শায়ন এতক্ষণ স্থির হয়ে বসে নেকড়ের চিৎকার শুনছিল। সে বলল, নেকড়েরা বিভিন্ন ধরনের শব্দে বিভিন্ন প্রকার মনোভাব প্রকাশ করে। এখন ওদের চিৎকারের ধরন শুনে বুঝতে পারছি শিকারের সন্ধান পেয়ে ওরা উল্লাস প্রকাশ করছে।
তা হবে, পরন্তপ বলল, কোন বন্যপশুকে লক্ষ্য করে ওরা যদি উল্লাস জানায় আমার আপত্তি নেই। আমাদের উপর ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হলেই মঙ্গল। মাংসাহারী শ্বাপদের ভক্ষ্য হয়ে অনেক জীবই জন্মগ্রহণ করেছে, সেইরকম কোনো
হঠাৎ থেমে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে পরন্তপ বলে উঠল, আমাদের চারটি অশ্ব পাহাড়ের নীচে রজ্জবদ্ধ আছে। তাদের লক্ষ্য করে ওরা চিৎকার করছে না তো?
সচমকে পিঠ থেকে ধনুর্বাণ টেনে নিয়ে শায়ন বলল, তাই তো! খুব সম্ভব তোমার আশঙ্কা
একলাফে গুহার বাইরে এসে দ্রুতবেগে গিরিপথ বেয়ে নামতে লাগল শায়ন। বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল সবাই। গিরিপথের উপর থেকে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিয়ে পরন্তপও পাহাড় থেকে নামতে লাগল দ্রুতবেগে।…
আশঙ্কা সত্য। রজ্জবদ্ধ অশ্বদের লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে হিংস্র উল্লাসে চিৎকার করছে নেকড়ে পাল।
পরন্তপ ও তার সঙ্গীরা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। প্রাণ বিপন্ন করে বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণ পথ বেয়ে তারা ক্ষিপ্রচরণে নীচে নামতে লাগল।…
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হতাশ কণ্ঠে পরন্তপ বলল, বৃথা চেষ্টা। আমরা কাছাকাছি যাওয়ার আগেই নেকড়ের দল ঘোড়াগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
একটি অশ্ব প্রাণপণ চেষ্টায় বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে ছুটে পালাল। অন্য তিনটি জানোয়ার দারুণ আতঙ্কে হ্রষাধ্বনি করতে লাগল বারংবার।
অধর দংশন করে কর্ণদেব ধনুর্বান তুলল। মুহূর্তে ছুটে গেল তির। একটি নেকড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নেকড়েরা ফিরেও তাকাল না। আবার ছুটল তির- একবার শায়নের ধনুক থেকে। আরও একটি নেকড়ে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। নেকড়েবাহিনীর ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখনই তীক্ষ্ণ শ্বাপদদন্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তিনটি অশ্বের দেহ।
শায়ন হঠাৎ ধনুর্বাণ তুলে অশ্বতিনটির দিকে লক্ষ্যস্থির করল। পরন্তপ বিস্মিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, শায়ন! ও কি করছ?
পরক্ষণেই শায়নের ধনুক থেকে জ্যামুক্ত তির ছুটে গিয়ে একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে দিল! মুক্ত পশু প্রাণপণে ছুটে পলায়ন করতে লাগল। তীব্রতর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল।
ধনুকে তির লাগিয়ে আবার নিশানা স্থির করতে লাগল শায়ন। অকস্মাৎ তার কানের কাছে। বেজে উঠল ধনুকের টঙ্কার ধ্বনি- বিদ্যুঝলকের মতো একটি বাণ ছুটে গিয়ে আর একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু কেটে তাকে মুক্তি দিল!
চমকে উঠে সবিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শায়ন দেখল তুণীর থেকে আর একটি তির টেনে নিয়ে ধনুকে যোজনা করছে শশক।
আবার ধনুষ্টঙ্কার! শশকের নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় তীর শেষ অশটিকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিল। ভীষণ চিৎকারে চারদিকে কাঁপয়ে নেকড়ের পাল অশ্বটিকে অনুসরণ করল। কিন্তু বেগবান অশ্ব তখন প্রাণভয়ে ছুটছে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সারিবদ্ধ বৃক্ষ আর উদ্ভিদের অন্তরালে সে আত্মগোপন করল। তার পশ্চাদ্ধাবন করে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল নেকড়ের দল।…
শশকের দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, তুমি আশ্চর্য ধনুর্ধর! লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এমন তিরন্দাজ আগে কখনও দেখিনি।
শশক হেসে বলল, এতখানি বয়সেও তুমি কখনও দর্পণ ব্যবহার করোনি, জেনে বিস্মিত হলাম।
শায়ন লজ্জিতভাবে বলল, দর্পণ ব্যবহার করব না কেন?… গর্ব ছিল আমার তুল্য তিরন্দাজ এই রাজ্যে নেই। তুমি আমার সেই দর্প চূর্ণ করেছ।
পরন্তপ বলল, একথা সত্য। শায়নের ধনুর্বিদ্যার খ্যাতি আমার কানেও এসেছে। তাই আজ তার লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হলেও খুব বেশি বিস্মিত হইনি। তুমি আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছ। ধনুর্বিদ্যায় তোমার ক্ষমতা শায়নের চাইতে কম নয়।
এই ব্যক্তির নাম শায়ন? শশক শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তিরন্দাজ শায়নের অদ্ভুত ক্ষমতার কথা আমিও শুনেছি। শুধু ধনুর্বিদ্যায় নয়– অসিচালনাতেও শায়নের খ্যাতি শ্রাবস্তী রাজ্যে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। আজ এই আশ্চর্য পুরুষের সাক্ষাৎলাভ করে ধন্য হলাম।
কর্ণদেব বলল, অসিচালনায় শশকও কিছু কম নয়। শল্যকে উদ্ধার করার সময়ে যে দস্যু-দলপতিকে শশক অসির আঘাতে হত্যা করেছিল, তার মৃতদেহ আমি দেখেছি। মৃত দলপতির ব্রহ্মতালু থেকে চিবুকের উপরার্ধ পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আসুরিক শক্তির সঙ্গে অসামান্য দক্ষতার যোগাযোগ ঘটলেই ওইভাবে আঘাত করা সম্ভব।
শশক চমকে উঠে বলল, তোমরা আমাকে ওই সময়ে দেখেছ?
পরন্তপ বলল, হ্যাঁ। আমরা দুর্বৃত্তদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলাম; অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো আবির্ভূত হয়ে তুমি আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা পণ্ড করে দিয়েছ। তবে সব ভালো যার, শেষ ভালো তার– তোমার মতো নিপুণ যোদ্ধাকে দলভুক্ত করে আমাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে।
আমিও বীর্যবান পুরুষদের সাহচর্যে এসে নিজেকে ধন্য মনে করছি; কিন্তু পরন্তপ! একটা কাজ তোমার ভালো হয়নি, কর্ণদেবের দিকে দৃষ্টিপাত করে শশক বলল, এই বালককে দলভুক্ত করা অন্যায় হয়েছে।