কাজলের অদ্ভুত বিবরণী শ্রীময়ী আর সীমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। একটু চুপ করে থেকে কাজল আবার বলল, ছোটোবেলায় মাকে হারিয়েছি, বাবাকেও খুব বেশিদিন পাইনি। মনে একটা অতৃপ্তি রয়েছে।
একটু থেমে শ্রীময়ীর মুখের দিকে তাকাল কাজল, কয়েকটা বছর আমি তোমার আশ্রয়ে থাকতে চাই, মা! জোসেফের ইচ্ছার দাস হয়ে স্বর্ণগর্দভে পরিণত হতে আমি চাই না। আমি সার্কাসের তাঁবুতে ফিরে গেলে তোমরা নিরাপদ হবে, কিন্তু এতদিন পরে তোমাদের কাছে পেয়ে সার্কাসের জীবনে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
কেন ফিরে যাবি? শ্রীময়ী আর্দ্রকণ্ঠে বললেন, আমাদেরই বা কে আছে বল? আর বিপদই বা হবে কেন? আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা তুই করতে পারবি না?
পারব। তবে—
কাজল হঠাৎ চুপ করল। দক্ষিণ করতল চিবুকে রেখে কী যেন ভাবতে শুরু করল।
শ্রীময়ী বলে উঠলেন, তবে বলে থামলি কেন? কি বলতে চাস তুই?
কাজল বলল, মা, তোমার কাছে বাবা ত্রিশ হাজার টাকা আমার জন্যে রেখে গেছেন এটা আমি জানতাম না। এতদিনে সুদে-আসলে টাকার অঙ্কটা নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। ওই টাকায় আমার প্রয়োজন নেই। টাকাটা তুমি রেখে দিও। দরকার হলে টাকাটা তুমি সীমার বিয়েতে খরচ করতে পারবে। দরকার হলে বলছি কেন দরকার তো হবেই- আমিও বোনের বিয়ের জন্য একটা মোটা অঙ্কের টাকা তোমার হাতে দিয়ে কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাব।
তার মানে? একটু আগে বললি আমার কাছে থাকবি। এখন বলছিস চলে যাবি? এই তোর ভালোবাসা? মায়ের প্রতি, বোনের প্রতি কর্তব্য নেই তোর? টাকা দিলেই সব কর্তব্য করা হল।
আমার বিয়ের জন্য তোমায় ভাবতে হবে না, সীমা ঝংকার দিয়ে উঠল, তুমি তো প্রথম দিন থেকেই আমাদের দুরে ঠেলে দিতে চাইছ। মা যা-ই বলুক আমি তোমায় থাকতে বলব না। আমাদের ভাগ্যে যা হওয়ার হবে, তুমি স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারো।
কাজলের মুখে করুণ হাসি ফুটল, আমি সার্কাসে ফিরে গেলে তোদের বিপদের ভয় নেই। তোদের স্নেহ-ভালোবাসা, মা-বোনের আদর পাওয়ার লোভই আমায় টেনে এনেছে তোদের কাছে। কিন্তু ভেবে দেখছি তোদের বিপন্ন করা উচিত হবে না। আমি তো তোদের কাছে থাকতেই চাই, শুধু জোসেফের ভয়ে
বাধা দিয়ে সীমা বলল, জোসেফ কী করতে পারে দাদা? এটা বিংশ শতাব্দী। দেশে সরকার আছে, পুলিশ আছে। তুমিও একটা নিরীহ নির্জীব গোছের মানুষ নও। একটা জাদুকরের ভয়ে তুমি মা-বোনকে ফেলে চলে যাবে?
