ভালোবাসার অধিকার! –সীমা এত বেশি অবাক হয়ে গেল যে, কিছুক্ষণ কথাই কইতে পারল না।
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে সীমা তিক্তস্বরে বলল, মা, তোমার আজকের কথাবার্তা আর ব্যবহারে আমি অবাক হয়ে গেছি। অঞ্জনের অর্থ যে কাজল সেটা অনেকেই জানে, কিন্তু হঠাৎ ওঁকে কাজল বলে ডেকে রসিকতা করতে গেলে কেন? না কি, তুমি যে একজন বিদুষী মহিলা সেটাই ওঁকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলে? সদ্য-পরিচিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এই ধরনের রসিকতা ছ্যাবলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ছি! ছি! তোমার কি হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল?
শ্রীময়ী মেয়ের কথার জবাব দিলেন না, কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে ক্রোধের ছায়া পড়ল।
মায়ের নীরব ক্রোধকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সীমা আবার বলে উঠল, তুমি যে ভিতরে ভিতরে জ্যোতিষ-চর্চা করছ, তা তো জানতাম না। ভদ্রলোক আর আসবেন না তুমি জানলে কি করে?
সীমা। –শ্রীময়ী কঠিন স্বরে বললেন, লেখাপড়া তোমার চাইতে আমি কিছু কম করিনি। ডিগ্রিটাই শিক্ষার মাপকাঠি নয়; তবু সেই ডিগ্রির হিসাবেও আমার ওজন তোমার চাইতে বেশি। তুমি বাংলায় বি. এ. পাশ করে মিঃ মুখার্জির সুপারিশের জোরে চাকরিটা পেয়ে গেছ। আমি ইংলিশে এম. এ. হয়েও বাড়িতে বসে আছি– কারণ, তোমার বাবা কোনোদিনই আমার চাকরি করাটা পছন্দ করতেন না। তবে লোকের কাছে, বিশেষ করে সদ্যপরিচিত ভদ্রলোকের কাছে বিদ্যা জাহির করার মতো তরলচিত্তের মেয়ে আমি নই। তোমরা শিক্ষার গর্ব করে, কিন্তু গুরুজনের সম্মান রেখে কথা বলতে পর্যন্ত জানো না। এই তোমাদের শিক্ষা?
সীমা দেখল মায়ের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে, সে সভয়ে বলে উঠল, মা।
ভয় পাওয়ার কারণ ছিল শ্রীময়ী সহজে রাগ করেন না, কিন্তু একবার খেপে গেলে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। একেবারে নির্জলা উপবাস ঘোষণা করে বসে থাকেন। তখন সীমাকেই ঘাট মেনে, হাতে-পায়ে ধরে মাকে খাওয়াতে হয়। আবার সেই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কায় সীমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রীময়ী উদ্যত ক্রোধ দমন করলেন, সংযত স্বরে বললেন, তোমার জন্মের আগে অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেছে, আর সেই সময় অনেক ঘটনাও ঘটে গেছে। সেসব কথা এখনই তোমাকে জানানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমার ব্যবহারে আজ যদি কোনো অসঙ্গতি দেখে থাকো, তাহলে তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। জানবে। এখন মাকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে আমাকে কৃতার্থ করো।
সাধারণত খাওয়ার ব্যবস্থা করেন মা, শরীর খারাপ হলে ভার পড়ে মেয়ের উপর। সীমা বুঝল, আজ শরীর নয়, মেজাজ বিগড়েছে, তাই এই নির্দেশ। সে নিঃশব্দে উঠে গেল খাওয়ার ব্যবস্থা করতে…
একটু পরে মাকে ডাকতে এসে সীমা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবার ফটোর তলায় এসে দাঁড়িয়েছেন মা, স্বামীর প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছেন তিনি। কয়েকটি কথা সীমার শ্রুতি-গোচর হল, সব যখন শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হল, তখনই কি আমায় পরীক্ষা করার জন্য নিয়তির এই খেলা! বিশ বছর পার হল না মাত্র কয়েকদিনের জন্য! আর দিন সাতেক পরেই সীমার জন্মদিন। তবে আমি প্রতিজ্ঞা পালন করব… নিশ্চয়ই তোমার কথা রাখব…
পরের কথাগুলো ভালো করে বুঝতে পারল না সীমা। নিঃশব্দে সে আবার ফিরে গেল রান্নাঘরে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই মুহূর্তে নিতান্তই স্কুল আর অপ্রয়োজনীয় মনে হল। চির-পরিচিতা মা যেন হঠাৎ রহস্যময়ী হয়ে উঠেছেন আজ!
৩. ‘আমি রাত্রির সন্তান’
-আরও দুটুকরো বরফ ফেলে দাও।
-আরে ব্বাস!
বেয়ারার অস্ফুট উক্তি অঞ্জনের কানে এল। সে হাসি চেপে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
খরিদ্দারের আদেশ পালন করার জন্য বেয়ারা পা বাড়াল, সঙ্গেসঙ্গে অঞ্জনের পিছন থেকে একটা অপরিচিত কণ্ঠ সকৌতুকে বলে উঠল, আরে ভাই, চমকে যাচ্ছ কেন? অবশ্য চমকে যাওয়াই স্বাভাবিক, এমন দারুণ ঠান্ডা কলকাতা শহরে কয়েক বছরের মধ্যে পড়েনি। তবে উনি বহুদিন ইউরোপের নানা জায়গায় ঘুরেছেন, তাই এই ঠান্ডা ওঁর গায়েই লাগছে না। ওঁর গেলাসের জিনিস একটু বেশি ঠান্ডা হওয়া দরকার।
চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল অঞ্জন, দেখল তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ। লোকটির দেহে ইউরোপীয় পরিচ্ছদ– গায়ের ফর্সা রং রোদে পুড়ে তামাটে, রোমশ জোড়া জ্বর নিচে একজোড়া ঝকঝকে কালো চোখ, সরু গোঁফ আর মাথায় লালচে-বাদামি চুলের মাঝখানে সিৗথ দেখে বাঙালি তো দুরের কথা ভারতীয় বলেই মনে হয় না। চেহারা দেখে যাই মনে হোক, তার কথা শুনে তাকে খাঁটি বঙ্গসন্তান ছাড়া আর কিছু ভাবা অসম্ভব।
সীমা আর শ্রীময়ীর কাছে বিদায় নিয়ে অঞ্জন চলে এসেছিল চৌরঙ্গী এলাকায়। অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছিল সে, মাথার ভিতরটা দপ দপ করছিল। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে বেয়ারাকে ঠান্ডা পানীয় পরিবেশনের ফরমাশ করল সে। বেয়ারা হুকুম তামিল করেছিল। কিন্তু ঠান্ডা পানীয়কে আরও-ঠান্ডা করার জন্য বরফ দেয়নি। এই নিদারুণ ঠান্ডায় কোনো খরিদ্দার যে বরফ চাইতে পারে, তা সে ভাবতেই পারেনি। তবু দুটুকরো বরফ দেওয়ার পরেও খরিদ্দারটি যখন আরও বরফ চাইল, তখনই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট স্বগতোক্তি, আরে ব্বাস! আর তখনই হল অপরিচিত আগন্তুকের আবির্ভাব। পরবর্তী ঘটনা আগেই বলা হয়েছে, পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।