বল্লভ এগিয়ে এসে নির্দিষ্ট স্থানে কয়েকবার হস্তচালনা করে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, পাথরের জোড়ে আমার আঙুল পড়েছে। এইখানেই আছে গুপ্তধন।
সকলে তাকিয়ে দেখল গুহাগাত্রে দুই হাত দিয়ে বল্লভ কিছু যেন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, .. একটু পরেই গুহার দেয়ালে ফাঁক দেখা দিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল শব্দে গুহার ভিতর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে একটা মস্ত পাথর সরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে একটা গহুর আত্মপ্রকাশ করল!
তৎক্ষণাৎ মহা উল্লাসে চিৎকার করে ছুটে গেল শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ তাদের লুব্ধ দৃষ্টির সম্মুখে দেখা দিয়েছে তিনটি বিশাল সিন্দুক!
কর্ণদেব এক লাফে ছুটে গিয়ে একটি সিন্দুকের ডালা টেনে খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঝকমক করে উঠল রাশি রাশি মণি-মুক্তা, অজস্র স্বর্ণমুদ্রা ও অলঙ্কার।
অন্য সিন্দুক দুটির ডালা খুলে দেখা গেল সেই দুটির মধ্যেও রয়েছে প্রভূত ধনসম্পদ!…
অকস্মাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো হো শব্দে হেসে উঠল কর্ণদেব। পরক্ষণেই সেই হাসি যেন রোগজীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রচণ্ড অট্টরোলে গুহার ভিতর প্রতিধ্বনি তুলে হেসে উঠল শায়ন, তারপরই সেই হাসির শব্দকে ডুবিয়ে জাগল বল্লভের প্রচণ্ড অট্টহাস্য।
হোহোহো! হা-হা-হা!অট্টহাস্যের তরঙ্গ ফেটে পড়তে লাগল গুহা-গহ্বরের মধ্যে। ধীরস্থির গম্ভীর বল্লভও সঙ্গীদের সঙ্গে অট্টহাসির পাল্লা দিতে লাগল মহা-উৎসাহে!…
পরন্তপ গম্ভীর মুখে তাকাল শশকের দিকে। শশকের মুখেও হাসি নেই। একবার পরন্তপের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করেই সে মুখ ঘুরিয়ে গুহার বাইরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল।
অট্টহাসির বেগ যখন কমে এসেছে, স্নায়ুর প্রবল উত্তেজনা শান্ত হওয়ায় সকলেই যখন অল্প-বিস্তর প্রকৃতিস্থ, সেই সময় হঠাৎ ধ্বনিত হল পরন্তপের গভীর কণ্ঠস্বর, শশক! গুহার পশ্চিম দেয়ালে কোন জায়গায় গুপ্তধন আছে সেকথা তুমি জানলে কি করে?
খুব সহজেই, শশক বলল, তোমার হয়তো মনে নেই মৃত্যুর আগে গুপ্তধনের সন্ধান বলতে বলতেই হঠাৎ শল্যের বাক্রোধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার প-প-পশ বলেই সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন ব্যাপারটাকে গুরত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম তোমাকে নাম ধরে সম্বোধন করার চেষ্টা করছিল সে। পরে বুঝলাম তা নয়।
-তা নয়! তবে? তবে কি বলতে চেয়েছিল শল্য?
-পশ্চিম দিকে গুপ্তধন লুকানো আছে এইকথাই সে বলতে চেয়েছিল। এখন বুঝলাম, পরন্তপ নয় পশ্চিম কথাটাই উচ্চারণ করতে গিয়ে মৃত্যুর স্পর্শে তার বাকরোধ হওয়ার উপক্রম করেছিল। তাই কথার খেই হারিয়ে সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল।
কিন্তু গুহার পশ্চিম দিকের দেওয়ালেও অন্তত চার পাঁচটি শ অক্ষর আছে। পাথরের জোড় এমন কৌশলে দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল যে, ফাটলের চিহ্ন চোখে পড়ে নি। তুমি কোনো চেষ্টা না করে দেয়ালে হাত না দিয়ে একবারেই গুপ্তস্থান আবিষ্কার করেছ। এটা কি করে সম্ভব হল?
