দলটা থমকে দাঁড়াল। সিঁড়িতে বাতি জ্বলছে। সিঁড়ির বাতি মাত্র চল্লিশ ওয়াটের। বাতি এই মুহূর্তে করিমের মাথার উপর বলে তাকে দেখা যাচ্ছে। সে অন্যদের দেখতে পাচ্ছে না। সে যে কোনো কারণেই হোক অসম্ভব ভীত। মজিদরা থমকে দাঁড়াল। করিম বলল, কে আপনারা?
মজিদ বলল, আমরা।
আমরা মানে কে?
মজিদ জবাব না দিয়ে আরো দুটা ধাপ পার হল। করিম চেঁচিয়ে বলল, স্টপ স্টপ।
মাহিন বিস্মিত গলায় বলল, করিম আমরা এখানে ব্যাপার কি?
করিম থমত খাওয়া গলায় বলল, উপরে উঠবেন না ভাই, প্লিজ।
ব্যাপার কি?
অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা?
চলেন নিচে যাই। নিচে গিয়ে বলি।
এখানেই বল কী অসুবিধা।
করিম কাঁপা কাঁপা বলায় বলল, ঘরে মীরন ভাই আছে। অন্য সময় আসেন।
মজিদ বলল, ফুর্তি করতে এসেছে?
করিম জবাব দিল না।
আলম বলল, ফুর্তিবাজ একটা ছেলে তার সঙ্গে দেখা না করে গেলে ভালো দেখায় না।
নো নো। স্টপ।
অসুবিধা আছে?
বললামতো অসুবিধা আছে।
মজিদ বলল, ভদ্রলোকের ছেলের সঙ্গে কথা বলব। আলাপ পরিচয় হবে। এর মধ্যে অসুবিধা কি? সেকি মেয়েছেলে নিয়ে এসেছে?
না না—এসব কিছু না।
মেয়েছেলে থাকলে অন্য ব্যাপার ছিল। যখন নাই তখন দেখা করতে অসুবিধা কি?
তাকে নিয়ে খানিকটা ঘুরব। দলে ফুর্তিবাজ একটা ছেলে থাকলে ভালো লাগে।
করিম কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ভাই আপনাদের পায়ে ধরি আপনারা চলে যান। কেন আমাকে বিপদে ফেলছেন? আমি গরীব মানুষ। এখান থেকে বের করে দিলে না খেয়ে মরব।
আলম বলল, চল চলে যাই। যথেষ্ট হয়েছে।
করিম সঙ্গে-সঙ্গে বলল, জ্বি ভাই চলে যান। কাল আসবেন। কাল আপনাদের। জন্যে ভালো জিনিস যোগাড় করে রাখব। প্রমিস ভাই প্রমিস।
মজিদ বলল, মীরন ভাইয়ার সঙ্গে দেখা না করে চলে যাব এ কেমন কথা। সঙ্গে মেয়েছেলে থাকলে অন্য কথা।
করিম ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, সঙ্গে মেয়ে ছেলে আছে ভাই। আজ চলে যান। রিকোয়েস্ট। আপনার পায়ে ধরি ভাই। আই টাচ ইয়োর ফিট।
করিম সত্যি-সত্যি পা ধরবার জন্যে এগিয়ে গেল। মজিদ মুখ বিকৃত করে বলল, থাক থাক পা ধরতে হবে না। চলে যাচ্ছি।
থ্যাংকস ভাই। মেনি থ্যাংকস।
মজিদ দু ধাপ সিঁড়ি নেমে গেল। নেমে থমকে দাঁড়াল। করিম বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন ভাই চলে যান।
মজিদ কড়া গলায় বলল, ব্যাপারটা কি বলেন তো। ঠিকমত বলেন। না বললে এই জিনিস পেটের মধ্যে ঢুকে যাবে। এই যন্ত্ররে চিনেন? এই যন্ত্রের নাম ক্ষুর। সান রাইজ ক্ষুর।
করিম সিঁড়িতে বসে পড়ল।
সে এই দলটিকে কিছুতেই তার ঘরে যেতে দিতে পারে না। ঘরে বিরাট সমস্যা। মীরন বেকুবের মতো এক কাণ্ড করে বসেছে। রাস্তায়-রাস্তায় ফুল বিক্রি করে এরকম একটা দশ-এগার বছরের মেয়েকে গাড়ি করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার রোগা ভোগা চেহারা। কিন্তু দেখতে সুশ্ৰী। মীরন তাকে কী বলে তুলিয়ে এতদূর এনেছে সেই জানে কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠবার মুখে মেয়েটি বেঁকে বসল, আফনে আমারে কই নেন?
