সাইফুদ্দিন সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, হারামজাদাকে জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের কর। হারামজাদার ছায়া যেন আমি না দেখি।
তাঁর সংহার মূর্তি দেখে জড়সড় হয়ে থাকা লম্বা মেয়েটি কেঁদে-কেটে অস্থির। সাইফুদ্দিন সাহেবের হৃদয়ে এই দৃশ্যও কোনো ছায়াপাত করল না। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, লম্বুকে নিয়ে এক্ষুনি বের হ। এক্ষুনি। ইমিডিয়েট।
তারা অবশ্যি কোথাও গেল না। যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নেই। কামরুল শুধু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। নতুন মেয়েটি দেখা গেল কাঁদার ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট। সারাক্ষণই কাঁদছে। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যে খুলনা থেকে আলমের বড় বোন রীতা এসে উপস্থিত।
তার সঙ্গে চারটা বড় বড় সুটকেস এবং তিন মেয়ে। রীতা এমিতেই বেশ হাসি-খুশি। দেখা গেল তার এবারের হাসি-খুশির মাত্রা অন্যবারের চেয়েও বেশি। সব কিছু নিয়েই হাসছে, মজা করছে। মাকে বলল, তোমার সঙ্গে কয়েক মাস থাকব মা। খুলনার লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না।
মা বললেন, বেশত থাকবি। তোর মেয়েদের স্কুলের ক্ষতি হবে না তো?
না। ওদের বাবা এসে ওদের নিয়ে যাবে।
তুই থাকবি?
হুঁ।
তুই একা থাকবি কী ভাবে?
বললামতো মা, খুলনার লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না। মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। এক সময় দেখবে মাথায় টাক পড়ে যাবে।
তোর কী হয়েছে সত্যি করে বলতে?
বললামতো কিছু হয় নি। লোনা পানি সহ্য হচ্ছে না।
রীতা কিছু না বললেও জানা গেল ব্যাপার জুটিল। বেশ জটিল। রীতার স্বামী কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার মুখলেস সাহেব দুমাসের মধ্যে কোনো খোঁজ খবর করলেন না। শুধু মনি অর্ডার করে রীতার মার নামে আড়াই হাজার টাকা পাঠালেন। রীতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই টাকা যদি তোমরা রাখ তাহলে আমি ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়ব। আল্লাহর কসম আমি ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দেব। টাকা ফেরত গেল। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার মুখলেস সাহেব আর কোনোরকম খোঁজ খবর করলেন না। সাইফুদ্দিন সাহেব উকিলের চিঠির মারফত জানতে পারলেন, চারিত্রিক দোষের কারণে মুখলেসুর রহমান তাঁর স্ত্রী মাসুদা রহমান ওরফে রীতাকে ইসলামী বিধি মোতাবেক তালাক দিয়েছেন। তার তিন কন্যা বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মাসুদা রহমানের সঙ্গেই থাকবে এবং তাদের খরচপত্র দেয়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সাইফুদ্দিন সাহেব হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন।
প্রথমবার বি. এ. ফেল করার পর কামরুল দ্বিতীয়বারও ফেল করল। যেদিন রেজাল্ট হল তার পরদিন তার স্ত্রী দুটি জমজ বাচ্চা প্রসব করে মর-মর হয়ে গেল। মেয়ে মানুষের জীবন সহজে বের হয় না বলেই সে কোনক্রমে টিকে গেল। কামরুলের বর্তমানে একমাত্র কাজ হচ্ছে দুই বাচ্চাকে কোলে করে ঘুম পাড়ানো এবং রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করা। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বলা, খবরদার আমি কিন্তু খুন। করে ফেলব। সত্যি খুন করে ফেলব। খুন করে ফাঁসি যাব।
তার স্ত্রী এই কথার উত্তরে খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে, দয়া করে তাই কর। খুন করে দেখাও যে একটা কাজ তুমি করতে পার। একেবারে অপদাৰ্থ তুমি না।
কি আমাকে অপদার্থ বললি?
হ্যাঁ বললাম। অপদার্থকে অপদার্থ বললে দোষ হয় না।
ঘরে তখন হুটোপুটির শব্দ শোনা যায়। জমজ বাচ্চা দুটি এক সঙ্গে কাঁদতে থাকে। সাইফুদ্দিন সাহেব চটি ফটফটিয়ে এগিয়ে আসেন। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলেন, হচ্ছে। কী এসব? এই হারামজাদা জুতিয়ে তোকে ঠাণ্ডা করব। এক্ষুনি তুই তোর লম্বুকে নিয়ে বেরিয়ে যা। এই মুহূর্তে। খোল হারামজাদা, দরজা খোল।
কামরুল দরজা খোলে না। তবে হুটোপুটির শব্দ থেমে যায়। জমজ বাচ্চা দুটি শুধু চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কাঁদে। সাইফুদ্দিন সাহেব চোখে অন্ধকার দেখেন। আলমও অন্ধকার দেখে। গাঢ় অন্ধকার।
আজ আশ্বিন মাস।
বারই আশ্বিন। পূর্ণিমার সন্ধ্যা। শহরে পূর্ণিমার চাঁদ সন্ধ্যা মেলাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় না। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। শহরের মানুষ পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে মাথা ঘামায় না। পূর্ণিমা অমাবস্যা শহুরে ব্যাপার নয়।
আলম আজকের পূর্ণিমার ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। সন্ধ্যা মেলাবার পর সে যথারীতি প্রাইভেট টিউশনিতে বেরিয়ে গেল। তাদের বাসার কাছেই তিথি নামের একটা মেয়েকে সেইংরেজি পড়ায়। মেয়েটি দুবছর ধরে এস. এস. সি. দিচ্ছে। এইবার নিয়ে হবে তৃতীয় দফা। মনে হচ্ছে এবারও কোনো উনিশ-বিশ হবে না। তিথির চেহারাটা মিষ্টি, তার চোখের মণি দুটিতে এক ধরনের স্নিগ্ধতা আছে। সে কথাও বলে গানের মতো সুরে। মাঝেমাঝে মাথা নিচু করে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে যে, আলমের ইচ্ছে করে তার পিঠে হাত রেখে বলতে— এই কী হয়েছে? এত হাসি কিসের?
আলম তিথিকে পড়াতে গেলেই ভাবে—এরকম চমৎকার একটা মেয়ে পড়াশোনায় এত গাধা হল কী করে? দুমাস ইংরেজি টেনস পড়াবার পরেও আমি ভাত খাই—এর ইংরেজি সে লেখে—I am rice eating.
আলম তিথিদের বাড়ির দরজার কলিং বেলে হাত রাখার আগেই তিথি বেরিয়ে এসে বলল, আজতো স্যার পড়ব না।
পড়বে না কেন?
আজ পূর্ণিমা!
পূর্ণিমাতে পড়া যায় না না-কি?
যায়। যাবে না কেন? তবে আমার মামাতো বোনরা সবাই এসেছে। আমরা ঠিক করেছি শাড়ি পড়ে আজ সারা রাত ছাদে বসে গান করব।
তুমি গানও জান?
আমিতো স্যার ছায়ানটে গান শিখি। আমার এবার থার্ড ইয়ার। থার্ড ইয়ারে আমি ফার্স্ট হয়েছি।
পড়াশোনা ছাড়া আর সবই দেখি তুমি ভালো জান।