রুদ্ধশ্বসে সীমা বলল, শয়তান! মানে, ওই কালো জাগুয়ারের চেহারাটাই ভেসে উঠেছিল?
-না। আংটির দর্পণে দেখলাম মাকে!
–মা!
–হ্যাঁ, মাকেই দেখেছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর মায়ের চেহারা মুছে গেল, ফুটে উঠল তোর ছবি।
-সীমার ছবি ফুটে উঠল আংটির মধ্যে! প্রথমে আমি, তারপর সীমা! এ যে অবিশ্বাস্য!
–হা মা। অথচ তোমাদের সে আগে কখনো দেখেনি।
অপরিসীম বিস্ময় আর আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইল দুই নারী।
শুধু এখানেই শেষ নয়, কাজল বলতে লাগল, আরও আছে। খুব স্পষ্ট করে কিছু না বললেও আভাসে-ইঙ্গিতে জোসেফ যা বলল, তা থেকে বুঝলাম অদ্ভুত অলৌকিক শক্তির অধিকারী সে। তার আরও ক্ষমতার পরিচয় পেলাম একটু পরে। রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি বিদেশির সঙ্গে মালিকের বাদানুবাদ শুরু হয়, তারপর ওই বিদেশি মানুষটির সঙ্গে রেস্তোরাঁর রেয়ারাদের মারামারি লেগে যায়। একটা লোকের বিরুদ্ধে অতগুলো বেয়ারাকে লাগতে দেখে আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল, কিন্তু জোসেফ ব্যাপারটায় নাক গলাতে দিল না- সোজা এগিয়ে গেল ঝটাপটি আর মারামারির মধ্যে। জোসেফের হাতের এক ঝটকায় এক বেয়ারা ছিটকে পড়ল। বুঝলাম হাতাহাতির ব্যাপারেও এই আশ্চর্য মানুষটির ভালো অভিজ্ঞতাই আছে। আহত বেয়ারার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে মালিককে বুঝিয়ে দিল পুলিশ এলে তারই বদনাম, আর বিদেশির স্বপক্ষে ও মালিকের বিপক্ষে সাক্ষী দেবে সে নিজে এবং তার সঙ্গী অর্থাৎ আমি– অতএব এই মুহূর্তে মালিক যেন তার বেতনভোগী বেয়ারাদের সংযত করে, না হলে সমুহ বিপদ।
মারামারি বন্ধ করার জন্য মালিকের আদেশের প্রয়োজন ছিল না, বিদেশি মানুষটা দস্তুরমতো শক্তিমান, তাকে নিয়েই বেয়ারার দল নাস্তানাবুদ হচ্ছিল এখন জোসেফকে বিরোধীপক্ষে যোগ দিতে দেখে তারা ঘাবড়ে গেল। বিদেশির সঙ্গে অজানা ভাষায় কথাবার্তা চার্লিয়ে কলহের কারণটাও আবিষ্কার করল জোসেফ। বিদেশি যে-খাদ্যের অর্ডার দিয়েছিল, তা না দিয়ে অন্য খাবার এনেছিল বেয়ারা। লোকটি সেই খাবার খায়নি এবং না-খাওয়া খাবারের জন্য দাম দিতেও রাজি হয়নি। ব্যাপারটা ইংরেজিতে মালিককে বুঝিয়ে দিল জোসেফ। মালিক তৎক্ষণাৎ দুঃখ প্রকাশ করে বিদেশির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। আসলে পরস্পরের ভাষা বুঝতে না পারার জন্য এই বিভ্রাট।
গোলমাল মিটলে জোসেফকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম লোকটি পর্তুগিজ। পর্তুগিজ ভাষায় জোসেফের এমন অদ্ভুত দখল দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতেই সে জানাল পৃথিবীর সতেরোটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে সে! শুনে আমি হতবাক!
রেস্তোরাঁ থেকে সার্কাসের আস্তানায় ফেরার সুযোগ আমি পেলাম না। জোসেফ আমায় জোর করে নিয় গেল পার্ক স্ট্রিটের এক অভিজাত হোটেলে, সেখানেই নাকি সাময়িকভাবে বাস করছে সে। হোটেলটা প্রথম শ্রেণির না হলেও বেশ ব্যয়বহুল, বুঝলাম জোসেফের আর্থিক অবস্থা দস্তুরমতো ভালো। সেখানে বসেই তার অনুরোধে নৈশভোজন সমাপ্ত করতে বাধ্য হলাম। তার পরই নতুন বিস্ময়ের চমক। আমার সবচেয়ে বড়ো বিপদ যে মা আর বোনের সান্নিধ্য থেকেই আসতে পারে সেকথা তত জোসেফ আমায় আগেই বলেছিল, এবার আমার সবচেয়ে কল্যাণকর বস্তুটির স্বরূপ সে আমায় দেখিয়ে দিল। আমার চোখের সামনে তার বাঁ হাতের প্রসারিত অনামিকায় বসানো রহস্যময় আংটির দর্পণে ফুটল
নাঃ, আমি বলব না, তোমরা অনুমান করতে পারো কার ছবি দেখলাম সেই আংটির দর্পণে?
