বুঝিয়ে দিচ্ছি। আজ রাতে যদি কোনো অঘটন না ঘটে, তাহলে ভবিষ্যতে কোনোদিন জোসেফ আমাদের নাগাল পাবে না। কাল সন্ধ্যার আগেই আমাদের ভারত-ভ্রমণ শুরু হবে। জোসেফের পক্ষেও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে হানা দিয়ে আমাদের আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
ভারত-ভ্রমণ! সে যে অনেক টাকার ধাক্কা! তাছাড়া আমার স্কুল?
–আবার বাজে কথা? স্কুল-টুল ছেড়ে দিবি। আর টাকার ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। জীবনটাকে বাজি রেখে বিশ বছর ধরে লড়াই করেছি ভাগ্যের সঙ্গে, একসময়ে ভাগ্যলক্ষ্মী আমায় কৃপা করেছেন- অতএব টাকার ভাবনা এখন নেই। ভারতের বাইরেও কয়েকটা ব্যাঙ্কে আমার টাকা আছে। সেই টাকার পরিমাণও খুব কম নয়। তবে মনে হয় সেখানে হাত দেওয়ার দরকার হবে না।
আমারও তাই মনে হয়,এতক্ষণ বাদে কথা বললেন শ্রীময়ী, উনি আমার নামে ত্রিশ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন; বলেছিলেন বিশ বছরের মধ্যে যদি ছেলে ফিরে আসে, তাহলে ওই টাকা যেন তাকেই দেওয়া হয়। বিশ বছর পেরিয়ে গেলে টাকাটা মেয়েরই প্রাপ্য হবে। সীমার কুড়ি বছর পূর্ণ হওয়ার দিন সাতেক আগে এই বাড়িতে তুই এসে পড়েছিলি তোর বোনের সঙ্গে। কাজেই ওই টাকাটা এখন তোর প্রাপ্য। কীভাবে সেটা তুই খরচ করবি সেটা আমাদের জানার দরকার নেই।
সীমা হাঁ করে মায়ের কথা শুনছিল, এবার বলে উঠল, ঈস্! দাদা যদি এলই, তবে সাত দিন পরে আমার জন্মদিনটা পার করে এল না কেন? এতগুলো টাকা হাত ফসকে চলে গেল।
দুঃখ করিস না বোন, কাজল হাসল, ওই টাকা তোরই থাকবে। ওখানে হাত দেওয়ার দরকার হবে না।
আমি ঠাট্টা করছিলাম দাদা, সীমা গম্ভীর হয়ে গেল, তুমি স্বচ্ছন্দে ওই টাকাটা নিতে পারো। তুমি যখন আমাদের ভার নিচ্ছ, তখন আলাদা করে আমার টাকার দরকার হবে কেন?
কাজল কিছু বলার আগেই শ্রীময়ী বললেন, তর্কের দরকার নেই। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে আর্থিক সমস্যাটা আমাদের সমস্যা নয়, কিন্তু আসল সমস্যা সম্পর্কে আমরা যে-অন্ধকারে ছিলাম, এখনও সেই অন্ধকারেই আছি। কাজল, সময় নষ্ট না করে জোসেফ সম্পর্কে যা জানিস, আমাদের বল। তোর মতো ছেলেও যাকে ভয় পায়, সে নিশ্চয়ই ভয়ংকর মানুষ।
শুধু ভয়ংকর নয়, কাজল বলল, ভয়ংকর বললে তাকে কিছুই বলা হয় না! জোসেফ হচ্ছে এক অমানুষিক মানুষ, যার সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। আইন তাকে ছুঁতে পারবে না। দৈহিক শক্তি দিয়ে তার মোকাবিলা করতে হলে পৃথিবীর সব চাইতে শক্তিমান মানুষও পরাজিত হবে।
ভীত কণ্ঠে সীমা বলল, তোমার মতো দুর্ধর্ষ মানুষও যদি তাকে ভয় পায়, তাহলে আমরা তার কবল থেকে আত্মরক্ষা করব কেমন করে?
আমরা পালিয়ে যাব! জোসেফ আমাদের সন্ধান পাবে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে ঘুরে কয়েকটা মাস আমরা কাটিয়ে দেব। এই সময়টা পার হয়ে গেলেই আমরা নিরাপদ। কারণ, এটা প্রতিশোধের ব্যাপার নয়— শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কাতেই লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। সামনে থেকে আমরা সরে গেলে সে আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে বটে, কিন্তু সেই ক্রোধ নিতান্তই সাময়িক। জোসেফকে যতদূর জানি, বিনা প্রয়োজনে অনর্থক প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি তৃপ্ত করার জন্য সে আমাদের সন্ধানে সময় নষ্ট করবে না। আধার ভাঙলে সে অন্য আধারের সন্ধানে মানোনিবেশ করবে।
–আধার!… মানে পাত্র?
