সব কিছুরই শেষ আছে। একসময়ে আমার প্রতীক্ষারও শেষ হল। পুঁথি বন্ধ করে উঠল। জোসেফ। এবার সময় হয়েছে। ঘড়িতে দেখলাম কাটায় কাঁটায় একটা। জোসেফ আমায় ইঙ্গিত করতেই আমি তার দিকে একটা থলি এগিয়ে দিলাম। থলিটা খুলল জোসেফ, মস্ত বড়ো একটুকরো মাংস বেরিয়ে এল। পকেট থেকে একটা শিশি বার করল জোসেফ, তারপর ছুরি দিয়ে মাংসের টুকরোটাকে জায়গায় জায়গায় চিরে ফেলল। শিশির ভিতর থেকে এক ধরনের সাদা গুড়ো বার করে সে ছড়িয়ে দিল ছিন্নভিন্ন মাংসের টুকরোর উপর। আমি বুঝলাম মাংসের সঙ্গে মিশে গেল প্রাণঘাতী তীব্র বিষ। সেই বিষাক্ত মাংস নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলাম আমার বিছানার উপর টান হয়ে শুয়ে পড়ল জোসেফ।
ব্ল্যাক জাগুয়ার শয়তান তখন অস্থির চরণে পায়চারি করছিল খাঁচার মধ্যে। খাঁচাটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। হিংস্র দন্তবিকাশ করে আমায় অভ্যর্থনা জানাল শয়তান।
মাংসের টুকরোটা খাঁচার ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম। ক্ষুধার্ত শ্বাপদ সেটাকে লুফে নিল। জোসেফের পরামর্শে জন্তুটাকে আমি সারাদিন অভুক্ত রেখেছিলাম।
জোসেফের কাছে শুনেছিলাম। বিষটা অতি ভয়ংকর। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই তীব্র বিষের ক্রিয়া দেখতে পেলাম। শূন্যে থাবা বিস্তার করে হঠাৎ ছটফট করে উঠল জন্তুটা, তারপর নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল। খাঁচার ফাঁক দিয়ে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে তার নিস্তব্ধ দেহটা কিছুক্ষণ লক্ষ করলাম, তারপর খাঁচার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম জন্তুটার মৃত্যু হয়েছে। তাড়াতাড়ি তাবুতে জোসেফের কাছে গিয়ে শয়তানের মৃত্যুসংবাদ দিলাম। জোসেফ আমাকে আবার ফিরে যেতে বলল শয়তানের কাছে। তাকিয়ে দেখলাম জোসেফের দুই চোখ বুজে গেছে। ফিরে এলাম শয়তানের খাঁচার মধ্যে, স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ করতে লাগলাম তাকে।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ তার দেহটা নড়ে উঠল। তারপরই জন্তুটা উঠে বসে আমার দিকে তাকাল। বুকের মধ্যে মুহূর্তের জন্য ভয়ের ধাক্কা লাগল। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, নিজেকে সামলে নিয়ে পরবর্তী ঘটনার জন্য প্রস্তুত হলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল শয়তান, পিছনের পায়ে ভর করে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের উপর দুই থাবা তুলে দিল। তারপর ডান থাবা তুলে আমার বাঁ কাঁধে দুবার চাপড় মারল। আমরা যেমন করে কারও কাঁধ চাপড়ে আনন্দ জানাই অবিকল সেই ভঙ্গি!
আমি তাকে বসতে বললাম। বসল। দাঁড়াতে বললাম। দাঁড়াল। বাইরে বেরিয়ে এসে খাঁচার দরজায় চাবি দিলাম। শয়তান বাধা দিল না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোয়ালটা একটু ঝুলে পড়ে আবছা আলোয় কয়েকটা দাঁত ঝকঝক করে উঠল। মনে হল জন্তুটা হাসছে!
