মির্জা সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। অন্যমনস্ক না হলে লক্ষ করতেন তিনটি যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিন জনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট, তিন জনই কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। হঠাৎ এক সঙ্গে তাদের হাসি থেমে গেল। হাসি এবং কান্না এমন জিনিস যে হঠাৎ করে থেমে গেলে অন্যমনস্ক মানুষের কানেও একটা ধাক্কা লাগে, ইন্দ্ৰিয় সজাগ হয়ে ওঠে। মির্জা সাহেব সচকিত হলেন। লক্ষ করলেন, তিন যুবকের মধ্যে এক জন বেশ খাটো। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে এবং তার এক পায়ে স্যাভেল অন্য পায়ে কিছু নেই।
ছেলেটি তার হাতের সিগারেট অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য দুই জনও একই ভঙ্গিতে সিগারেট খুঁড়ে ফেলল। দৃশ্যটি অস্বাভাবিক। সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ আমরা আশে পাশেই ফেলি, এত দূরে ফেলি না। এক জন যে জায়গায় যে ভাবে সিগারেট ফেলবে অন্য দুই জনও ঠিক তাই করবে এটাই বা কেমন? এই তিন জনের মনে কিছু একটা আছে। সেই কিছুটা কী?
বেঁটে যুবকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্যেরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেঁটে যুবকটির হাতে লম্বা কোনো একটা জিনিস যা সে গোপন করতে চেষ্টা করছে। আশে পাশে কোনো স্ট্রিট ল্যাম্প নেই বলেই যুবকটির মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। চাঁদের আলো যত তীব্রই হোক মানুষের মুখের ভাব তাতে ধরা পড়ে না। বেঁটে যুবকটি মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় বলল, আছেন কেন?
মির্জা সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছ?
জ্বি না। আফনেরে না। আফনের কান্ধে যে দুই ফিরিস্তা আছে তাহারে জিগাই।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সব কিছু কি বোঝা যায় চাচামিয়া? কিছু বোঝা যায়, কিছু যায় না। এই হইল জগতের নিয়ম।
মির্জা সাহেবের বিস্ময় আরো বাড়ল তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। এই যুবকরা আসলে কী চায় তা তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন। বেঁটে যুবকটি তার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছে। নেশা করে আসে নি তো? এলকোহলের তিনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন না। এলকোহল ছাড়াও আরো সব নেশার জিনিস আছে। তেমন কিছু না তো? এমিটোফিন জাতীয় কোনো ড্রাগ। ঢাকা শহরে এসব কি চলে এসেছে?
তিনি সহজ স্বরে বললেন, কী ব্যাপার বলতো?
বেঁটে যুবকটি বলল, য়ভ য়পা না খিদে লাহা।
তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। এই যুবকটি কি কোন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করছে?
বাকি দুজন যুবকও এবার এগিয়ে আসছে। মির্জা সাহেব বললেন, তোমরা কারা?
