তিথি মিষ্টি করে হাসল। আলম বলল, আমি কি তাহলে চলে যাব?
স্যার, এক মিনিট দাঁড়ান। আপনার বেতন আরা আমার কাছে দিয়ে গেছেন।
মাসতো এখনো শেষ হয় নি। আব্বা সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন, পনেরদিন পরে ফিরবেন।
টাকা নেবার সময় তিথির আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল। তিথি এমন চমকে উঠল যে আলম অবাক হয়ে তাকাল। তিথি মাথা নিচু করে আছে। তার শরীর কাঁপছে। তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার একটু চা খেয়ে যান।
না থাক।
চা বানানই আছে। যাব আর নিয়ে আসব। একটু বসুন। আমার মামাতো বোনেরা আপনাকে দেখতে চায়।
আলম বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে দেখতে চায় কেন?
তিথির ঠোঁটে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা। কিছু একটা বলতে গিয়েও সে বলল না। আলম বলল, আজ আমার একটু কাজ আছে। আজ যাই। তোমরা যাও ছাদে বসে গান কর।
আমরা স্যার আজ সারারাত গান করব। আমার ফুফাতো বোনরাও আসবে।
ভালো। খুব ভালো।
তিথিদের বাড়ি থেকে বের হয়েই আলম টাকা গুনল। তিনশ টাকা করে দেবার কথা। প্রায়ই টাকা কম থাকে। গত মাসে বিশ টাকা কম ছিল। এর আগের মাসে ছিল দশ টাকা কম। দশ বিশ টাকা কম হলে সেটা আর বলা যায় না। মেজাজ শুধু অসম্ভব খারাপ হয়ে যায়। আজ হিসেব ঠিক আছে। দুটা একশ টাকার নোট, দুটা পঞ্চাশ টাকার নোট। আলম একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আলাদা করে রাখল। বাকি টাকাটা মাকে দিয়ে দিতে হবে। ঘরে টাকা পয়সার অবস্থা খুবই খারাপ। সকালে পুরানো খবরের কাগজ এবং টিনের কৌটা বিক্রি করে বাজার হয়েছে। তাও চিনি কেনা হয় নি। চিনির অভাবে ভোরবেলা চা হয় নি।
বাড়িতে পা দিতেই আলমের মা বললেন, তোর কাছে টাকা আছে নাকিরে আলম। বৌমার বাচ্চাগুলির দুধ শেষ হয়ে গেছে। বাকির দোকানে পাঠিয়েছিলাম। বাকি দিচ্ছে না। তোর বাবা নিজে গিয়েছিলেন। দোকানদার তাকে কী সব বলেছে, ঘরে এসে উনি কামরুলের সঙ্গে আজে-বাজে সব কথা বললেন। বউটা তখন থেকে কাঁদছে।
কী বলেছেন বাবা?
সব সময় যা বলেন তাই বলেছেন। কামরুলকে বলেছেন—তুই তোর তালগাছ নিয়ে বেরিয়ে যা। নিজের পথ দেখ। বউটা তখন থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তুই কোনোখান থেকে কিছু টাকা আনতে পারবি?
আলম আড়াই শ টাকা মার হাতে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মা। ফিরতে দেরি হবে।
যাবি কোথায়?
এই রাস্তায় ঘুরব। যাব আবার কোথায়?
তুই কি স্কুলের চাকরিটা নিবি?
জানি না। নিতেও পারি।
নিয়ে নে বাবা। না নিলে সৰ্বনাশ হয়ে যাবে—এদিকে রীতার আবার……
তিনি কথা শেষ করলেন না। আলম বলল, বড় আপার আবার কী হয়েছে?
না কিছু না। তুই কি রাতে ভাত খাবি?
হ্যাঁ, খাবার ঢাকা দিয়ে রেখো।
আলম এসে বারান্দায় এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। লম্বা মেয়েটা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার গাল ভেজা, ভেজা গালে চাঁদের আলো পড়েছে। সমস্ত মুখ চিকচিক করছে। আলমের ইচ্ছা হল বলে—তুমি বাবার কথায় কিছু মনে করো না। অভাবে অনটনে বাবার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি তোমার বাচ্চা দুটির কাছে যাও।
কথাগুলো বলা হল না। এই মেয়েটির সঙ্গে আলমের কখনো কথাবার্তা হয় না। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে।
আলম রাস্তায় নেমেই পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল পঞ্চাশ টাকার নোটটা ঠিক আছে কি-না। ঠিক আছে। নোটটা খরচ করা যাবে না। এ মাসের কয়েকটা দিন এবং সামনের মাসের ত্রিশ দিন পড়ে আছে।
আলম আকাশের দিকে তাকাল। তখনি প্রথম বারের মতো চোখে পড়ল আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। চট করে যে কথাটা তার মনে হল তা হচ্ছে—তিথিরা কি গান শুরু করেছে?
আলম হাঁটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। সে কোথায় যাবে এখনো ঠিক করে নি। হয়ত কোথাও যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। একা হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। মজিদের কাছে গেলে কেমন হয়? মজিদের কাছে গেলে সময়টা ভালো কাটবে। তবে মজিদ অনেকটা দূরে থাকে। উত্তর শাহজাহানপুরে। এত দূরে সে যাবে? যাওয়া যায়। মজিদের কাছে গেলে ভালো লাগবে। মনটা কেমন হয়ে আছে। মজিদের সঙ্গে গল্প গুজব করলে মনটা ভালো হবে।
দ্বিতীয় যুবকের নাম মজিদ
দ্বিতীয় যুবকের নাম মজিদ। আবদুল মজিদ। আবদুল মজিদের কাছে এলে তার বন্ধু-বান্ধবদের সময় ভালো কাটে এই তথ্য মজিদের ফুপু এবং ফুপা দুজনের কেউই জানেন না। তারা মজিদকে চেনেন এক জন অপদাৰ্থ, অকৰ্মণ্য স্বল্পবুদ্ধির মানুষ হিসেবে ইতোমধ্যেই চোর হিসেবে যার কিঞ্চিৎ অখ্যাতি রটেছে।
মজিদ ছোটাখাটো এক জন মানুষ। সাধারণত ছোটখাটো মানুষের স্বাস্থ্য ভালো হয়, মজিদের তা না। সে বেশ রোগা। স্কুলে তার নাম ছিল স্কু ড্রাইভার। এই বিচিত্র নামের তেমন কোন ইতিহাস নেই। স্কুলে প্রতিভাবান ছেলে হিসেবে তার খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই ছিল। তবে তার প্রতিভা পড়াশোনার খাতে বয় নি। তার প্রতিভার সবটাই ছিল অনুকরণে। সে যে কোন মানুষের চরিত্র একটি কথা বা ক্ষুদ্র একটি ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলতে পারত। আর পারত উল্টো কথা বলতে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টো করে জবাব দিত এবং তা এত দ্রুত বলে দিত যে মনে হত সে এই ভাবেই কথা বলে। যেমন কেউ যদি বলত, কেমন আছিস মজিদ। সে বলত, লোভা, ইতু নমকে। অর্থাৎ ভালল, তুই কেমন?
তার উল্টো কথা বলার খ্যাতি স্কুলের হেড স্যারের কানেও পৌঁছেছিল। তিনি তাকে একদিন ডাকিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ তার উল্টো কথা বলার বিদ্যা পরখ করলেন এবং শেষ মেষ বললেন, তুই একটা অসাধারণ ছেলে। ভালো মতো পড়া লেখা করিস। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলিস।