রেসকোর্সের ময়দানে ঢোকা হল না। বৃষ্টিতে কাদা হয়ে আছে। কাদার উপর হাঁটাহাটি কারো পছন্দ হল না। তাছাড়া জায়গাটা জনশূন্য। বৃষ্টি হবার করণেই হয়ত কেউ নেই। মজিদ বলল, চল ফিরে যাই। করিমের কাছে যাওয়া যায়।
আলম বলল, করিমের কাছে কী জন্যে? জিন খাবি?
হুঁ।
সবাই আবার ফিরে চলল। কেউ কোনোরকম আপত্তি করল না। মাহিন আবার তার ইমার্জেন্সি স্টক থেকে সিগারেট বের করেছে। এবার সে এক ধরায় নি—অন্য দুজনকেও দিয়েছে। মাহিন মনে-মনে আশা করছিল মজিদ রাগ করে সিগারেট নেবে না। তা হয় নি। মজিদ সহজ ভাবেই সিগারেট নিয়েছে।
দলটা দ্রুত গতিতে হাঁটছে। এত দুত যে মির্জা সাহেব ঠিক তাল মিলাতে পারছেন না। বার-বার পিছিয়ে পড়ছেন। মাহিন তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে।
মাহিন নিচু গলায় কথা বলা শুরু করল। মির্জা সাহেবের কথা বলতে ইচ্ছা করছে। না তবু বলছেন।
আমেরিকায় আপনি কী করেন?
একটা ফার্মের সঙ্গে যুক্ত আছি।
কী ফার্ম?
রিসার্চ ফাৰ্ম। ওরা ওয়াটার সলুবেল পলিমার নিয়ে গবেষণা করে। নতুন নতুন প্রডাক্ট তৈরি করে।
আপনি কি সাইনটিস্ট না-কি?
হ্যাঁ, তা বলা যেতে পারে।
বেতন কত পান।
অনেক।
অনেকটা কত সেটা বলেন? না-কি বলা যাবে না।
বলা যাবে না কেন। নিশ্চয়ই বলা যাবে। বৎসরে তিরানব্বই হাজার ডলার পাই।
ট্যাক্স কাটে না?
সব কেটে-কুটে এই পাই।
তিরানব্বই হাজার ডলার মানে বাংলাদেশি টাকার কত?
জানি না কত।
হিসেব করে বের করেন কত। বত্রিশ দিয়ে গুণ দেন। ডলার এখন বত্রিশ করে যাচ্ছে।
মির্জা সাহেব প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বললেন, প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা।
এক বৎসরেই ত্রিশ লক্ষ পান?
হ্যাঁ। করেন কী এত টাকা দিয়ে?
মির্জা সাহেব জবাব দিলেন না। মাহিন বলল, আপনার গাড়ি আছে?
আছে।
একটা না দুটা?
দুটা আছে।
বাড়ি কিনেছেন?
হ্যাঁ।
কটা রুম সেই বাড়িতে?
বলতে পারছি না। দোতলা বাড়ি বেশ কিছু রুম আছে।
নিজের বাড়িতে কটা রুম তাও বলতে পারছেন না?
মির্জা সাহেব চুপ করে গেলেন। তিনি মাহিনের গলার উত্তাপ টের পাচ্ছেন। ছেলেটা রেগে যাচ্ছে। চাপা রাগ। চাপা রাগ যে কোনো মুহূর্তে ভয়ংকর রূপে ফুটে বেরুতে পারে।
বাড়িতে সুইমিং পুল আছে?
আছে।
রাজার হালে আছেন তাহলে।
আর দশটা বিত্তবান আমেরিকানদের মতোই আছি।
আপনার লজ্জা লাগে না?
লজ্জা?
হ্যাঁ লজ্জা। দেশের মানুষ না খেয়ে আছে আর আপনি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন।
তোমার কি ধারণা আমি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা বন্ধ করলে দেশের লোক খেতে পাবে?