সমবেত নারীকণ্ঠে উত্তর এল জোসেফ!
কাজল মাথা নাড়ল। উত্তর ঠিক হয়নি। হতবুদ্ধ মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল কাজল, দর্পণে ফুটল কুচকুচে শয়তান, অর্থাৎ সার্কাসের কালো জাগুয়ারটাকে দেখলাম আংটির আয়নার মধ্যে!
দুজনেই চুপ। শ্রীময়ী বা সীমা করাও মুখেই কথা নেই।
কাজল আবার বলল, ওই শয়তানই নাকি আমার সৌভাগ্যের জীবন্ত প্রতীক! জোসেফ কথাটা একেবারে ভুল বলেনি। এক অমানুষিক মানুষের কাছে যদি আত্মবিক্রয় করি তাহলে ওই জন্তুটা আমায় এনে দিতে পারে প্রচুর অর্থ!
হতভম্ব সীমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বলো কী দাদা!
আমি কিছু বলি না, কাজল হাসল, জোসেফ বলছে ওই ভয়ংকর জন্তুটাই আমার সৌভাগ্যের আধার। এমন উপযুক্ত আধার নাকি হয় না!
৮. অর্থ সারমেয় ঘটিত
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাজল আবার তার কাহিনি শুরু করল, সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে সেই রাতে আমায় বিদায় দিল জোসেফ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে গভীর রাত্রে সার্কাসের তাবুতে ফিরে এলাম। পরের দিন যৎসামান্য জিনিস নিয়ে জোসেফ এল আমার আস্তানায়। দুদিন পরে আমার খেলা শুরু হওয়ার কথা। শয়তানই আমার খেলার প্রধান আকর্ষণ। অথচ তখন পর্যন্ত জন্তুটাকে আমি ভালো করে বাগ মানাতে পারিনি। বেগতিক দেখলে ব্ল্যাক জাগুয়ারের খেলা বন্ধ করে দিতে পারি, তবে সেক্ষেত্রে আমার মান-মর্যাদা থাকবে না। কাজেই বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। জোসেফের পরিকল্পনা যদি কার্যকরী হয়, তাহলে অবশ্য চিন্তার কারণ নেই, কিন্তু –
বাধা দিয়ে সীমা বলে উঠল, জোসেফের পরিকল্পনার বিষয় কিন্তু তুমি এখন পর্যন্ত কিছুই বলো নি।
যথাসময়ে জানতে পারবি,কাজল বলতে লাগল, এখন বাধা দিস না। সেদিন নৈশভোজন শেষ হওয়ার পর জোসেফকে আমার তাবুতে রেখে আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। মনের ভিতর তখন ঝড় চলছে। পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম। রাত এগারোটার পর ফিরে এলাম। তাবুর মধ্যে জোসেফকে দেখলাম। একটা বই-এর পাতায় ডুবে রয়েছে সে। বইটি সাধারণ বই নয়, হাতে-লেখা পুঁথি। অত্যন্ত জরাজীর্ণ, ভাষাও আমার কাছে দুর্বোধ্য। সার্কাসের অন্যান্য লোকজন অধিকাংশই শুয়ে পড়েছে। যারা এখনও শয্যা আশ্রয় করেনি, তারা শয়নের উদ্যোগ করছে। আমি এদিক-ওদিক ঘুরে তাবুর চারদিক পর্যবেক্ষণ করলাম, তারপর ফিরে এসে হাতে-লেখা পুঁথি সম্পর্কে জোসেফকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। নিরুত্তরে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার পুঁথির পাতায় মনোনিবেশ করল জোসেফ। একসময়ে বারোটা বাজল। আমি এগিয়ে গিয়ে জোসেফের কাঁধে হাত রাখলাম। জোসেফ জানাল এখনও সময় হয়নি। আমার তখন অসহিষ্ণু অবস্থা। জোসেফের পরিকল্পনা কার্যকরী হয় কি না জানার জন্য ছটফট করছি। কোনো রকমে সময় কাটানোর জন্য বরিস এডার নামে সোভিয়েত রাশিয়ার বিখ্যাত সার্কাস-খেলোয়াড়ের একটি বই নিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম আমার চোখ দুটো অর্থহীন ভাবে বই-এর পাতায় ঘুরেছে, লিখিত বক্তব্যের কিছুই বোধগম্য হয়নি!