কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে যতই অনীহা থাক, সীমার সম্বন্ধে অঞ্জন ঘোষের আগ্রহের অভাব ছিল না। বিশেষ করে সীমার বাবা মহাদেব চৌধুরীর নামটা শোনার পর থেকেই সীমার বিষয়ে তার কৌতূহল যেন হঠাৎ অন্তত তীব্র হয়ে উঠেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সীমার পিতৃনাম শোনার আগে পর্যন্ত অঞ্জন ঘোষের আচরণে একটা নির্লিপ্ত সৌজন্যবোধ ছাড়া বিশেষ মনোযোগের আভাস দেখা যায় নি। কিন্তু মহাদেব চৌধুরী নামটা শোনামাত্র তার চমকটা সীমার চোখে পড়েছে এবং তারপর থেকেই অঞ্জন ঘোষ যেন সীমার অস্তিত্ব সম্পর্কে বড়ো বেশি রকম সচেতন হয়ে উঠেছে।
অঞ্জন ঘোষ মানুষটাকে কেমন যেন গোলমেলে মনে হয়েছে সীমার, কিন্তু যে-মানুষটা তাকে এইমাত্র বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, তাকে বাড়ির দরজা থেকে বিদায় দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না– অতএব ভিতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সীমা। শুধু কৃতজ্ঞতাবোধে নয়, মানুষটাকে এর মধ্যেই তার ভালো লেগে গেছে…
অঞ্জন ঘোষ খুব লম্বা চওড়া নয়, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে নিতান্তই সাধারণ। তার মতো একটি মানুষ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেভাবে সশস্ত্র গুণ্ডাদের কাবু করল, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার বিস্ময়কর কীর্তি আর সংযত ভদ্র ব্যবহার সীমাকে আকৃষ্ট করেছিল, তার উপর কৃতজ্ঞতাবোধ তো ছিলই। অঞ্জন মুখে বিদায় চাইলেও এখনই বোধহয় সীমার সান্নিধ্য ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিল না; তাই সীমা যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে বলল, সে মৃদু হেসে চুপ করে রইল। মনে হয় এই ধরনের অনুরোধই আশা করেছিল সে।
দরজার কড়া ধরে আবার নাড়তে যাচ্ছিল সীমা, কিন্তু তার আগেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার উপর এসে দাঁড়াল একটি নারীমূর্তি। অঞ্জন বুঝল, ইনিই সীমার মা। মহিলাটির হাতে বা গলায় অলঙ্কারের চিহ্নমাত্র ছিল না, কালো পাড়ের সাদা শাড়িটাও নিতান্তই সাধারণ তবু অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মধ্যেও তার মুখশ্রীতে আভিজাত্যের স্বাক্ষর দেখতে পেয়েছিল অঞ্জন।
হঠাৎ লোডশেডিং-এর অভিশাপমুক্ত হয়ে সারা এলাকাটা আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠল। মুক্তদ্বারপথে এক ঝলক আলো এসে পড়ল অঞ্জনের গায়ের উপর।
মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল সীমা, কিন্তু তার আগেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এ কী! এ কী ব্যাপার!
মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সঙ্গীর দিকে দৃষ্টিপাত করেই চমকে উঠল সীমা, রক্ত! আপনার জামাটা যে রক্তে ভিজে গেছে!
হ্যাঁ, অঞ্জনের হালকা-ধূসর সোয়েটারে বুকের কাছে লাল রক্তের ছাপ হঠাৎ-আলোর ঝলকানিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দ্রুত এগিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে পা রেখে সে বলল, চলুন, ভিতরে চলুন।
মহিলা সমানে এসে তাদের একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে এলেন। সোফার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সীমা বলল, অঞ্জনবাবু, বসুন।
তারপর মায়ের দিকে ফিরল, মা, আমি পথে গুণ্ডার খপ্পরে পড়েছিলুম। ইনি আমায় উদ্ধার করেছেন। এঁর নাম অঞ্জন ঘোষ। আর অঞ্জনবাবু বুঝতেই পারছেন, ইনি আমার মা।
অঞ্জনের দিকে অনুযোগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সীমা বলল, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি, বুকে ছুরির খোঁচা লেগেছে। কথাটা একবার বলবেন তো? দরজা থেকেই তো বিদায় নিচ্ছিলেন। আমরা কি এতই অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর যে, ওষুধ-বিষুধ না লাগিয়েই আপনাকে দরজা থেকে বিদায় করে দেবে?
কুণ্ঠিতভাবে হেসে অঞ্জন বলল, না, তা নয়! ছুরির খোঁচা লাগে নি। ওটা গুণ্ডাদের গায়ের রক্ত।
বাজে কথা, সীমা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, অঞ্জনবাবু, লোকটাকে আপনি লোহার রড কিংবা ছুরি দিয়ে মারেননি, হাতেই মেরেছেন। অতটা রক্ত ছিটকে আপনার গায়ে লেগেছে বলতে চান?… জামা খুলুন, আমি দেখব।
হ্যাঁ, জামাটা খুলে ফেল, সীমার মা বললেন, আমিও একবার দেখতে চাই। বিপদের সময় সঙ্কোচ করতে নেই।
আমতা-আমতা করে অঞ্জন বলল, কিন্তু বিপদ তো হয় নি।
সেটা আমি বুঝব, সীমার মা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন, তুমি বললাম বলে কিছু মনে কোরো না বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, তুমি বলবেন বইকী, দ্বিধাগ্রস্তভাবে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জন বলল, কিন্তু জামাটা কি খুলতেই হবে?
মৃদু হেসে মা বললেন, হ্যাঁ।
নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই সোয়েটার এবং শার্ট খুলে ফেলল অঞ্জন। তাতেও নিষ্কৃতি নেই, অতএব গেঞ্জিটাও খুলতে হল। না, কোথাও আঘাতের দাগ বা রক্ত দেখা যাচ্ছে না। সত্যি কথাই বলেছে অঞ্জন। কিন্তু অঞ্জনের নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সীমা-~
দৃঢ় পেশীবদ্ধ দেহ; বুকে, পেটে, কাঁধে কোথাও মেদের অস্তিত্ব নেই, শুধু দেখা যায় ঢেউ-খেলানো মাংসপেশীর বিস্তার! একেই বোধহয় বলে বর্ণচোরা আম! এতক্ষণে সীমা বুঝল, একটু আগে যে ভেলকিটা দেখিয়েছে অঞ্জন, তার উৎস কোথায়!
কিন্তু শুধু পেশীর সৌষ্ঠব নয়, আর একটি বস্তু সীমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল– বুকের নিচে পাঁজরের কাছে তিনটি সমান্তরাল দীর্ঘ ও গভীর ক্ষতিচিহ্ন রয়েছে অঞ্জনের দেহে, মনে হয় ত্রিশূলের মতো কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেউ পাঁজরের উপর ওই ক্ষতচিহ্ন তিনটি এঁকে দিয়েছে।
সীমা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কী ভীষণ! এমনভাবে কেটে গিয়েছিল কি করে?
অত্যন্ত বিব্রত হয়ে অঞ্জন বলল, ও কিছু নয়। অনেকদিন আগে একটা বনবেড়াল আঁচড়ে দিয়েছিল।