ওইখানেই তো আমার পৌরুষে লাগছে সীমা। তবে জোসেফকে তুই তুচ্ছ ভাবিস না। ইউরোপে একসময় ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে একধরনের জাদুবিদ্যা প্রচলিত ছিল। ওই বিদ্যা যে-সব জাদুকর আয়ত্ত করতে পেরেছিল, তারা অসাধ্যসাধন করতে পারত। আমার মনে হয় ওই গুপ্তবিদ্যা এখনও পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি। যে ভাবেই হোক ব্ল্যাক ম্যাজিক নামে কুখ্যাত জাদু নিয়ে অনুশীলন করেছে জোসেফ। সাধনায় কিছুটা সিদ্ধিলাভ যে তার হয়েছে, তা তো আমি স্বচক্ষেই দেখেছি, সেইজন্যেই তো ভয় পাচ্ছি।
–বাজে কথা ছাড়ো। তোমার কোথাও যাওয়া হবে না দাদা। একটু আগেই তুমি বলছিলে আমাদের নিয়ে ভারত-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বে, এখন আবার অন্য সুর গাইছ কেন? না, না, তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।
–বলছিস?
–হ্যাঁ। বলছি।
কিন্তু সীমা, তুই তো খুব বেশিদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবি না।
–কেন? কেন?
–যখন এসে পড়েছি, তখন দাদার কর্তব্য তো করতেই হবে। একটা ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিতে হবে না?
হঠাৎ বিয়ের প্রসঙ্গ অপ্রত্যাশিত। সীমা কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে দাদার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপরই মুখ লাল আর চোখ নিচের দিকে, ধ্যেৎ! বাজে কথা বোলো না তো।
হেসে উঠে কী যেন বলতে যাচ্ছিল কাজল, বলা হল না। আচম্বিতে মধ্যরাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে জাগল এক প্রচণ্ড জান্তব কোলাহল! অনেকগুলো কুকুর তারস্বরে চিৎকার করে উঠেছে বাড়িটার খুব কাছেই!
কাজলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল সে।
সীমা বলল, কুকুরের ডাক শুনে এমন ভড়কে গেলে কেন দাদা?
শুনতে পাচ্ছিস না কুকুরগুলো কেমন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছে?
তাতে ভয় পাওয়ার কি আছে? কুকর তো কত কারণেই চাঁচায়। হয়তো পাড়ায় চোর ঢুকেছে।
–নারে সীমা, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। জানোয়ার নিয়ে বহুদিন কাটিয়েছি। সার্কাসে কুকুরের খেলাও দেখিয়েছি। কুকুরের স্বভাব-চরিত্র আমি ভালোভাবেই জানি। কুকুরগুলো কিছু দেখে খেপে গেছে, কিন্তু ভয়ও পেয়েছে সেইজন্যই ওইভাবে ডাকছে।
হঠাৎ একটা তীব্র আতাঁরব উঠল, স্পষ্টই বোঝা গেল আর্তনাদ করতে করতে কুকুরগুলো বাড়ির সামনে থেকে সরে যাচ্ছে…
মাথার উপর ছাতে একটা শব্দ হল- ধপ!
গুরুভার কোনো বস্তু যেন ছাতের উপর ছিটকে এসে পড়েছে।
৯. বিভীষিকার আবির্ভাব
শব্দটা সবাই শুনেছিল। স্তব্ধতা ভঙ্গ করল সীমা, মনে হল বাড়ির পাশের গাছটা থেকে কিছু যেন লাফিয়ে পড়ল ছাতের উপর– তাই না মা?
শ্রীময়ী মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, গাছের ডালপালার মধ্যে একটা শব্দ আমি শুনেছি।
হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন শ্রীময়ী, হ্যাঁ রে সীমা, ছাদের দরজা বন্ধ করেছিলি তো?
সীমার মুখ সাদা হয়ে গেল, না, মা। ভুল হয়ে গেছে।
সর্বনাশ!
কিছু সর্বনাশ হয়নি, দরজাটা আমি বন্ধ করে দিয়ে আসছি, কাজল বলল, ছাতে ওঠার সিঁড়িটা দেখিয়ে দে সীমা।