ঘটনার অভাবনীয় পরিস্থিতি তিনজন দর্শককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। হঠাৎ কৰ্ণদেব বলে উঠল, শায়ন! তুমি কি উন্মাদ হয়েছ? বহু বৎসর আগে মল্লভূমিতে তোমার মাতুলপুত্র ন্যায়সঙ্গত দ্বৈরথ-রণে নিহত হয়েছে- সেইজন্য তুমি বিশ্বস্ত এক সহচরের অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করতে চাও? না, না, এমন কাজ আমি তোমায় করতে দেব না।
কর্ণদেব সামনে এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই একলাফে পিছিয়ে গিয়ে শায়ন হিংস্রকণ্ঠে গর্জে উঠল, কর্ণদেব! আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হাত দিও না। সাবধান!
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, শায়ন! তুমি কাকে সাবধান করছ? বল্লভ তোমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু আমি করব না।
জ্বলন্ত চক্ষে তার দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, কর্ণদেব! তোমার স্পর্ধা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মনে রেখো আমার ধৈর্য অসীম নয়।
তরবারির মুষ্টিতে হাত রেখে কর্ণদেব তপ্তস্বরে বলল, আমিও ধৈর্যের শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছি।
অকস্মাৎ কর্ণদেবের দক্ষিণ বাহু দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে ধরে পরন্তপ বলে উঠল, কর্ণদেব! এটা শায়নের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার হস্তক্ষেপ এখানে অবাঞ্ছনীয়।
গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমারও তাই মনে হয়। হয়তো বলপূর্বক শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু
সিংহের মতো গর্জন করে শায়ন বলল, তোমরা সমবেতভাবে চেষ্টা করলে আমায় বধ করতে পারবে, কিন্তু বলপূর্বক আমাকে নিরস্ত্র করতে পারবে না।
শায়নের কথায় কান না দিয়ে শশক বলল, শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু অন্ধ আক্রোশের নিবৃত্তি ঘটবে না– অদূর ভবিষ্যতে আবার এই ঘটনার পুরনাবৃত্তি অনিবার্য। সুতরাং দ্বন্দ্বযুদ্ধেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
বিমর্ষভাবে মস্তক সঞ্চালিত করে বল্লভ বলল, আমি অস্ত্রগ্রহণ করব না। শায়ন ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেছে, এখন সে উন্মাদ-তুল্য। সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হলে সে তার ভুল বুঝতে পারবে।
আর্যযোদ্ধা যুদ্ধে ভীত। কাপুরুষকে হত্যা করে না, কঠোর স্বরে শায়ন বলল, কিন্তু বল্লভ! তোমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
চকিতে বিদ্যুৎশিখার মতো শায়নের তরবারি বল্লভের মুখের কাছ থেকে ফিরে এল। সকলে সচমকে দেখল বল্লভের দক্ষিণ কর্ণ মুখের উপর থেকে বিলুপ্ত ক্ষতমুখ থেকে ছুটছে তপ্ত রক্তস্রোত।
কয়েকমুহূর্ত নিশ্চল হয়ে বসে রইল বল্লভ, একবার ক্ষতস্থানে হাত দিল, তারপর চোখের সামনে রক্তাক্ত হাতটি ধরে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নির্বোধের মতো শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল ঘটনাটা যেন এখনো তার বোধগম্য হয়নি, নিজের চোখকেও যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না…।
ধীরে অতি ধীরে, তার মুখের উপর ফুটল যন্ত্রণার চিহ্ন, তারপরই ক্রোধের আবির্ভাবে মুছে গেল যন্ত্রণার চিহ্ন মুখের উপর থেকে, দারুণ আক্রোশে জ্বলে উঠল দুই চক্ষু, দণ্ডায়মান শায়নের মুখের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভীষণবণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আহত মল্ল…
সেই ভয়ংকর অমানুষিক ধ্বনি অসিযোদ্ধাকে বিহ্বল করে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে উপবিষ্ট অবস্থা থেকেই বল্লভের বিশাল দেহ জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে গেল শায়নের দিকে! অসিযোদ্ধায় অভ্যস্ত স্নায়ু যন্ত্রচার্লিতের মতো কাজ করল, তীক্ষ্ণ তরবারি দংশন করল বল্লভের মস্তকে পরক্ষণেই পেশীস্ফীত দুই বিশাল বাহুর মরণবাঁধনে বন্দি হল শায়নের মস্তক, স্কন্ধ ও গ্রীবাদেশ!
মট করে একটা শব্দ; শায়নের মাথা হেলে পড়ল, বল্লভের বাহুর বাঁধন সরে গেল, সশব্দে গুহাতলে লুটিয়ে পড়ল শায়নের দেহ!
মাথার উপর বিদ্ধ তরবারিকে টেনে আনার চেষ্টা করল বল্লভ। পারল না; শাণিত অস্ত্র ব্রহ্মতালু ভেদ করে বসে গেছে। বল্লভের দুই হাত শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল, তারপর মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল। গুহাতলে মাটি ও পাথরের উপর ছুটল রক্তের স্রোত।
স্তম্ভিত দর্শকদের মধ্যে প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল শশক। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে মৃতদেহ দুটিকে পরীক্ষা করে সে মন্তব্য করল, সব শেষ। বল্লভের মস্তক অসির আঘাতে বিদীর্ণ, শায়নের ঘাড় ভেঙে গেছে মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে। ইহজীবনে ওরা আর কলহ করবে না।
বিস্ফারিত নেত্রে মৃতদেহ দুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল কর্ণদেব। অভাবিত এই ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি তার রসনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
দুই হাত কোমরে রেখে কঠোর হাস্য করে পরন্তপ বলল, চারটি জীবন্ত সংখ্যার মধ্যে দুটি সংখ্যা অবলুপ্ত হল মৃত্যুর করাল গ্রাসে। অপর দুটি সংখ্যার মধ্যে একটির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন এবং অপরটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
পরন্তপের দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব স্খলিতস্বরে বলল, পরন্তপ! আমাদের দুটি বন্ধু শোচনীয়ভবে মৃত্যুবরণ করেছে। এখন কি তোমার পরিহাসের সময়?
পরন্তপ গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদৌ পরিহাস করছি না।
প্রথম দুটি সংখ্যা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য বুঝলাম, কর্ণদেব বলল, কিন্তু কে বিপন্ন আর কার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সে কথা বুঝতে পারছি না।
আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, পরন্তপর বলল, যদি কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আমাদের সুযোগ্য বন্ধু শশকের সাহায্য চাইলেই সে তোমায় সহজভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।
পরন্তপ! শশকের কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কথা আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু এসব হেঁয়ালি ছেড়ে মৃত বন্ধু দুটির সৎকার কার্যে মনোনিবেশ করা উচিত অবিলম্বে।