অঞ্জন আর বিরক্তি গোপন করার চেষ্টা করল না, উত্তপ্ত স্বরে বলে উঠল, আপনি যখন ব্রেজিলের আমদানিকরা বিপদের কথা বলছেন, তখন আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। অন্য কোনো বিপদের কথা আমি জানি না।
আমি জানি।
–বেশ, বলুন। আমি শুনছি।
–বলবার কিছু নেই, শুনবার কিছু নেই, শুধু দেখার আছে।
বিপদের স্বরূপ দেখার জন্য আপনার সঙ্গে আমি কোথাও যেতে রাজি নয়।
কোথাও যেতে হবে না, এই ঘরে বসেই আপনি সব দেখতে পারেন, সব জানতে পারবেন। জোসেফ তার বাঁ হাতটা টেবিলের উপর মেলে দিল, উপুড় করে আঙুলগুলো প্রসারিত করল অঞ্জনের চোখের সামনে প্রাণঘাতী বিপদের চেহারাটা দেখে নিন।
অসতর্ক পথিক পায়ের কাছে হঠাৎ সাপ দেখলে যে-ভাবে চমকে ওঠে, ঠিক সেইভাবে চমকে উঠল অঞ্জন, কে তুমি?
জোসেফ হাসল, উত্তেজিত হবেন না। লোকে শুনছে।
কথাটা সত্যি। অঞ্জনের উত্তেজিত তীব্ৰস্বর কয়েকজন খরিদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুজন বেয়ারাও থমকে দাঁড়িয়েছে, তাদেরও চোখ পড়েছে অঞ্জন আর জোসেফের দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে কণ্ঠস্বর সংযত করে নিল অঞ্জন, ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনি কে? দৈবজ্ঞ মহাপুরুষ? না, শয়তানের মন্ত্রশিষ্য? কে আপনি?
টেবিলের পাশেই জানালা। সেই জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল জোসেফ, মিঃ চৌধুরী, কী দেখছেন ওখানে?
-~-কী দেখব? অন্ধকার আকাশ, আবার কী?
শুধু আকাশ? শুধু অন্ধকার? আলোর ফুলকিগুলো দেখতে পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি। অন্ধকার আকাশে জ্বলছে অসংখ্য তারা। নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। ওখানে দেখার কি আছে?
নির্বোধ মানুষ শুধু তারা দেখবে, জোসেফ হাসল, পরক্ষণেই মুছে গেল হাসির রেখা, তার ওষ্ঠাধর থেকে, ঝকঝকে কালো চোখ থেকে বিদায় নিল উজ্জ্বল দীপ্তি; ম্লান স্তিমিত দৃষ্টি আকাশের দিকে সঞ্চালিত করল জোসেফ, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, ওরা তারা নয়।
তারা নয়? তাহলে ওগুলো কি?
ওরা তারা নয়। অসংখ্য নক্ষত্রের অগ্নিময় চক্ষু মেলে মায়াবিনী রাত্রি তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে, পাহারা দিচ্ছে তার গোপন রহস্যের রত্নভাণ্ডার। মানুষের পার্থিব চক্ষু রাত্রির অন্ধকার অঞ্চল ভেদ করে সেই অমূল্য রত্নভাণ্ডারের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারে না। কিন্তু আমি পারি।
–আপনি পারেন? কেমন করে? আপনি কি পৃথিবীর মানুষ নন?
–হ্যাঁ, আমিও পৃথিবীর মানুষ। তবে আমার কথা স্বতন্ত্র। অগণিত নক্ষত্রের আগুন-জ্বালা চোখে মায়াবিনী রাত্রি যা দেখতে পায়, মাত্র দুটি চোখ দিয়েই আমিও তাই দেখতে পাই। কারণ?- আমি যে রাত্রির সন্তান!
স্তম্ভিত অঞ্জন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল উপবিষ্ট মানুষটির দিকে!… জোসেফের মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন নিষ্প্রাণ… দুই চোখের উদাস দৃষ্টি হারিয়ে গেছে অন্তহীন আকাশের অন্ধকারে…
আচম্বিতে উচ্চকণ্ঠের বচসা ও কোলাহলে ফিরে এল আচ্ছন্ন চেতনা, সচমকে মুখ তুলে অঞ্জন দেখল দোকানের কাউন্টারে ভিড় জমে উঠেছে একটি বিদেশি মানুষকে ঘিরে। লোকটির চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার অধিবাসী। উক্ত বিদেশি ও দোকানের মালিকের ক্রুদ্ধকণ্ঠের বাদানুবাদ ভেদ করে কলহের উৎস আবিষ্কার করা সম্ভব নয় তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে। হঠাৎ মালিকের ইঙ্গিতে একজন বলিষ্ঠ দর্শন বেয়ারা লোকটির ঘাড়ে হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল এবং এক ধাক্কাতেই পৌঁছে দিল দরজার কাছে
তার পরই অভাবিত কাণ্ড!
রবারের বল দেয়ালে ছুড়লে যে ভাবে ঠিকরে ফিরে আসে, ঠিক সেইভাবেই ফিরে এল লোকটি তার আক্রমণকারীর দিকে! পরক্ষণেই চোয়ালের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড ঘুষি এবং আক্রমণকারী বেয়ারা হল ভূমিশয্যায় লম্বমান! হৈ হৈ! গণ্ডগোল! ধুন্ধুমার!..
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, অঞ্জন ক্রুদ্ধস্বরে বলল, কিন্তু অতগুলো লোক মিলে একটা লোককে মারছে এই দৃশ্য অসহ্য।
সে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই বাধা পড়ল। তাকে ঠেলে সরিয়ে সামনে এগিয়ে এল জোসেফ, না, মিঃ চৌধুরী, আপনি ঝামেলা করবেন না। ব্যাপারটা আমি সামলাতে পারব।
লম্বা লম্বা পা ফেলে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল জোসেফ- সেখান তখন বিদেশি মানুষটি লড়াই করছে সপ্তরথী-বেষ্টিত অভিমন্যুর মতো!…
৪. বার্তা
কড়া ধরে একবার নাড়াতেই দরজাটা সশব্দে খুলে গেল তুই কেমন মেয়ে রে? ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন শ্রীময়ী, এই সেদিন এক কাণ্ড বাধিয়েছিলি, যদি কাজল না এসে পড়ত, তাহলে
তাহলে কি হত তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আগে ঘরে ঢুকতে দাও, বলে চট করে মায়ের পাশ কাটিয়ে সীমা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরলেন শ্রীময়ী, কিন্তু কিছু বলার আগেই মাকে জড়িয়ে ধরল সীমা, লক্ষ্মীটি মা, বকাবকি কোরো না। আগে আমার কথা শোনো।
কী শুনব? শ্রীময়ী শক্ত গলায় বললেন, তুই বলে গেছিস সাড়ে নয়টার মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবি আর এখন প্রায় এগারোটা বাজে! আমার চিন্তা হয় না? এত রাতে আবার যদি একটা দুর্ঘটনা ঘটত? তোর সাহসকেও বলিহারি!
একগাল হেসে সীমা বলল, দুর্ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না যে। ছাত্রীর বাবা আমাকে তার মোটরে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
শ্রীময়ীর মুখের কঠিন রেখাগুলো একটু নরম হল, তুই বলে গেলি সাড়ে নয়টার মধ্যেই সার্কাস দেখে ফিরে আসবি। তোর ছাত্রীর সঙ্গে তার মা বাবাও যাবেন শুনে আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু রাত যখন এগারোটা, তখনও তোর পাত্তা নেই। কাজেই দুশ্চিন্তা