জানি না স্যার। আমি কিছুই জানি না। সারাক্ষণ আমি বাইরে ছিলাম।
কতক্ষণ আগের ব্যাপার?
ঘন্টা খানেক আগের ব্যাপার। বেশিও হতে পারে। আমার স্যার শরীর খারাপ। জল বসন্ত-মাথার কোনো ঠিক নাই।
তুমি কি মীরন নামের ছেলেটিকে এর মধ্যে একবারও ডেকে জিজ্ঞেস কর নি–কী ব্যাপার?
করেছি। সে জবাব দেয় নি?
জ্বি না।
মজিদ ক্ষুরের ফলাটা টেনে বের করল। মির্জা সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বললেন। না। মজিদের ভঙ্গি, আচার আচরণে এই মুহূর্তে যে কোনো মানুষ বলে দেবে মজিদ ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর কাটবে না। এই ঘোর কাটবার নয়।
হুড়মুড় শব্দ হল। কারো কিছু বুঝবার আগেই মজিদের প্রায় গা ঘেঁসে ছুটে নেমে গেল করিম।
মজিদ নড়ল না। করিমের প্রতি সে কোনো আগ্রহ বোধ করল না।
আলম প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। চল ভেঙ্গে যাই।
মাহিন বলল, আমার মতে এটাই বেস্ট পসিবল একশান। করিম হারামজাদার ভাব ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে মার্ডার-ফার্ডার হয়ে গেছে। উপস্থিত থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মজিদ বলল, চলে যেতে চাইলে যা।
তুই যাবি না। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে তুই কবি কী?
তোদের চলে যেতে বলছি তোরা চলে যা।
আলম বলল, দোস্ত এটা মাথা গরম করার সময় না। এখানে থাকলেই মার্ডার কেইসে পড়ে যাবি।
তুই চলে যা।
আলম এবং মাহিন সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগল। তারা নেমে যাচ্ছে তবে একটু পরপর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। মির্জা সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বেশ স্পষ্ট স্বরেই বললেন,
মজিদ তুমি কী করতে চাও?
নখু রেক বলফে।
ঐ ছেলেটিকে খুন করতে চাও?
হ্যাঁ।
আমি কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। যদি সত্যি-সত্যি এখানে কোনো হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে আমরা দেখব যেন পুলিশ এসে ছেলেটাকে ধরে। যেন বিচার হয়, আমরা চাই যেন শাস্তি হয়।
পয়সাওয়ালা মানুষদের শাস্তি এদেশে হয় না।
এটা শুধু এ দেশের জন্যে সত্যি নয়, এটা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের জন্যে সত্যি। তবু আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেন আইন নিজের পথে চলে। তুমি যা করতে যাচ্ছ। তার ফল ভয়াবহ। তুমি ফাঁসিতে ঝুলবে, তুমি পয়সাওয়ালা নও। কেউ তোমাকে বাঁচাবে না।
নখু রেক বলফে।
তুমি ক্ষুরটা ফেলে দাও। তারপর আমার সঙ্গে হোটেলে চল। হোটেলের লাউঞ্জে বসে হট কফি খেতে খেতে গল্প করব। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এ দেশ ছেড়ে যাবার আগে আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করে যাব। তুমি কি আমেরিকা যেতে চাও? যেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও করা যাবে। মানি ক্যান ড়ু ওয়ান্ডারফুল ট্রিকস।
নখু রেক বলফে।
তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে মজিদ। বেশ পছন্দ হয়েছে। আমেরিকায় তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পার। আমার মেয়েটা একা-একা থাকে। সে এক জন সঙ্গী পাবে। জীবন চমৎকার একটা জিনিস মজিদ। ইউ ক্যান নট গ্যামবল উইথ ইট। লিসন টু মি। বি রিজনেবল।
মির্জা সাহেব মজিদের দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসতে মজিদ হুংকার দিয়ে উঠল—স্টপ।
মির্জা সাহেব থমকে দাঁড়ালেন।
যান হোটেলে চলে যান। যান বলছি।
মির্জা সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। মজিদ তরতর করে তিন তলায় উঠে গেল। করিমের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল।
মজিদ নিচু গলায় বলল, মীরন ভাই ভালো আছেন?
মীরন ভয়ার্ত গলায় বলল, আপনি কে?
মজিদ তার উত্তর না দিয়ে আগের চেয়েও নরম গলায় বলল, ভাই সাহেব মেয়েটা কি মরে গেছে?
মীরন কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, বুঝতে পারছি না। শরীরতো এখনো গরম। আপনি কে?
আমার নাম আবদুল মজিদ।
আপনার হাতে এটা কি?
এটা কিছু না। এর নাম ক্ষুর।
ক্ষুর দিয়ে কী করবেন?
মজিদ মধুর স্বরে হাসল। হাসতে হাসতেই নরম স্বরে বলল, নখু বরক—খুন করব।
মজিদ নিচে নেমে এসে দেখে মির্জা সাহেব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। মজিদ বলল, আপনি যান নি?
না।
আপনি কি দয়া করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবেন।
নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব।
ফুপা-ফুপুর সঙ্গে একটু দেখা করব। রাতটা থাকব। সকালে পুলিশের কাছে ধরা দেব। আমার বাসা কিন্ত বেশ দূর। আপনাকে অনেক হাঁটতে হবে।
অসুবিধা নেই আমি হাঁটব। তুমি ঠিকমত পা ফেলতে পারছ না। মজিদ আমি কি তোমার হাত ধরব?
না হাত ধরতে হবে না। চলুন রওনা হই।
তারা দুজন পথে নামল। মজিদ ছোট-ঘোট পা ফেলতে ফেলতে এক সময় বলল, স্যার আপনার মেয়েটার নাম কি?
ওর নাম পলিন।
ও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর।
হা সুন্দর। তুমি কি ওর ছবি দেখবে। আমার মানি ব্যাগে ওর ছবি আছে।
মির্জা সাহেব ছবি বের করে মজিদের হাতে দিলেন।
মজিদ বলল, স্যার আপনার মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর।
তারা হাঁটছে। ঘুমন্ত শহরের পথে জোছনার আলো। এই চাঁদের আলো বড় অদ্ভুত জিনিস। এই আলোয় চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে যায়। পিচ ঢালা কালো কঠিন রাজপথকে মনে হয় ভাদ্র মাসের শান্ত নদী।
তারা হাঁটছে। পায়ের নিচে নদী। মাথার উপর অন্য এক রকম আকাশ। চারপাশে থৈ-থৈ জোছনা। যে জোছনা মানুষকে পাল্টে দেয়। যে জোছনায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্ৰম হয়।
হাতে রক্ত লেগে আছে
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর মজিদের ফুপা দরজা খুললেন। তিনি কিছু বলার আগেই মজিদ বলল, ভালো আছেন ফুপা?
জমির সাহেব থমথমে গলায় বললেন, রাত দুপুরে এটা কী ধরনের রসিকতা?
মজিদ উদাস গলায় বলল, রসিকতা না ফুপা। কিছুক্ষণ আগে একটা খুন করে আসলাম। ফুপুকে ডেকে তোলেন। সাবান আর পানি দিতে বলেন। হাতে রক্ত লেগে আছে। হাত ধুতে হবে।