মজিদ বলল, কি তোরা যাবি রেসকোর্সের মাঠে?
আলম বলল, ঐখানে আছে কি?
মজিদ চাপা গলায় বলল, ফুর্তির জায়গাই হচ্ছে রেসকোর্সের মাঠ। গাছ বড় হয়েছে। অন্ধকার-অন্ধকার ভাব। এই সব অন্ধকারে মজার মজার জিনিস দেখবি।
দূর বাদ দে।
বাদ দেব কেন? ঢাকার লাইফ দেখব না? আমাদের সঙ্গে ফরেন চাচামিয়া আছে। ফরেন চাচামিয়াকে দেখিয়ে দেই। কি ফরেন চাচামিয়া, দেখতে চান না?
মির্জা সাহেব সহজ গলায় বললেন, না।
বিলাতি মেম সাহেব ছাড়া মন বসে না? নিচে কার্পেট উপরে ঝাড়বাতি। মেম সাহেবের কোমরে হাত দিয়ে নাচ।
সবাই যে এ রকম করে তা কিন্তু না।
চাচামিয়া বুঝি করেন না?
না।
চাচামিয়া কি মৌলানা না-কি?
মির্জা সাহেব জবাব দিলেন না। দলটি রেসকোর্সের দিকে এগুতে লাগল। মজিদ এখন দলপতি। পছন্দ না করলেও সবাই তার পেছনে-পেছনে যাবে। ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়ত এদের মধ্যে অন্য কেউ দলের নেতৃত্ব নেবে। তবে আজকের রাতটা মজিদের। সময় নেতা তৈরি করে। ঠিক সময়ে ঠিক নেতা এই কারণেই বের হয়ে আসে।
আলম বলল, পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। খাওয়ার পানি আছে না-কি।
মজিদ বলল, রেসকোর্সে পুকুর আছে।
ঐ জার্ম ভর্তি পানি আমি খাব, বলিস কি?
দরকার হলে খাবি। সে রকম তৃষ্ণা হলে সব খাওয়া যায়।
মির্জা সাহেব লক্ষ করলেন মজিদ ছেলেটা অনেকক্ষণ উল্টো করে কথা বলছে না। সে কি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ঘোর কেটে যাচ্ছে? সব বড় ক্ৰাইম এক ধরনের ঘোরের মধ্যে করা হয়। ঘোর কেটে গেলে ক্রিমিন্যালরা কিছু করতে পারে না। তাদের মন সাধারণ মানুষের চেয়েও তরল অবস্থায় চলে যায়, অল্পতেই তারা আবেগে অভিভূত হয়। মন্টানা শহরের সেই কুখ্যাত খুনীর কথাই ধরা যাক। কী নাম ছিল যেন-জন-রেমন্ড? নাকি জেনি-রে। জেনি-রেই হবে। মেয়েলি ধরনের নাম। ঘঘরের মধ্যে চলে গেলে গলায় বেল্ট পেঁচিয়ে খুন করত। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কোনো বাছ বিচার ছিল না। ধরা পড়বার পর পুলিশ যখন জানতে চাইল, কেন খুন করতে? সে পাইপ টানতে-টানতে হাসিমুখে বলেছিল, মরবার সময় লোকগুলি কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাত, দেখতে বড় ভালো লাগত।
অদ্ভুত চোখ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?
তাদের চোখের দৃষ্টিতে ভালবাসা মাখানো থাকত।
ভালবাসা?
হ্যাঁ। ভালবাসা। গভীর ভালবাসা। তুমি না দেখলে বুঝতে পারবে না। মৃত্যু পথযাত্রীর চোখ বড় মায়াময়।
এই জেন-রেই সুস্থ থাকা অবস্থায় লাল নীল কাগজে মজার মজার ছড়া লিখে ছোট-ঘোট বাচ্চাদের বিলাত।
Dick dick dick
My dog is sick
Her dog is long
Sing sing a song.
