বনবেড়াল! সীমার দুই চোখে অবিশ্বাস, বনবেড়াল এমন সাংঘাতিক ভাবে আঁচড়ে দিল? তা বনবেড়ালটার কবলে পড়লেন কি করে? খুব বনে বনে ঘুরতেন বুঝি?
ইয়ে, তা একসময় ঘুরেছি বইকী, অঞ্জনের মুখ কাচুমাচু।
কিন্তু বনবেড়াল কি হঠাৎ মানুষকে তেড়ে এসে আঁচড়ে দেয়? সীমার হৃতে কুঞ্চনরেখা, আর বনবেড়ালের নখে এমন সাংঘাতিক ক্ষত হয়?
হয়, হয়, মস্ত বড়ো বনবেড়াল যে! তাড়াতাড়ি গেঞ্জিটা তুলে নেয় সে। কিন্তু গায়ে দেবার আগেই বাধা পড়ল।
তোমার বাঁ হাতের উপর এই লাল জডুলটা ভারি অদ্ভুত, সীমার মা এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, ক্ষতচিহ্নের পরিবর্তে অঞ্জনের বাহুর উপর লাল চিহ্নটাই যেন তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে, এটা কি জন্ম থেকেই রয়েছে?
বলতে বলতেই বাহুর উপর জডুল চিহ্নটায় হাত রাখলেন তিনি।
তাই তো শুনেছি– চটপট জামা পরে ফেলে অঞ্জন।
আমি একজনকে জানতাম, অঞ্জনের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাইলেন সীমার মা, তার বাঁ হাতের উপরদিকে ঠিক এই রকম অর্ধচন্দ্রের মতো লাল জড়ুল ছিল। ঠিক এই রকম।
হতে পারে–অঞ্জন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, দুটো মানুষের মধ্যে সাদৃশ্য থাকা অসম্ভব নয়।
২. রহস্যময়ী শ্রীময়ী
আপনি দয়া করে আমার সোয়েটারটা একটা কাগজে মুড়ে দেবেন? অঞ্জন সীমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বুঝতেই পারছেন রক্তমাখা সোয়েটার নিয়ে রাস্তায়
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, সোয়েটার নিয়ে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াল সীমা, আর একটু চা খেয়েও যাবেন।
অঞ্জন উত্তর দিল না। তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে দেওয়ালের উপর একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফের দিকে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, খুব কাছে থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল আলোকচিত্রের মানুষটিকে হাসিখুশি এক যুবক; প্রসন্ন দৃষ্টি, সুপুরুষ।
সীমার মা মৃদুস্বরে বললেন, সীমার বাবা।
-মহাদেব চৌধুরীর অল্প বয়সের ছবি?
–নিতান্ত অল্প বয়সের নয়। ওঁকে দেখলে বয়স বোঝা যেত না।
একটা ছোটো পাত্রের উপর চায়ের কাপ আর ডিমভাজা নিয়ে প্রবেশ করল সীমা, বিশেষ কিছু করতে পারিনি, শুধু ওমলেট আর চা।
ওমলেটের প্লেট টেনে নিয়ে অঞ্জন বলল, শুধু চা হলেই চলত, আর কিছু দরকার ছিল না। আপনি বরং সোয়েটারটা চটপট কাগজে মুড়ে নিয়ে আসুন।
এখনই আনছি, বলে সীমা আবার অন্তঃপুরে অদৃশ্য হল।
ওমলেট শেষ করে সামনের ছোটো টেবিলটার উপর থেকে চায়ের পেয়ালা তুলে নিল অঞ্জন। সীমার মায়ের দিকে চোখ না তুলেও সে অনুভব করেছিল তার দুই চোখের দৃষ্টি তার উপর স্থির হয়ে আছে…
অবশেষে এই অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ভঙ্গ করার জন্যই অঞ্জন বলে উঠল, বাড়িটায় শুধু আপনারা দুজন মহিলা থাকেন, ভয় করে না?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকেই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন উদ্দিষ্ট মহিলা, তোমার বাবার নাম কী?
অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন! এবং অপ্রাসঙ্গিক! অঞ্জন চমকে বিষম খেল। পেয়ালা থেকে চা ছিটকে পড়ল। সীমা যখন ঘরে ঢুকল অঞ্জন তখন বিষম কাশছে।
হাতের প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে সীমা বলল, এই রইল আপনার সোয়েটার। কিন্তু এমন কাশছেন কেন? বিষম লেগেছে মনে হচ্ছে?
কোনো রকমে কাশির ধাক্কা সামলে অঞ্জন বলল, হ্যাঁ, হঠাৎ বিষম খেয়েছি।
তারপরই কবজি ঘুরিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, ওঃ! দশটা বাজে।
টেবিলের উপর থেকে সোয়েটারের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে অঞ্জন বলল, এবার আমি চলি।
উদবিগ্ন স্বরে সীমা বলল, হ্যাঁ, বেশি রাত করা উচিত হবে না। শয়তানগুলোর খপ্পরে পড়তে পারেন। যে রাস্তা দিয়ে এসেছেন, ওই পথে ফিরবেন না। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই
জানি, ডানদিকে বড়ো রাস্তা পাব,অঞ্জন বলল, তলে গুণ্ডাদের ভয় করি না। আজ রাতে অন্তত ওরা আমার সামনে আসতে সাহস পাবে না।
–তবু সাবধানের মার নেই।
মারেরও সাবধান নেই। যাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতি রাত্রেই আমাকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে হয়, তাদের তুলনায় এই গুণ্ডারা নিতান্তই শিশু, বলতে বলতেই অঞ্জনের মুখে এক অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল, লোকদুটোর অবস্থা কি হয়েছে জানেন? একজনের নাকের হাড় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, কোনো ডাক্তার ওই হাড় জোড়া লাগাতে পারবে না। আর একজন সারা জীবন বুকের ব্যথায় কষ্ট পাবে। কোনো ডাক্তারই ওই ব্যথা সারিয়ে দিতে পারবে না। হয়তো
একটু হেসে অঞ্জন আবার বলল, হয়তো ওই বুকের ব্যথা তার আয়ুকেও কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। সেজন্য আমার দুঃখ নেই। দুনিয়া থেকে একটা পাপ তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে সমাজের ভালো ছাড়া মন্দ হবে না।
আপনি সাংঘাতিক মানুষ তো সীমা বলে উঠল, আপনাকে দেখলে কিন্তু বোঝাই যায় না যে, আপনি এমন ভীষণভাবে মারামারি করতে পারেন! কিন্তু প্রতিরাত্রে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে হয় বললেন কেন? আপনার এই কথার অর্থও কিছু বুঝতে পারলাম না। কি করেন আপনি?
সব কথা কি চটপট বোঝা যায়? হাসতে হাসতে অঞ্জন বলল, আপনার মাকে দেখলে কি বোঝা যায় যে, আপনার মতো একটি মেয়ের উনি মা হয়েছেন? অপরিচিত মানুষ আপনাদের দেখলে ওঁকে আপনার দিদি বলেই ভাববে, মা বলে কখনই ভাবতে পারবে না।
সীমার মা যেন একটু লজ্জিত হলেন, কিন্তু সীমা বলে উঠল, কথাটা ঠিক। ছোটোবেলা থেকেই মা নাকি অসাধারণ সুন্দরী। তাই তো দাদু নাম রেখেছিলেন শ্রীময়ী।