মীরন তার হাত চেপে ধরে বলল, চুপ থাক। টাকা পাবি। মেলা টাকা পাবি। মেয়েটা হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, আফনে আমার কই নেন? আফনে আমারে কই নেন?
হৈ-হৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে করিম নেমে এসে দেখে এই কাণ্ড। সে ভীত গলায় বলল, মীরন কী কর তুমি।
মীরন ভারী গলায় বলল, আপনি এসে এর আরেকটা হাত ধরেন তো। বড় যন্ত্ৰণা করছে।
মীরন ছেড়ে দাও। ঝামেলা হবে।
আরে দূর দূর।
মীরন ভাই তোমার পায়ে ধরি।
আমার পায়ে ধরতে হবে না। আপনি এর হাতটা ধরেন। হারামজাদীর কত বড় সাহস। আমার হাতে কামড় দিয়েছে। রক্ত বের করে দিয়েছে। হারামজাদীকে আমি উচিত শিক্ষা দেব।
মীরন ভাই কথা শোন।
ধুত্তোরী যন্ত্রণা। হাতটা ধরেন।
মীরনের মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। চোখ ঘোলাটে। মনে হচ্ছে। রেগে যাচ্ছে। রেগে গেলে এই ছেলে চণ্ডাল। করিম এসে মেয়েটির হাত ধরল। হাত ধরা মাত্র মেয়ে সেই হাতে কামড় দিল। মহা বিচ্ছু মেয়ে।
এই বিচ্ছু মেয়ে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে করিমের ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। সেখানে কী হচ্ছে একমাত্র আল্লা মালুদই জানে। প্রথম কিছুক্ষণ বিকট গোঙানী শোনা গেছে। সেই শব্দ কমে এসেছে। সম্ভব মুখ চেপে ধরার কারণে। তারপর আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই।
করিম ক্রমাগত দোয়া ইউনুস পড়ে যেতে লাগল। হে আল্লা বিপদ থেকে উদ্ধার কর। এই হারামজাদা মীরন কী বিপদে ফেলল? বিপদের এই চাকরি আর ভালো লাগে না। এরচে গুলিস্তানে ভিক্ষা করা ভালো। হে আল্লা দয়া কর।
আল্লাহ দয়া করেন নি। বিপদ কমে নি উল্টো বিপদ আরো বেড়েছে। মজিদ ভাইয়ের মতো ঠাণ্ডা ছেলে হাতে ক্ষুর নিয়ে উপস্থিত। এখন কোন্ ঝামেলা বেঁধে যায় কে জানে।
সঙ্গে কোট পরা ভদ্রলোকই বা কে? কে জানে। পুলিশের আই.বি-র লোক নাতো। আই. বি-র লোগুলো এই রকমইতো থাকে।
মজিদ বলল, কথা বলছেন না বিষয় কি করিম ভাইয়া। মেরা পেয়ারা ভাই দিমু জিনিস পেটে হান্দাইয়া?
মজিদ সিঁড়ি বেয়ে তিন ধাপ এগিয়ে এল। করিম ফাঁস-ফাঁসে গলায় বলল, বলছি ভাই। পুরোটা ভেঙ্গে বলছি। শালার কী যন্ত্রণার মধ্যে যে পড়লাম। আপনাদের সাথে ইনি কি পুলিশের লোক?
বাজে প্যাচাল বন্ধ কইরা আসল কথা কহেন বাহে। সময় নাই।
করিম মূল ঘটনা অতি দ্রুত বলে গেল। মনে হল কেউ এক জন দাড়ি কমা ছাড়া রিডিং পড়ছে। দম নেবার জন্যেও থামছে না। করিম চুপ করা মাত্র মির্জা সাহেব কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কি মারা গেছে?