–পরন্তপ! মস্তিষ্ককে চালনা করতে জানি বলেই এটা সম্ভব হল। শল্য চারদিকের দেয়াল শ অক্ষরের চিহ্নত করেছিল, তার কারণ আছে। দৈবক্রমে কোনো পথিক যদি এখানে এসে এক জায়গায় একটি মাত্র অক্ষর খোদিত দেখতে পায় এবং কৌতূহল বশে সেইস্থানে নাড়াচাড়া করতে থাকে– তাহলেই সর্বনাশ! গুপ্তধন আবিষ্কৃত হবে তৎক্ষণাৎ! সেইজন্যই চারদিকে শ অক্ষরের ছড়াছড়ি। পশ্চিম দেয়ালে অক্ষরের সংখ্যা কম। তার মধ্যেও যে অক্ষরটি সবচেয়ে অস্পষ্ট, সেইটির দিকে সহজে দর্শকের চোখ পড়বে না। ওই কথা বুঝেই উক্ত অক্ষরকে সবচেয়ে অস্পষ্ট করে খোদাই করেছিল শল্য। আশা করি এখন বুঝতে পারছ কেমন করে আমি গুপ্তধন অতি সহজেই আবিষ্কার করেছি।
সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শশকের বক্তৃতা শুনছিল। এবার বল্লভ মুগ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, তুমি অসাধারণ মানুষ। শশক! তোমার দেহ এবং মস্তিষ্ক সমান শক্তিশালী।
কর্ণদেব বলল, বল্লভের কথা সত্য। পেশীর শক্তি ও মস্তিষ্কের শক্তির এমন আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায় না। শশক! মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচরবিভাগে কাজ করলে তুমি মন্ত্রী মহাসত্ত্বের প্রিয়পাত্র হয়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করতে পারবে।
শশক চমকে উঠল, তারপর মৃদুহেসে বলল, কর্ণদেব! তোমার উপদেশ আমি মনে রাখার চেষ্টা করব।
শায়ন বলল, এই বিপুল সম্পদ বহন করে শ্রাবস্তীর রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব নয়। অবশ্য কিছু রত্ন ও কয়েক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আমরা পরিধেয় বস্ত্রে বন্ধন করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই বিপুল সম্পদের তুলনায় সে আর কতটুকু? আমরা কি তবে একই সঙ্গে নগরীতে গিয়ে অশ্ব সংগ্রহ করে আবার দলবদ্ধ হয়ে ফিরে আসব অবশিষ্ট সম্পদের জন্য? এ ছাড়া আর কি ব্যবস্থা হতে পারে? আমরা প্রত্যেকেই এখন স্থানটি জেনে ফেলেছি। আমাদের পক্ষে যে-কোনো ব্যক্তি গোপনে এসে সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে পলায়ন করতে পারে। এতএব, সম্পদ যথাযথ ভাবে বণ্টন না হওয়ার আগে আমাদের পরস্পরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অনুচিত। অবশ্য আমি কারও সততায় সন্দেহ প্রকাশ করছি না, কিন্তু তবু সতর্ক থাকা উচিত। কি বলো পরন্তপ?
পরন্তপ বলল, এই সম্পদের অর্ধাংশ শশকের প্রাপ্য। শস্যের অনুরোধে তার প্রাপ্য অংশ শশককে দিতে আমি প্রতিশ্রুত। সমস্ত ধনসম্পদের হিসাব নিয়ে চুল চেরা ভাগ করার সময় নেই। তাই মোটামুটিভাবে বণ্টনের যে ব্যবস্থা ভেবেছি, তা তোমাদের বলছি। তিনটি সিন্দুকের ভিতর একটি সিন্দুক শশক পাবে। অপর দুটি সিন্ধুকের ধনরত্ন আমাদের চারজনের মধ্যে ভাগ হবে। আমার এবং কর্ণদেবের অংশ তোমদের সম্মতিক্রমে এখনই গ্রহণ করছি।