এখানেও চালাকি!… বেশ মানলাম এটাও পুরোপুরি মিথ্যে বলোনি। কিন্তু বাবার নামটা কি ঠিক বলেছিলে?
–ঠিকই বলেছিলাম। ভেবে দ্যাখ।
-বলেছিলে বিশ্বনাথ ঘোষ… ওঃ হো? মহাদেবের আর এক নাম বিশ্বনাথ! ঘোষ উপাধিও সত্যি, তবে ব্যবহার করা হয় না বলে খেয়াল করিনি। দাদা! খুব ধোঁকা দিয়েছে আমাদের!
বহুবচন ব্যবহার করিস না সীমা, শ্রীময়ী হাসলেন, আমি হতভাগাকে চিনতে পেরেছিলাম।
আর তখনই বুঝি অঞ্জন ঘোষের খোলস ছিঁড়ে কাজল চৌধুরীকে আবিষ্কার করলে? কাজল হেসে বলল, আসলে হাতের জডুলটা হঠাৎ তোমার চোখে পড়ে গেল, তাই ধরা পড়লাম। না হলে আমায় চিনতে পারতে না।
না রে কাজল, শ্রীময়ী বললেন, আগেই সন্দেহ হয়েছিল। বিশ বছরে অনেক বদলে গেছিস, কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারিসনি। তবে জডুলটা দেখার পর যেটুকু সন্দেহ ছিল, সেটুকুও চলে গেল নিশ্চিত বুঝলাম, গুণধর ছেলে বাপকে একবার দেখতে এসেছে।
শুধু বাপকে নয়, কাজল চোখ টিপে হাসল, যে অত্যাচারী মহিলাটির থাপ্পড় খেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম, তার জন্যও বড়ো মন কেমন করছিল।
তাহলে চোরের মতো পালিয়ে গেলি কেন?
–কেমন যেন সঙ্কোচ হল। হয়তো পরে আসতাম।
বাজে কথা, ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল সীমা, আমাকে তুমি সার্কাসের তাঁবুতে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছ। মাকেও তোমার কথা জানাতে নিষেধ করেছিলে। আজ তুমি আমাদের কাছে এসেছ বটে, কিন্তু সেদিন পর্যন্ত তুমি আমাদের এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করেছ। আমার কথা অস্বীকার করার চেষ্টা করো না দাদা।
অস্বীকার করছি না বোন, সত্যি কথাই বলছি। প্রথমে সঙ্কোচ হয়েছিল বলেই পরিচয় দিইনি। পরে নিশ্চয়ই আসতাম, পরিচয়ও দিতাম। কিন্তু তারপরই বাধা এল।
–বাধা! কীসের বাধা?
কাজলের মুখের হাসি হঠাৎ মিলিয়ে গেল, শুষ্কস্বরে সে বলল, বাধা দিয়েছিল জোসেফ।
আমাদের সে চিনল কী করে? সীমা সবিস্ময়ে বলল, মাকে সে কখনো দেখেনি। সার্কাসে সে আমায় দেখতে পারে, কিন্তু তার আগে আমার অস্তিত্ব তার জানার কথা নয়। অবশ্য তোমার মুখ থেকে আমাদের কথা সে জানতে পারে বটে।
আমি তাকে কোনো কথাই বলিনি, ক্লান্তস্বরে কাজল বলল, আমার বলাবলির অপেক্ষা রাখে না সে। আমি তাকে কিছু বলার আগেই আমার মা আর বোনের খবর সে আমাকেই জানিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তাদের থেকে দুরে না থাকলে আমার অমঙ্গল হবে। মা-বোনের সংস্রব নাকি আমার পক্ষে ক্ষতিকর।
আবার একটা হেঁয়ালি, সীমা রুষ্টকণ্ঠে বলল, আমাদের কথা সে কেমন করে জানল? ওই জোসেফ নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগই বা হল কী করে? তোমার আত্মকাহিনি তো শুনলাম, এবার জোসেফের রহস্যটা একটু পরিষ্কার করে। একটা অজানা আতঙ্কের ভাব আমার ভালো লাগছে না, দাদা।
হ্যাঁ, জোসেফের ব্যাপারটা তত তাদের বলতেই হবে, কাজল বাঁ হাতের কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল, এখন খাওয়ার ঝামেলা সেরে ফেলা যাক। অনেক রাত হয়েছে। খাওয়ার পর জোসেফের কথা বলব। সতর্ক হওয়ার জন্য বিপদের সত্যিকার চেহারাটা তোদেরও জেনে রাখা দরকার।
৭. দর্পণ ও আধার!