–হ্যাঁ।
দাদা! আবার হেঁয়ালি? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।
–না, না রাগ করিস না কাজল ব্যস্ত হয়ে উঠল, আসলে জোসেফ লোকটাই এক মূর্তিমান রহস্য, তার সম্বন্ধে সব কিছু খুলে না বলে মাঝখান থেকে কিছু বললে হেঁয়ালির মতোই মনে হবে। আচ্ছা, এবার মন দিয়ে শোন, তুমিও শোনো মা।
কয়েকমাস আগের কথা। সীমার সঙ্গে যে রাতে নাটকীয়ভাবে আমার পরিচয় ঘটল, সেই রাতেই আমি জোসেফের সঙ্গেও পরিচিত হলাম একটা রেস্তোরাঁর মধ্যে। লোকটা নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল। কিছুক্ষণ আজেবাজে কথা বলে সে শয়তানের উল্লেখ করল–
শ্রীময়ী ও সীমা দুজনেই চমকে গেলেন, শয়তান! তার মানে?
ব্রেজিল থেকে যে কালো জাগুয়ারটাকে আমদানি করা হয়েছিল, তার নাম দিয়েছিলাম শয়তান। কথাটা একটু আগেই বলেছি, তোমরা ভুলে গেছ। এখন যা বলছি, মন দিয়ে শোনো। শয়তান নামকরণ সার্থক হয়েছিল। এমন বেয়াড়া জানোয়ার নিয়ে আগে কখনো খেলা দেখাইনি। অনেক চেষ্টা করেও জন্তুটাকে যখন বাগ মানাতে পারলাম না–
বাধা দিয়ে সীমা বলল, বাঃ! আমি তো সার্কাসে ওই কালো জাগুয়ারের খেলা দেখেছি। জন্তুটা তোমার কথায় পোষা কুকুরের মতো খেলা দেখিয়েছে, প্রতিটি আদেশ পালন করেছে নির্বিবাদে।
আহা! আমার বক্তব্য তো এখনো শেষ হয়নি। তুই বড়ো অসহিষ্ণু সীমা। ধৈর্য বলে কোনো পদার্থ তোর মধ্যে নেই।
-ঠিক আছে। আমি আর একটাও কথা বলব না। কিন্তু জাগুয়ার নিয়ে আমি গবেষণা শুনতে চাই না। আমি জোসেফের কথা শুনতে চাই।
–জাগুয়ারের প্রসঙ্গ অকারণে তুলিনি। মাঝখানে বাধা দিলে কথার খেই হারিয়ে যায়। কি যেন বলছিলাম… হ্যাঁ, যে রাতে তোর সঙ্গে পরিচয় হল, সেই রাতে আমি তোদের বাড়িতেই আসছিলাম। ইচ্ছে ছিল, বাবার সঙ্গে দেখা করব। বাবার সঙ্গে দেখা হল না, তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে খুবই বিচলিত হয়েছিলাম। অবশ্য তোদের সামনে আমার মনোভাব প্রকাশ করিনি। মা যে আমায় চিনতে পেরেছিলেন, সেটাও বুঝেছিলাম। মা-ই সেটা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কায়দা করে কিছু টাকা ফেলে এলাম, কিন্তু মনটা তোদের জন্য ভীষণ ছটফট করতে লাগল। ক্ষুধাবোধ একেবারেই ছিল না, কিন্তু তৃষ্ণা পেয়েছিল ভীষণ। ঠান্ডা কিছু গলায় ঢালার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। সেই সঙ্গে এক জায়গায় একা একা বসে মনটাকে শান্ত করারও প্রয়োজন বোধ করছিলাম। অত রাতে কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে কোনো ভালো রেস্তোরাঁ খোলা থাকে না। তাই চৌরঙ্গি এলাকায় এসে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে ঠান্ডা পানীয় চাইলাম। সেখানেই জোসেফের সঙ্গে আলাপ। সোজাসুজি কোনো কথা না বলে ইঙ্গিতে জোসেফ বুঝিয়ে দিল আমার সমস্যা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবহিত– অর্থাৎ ব্রেজিল থেকে আমদানি করা বিপদ নিয়ে যে আমি অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়েছি, সে কথা তার অজানা নয়। অবাক হয়ে গেলাম। দুদিন পরে খেলা, এখনো জন্তুটাকে বাগ মানাতে পারিনি তাই নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার কথা বাইরের লোক জানবে কী করে?… শুধু এখানেই শেষ নয়, আমার আসল নামটা তার মুখে শুনে চমকে উঠেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশে হয়তো সে আমার খেলা দেখেছে, এখানে এসে আমায় চিনতে পেরেছে। একটু ভাবতেই ভুল ভাঙল। বিদেশে আমি খেলা দেখিয়েছি অঞ্জন ঘোষ নামে, কাজল চৌধুরী নামটা তো কারও জানা সম্ভব নয়! শয়তানকে নিয়ে আমার সমস্যার কথাই বা সে জানল কী করে?… সমস্যার সমাধান করে দিল জোসেফ স্বয়ং। বলল, আপনার বিপদের স্বরূপ আপনি জানেন না, চিনে নিন বলেই তার বাঁ হাতের অনামিকাতে বসানো একটা আংটি আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। আশ্চর্য ব্যাপার আংটির চৌকো কালো পাথরটা স্বচ্ছ হয়ে গেল, ফটে উঠল একটি পরিচিত প্রতিমর্তি। সেই প্রতিমর্তির দিকে তাকিয়ে জোসেফ বলল, মিঃ চৌধুরী, আপনার বিপদের সত্যিকার চেহারাটা দেখে নিন। সীমা ভাবতে পারিস আংটির দর্পণে কার চেহারা ফুটে উঠেছিল?