এবার ফিরে গেলাম জোসেফের কাছে। তার নাকে হাত দিয়ে বুঝলাম নিঃশ্বাস পড়ছে না। বুকে মাথা রাখলাম, হৃদপিণ্ডে স্পন্দন নেই। পরিকল্পনা অনুসারে ঘড়ি দেখলাম। রাত দেড়টা। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম শয্যাশায়ী জোসেফের প্রাণহীন দেহটার দিকে। হঠাৎ নড়ে উঠল মৃতদেহ! তারপর বন্ধ চোখ দুটো খুলে গেল, শুনতে পেলাম জোসেফের কণ্ঠস্বর, মিঃ চৌধুরী! এবার বিশ্বাস হচ্ছে? কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। ঘাড় নেড়ে জানালাম বিশ্বাস হয়েছে।
কাজলের কথা শেষ হল। অস্বাভাবিক স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল ঘরের মধ্যে। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন শ্রীময়ী, কাজল, ব্যাপারটা তাহলে কী হল? জোসেফের আত্মা কি জন্তুটার দেহে প্রবেশ করেছিল? তাই যদি হয়, তাহলে জোসেফ জীবন্ত হয়ে উঠলে শয়তানের বেঁচে থাকার কথা নয়।
বেঁচে থাকে না, শুদ্ধস্বরে কাজল বলল, দিনের বেলা শুধু খাদ্য গ্রহণের সময় ছাড়া অন্য সময়ে সার্কাসের লোকেরা শয়তানকে ঘুমোতেই দেখে। আসলে ওটা ঘুম নয়, মৃত্যুর নামান্তর মাত্র। জোসেফ যখন দিনের বেলা চলাফেরা করে, শয়তানের মৃতদেহ তখন পড়ে থাকে খাঁচার মধ্যে। একটা কালো কাপড় দিয়ে খাঁচাটা ঢাকা থাকে। শয়তানকে দিনের মধ্যে একবার খাওয়ানো হয়। এই মাংস আমিই দিয়ে আসি। সেই সময় আমার বিছানায় শুয়ে থাকে জোসেফ। কেউ যদি তখন জোসেফকে লক্ষ করে, তাহলে তার দেহে জীবনের কোনো লক্ষণই খুঁজে পাবে না। অবশ্য আমার অনুমতি ছাড়া আমার নিজস্ব তাঁবুতে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। তাও যদি দৈবক্রমে কেউ আমার তাঁবুতে আসে, তাহলে শয্যার উপর জোসেফকে দেখলে তাকে নিদ্রিত মনে করে স্থানত্যাগ করবে। জোসেফ যে আমার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু, এই কয়দিনে সার্কাসের সব লোকই তা জানতে পেরেছে। আমার বিছানায় তাকে শুয়ে থাকতে দেখলে কেউ কিছু মনে করবে না। কাজেই দুপুরবেলা শয়তানের খাওয়ার সময় জোসেফের জীবন্ত মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। রাতেও একই অবস্থা। শয়তানের খেলা শেষ হয়ে গেলে সে খাঁচায় ঢুকে মরণঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে, আর শয্যাশায়ী জোসেফের নিস্পন্দ দেহ হঠাৎ প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে আমার তাবু ছেড়ে রওনা দেয় তার হোটেলের দিকে।
এক মাসের মধ্যেই আমি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলাম। দর্শকরা কালো বাঘের খেলা দেখে মুগ্ধ। হিংস্র শ্বাপদ থাবা দিয়ে আঁচড় কেটে সার্কাসের মাটিতে অঙ্কের সংখ্যা লিখতে পারে, যোগ-বিয়োগ করতে পারে এবং তার প্রভু, অর্থাৎ আমার আদেশ পালন করে নির্বিবাদে। তারা আশ্চর্য হয়ে যায় যখন দেখে আমার হাতে চাবুক পর্যন্ত নেই, শুধু মুখের কথাতেই আদেশ পালন করছে ভয়ংকর শ্বাপদা কালো বাঘকে ঘড়ি দেখতে বললে সে ঘড়ি দেখে মাটিতে আঁচড় কেটে সময় জানিয়ে দেয়। ধরো, ঘড়িতে দেখা গেল নয়টা পনের জন্তুটা নখের সাহায্যে সার্কাসের বালিভরা জমির উপর ইংরেজিতে নয় লিখে একটা লম্বা টান দিল, তারপর লিখল পনের। বলাই বাহুল্য, পরের সংখ্যাও সে ইংরেজিতেই লিখেছিল। এই রকম আরও অনেক খেলা আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। জাগুয়ারের দেহে অবস্থান করে মানুষের আত্মা, অতএব আমার কথা বুঝে কাজ করতে অসুবিধা হয় না। কালো জাগুয়ারের অত্যাশ্চর্য খেলা দেখতে ভিড় জমে ওঠে সার্কাসের প্রদর্শনীতে। আমার কমিশন বাড়তে থাকে। অবশ্যই তার একটা অংশ যায় জোসেফের পকেটে। অর্থের আগমন বন্ধ হলে জোসেফের রাগ হওয়ারই কথা। তোমাদের প্রতি, বিশেষ করে মায়ের প্রতি আমার আকর্ষণ বুঝতে পারত জোসেফ। তার ভয় ছিল একসময় হয়তো সব ছেড়ে দিয়ে আমি মায়ের কাছে চলে যেতে পারি। সেই জন্যই আমার সঙ্গে সংস্রব রাখতে তোমাদের নিষেধ করেছিল সে,। তার কথা না শুনলে কী হবে স্পষ্ট করে বলেনি জোসেফ, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি সে তোমাদের হত্যা করার চেষ্টা করবে। তার অর্থের লালসা যতদিন তৃপ্ত না হবে, ততদিন সে আমাকে মুক্তি দিতে চাইবে না।