রাত বারোটা। খাওয়া-দাওয়া শেষ। মা আর মেয়ের শয়নকক্ষেই মেঝের উপর কাজলের শয্যা প্রস্তুত হয়েছে। খাটের উপর মা ও মেয়ে, নিচে কাজলের বিছানা। কাজলের নির্দেশেই ওই ব্যবস্থা। শ্রীময়ী ও সীমা বুঝেছিল কোনো অজানা বিপদের আশঙ্কাতেই একঘরে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করেছে কাজল। পারিবারিক পরিবেশ এর মধ্যেই যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠেছে। নিজের অজ্ঞাতসারেই সীমাকে তুমি ছেড়ে তুই বলেছে কাজল এবং সীমার ব্যবহারেও ছোটো বোনের অধিকার-বোধ এখন অতিশয় স্পষ্ট। সম্ভবত অজ্ঞাত বিপদের আশঙ্কাই অল্পসময়ের মধ্যে দূরের মানুষদের কাছে টেনে এনেছে।
কোনো ভূমিকা না করেই কাজল বলল, অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়াই উচিত ছিল। তবু এখনই শুয়ে পড়া চলবে না। জোসেফের বৃত্তান্ত আজ রাত্রেই তোমাদের জানানো দরকার। শিয়রে শমন নিয়ে নিশ্চিন্তভাবে ঘুমানো উচিত হবে না।
আমরা তো শুনতেই চাই, সীমা বলল, তুমি যখন বাড়িতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে এই ঘরে তোমার শোয়ার ব্যবস্থা করতে বললে, তখনই বুঝলাম আজ রাত্রে কোনো বিপদের আশঙ্কা করছ তুমি। দাদা, তুমি বাড়ি আছ এটা মস্ত ভরসা। তবু বিপদের সঠিক চেহারাটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। মোটামুটি একটা কথা অবশ্য বুঝতে পারছি;– অজানা বিপদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে জোসেফ নামে রহস্যময় মানুষটি।
নির্ভুল অনুমান।
-দাদা, আজকের রাত হয়তো নিরাপদেই কাটবে। কারণ, তুমি রয়েছে। কিন্তু এভাবে অজানা আশঙ্কার মধ্যে দিনের পর দিন কাটাব কি করে? প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আমাদের পাহারা দেওয়া তোমার পক্ষেও সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার স্কুল আছে, সন্ধ্যার পর মেয়ে পড়ানোর কাজগুলো রয়েছে, আমাকে তো দিনে-রাতে বাইরে বেরোতেই হবে। বিপদের হামলা আমার উপর যখন-তখন হতে পারে।
-স্কুল আর মেয়ে-পড়ানোর ব্যাপারটা এখন ভুলে যা সীমা। তবে তোর কথাটা সত্যি প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তোদের চোখে চোখে রাখা সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও নেই। আজকের রাত ভালোয় ভালোয় কেটে গেলে ভয়ের কারণ আর থাকবে না।
সে কী? জোসেফ কি তোমায় বলেছে যা-কিছু করার আজ রাতেই করবে! আজ যদি সে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কখনো আমাদের উপর সে হামলা করবে না এমন কথা অবিশ্বাস্য। দাদা, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।