পথিকের ডান হাত বিদ্যুদ্বেগে ছুরিকাধারীর মুখের উপর ছোবল মারল, সঙ্গেসঙ্গে আর্তনাদ করে লোকটা ছিটকে পড়ল রাস্তার উপর! তার সেই দুই সঙ্গী সবিস্ময়ে দেখল তাদের দোস্ত দুই হাতে মুখ চেপে ধরে ছটফট করছে! বলাই বাহুল্য, হাতের ছুরিটা আগেই হস্তচ্যুত হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটির উপর!
বিস্ময়ের চমক কাটার আগেই পথিক আবার আক্রমণ করল। যে-গুণ্ডাটা মেয়েটির ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছিল, এবারের শিকার হল সে। দুজনের মাঝখানে প্রায় পাঁচ ছয় হাত রাস্তা পথিক পেরিয়ে গেল চোখের নিমেষে, পরক্ষণেই কি ঘটল বোঝা গেল না। শুধু দেখা গেল, ব্যাগ হাতে গুণ্ডাটা তিন-চার হাত দূরে ছিটকে পড়ে একেবারে স্থির হয়ে গেল! লোকটা আর্তনাদ করারও সময় পায় নি।
পথিক এইবার ঘুরে দাঁড়াল তৃতীয় ব্যক্তির দিকে, ছুরি-ছোরা দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়, বুঝেছ? এবার সোজা কেটে পড় এখান থেকে, না হলে তোমার অবস্থাও হবে তোমার বন্ধুদের মতো।
লোকটা ইতস্তত করছিল, কিন্তু পথিক তার দিকে এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই সে তৎক্ষণাৎ দুর্জনের সান্নিধ্য ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল
চোখের পলকে পিছন ফিরে এক দৌড়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল অকুস্থল থেকে! ধরাশায়ী দুই বন্ধুর দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করল না!
মাটিতে পড়ে-থাকা ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে পথিক মেয়েটির হাতে দিল, এবার চলুন, এখান থেকে সরে পড়া যাক।
মেয়েটি এদিক-ওদিক দৃষ্টিনিক্ষেপ করল রিকশাওয়ালার উদ্দেশে। কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না। লোকটা গোলমালের সূত্রপাত দেখে আগেই সরে পড়েছে নিঃশব্দে।
মেয়েটির মনের ভাব বুঝে পথিক বলল, রিকশার আশা করে লাভ নেই। আপনি কোথায় যাবেন?
কম্পিত স্বরে উত্তর এল, দেবেন্দ্র মল্লিক রোড।
-ওঃ! তাহলে তো কাছেই। চলুন, আমিও ওইদিকেই যাব।
সামনের সাদা একতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে তরুণী বলল, এটাই আমার বাড়ি।
-এই বাড়ি?
পথিকের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়ের আভাস পেয়ে তরুণী ফিরে তাকাল হ্যাঁ, এই বাড়ি। কিন্তু আপনি যেন চমকে গেলেন মনে হচ্ছে?
না চমকাই নি তো, পথিক এবার সহজ ভাবেই বলল, চমকানোর কি আছে?
তরুণীর মনে হল তার সঙ্গী যেন কিছু গোপন করতে চাইছে, কিন্তু এই বাড়িটাই তার বাসস্থান জেনে বিস্মিত হওয়ার কি আছে তা ভেবে পেল না। সে আর কোনো কথা না বলে দরজার কড়া নাড়ল।
পথিক বলল, এবার তো আপনি নিরাপদ। আমি এখন যেতে পারি?
সে কি! তরুণী মৃদু হাসল, মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন না?
পথে আসতে আসতেই মেয়েটি তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছে বাবার মৃত্যুর পর সে মায়ের সঙ্গে রয়েছে; বি. এ. পাশ করে ভাগ্যক্রমে একটি বিদ্যালয়ে সে শিক্ষিকার কাজ পেয়ে যায়। অবসর সময়ে কয়েকটি ছাত্রীকে পড়ায়। তার উপার্জিত অর্থেই মা আর মেয়ের অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয়। বাবা ওই বাড়িটি ছাড়া কিছু রেখে যেতে পারেন নি। সাধারণত রাত আটটার মধ্যেই সে বাড়িতে এসে পড়ে, কিন্তু আজ এক ছাত্রীর বাড়িতে দেরি হয়ে গেছে- পথে এই বিপত্তি।
অবশ্যই নিজের থেকে এত কথা বলতে চায়নি মেয়েটি, কিন্তু পথিক যখন রাতবিরেতে একা ঘুরে বেড়ানোর জন্য তাকে মৃদু তিরস্কার করল এবং নারী স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ পরিণাম দেখিয়ে আধুনিকাদের কটাক্ষ করে মন্তব্য প্রকাশ করল, তখন আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না…
মেয়েটি তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেও পথিক নিজের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই বলে নি। এদিকে সে কোথায় এসেছে জানতে চাওয়ায় পথিক যেন বিব্রত বোধ করেছে, তারপর বলেছে তার বন্ধুর এক পরিচিত ব্যক্তির সন্ধানেই সে এদিকে এসেছিল। রাস্তার নাম তার মনে আছে, যে কাগজে উক্ত ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল, সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে। শুধু রাস্তার নাম দেখে কলকাতা শহরে কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যে অতিশয় দুরূহ, মেয়েটির এই মন্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে সে বলেছে, পথে বেরুনোর সময়ও কাগজটা তার সঙ্গে ছিল, কিন্তু এখন সে কাগজটা পাচ্ছে না। হয়তো মারামারির সময়ে কাগজটা রাস্তায় পড়ে গেছে। ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব নয়, কিন্তু মনে হল পথিক সত্যি কথা বলছে না– তবু যে-লোক তার অর্থ ও সম্মান বাঁচিয়েছে তাকে আর জেরা করেনি সীমা।
সীমা- সীমা চৌধুরী। পথে আসতে আসতে তার নাম জানিয়েছে সীমা পথিক বন্ধুকে। পথিকের নামটাও সে জেনেছে এর মধ্যে। নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরেই অঞ্জন ঘোষ তার নাম জানিয়েছে সঙ্গিনীকে; কিন্তু তার বাসস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বিব্রত বোধ করেছে। আমতা-আমতা করে অঞ্জন জানিয়েছে কর্মস্থল দিল্লি, সে সেখানেই থাকে। কলকাতার পার্ক সার্কাসে এক বন্ধুর বাড়িতে দুদিন হল এসেছে, তবে ঠিকানাটা তার মনে নেই। তার গন্তব্যস্থল এবং বর্তমান বাসস্থান সম্পর্কে স্মরণশক্তির নিদারুণ দুর্বলতা খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি সীমার কাছে। শোনা যায়, ভাবুক প্রকৃতির কবি কিংবা শিল্পীরা দারুণ আপন-ভোলা হয়, কিন্তু অঞ্জন ঘোষ মানুষটাকে কবি বা শিল্পী বলে ভাবতেই পারে না সীমা। দিল্লিতে সে কি কাজ করে এই প্রশ্নটাও সীমার মনে এসেছিল, কিন্তু যে-লোক নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে চায় না, তাকে আর প্রশ্ন করার প্রবৃত্তি হয়নি সীমার।