মজিদ হুংকার দিয়ে উঠল, চুপ কর শালা আবার তর্ক করে।
আমি তর্ক করছি না। প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি।
শালা তোকে প্রশ্নের জবাব দিতে কে বলেছে? এই লালটুস শালাকে খুন না। করলে আমি শান্তি পাচ্ছি না। শালার মুখের দিকে তাকালে গা কাঁপছে। শালা ত্রিশ লাখ টাকা কামাই করে আমাদের মানুষ মনে করছে না। হারামজাদা বজ্জাত।
মির্জা সাহেবের বুক কেঁপে উঠল। মজিদের উন্মাদ রাগ তিনি টের পাচ্ছেন। এই রাগ বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা নদীর প্রবল জলধারার মতো পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে কোনো সময় নিজেই পথ বের করে নেবে।
উনিশশ বাষট্টি সনে নিজেই এ রকম অন্ধ রাগের একটি দৃশ্য দেখেছেন। নীলক্ষেতের লেপ তোষকের দোকানগুলোর কাছে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে লালরঙের একটা ভোক্সওয়াগনে করে দ্রুত যাচ্ছেন। একটা ছোট বাচ্চা কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গেল। গাড়িতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। প্ৰচণ্ড ব্রেক কষে ভদ্রলোক গাড়ি থামালেন। দরজা খুলে ছুটে গেলেন বাচ্চাটির কাছে। বাচ্চাটাকে রাস্তা থেকে টেনে তোলার আগেই লোকজন তাকে ধরে ফেলল। ঝাকড়া চুলের গোয় হলুদ রঙের মাফলার জড়ানো এক যুবক অন্ধ রাগে চেঁচাতে লাগল-হারামজাদা না দেখে গাড়ি চালায়। হারামজাদার চোখ গেলে দেন। হারামজাদার চোখ দুটো গেলে দেন…। ছেলেটার সঙ্গে-সঙ্গে আরো অনেকে চেঁচাতে লাগল-চোখ গেলে দাও। চোখ গেলে দাও।
মির্জা সাহেবের মতো আরো অনেকের চোখের সামনে ভয়াবহ ঘটনাটা সত্যি-সত্যি ঘটে গেল।
আজো এরকম কিছু ঘটবে। অন্ধ রাগের ছায়া মজিদের চোখে মুখে। তার প্যান্টের পকেটে ভয়াবহ একটি অস্ত্র।
ইসলাম ব্রাদার্সের আঠারতলা দালানের চত্বর
দলটি আবার ঢুকল ইসলাম ব্রাদার্সের আঠারতলা দালানের চত্বরে। ঢোকার মুখে স্থূপ করে রাখা রডে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মজিদ। যে কোনো পতনের দৃশ্য হাস্যরস তৈরি করে। এই দৃশ্যটি করল না। বরং সবাই মিলে খানিকটা শংকিত বোধ করল। মাহিন বলল, ব্যথা পেয়েছিস?
মজিদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, না, আরাম পেয়েছি। অন্য সময় এই কথায় প্রচুর হাসাহাসি শুরু হয়ে যেত আজ হল না। আজ দলটির অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।
মজিদ সিঁড়ি বেয়ে তিন তলার দিকে রওনা হল। করিমের কাছে যাবে এইটুকু সে জানে। কেন যাবে তা জানে না। কতক্ষণ থাকবে তাও জানে না। শেষ পর্যন্ত নাও যেতে পারে। তিন তলায় উঠার পর হয়ত আর করিমের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা থাকবে না। সে ফিরে যাবে। দলের অন্যরা কিছুই ভাবছে না। তারা মজিদকে অনুসরণ করছে। মজিদ যা করবে তারা তাই করবে।
তাদের তিন তলা পর্যন্ত উঠতে হল না। দোতলার সিঁড়িতে পা দেয়া মাত্ৰ করিম নেমে এল। তার গায়ে সাদা একটা কম্বল। তাকে দেখাচ্ছে ভালুকের মতো। তার জ্বর সম্ভবত আরো বেড়েছে। মুখ কেমন যেন লালচে দেখাচ্ছে। সে উঁচু গলায় বলল, স্টপ স্টপ। আপনারা যান কোথায়?