এখন ভাববেন। কাল ভোরেই তিনি আমাদের খোঁজে বের হবেন। খুঁজে বের করা খুব একটা জটিল সমস্যা হবে না।
মির্জা সাহেব বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি? বেঁটে যুবকটি বলল, নো কট। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি সাংকেতিক ভাষার অর্থ উদ্ধার করলেন। ছেলেটি উল্টো করে বলছে। নো কট হচ্ছে—নো টক। বেঁটে ছেলেটির নামও তিনি জেনেছেন। তার নাম মজিদ। লম্বা ছেলেটি আলম। অন্যজনের নাম তিনি এখনো জানেন না।
নাম না জানা ছেলেটি বলল, সিগারেট দরকার। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে।
মজিদ মির্জা সাহেবকে বলল, আপনার কাছে সিগ্রেট আছে?
না।
ধূমপান করেন না?
এককালে করতাম। এখন করি না।
ক্যানসারের ভয়ে?
হ্যাঁ।
এত বেঁচে থাকার শখ?
মির্জা সাহেব দুটি ব্যাপার লক্ষ করলেন, ছেলেটা কথার ধরন বদলেছে। ভদ্র স্বর বের করেছে। তাই হয়ে থাকে। পাশাপাশি কিছু সময় থাকা মানেই পরিচয়। নিতান্ত অপরিচিত এক জনের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা যায় কিন্তু পরিচিত কারোর সঙ্গে করা যায় না। সাইকোলজিস্টরা যে কারণে বলেন, খারাপ প্রকৃতির মানুষের হাতে। পড়লে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। তারা যা বলে তাতেই রাজি হতে হবে। এবং চেষ্টা করতে হবে কথা বার্তা বলার। তাদের কেউ যদি বলে, আমরা এখন তোমাকে গুলি করে মারব, তখন ভয়ে অস্থির হওয়া চলবে না। ভয় খুব সংক্রামক। তোমার ভয় দেখে সেও ভয় পাবে। একজন ভীতু মানুষ ভয়ংকর কাণ্ড করে। পৃথিবীতে হত্যার স্টেটিসটিকস নিলে দেখা যাবে যে বেশিরভাগ খুনগুলো করেছে ভীতু মানুষেরা। কাজেই কেউ তোমাকে হত্যা করতে চাইলে তুমি সময় চাইবে। যাকে বলে কালক্ষেপণ। শুধু কথা বলবে। তুমি যদি নন স্মোকারও হও তবু বলবে, আমাকে মেরে ফেলতে চান, আমার কিছু করার নেই। দয়া করে আমাকে একটা সিগারেট দিন। একটা সিগারেট হাতে পাওয়া মানে পাঁচ মিনিট সময় বেশি পাওয়া। খেয়াল রাখবে, পাঁচ মিনিট অনেক সময়। এই সময়টা কাজে লাগাবে। এমন ধরনের কথা বলবে যার জন্যে হত্যাকারী প্রস্তুত নয়। যেমন, তুমি তার শার্টের দিকে তাকিয়ে বলতে পারআপনার এই হাওয়াই শার্টের রঙটা চমৎকার। আমার অবিকল এরকম একটা ছিল। এক লোকের হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে শার্টটা ফুটো হয়ে গেছে। তোমার কথায় লোকটা হকচকিয়ে যাবে। তার শার্টের মতো তোমারও একটা শার্ট ছিল এটা শোনার পর তার সঙ্গে তোমার একটি সূক্ষ্ম বন্ধন তৈরী হবে। তোমার শার্টটি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সে তোমার প্রতি খানিকটা সহানুভূতি বোধ করবে। এই সহানুভূতি খুবই সূক্ষ্ম। তবে সূক্ষ্ম হলেও কাজের।
মির্জা সাহেব বললেন, একটা দোকান খোলা দেখা যাচ্ছে। ওখানে কি সিগারেট পাওয়া যাবে?
তারা জবাব দিল না কিন্তু খোলা দোকানটির দিকে হাঁটতে লাগল। দোকানের নাম। রূপা স্টোর। সাড়ে বত্রিশ ভাজা ধরনের দোকান। বিদেশি কসমেটিকস থেকে আইসক্রিম পর্যন্ত আছে। সঙ্গে কনফেকশনারি। দুজন কর্মচারী। এরা দুজনই দোকান বন্ধ করায় ব্যস্ত। তারা ঢাকা মাত্র বিরক্ত গলায় বলল, দোকান বন্ধ।
মাহিন বলল, পুরোপুরি বন্ধত এখনো হয় নাই ভাই। এক প্যাকেট সিগারেট নিব। ফাইভ-ফাইভ আছে।
আছে বিক্রি হবে না।
কেন হবে না?
একবার বললাম শুনলেন না, দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।
মজিদ তীব্র চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। আলম বলল, ভাই রাত হয়ে গেছে সিগারেট পাওয়া যাবে না। আপনার কাছে আছে দিয়ে দেন চলে যাই।
সারাদিন বেচাকেনা করে কর্মচারী দুজনেরই মেজাজ খুব খারাপ। রোগা হাড় জিজিড়ে যে জন, সে-ই কটকট করছে। অন্যজন বেশ বলশালী। সে এতক্ষণ কথা বলে নি। এখন বলল, মালিক ক্যাশ নিয়ে দোকান বন্ধ করতে বলে দিয়েছে। আপনারা সিগারেটের দাম দিবেন আমি ভাংতি দিতে পারব না।
মাহিন বলল, যা দাম হবে তাই দিব ভাংতি দিতে হবে না।
মোটা কর্মচারী এক প্যাকেট সিগারেট বের করে বলল, পঞ্চাশ টাকা দেন।
মাহিন বলল, বাজারেত পঁয়তাল্লিশ টাকা, আপনি পঞ্চাশ চাচ্ছেন কেন?
বাজারে পয়তাল্লিশ হলে বাজার থেকে নেন।
সে প্যাকেট ঢুকিয়ে রাখল। আলম বলল, প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রাখলেন কেন ভাই সাহেব? কিনব না এমন তো বলি নাই। হয়তো পঞ্চাশ টাকা দিয়েই কিনব।
আলম পঞ্চাশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিল।
রোগা কর্মচারীটি সঙ্গে-সঙ্গে বলল, নোটটা বদলে দেন ছেড়া আছে।
কোথায় ছেড়া?
এই যে দেখেন স্কচ টেপ মারা।
মির্জা সাহেব এক দৃষ্টিতে আলমের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি খুব অস্বস্তি নিয়ে লক্ষ করলেন, ছেলেটির ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠছে। যতদূর মনে হচ্ছে এর কাছে এই পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছাড়া আর কিছু নেই। সম্ভবত তার বন্ধুদের কাছেও নেই। মির্জা সাহেব পরিষ্কার বুঝলেন ঘটনা এখন অন্যদিকে মোড় নেবে। তিনি কি কিছু করতে পারেন? তার কাছে বাংলাদেশি টাকা নেই। টাকা থাকলে চকচকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট কাউন্টারে রেখে দিতেন। এতে অবশ্যই কাজ হত।
আলম বলল, এই নোট রাখবেন না?
বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে গেল। মোটা কর্মচারীটি বলল, রেখে দেরে লিটু। ঝামেলা শেষ কর।
তার কথা শেষ হবার আগেই লিটু উলটে পড়ে গেল। আলম প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটেছে যে আলম নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না, কী ঘটে গেল। সে তাকিয়ে দেখল লিটু নামের লোকটা দুহাতে তার নাক চেপে ধরে আছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে।