আপনার মা সার্থকনামা মহিলা। বয়েস তার সৌন্দর্যে এখনও হাত ছোঁয়াতে পারেনি, অঞ্জন বলল, তারপর সীমার দিকে তাকিয়ে হাসল, আপনার মায়ের থেকেই এমন চেহারা পেয়েছেন আপনি।
কী যে বলেন, সীমা হাসল, মায়ের সঙ্গে আমার তুলনাই চলে না।
খুব হয়েছে, কপট ক্রোধে মেয়েকে ভর্ৎসনা করলে শ্রীময়ী, আর মায়ের রূপবর্ণনা করতে হবে না।
তারপর হঠাৎ অঞ্জনের দিকে ফিরে বললেন, কথায় কথায় রাত হয়ে গেল। আর তোমায় আটকাব না। কিন্তু কাজল, তোমার বাবার নামটা তো বললে না?
বাবার নাম, বাবার নাম কিন্তু আমার নাম তো কাজল নয়, বিস্মিত কণ্ঠে অঞ্জন বলল, আপনি আমায় কাজল বলে ডাকলেন কেন?
শুদ্ধ ভাষায় যাকে অঞ্জন বলে, চলতি ভাষায় তাকেই তো কাজল বলে, তাই নয় কি? শ্রীময়ী হাসলেন, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল, আসল কথাটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বাবার নামটা বলতে কি তোমার আপত্তি আছে?
না, না, আপত্তি থাকবে কেন? শ্রীময়ীর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল অঞ্জন, মুখ নিচু করে বলল, বাবার নাম বিশ্বনাথ ঘোষ।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। সীমার মনে হল তার অলক্ষ্যে কি যেন একটা ব্যাপার ঘটে গেল।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল অঞ্জন, অনেক দেরি হয়ে গেল। অনুমতি করুন, আজ আমি যাই।
শ্রীময়ী কিছু বলার আগেই সীমা বলে উঠল, যাই বলতে হয় না, বলুন আসি। কিন্তু আবার কবে আসবেন বলে যান।
হ্যাঁ, তা আসব, সুযোগ পেলেই আসব, স্খলিত স্বরে অঞ্জন বলল, তবে কবে আসতে পারব বলতে পারি না।
ছুটির দিনে আসলে ভালো হয়। মানে শনি, রবিবার। অন্যান্য দিন স্কুল থাকে, বিকেলে ছাত্রী পড়িয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। রাতে এলে তত বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। আমি আসছে রবিবার সকালে আপনাকে আশা করব।
অঞ্জন উত্তর দেওয়ার আগেই শ্রীময়ী বলে উঠলেন, তোমার যখন খুশি চলে এস। সীমা না থাকলেও আমাকে সারাদিনই তুমি বাড়িতে পাবে। আসবে তো কাজল?
আসব, অঞ্জন হেসে ফেলল, কিন্তু আপনি কি আমায় কাজল বলেই ডাকবেন না কি?
শ্রীময়ীও হাসলেন, যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
অঞ্জন এইবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রীময়ীর দিকে তাকাল।
চোখে চোখ পড়ল। শ্রীময়ী চোখ ফিরিয়ে নিলেন না।
অস্ফুট স্বরে কি যেন বলল অঞ্জন, তারপরই হঠাৎ নিচু হয়ে শ্রীময়ীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে গেল।
এমন আকস্মিক প্রস্থান শ্রীময়ী ও সীমার কল্পনার বাইরে, দুজনেই কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। বিস্ময়ের ধাক্কাটা মেয়ের আগে মা-ই প্রথম সামলে নিলেন, দরজার সামনে দ্রুতপদে এগিয়ে এসে বাইরে দৃষ্টিপাত করলেন শ্রীময়ী। দূরে মোড়ের মাথায় বড়ো রাস্তার দিকে অঞ্জনের দেহটা অন্তর্ধান করার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর দৃষ্টিগোচর হল..
হঠাৎ মেয়ের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলেন শ্রীময়ী, মা, ওখানে কি দেখছ? এদিকে দেখ, অঞ্জনবাবু তার মানিব্যাগটা ফেলে গেছেন।
শ্রীময়ী ফিরে দেখলেন মেয়ে একটা মানিব্যাগ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার চেঁচিয়ে উঠল সীমা, উরি ব্বাস! এত টাকা! উনি তো ব্যবসায়ী নন, শুনেছি দিল্লির এক সওদাগরি অফিসে চাকরি করেন, এত টাকা নিয়ে উনি ঘোরাঘুরি করেন কেন?
ব্যাগ খুলে একতাড়া নোট বার করল সীমা। গুনে দেখল পাক্কা বারোশো টাকা রয়েছে।
টাকাগুলো সন্তর্পণে ব্যাগের মধ্যে রাখতে রাখতে সে বলল, দেখি ভিতরে যদি ঠিকানা লেখা কার্ড পাওয়া যায়।
পাওয়া গেল। তবে ঠিকানা লেখা কার্ড নয় বা কাগজ নয়, একটি ছোটো পাসপোর্ট সাইজের ফটোগ্রাফ। চোদ্দ কি পনের বছরের একটি কিশোরের প্রতিচ্ছবি, সময়ের প্রলেপে ঈষৎ বিবর্ণ।
দেখতে দেখতে সীমা বলে উঠল, ভারি সুন্দর, তাই না মা?
সত্যিই সুন্দর। একমাথা কোঁকড়া চুলে-ঘেরা মুখোনা মুহূর্তেই দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছবিখানা দেখতে দেখতে হঠাৎ শ্রীময়ীর দুই চোখ প্রখর হয়ে উঠল, মেয়ের হাত থেকে টেনে নিয়ে তিনি সেটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
তুমি যে ফটো দেখতে দেখতে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলে মা, সীমা হেসে উঠল, দাও, ওটা ব্যাগের ভেতরেই রেখে দিই।
সীমার প্রসারিত হাত ঠেলে দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, এটা আমার কাছেই থাক।
মেয়ের হাত থেকে মানিব্যাগটাও টেনে নিলেন তিনি, এটা আমার কাছে রইল। সংসারের নানা প্রয়োজন রয়েছে। আসছে মাসে তোর দুটো টিউশানি থাকছে না। টাকাটা হয়তো দরকার হবে।
তুমি বলছ কী? সীমা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, অঞ্জনবাবু যখন ফিরে এসে ব্যাগের কথা জিজ্ঞাসা করবেন, কি বলব? বলব, পাইনি? ছি, ছি, তোমার কি হয়েছে বল তো? অভাব অভিযোগ থাকলে কি আমরা চুরি করব?
–চুরির প্রশ্ন আসছে কেন? অস্বীকারই বা করব কেন?
তাহলে কি ভিক্ষার দান বলে টাকাটা গ্রহণ করতে হবে?
তোমাকে কিছুই বলতে হবে না বাছা, শ্রীময়ীর কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট বিরক্তি, কাজল যদি ফিরে আসে, যা বলার আমিই বলব। তবে জেনে রাখো, সে আর আসবে না। ওটা সে ভুল করে ফেলে যায়নি, গোপানে রেখে গেছে।
একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়ে সীমা বলল, কেন? উনি শুধু-শুধু দুজন প্রায়-অপরিচিত মহিলাকে অতগুলো টাকা দান করতে যাবেন কেন? আমরাই বা টাকা নেব কোন অধিকারে?
মুখ টিপে হেসে শ্রীময়ী বললেন, ভালোবাসার অধিকারে।