এসব গোপন কথা প্রকাশ্যে বলা চলে না। কানে কানে বলছি। শোনো।
উত্তানপাদের কানের কাছে মুখ এনে কর্ণদেব কি যেন বলল। বল্লভ কথা শুনতে পেল না, কিন্তু দেখল উত্তানপাদের সর্বাঙ্গ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো শিহরিত হল!
সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, সেকি! কী ভয়ংকর!… না, না, না, আমি মণিমাণিক্য চাই না।
কর্ণদেবের অধরে জাগল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, আর ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা?
–না, না। আমি তিন সহস্র পেলেই খুশি।
তিন সহস্র নয়, কর্ণদেব তীব্রস্বরে বলল, তুমি সুদ পাবে না। আসল তিনশত নিয়ে তুমি বল্লভকে নিষ্কৃতি দেবে। নচেৎ–
-ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি তিনশত স্বর্ণমুদ্রার বেশি দাবি করব না।
–আচ্ছা। এখন শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো।
দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করল কুসীদজীবী উত্তানপাদ। বল্লভ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর বলল, ব্যাপারটা কি হল বলল তো কর্ণদেব?
-কুসীদজীবী উত্তানপাদের সুমতি হয়েছে।
–অকস্মাৎ উত্তানপাদের এমন সুবুদ্ধির উদ্রেক হল কেন? কর্ণদেব! তুমি চুপি চুপি ওর কানে কি মন্ত্র দিয়েছ?
-কিছু না। মন্দলোকের কি সুবুদ্ধি হয় না? বল্লভ! পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নেমে আসছে। আজ রাত্রে আমি আপনার গৃহে অতিথি হতে চাই। আপত্তি নেই তো?
বিজ্ঞজন বলেন, অজ্ঞাত কুলশীলকে গৃহে স্থান দিতে নেই, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি। চলো।
কিছুক্ষণ দুজনেই নিঃশব্দে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল কর্ণদেব, বল্লভ! সামান্য অর্থের জন্য ঘৃণ্য কুসীদজীবী আপনাকে অপমান করতে সাহস পায়? আপনি ইচ্ছা করলেই প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে পারেন।
প্রচুর অর্থ? না, প্রচুর অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা আমার নেই, কর্ণদেব।
-কেন নয়? আজই তো আপনি জয়দ্রথের পুরস্কারের অর্থে আপনার প্রাপ্য না নিয়েই স্থানত্যাগ করলেন। কিন্তু কেন? আপনার তো অর্থের প্রয়োজন আছে।
-ওই অর্থে যদি ঋণ শোধ করতে পারতাম তাহলে হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরস্কারের অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রা থেকে আমি কত পেতাম?… হয়তো তিনশত। তাতে আমার ঋণশোধ হত না। অবশ্য তুমি কোন মন্ত্রবলে নরপিশাচ উত্তানপাদকে বশীভূত করেছ জানি না, তবে সুদ ছেড়ে আসলের তিনশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে সে আমাকে অব্যাহতি দিত না কিছুতেই। তাছাড়া আমি নেকড়ে-বাহিনীর বিরোধিতা করেছিলাম একটি কিশোরকে, অর্থাৎ তোমাকে, অপঘাতে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য সেক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করলে দেশের মানুষ আমাকে লোভী মনে করত। বিশেষ করে আমার শিষ্যদের কাছে আমার ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হত। সেটা আমার পক্ষে অতিশয় বেদনাদায়ক।
-বল্লভ। আমি আপনার মতো একটি মানুষের সন্ধান করছিলাম।
বল্লভের চলার গতি মন্থর হল। সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসন্ন রাত্রির আভাস পরিস্ফুট। অন্ধকার ভেদ করে সঙ্গীর মুখ দেখার চেষ্টা করল বল্লভ, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, কর্ণদেব! তুমি প্রথমে জয়দ্রথের সন্ধান করছিলে এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছিলে। সে তোমার অপরিচিত, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তোমার এত আগ্রহ ছিল কেন? তারপর হঠাৎ তুমি জয়দ্রথ সম্পর্কে নিরুৎসুক হয়ে পড়লে। কারণ, তুমি অধিকতর বলশালী আর একটি মানুষকে অর্থাৎ আমাকে আবিষ্কার করলে। বুঝলাম, যে কারণেই হোক, তুমি অত্যন্ত বলশালী একটি মনুষ্যের সন্ধান করছিলে; বলো কর্ণদেব, আমার অনুমান যথার্থ কি না?
-যথার্থ বটে।
তারপর এখন দেখছি তোমার নিকট প্রচুর অর্থ রয়েছে। শুধু স্বর্ণমুদ্রা নয়, তোমার কাছে রয়েছে মহামূল্যবান বৈদূর্যমণি। তুমি শ্রেষ্ঠী বা সওদাগর নও। অথচ তুমি অবহেলাভরে বহন করছ রাজার ঐশ্বর্য! তোমার চালচলন রহস্যময়। এই নগরীতে তুমি নবাগত, তোমার ব্যবহারে তা প্রমাণিত হয়েছে। কেন, কোন উদ্দেশ্যে, তুমি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছ জানি না; তবে একটা কথা তোমায় জানিয়ে দিচ্ছি– যদি প্রয়োজন হয় তবে পথবাসী বা বনবাসী হতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো কারণেই আমি পাপের পথে অগ্রসর হব না।
–বল্লভ! পাপপুণ্য নিতান্তই আপেক্ষিক শব্দ।
–বাঃ! এই বয়সেই দার্শনিক সুলভ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হয়েছে দেখছি! অস্ত্রত্যাগ করে শাস্ত্রচর্চা করলে তুমি বোধহয় লাভবান হতে পারতে- বুঝেছ কর্ণদেব?
– শাস্ত্র ও শস্ত্র দুটি বস্তুর সঙ্গেই আমার কিছু পরিচয় ঘটেছে। একসময় পুস্তক হাতে বিদ্যাভ্যাস ছিল আমার একমাত্র কর্তব্য। পরে বুঝলাম শস্ত্রের ক্ষমতা বেশি, তাই–
তাই মসি ছেড়ে অসি ধরেছে? কিন্তু এই মুহূর্তে অসিতে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ঘটে নি।
কর্ণদেব লজ্জিত হয়ে বলল, ক্ষমা করবেন। ক্ষণিকের উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। জেনে রাখবেন অসি নয়, মসিই ছিল এক সময়ে আমার প্রিয় বস্তু। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান।
অন্ধকারে বল্লভের হাসির শব্দ শোনা গেল, তুমি দেখছি পরশুরামের নতুন সংস্করণ! কিন্তু পরশুরাম কুঠার ধরেছিলেন ধরণীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করার জন্য তুমি ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে অসি ধারণ করেছ কেন?
কর্ণদেব বলল, আপনার প্রশ্নের উত্তরে অনেক–কী হল?
হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কর্ণদেবের গতিরোধ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, তারপর অন্ধকারে তীব্ৰদৃষ্টি মেলে কি যেন দেখতে লাগল।