেনে চলব… মাতৃভূমির মর্যাদা… মেয়েকে তিনি তাঁর দেশ দেখাতে এনেছেন। যে সাতটা দিন তিনি এখানে থাকবেন তিনি চান না, এই সাত দিনে কেউ তাঁর মেয়ের মনে আঘাত করার মতো কিছু করে। কারণ সামান্য মন খারাপ হলে পলিন অনেক দিন পর্যন্ত বিষণ্ণ থাকে।
ইমিগ্রেশনে মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগবে। প্রচণ্ড ভিড়। তিনি শুনে এসেছিলেন। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন নাকি খুব ঝামেলা করে। বাস্তবে সেরকম দেখছেন না। ছেলেগুলো ভদ্র ব্যবহার করছে। এক জন এক ডজন পন্ডস্ ক্রিম নিয়ে এসেছে। তাকে ইমিগ্রেশনের বাচ্চামতো ছেলেটি বলল, এই ক্রিম তো দেশেই তৈরি হচ্ছে। এতগুলো আনলেন কেন? আর এটা কি নাইলনের দড়ি? ব্যান্ড আইটেম। এইসব আজে বাজে জিনিস দিয়ে সুটকেস ভর্তি করেছেন। ব্যাপার কী ভাই?
উত্তরে লোকটি বোকার মতো দাঁত বের করে আসছে। ছেলেটি স্যটকেসে চক দিযে সাইন করে বলল, যান। মির্জা সাহেব মুগ্ধ হলেন। কী সব ভয়ঙ্কর গল্পই না প্রচলিত। এরা নাকি জাঙ্গিয়া পরিয়ে উঠবস করায়। কসমেটিকস অর্ধেক রেখে দেয়। নিচু গলায় বলে, কিছু ডলার ছেড়ে দিন।
এইসব গল্প বাঙালিদের কাছ থেকেই শোনা। প্রথম প্রথম আমেরিকায় আসার পর বাঙালিরা নিজের দেশ সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা উগরে দেয়। ভয়াবহ একটি ছবি আঁকে। মনে হয় সেটা জঙ্গুলে একটা দেশ। যে দেশের সব মানুষ ঠগ, ফাঁকিবাজ। যে দেশে কিছুই পাওয়া যায় না। ঘুষ খাওয়ার জন্যে সবাই হা করে থাকে। রাত আটটার পর রাস্তায় বের হওয়া যায় না।
গল্পগুলো এমন ভাবে করা হয় যাতে মনে হয় দেশটা বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে গেলেই তাঁরা সবচে খুশি হবেন।
এরা কেন এরকম করে? অপরাধ বোধর কারণে? দেশ ছেড়ে চলে এসেছে— সেই গ্লানি জমে আছে মনে। গ্লানি আড়াল করবার জন্যেই নিশ্চয়ই বলা। নিজেকেই সে বোঝায়।
ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট?
পলিন হেসে ফেলল। আনন্দ ঝলমলে গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমাকে ম্যাডাম বলছেন কেন? আমার বয়স তের। মীর্জা সাহেব লক্ষ করলেন, মেয়ের বিষণ্ণ ভাব কেটে গেছে। কী চমৎকার বয়স। মেঘ ও রৌদ্র অনবরত খেলা করে। এই অন্ধকার এই আলো। পলিনের মনে বিদেশিনীর স্মৃতি এখন আর নিশ্চয়ই নেই। মির্জা সাহেব কাস্টমস-এর এই যুবকটির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। একটা কিছু উপহার এই ছেলেটিকে দিতে ইচ্ছা করছে। সেটা সম্ভব নয়।
আপনাদের আমেরিকান পাসপোর্ট?
জ্বি।
অনেকদিন পর দেশে ফিরছেন?
জ্বি।
প্রায় একুশ বছর পর।
ডিক্লেয়ার করার মতো কিছু কি আছে?
জ্বি না।
মির্জা সাহেব তাঁর সুটকেস খুললেন। ছেলেটি সুটকেসের দিকে না তাকিয়েই বলল, একুশ বছরে সব বদলে গেছে। কিছু চিনতে পারবেন না।
মির্জা সাহেব বললেন, আমি নিজে কিছু দেখতে আসি নি মেয়েকে দেশ দেখাতে এনেছি। মেয়ের নাম পলিন। মির্জা সাহেব দুটি ভুল কথা বললেন। তিনি মেয়েকে দেশ দেখাতে আনেন নি। নিজেই দেখতে এসেছেন। মেয়ের নাম পলিন নয়। নাম পোওলেন। তার মায়ের রাখা নাম। তিনি পলিন করে নিয়েছেন। নামটাকে বাঙালি করা হয়েছে। ই-কার যুক্ত শব্দগুলো কেন জানি বাংলা-বাংলা মনে হয়।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। টেম্পারেচার বোধহয় হঠাৎ খানিকটা নেমে গেছে। আশে পাশে শিলাবৃষ্টি হলে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পড়ে। পলিন অল্প অল্প কাঁপছে। মির্জা সাহেব ট্যাক্সির কাঁচ উঠিয়ে দিলেন। পলিন বলল, কাঁচ নামানো থাকুক দেখতে দেখতে যাই।
তোমার তো ঠাণ্ডা লাগছে। শীতে কাঁপছ।
তেমন ঠাণ্ডা লাগছে না।
দেশটা কেমন লাগছে মা?
ভালো। তবে তুমি যে বলেছিলে খুব সবুজ। তেমন সবুজ তো না।
বৃষ্টি হচ্ছে তো তাই বুঝতে পারছ না।
মির্জা সাহেব, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রাস্তাটি কি নতুন করা হয়েছে?
ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা না ঘুরিয়ে বলল, না।
পৃথিবীর সব দেশের ড্রাইভাররা কথা বলতে ভালবাসে। একটা প্রশ্ন করলে হড়বড় করে একগাদা কথা বলে। এই ড্ৰাইভার সে রকম নয়। সমস্ত পৃথিবীর উপর সে বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাচ্ছে খুব দ্রুত। বিপজ্জনক কয়েকটা ওভারটেক করল। বৃষ্টি-ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় সে যা করছে তা ঠিক না। কিন্তু লোকটা ওভারটেক করে মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটিই হয়ত তার জীবনের একমাত্র আনন্দ। পৃথিবীর সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে।
বারা।
কি মা?
ঐ ব্রিটিশ মহিলা, আমার কথার জবাব দিলেন না কেন?
তিনি হয়ত তোমার কথা শুনতে পান নি।
আমারও তাই মনে হয়।
পলিন চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে পড়ে আছে। নতুন দেশ। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার কথা। পলিন দেখছে না। তার কি ভালো লাগছে না? মির্জা সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল।