তোর বাবারতো টাকা-পয়সা আছে।
বাবার টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসবে? তাঁর অনেস্ট বাতিক ছিল। ঘুষ নিতেন। না। আসলে ভীরু টাইপের লোক ছিলেন। ঘুষ নিতে সাহস লাগে। সাহস ছিল না, বাইরে প্রচার করেছেন—অনেস্ট। পেনসনের টাকা-পয়সা দিয়ে মিরপুরে জমি কিনেছেন। সেই জমির দখল পাচ্ছেন না। পুলিশের লোক হয়েও জমির দখল পাচ্ছেন। না, বুঝে দেখ অবস্থা। ঐ দিন দেখে এসেছি ঐ জমিতে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একখানা বাড়ি তুলছে। বিরাট সমস্যায় খাবি খাচ্ছি। বুঝলি।
তারা চুপচাপ হয়ে গেল। তিনজনেই নিঃশব্দে এগুচ্ছে। রাত এগারটার মতো বাজে। রাস্তা নির্জন। এই দিকে রিকশার চলাচল এমিতেই কম। আজ আরও কমে গেছে। মাঝে-মাঝে হুম করে অতি দ্রুত এক আধটা প্রাইভেট কার চলে যাচ্ছে।
আলম বলল, কেমন যেন ভয়ভয় লাগছে। ছিনতাই পার্টির হাতে পড়তে পারি।
মজিদ বলল, তোর আছে কী যে ছিনতাই পার্টির হাতে পড়বি?
রিস্টওয়াচ আছে।
মজিদ বলল, সাথে ক্ষুর আছে, আমরাই এখন ছিনতাই পার্টি। দাঁড়িয়ে দেখ এক্ষুনি একটা ছিনতাই করব।
পাগলামী করি না মজিদ।
ছিনতাই না করলেও ভয় দেখিয়ে দেই। ভয় দেখাতে তো অসুবিধা নেই।
বাদ দে। বরং চল করিমের ওখানে তাস খেলব।
মজিদ বলল, দুনিয়ার এক নম্বর মজা কিসে হয় জানিস? এক নম্বর মজা হল ভয় দেখানোয়। পৃথিবীর মানুষ সারাক্ষণ এক জন আরেক জনকে ভয় দেখায় কেন? মজা পায় বলেই ভয় দেখায়। ভয়ের মধ্যেই আসল মজা।
কাকরাইলের দিক থেকে হুডতোলা একটি রিকশা আসছে। আলম বা মাহিন কিছু বুঝবার আগেই মজিদ রাস্তায় নেমে তীব্র গলায় বলল, যায় কেডা? থাম দেহি।
তার গলার স্বর সে কর্কশ করে ফেলেছে। পুরান ঢাকার ছেলেপুলেদের মতো ঢাকাইয়া স্বর বের করেছে। রিকশাওয়ালা হকচকিয়ে থেমে গেল।
মজিদ বলল, আতের মইদ্যে এইটা কী, ক দেহি? এই জিনিসের নাম কি?
চাঁদের আলোয় ক্ষুরের ফলা চকচক করতে লাগল। রিকশাওয়ালা বুড়ো। সে রিকশা থেকে নেমে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। শুরুতে একবার মাত্র মজিদের দিকে তাকিয়েছিল, এখন আর তাকাচ্ছে না। মনে হয় এ রকম পরিস্থিতিতে এর আগে
সে আর পড়ে নি।
পুরো ব্যাপারটাই এত আকস্মিক যে আলম এবং মাহিন হকচকিয়ে গিয়েছে। আলম ভীত স্বরে ডাকল, এই মজিদ এই। সেই স্বর এতই ক্ষীণ যে মজিদের কানে পৌঁছল না।
মজিদ হুংকার দিল, রিকশার বিতরে কোন্ হালা? মাতা বাইর কর। চাঁন মুখ খান দেহি।
রিকশার আরোহী দুজন। মধ্য বয়স্ক এক জন ভদ্রলোক সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। তার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। এই মেয়েটি ভয়ে ও আতংকে সাদা হয়ে গেছে। পুরুষটি নামতে চেষ্টা করতেই মেয়েটি সজোরে তার হাত আকড়ে ধরল। পুরুষটি বেশ বলশালী। পরনে স্ট্রাইপ দেয়া হাফ শার্ট। মাথার চুল ছোট-ছোট করে কাটা। সে ভয় পেলেও চেহারায় তা বোঝা যাচ্ছে না। সে মোটামুটি স্বাভাবিক গলায় বলল, ভাই আপনি কী চান?
নামতে কইছি কথা কানে ঢুকে না? না-কি ক্ষুর হালাইয়া দিমু?
লোকটি স্ত্রীর সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে রিকশা থেকে নেমে পড়ল। নিচু গলায় বলল, টাকা বিশেষ কিছু আমাদের সঙ্গে নাই ভাই সাহেব। বলেই সে পকেটের মানিব্যাগ বের করল।
মজিদ খেকিয়ে উঠল, ট্যাকা-পয়সা তোর কাছে চাইছিরে হারামী? তুই মানিব্যাগ বাইর করলি কোন কামে?
ভুল হয়ে গেছে কিছু মনে করবেন না।
আমার ওস্তাদ ঐখানে খাড়াইয়া আছে ওস্তাদরে সালাম দে।
লোকটি আলমের দিকে তাকিয়ে সালামের মতো ভঙ্গি করল। মুখে বিড় বিড় করে কী যেন বলল।
মজিদ বলল, ওস্তাদ পিস্তলডা বাইর করেন। এই হালা ফকিরের পুলা পিস্তল দেখবার চায়।
রিকশায় বসে থাকা মেয়েটি এইবার ফুঁপিয়ে উঠল। রিকশাওয়ালা অসহায় ভাবে একবার মেয়েটির দিকে একবার মজিদের দিকে তাকাচ্ছে। দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখা গেল। লোকটি প্রবল আশা নিয়ে হেড লাইটের দিকে তাকাচ্ছে। গাড়ি কিন্তু আমল না। হুস করে বের হয়ে গেল। মজিদ বলল, রিকশার মইদ্যে ঐ মাইয়া কে?
আমার স্ত্রী।
বিহা করা ইসতিরি?
জ্বি।
লাইছেন আছে? বিহার লাইছেন আছে।
ভাই আমার সাথে তিন শ টাকা আছে এইটা নেন আর আমার স্ত্রীর একজোড়া। কানের দুল আছে খুলে দিচ্ছি। এইগুলি নিয়ে আমাদের যেতে দিন ভাই আমার এক আত্মীয়ের অসুখের খবর পেয়ে যাচ্ছি। নয়ত এত রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বের হতাম না।
হারামী তুই কচ কী? টাকা-পয়সা তোর কাছে চাইছি? কানের দুল চাইছি? ঐ হারামজাদা আমার একটা ইজ্জত নাই?
ভাই, কী চান বলেন?
তুই কানে ধর। কানে ধইরা মাফ চা।
জ্বি, কী বললেন?
কী কইলাম হুনস নাই—কানে ধর।
লোকটি কানে ধরল। রিকশায় বসে থাকা মেয়েটি ক্রমাগত ফুপাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ক্ষীণ স্বরে বলল, শব্দ কইরেন না আম্মা, আল্লাহর নাম নেন।
হারামজাদা কানে ধরছস?
জ্বি।
তুই কী করস?
রেলওয়েতে চাকরি করি।
রেলওয়ের মইদ্যে সব চোরের আড্ডা। তুইও হালা চোর। হুনস কী কইলাম?
জ্বি।
আর চুরি করিস না।
জ্বি আচ্ছা।
যা অখন ভাগ।
লোকটি মজিদের কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এখনো কান ধরে আছে।
কথা কানে ঢুকে না? কী কইলাম তোরে? বউ লইয়া ভাগ। অমন ছুন্দর বৌ লইয়া বাইর হবি না।
জ্বি আচ্ছা।
আমার দুই ওস্তাদরে সেলাম দে। সেলাম দিয়া ভাগ।
লোকটি স্পষ্ট স্বরে দুবার বলল, স্লামালিকুম। তারপর রিকশায় উঠে বসল। রিকশায় উঠার সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটি তার গায়ে এলিয়ে পড়ে গেল। বুড়ো রিকশাওয়ালা ঝড়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে রিকশা নিয়ে উড়ে গেল।