স্বাস্থ্যবান যুবকটি বলল, তুমি তুমি করছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমরা কচি খোকা।
অবশ্যই তোমরা কচি খোকা নও। আমার বয়স অনেক বেশি সেই কারণেই তুমি বলছি।
আপনি কথা বেশি বলেন। নো টক।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বেঁটে যুবকটি বলল, পেটের ভিতর যখন ক্ষুর হান্দাইব তখন বুঝবি বিষয় কি? হালা তুমি তুমি করে। হালার কত বড় সাহস।
লম্বামতো জিনিসটা যে একটা ক্ষুর তিনি তা আন্দাজে বুঝে নিলেন। সামান্য একটা ক্ষুর হাতে এই তিন যুবক তাঁকে ঘিরে ধরে আছে। এরা মাগার। পথচারীর টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্রপাতির বল তেমন নেই। ক্ষুরের মতো সামান্য জিনিস নিয়ে পথে নেমেছে।
এটা কি ঢাকা শহরের স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য? তাঁর কাছে রাতের নিউইয়র্ক বলে মনে হচ্ছে। তিনি নিউইয়র্কে দুবার মাগারদের হাতে পড়েছেন। দুবারই ওদের হাতে ছিল আট ইঞ্চি হোরা। প্রথমবার দুজন কালো ছেলে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। এক জন নেশার কারণে দাঁড়াতে পারছিল না। ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় জন নেশা করে নি। সে শীতল গলায় বলল, একটা ডলার দিতে পার। খুবই প্রয়োজন।
তিনি ওয়ালেট বের করলেন এবং নিশ্চিন্ত হলেন ছেলেটি ওয়ালেট ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাবে। তা সে করল না। শান্ত ভঙ্গিতে ডলারের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। মির্জা সাহেব ডলার বের করে দিলেন। ছেলেটি বলল, ধন্যবাদ। আমার এই বন্ধুকে কি তুমি এক শ ডলার দিতে পার? ওর এক শ ডলারের খব প্রয়োজন।
তিনি বললেন, এক শ ডলার আমার সঙ্গে নেই। সে এই ওয়ালেটটি নিতে পারে।
ধন্যবাদ। ঘড়িটা খুলে দাও।
তিনি ঘড়ি খুলে দিলেন। তখনি ছেলেছি প্রচণ্ড একটা ঘুষি তার পেটে বসিয়ে দিল। তিনি ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেটি ফিরেও কাল না। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে শিস দিতে দিতে এগিয়ে গেল। একবার পিছনে ফিরে তাকাল না। ভয়ংকর যে খুনী সেও অন্তত একবার তার খুনক মৃত দেহটির দিকে তাকায়।
এরাও কি সেই কালো ছেলেটির মতো? মনে হচ্ছে না। এদের চেহারা ভদ্র। অবশ্যি ঐ কালো ছেলেটির চেহারাও ভদ্র ছিল। কি সুন্দর করে কথা বলছিল।
মির্জা সাহেবকে চমকে দিয়ে বেঁটে ছেলেটি বলল, কিরে হালা কতা কচ না ক্যান?
বেঁটে জন বা হাতটায় একটা ঝাঁকি দিতেই খচ করে শব্দ হল। ক্ষুরের ফলা খুলে গেল। মির্জা সাহেব এই প্রথম বুঝলেন ক্ষুর একটা ভয়াবহ অস্ত্ৰ।
তোর পকেটে কী আছে?
ট্রাভেলার্স চেক। তোমরা এই চেক ভাঙাতে পারবে না।
মির্জা সাহেবের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেছি বলল, চাচামিয়া তাইলে ফরেন মাল। আবুধাবি? না কি কুয়েত?
বেঁটে ছেলেটি খিকখিক শব্দ করছে। হায়োর হাসির সাথে এই শব্দের একটা মিল আছে। মির্জা সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, তোমরা আমার ঘড়িটা নিতে পার। দামি ঘড়ি বিক্রি করলে কিছু পাবে।
তাঁর নিজের শান্ত গলার স্বরে তিনি নিজেই চমকে গেলেন। তিনি যেন বেশ মজা পাচ্ছেন কথা বলতে চাঁদের আলোয় এই তিন যুবককে কেন জানি মোটেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। একটা খালি রিকশাকে এই সময় আসতে দেখা গেল। বুড়ো রিকশাওয়ালা, তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ রিকশার গতি দুত করে দিল। এ রকম দৃশ্য সে মনে হয় আরো দেখেছে। এবং সে জানে এই সব ঘটনাকে পাশে রেখে দুত এগিয়ে যাওয়াই নিয়ম। পেছনের ছেলেটি মির্জা সাহেবের কাঁধে হাত রাখল। আগের মতো মেয়েলি গলায় বলল, চাচা মিয়া, চলেন এট্টু সামনে। আপনের লগে একখান কতা আচে।