এক পাবলিশার আবার এই সব ছড়া জোগাড় করে এক বই ছাপিয়ে ফেলল। বইটির নাম Black Rhymes- কালো ছড়া। আমেরিকা হচ্ছে পাগলের দেশ।
মাহিনের সিগারেট শেষ হয়েছে। সে এসে দলে যোগ দিয়েছে। তার একা-একা সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা কেউ লক্ষ করে নি দেখে সে বেশ খুশি। সে ফুর্তিবাজের গলায় বলল, কি মারাত্মক চাঁদ উঠেছে দেখেছিস নাকি রে মজিদ?
মজিদ জবাব দিল না। আকাশের দিকে তাকালও না। এক দল থুথু ফেলল। মাহিন বলল, সুকান্ত বেঁচে থাকলে এই চাঁদ দেখে আরেকটা বিপ্লবী কবিতা লিখে ফেলত। থ্যাংক গড যে মারা গেছে।
মজিদ এবারো জবাব দিল না। আবার এক দল থুথু ফেলল, মাহিন বলল, কথা বলছি না কেন?
স্বার্থপর হোটলোকের বাচ্চার সঙ্গে আমি কথা বলি না।
আমি স্বার্থপর?
ইচ্ছা করে পেছনে পড়ে গেলি হারামজাদা ছোটলোক।
আরে একটা সিগারেট কেমন করে জানি পকেটে ছিল আমি জানতাম না-আপ অন গড।
আবার মিথ্যা কথা বলছিস? প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আবার প্যাকেটে রেখে দিলি…
একটাই সিগারেট ছিল। বিশ্বাস কর খালি প্যাকেট। আপ অন গড।
খালি প্যাকেট কোনো শালা পকেটে রাখে?
মির্জা সাহেব বিস্মিত হলেন। মজিদের মধ্যে নেতার গুণাবলি চলে এসেছে। দলের সবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। কে কী করছে না করছে তা সে এখন জানে।
মাহিন থমথমে গলায় বলল, সিগারেট যদি প্যাকেটে থেকেই থাকে তাতে অসুবিধা কি? আমি কি তোর পয়সায় সিগারেট কিনেছি। গালাগালি করছিস কেন? ফস করে হারামজাদা বলে ফেললি। শালা তুই হারামজাদা বানান জানিস?
আলম বিরক্ত মুখে বলল, কী শুরু করলি তোরা। চল হাঁটি।
মাহিন বলল, আমি হাঁটাহাটির মধ্যে নেই। বাসায় চলে যাব।
আলম বলল, এখন বাসায় যাবি কি? মাত্র বারটা চল্লিশ বাজে। নাইট ইজ স্টিল ইয়াং।
বারটা চল্লিশ বাজুক বা তেরটা চল্লিশ বাজুক আমি চললাম।
সত্যি যাচ্ছি?
হ্যাঁ সত্যি।
আলম বলল, চল সবাই মিলে চলে যাই। পুলিশে ধরলে মুশকিল। হাজতে চালান করে দিবে। মজিদ, চল যাওয়া যাক।
তোরা যেতে চাইলে যা।
তুই একা-একা কী করবি?
বললাম না একটা খুন করব। দাঁড়িয়ে আছিস কেন চলে যা।
তুই যাবি না?
না।
আর এই ভদ্রলোককে কী করবি?
নখু বরক, নখু বরক।
মির্জা সাহেব চমকে উঠলেন। উল্টো কথা আবার ফিরে এসেছে। ছেলেটা কথাও বলছে তীক্ষ্ণ স্বরে, আগের পাগলামী কি আবার ফিরে আসছে। সঙ্গের ছেলে দুটি চলে গেলে ঝামেলা হবে।
মজিদ বলল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চলে যা।
ওরা গেল না দাঁড়িয়ে রইল। মজিদ রেসকোর্সের দিকে হাঁটতে শুরু করা মাত্র তারাও পেছনে-পেছনে আসতে লাগল। মির্জা সাহেব লক্ষ করলেন মজিদ এখন আর পা টেনে-টেনে হাঁটছে না। ব্যথা বোধ নিশ্চয়ই নেই। সে তাহলে ঘরের মধ্যে আছে, ঘোর কাটছে না।