আমার রক্ষাকর্তা দেখেছিল আমি গুণ্ডাদের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি, দস্তুরমতো লড়াই করেছিলাম। আমার সাহস আর ঘুসি চালানোর কায়দা তার ভালো লেগেছিল। তার কাছে প্রস্তাব করতেই সে আমায় মার্শাল আর্টের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে রাজি হল। কিছুদিন তার কাছে ব্যাপারটা বুঝে নিলাম। অত্যন্ত কঠিন সাধনার ব্যাপার। কয়েকমাসে কিছু আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আমার রক্ষাকর্তা বা শিক্ষক যা-ই বলো, ইতালিতে ব্যবসা করত। আমাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমাকে সার্কাসের খেলার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হত। বুঝলাম, এভাবে কিছু হবে না। সার্কাস পার্টিতে ইস্তফা দিলাম। তারপর আমার শিক্ষক তোজোর পরামর্শ অনুসারে তারই চিঠি নিয়ে জাপানের একজন ক্যারাটেকা অর্থাৎ ক্যারাটে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করলাম। আমায় নানাভাবে পরীক্ষা করে ওই ক্যারাটেকা আমায় উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শিক্ষা দিতে সম্মত হলেন। একসময় বক্সিং শিখেছিলাম, সেটা এবার কাজে লাগল। কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সাধনায় কিছুটা সিদ্ধিলাভ করলাম। এর মধ্যে অন্য ওস্তাদের কাছেও গেছি। ক্যারাটে, হপকিভো, কুংফু প্রভৃতি মার্শাল আর্টের কৌশলগুলিকে যথাসাধ্য আয়ত্ত করলাম। এর মধ্যে টাকা ফুরিয়ে এসেছিল, সুতরাং আবার ফিরে গিয়ে ইউরোপের এক সার্কাস দলে যোগ দিতে বাধ্য হলাম। কয়েক বছরের ওই ঘটনাবহুল জীবনেও বাবার কথা মনে হত, আর–
সীমা প্রশ্ন করল, আর কী? থামলে কেন?
–আর নতুন-মায়ের কথাও মনে পড়ত বার বার। সত্যিকার ভালোবাসা বোধ হয় মানুষ ভুলতে পারে না। তাই নতুন-মাকেও বার বার মনে পড়ত। মাতৃস্নেহের মর্যাদা দিইনি বলে একটা অপরাধ বোধও মনকে পীড়া দিত। অবশেষে হঠাৎ সুযোগ হল ভারতে আসার। ভারতে এক সার্কাস-ব্যবসায়ী তখন আমেরিকায় ছিল। দৈবক্রমে আমিও সেই সময় আমেরিকাতেই বিভিন্ন স্থানে খেলা দেখাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক তো আমার খেলা দেখে মুগ্ধ; আমার সঙ্গে দেখা করে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমাকে তার ভারতীয় সার্কাসে যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। বলাই বাহুল্য, তৎক্ষণাৎ রাজি হলাম। যে-পার্টিতে সেই সময়ে কাজ করছিলাম, তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ তখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই নতুন দলে যোগ দিতে বাধা ছিল না। কিন্তু একটা দুষ্কর্ম করে ফেললাম।
দুষ্কর্ম! সীমা বিস্মিত হল, সেটা কী রকম?
শ্রীময়ীর কৌতূহল দৃষ্টিও সঞ্চালিত হল ছেলের মুখের উপর।
কাজল বলল, আমি যেখানে কাজ করতাম, সেই সার্কাস পার্টি আমার অনুরোধে একটা ব্ল্যাক জাগুয়ার কিনেছিল।
সীমা বলল, ব্ল্যাক জাগুয়ার। সেটা কি বস্তু?
শ্রীময়ী বলে উঠলেন, দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে, বিশেষত ব্রেজিলে জাগুয়ার নামে এক ধরনের বিড়াল জাতীয় জানোয়ার পাওয়া যায়। জাগুয়ারের চেহারা অনেকটা লেপার্ড বা চিতাবাঘের মতো। তবে চিতাবাঘের চাইতে জাগুয়ার বড়ো হয়, গায়ের জোরও তার বেশি। ভীষণ হিংস্র জন্তু। ওদের মধ্যে কোনো কোনোটা একেবারে কুচকুচে কালো। ইংরেজিতে তাদেরই ব্ল্যাক জাগুয়ার বলা হয়।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে শ্রীময়ীর দিকে তাকাল কাজল, সত্যি, এসব খবরও তুমি রাখো!
মুখ টিপে হেসে শ্রীময়ী বললেন, অবসর সময়ে একটু-আধটু বই পড়ার অভ্যাস ছিল। ওইসব বই-এর দৌলতেই কিছু কিছু তথ্য জানতে পেরেছি।
সীমা আবার ধৈর্য হারাল, ব্ল্যাক জাগুয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমি জানতে চাই না। জন্তুটাকে নিয়ে তুমি কোন দুষ্কর্ম করলে তাই বলল।
কাজল বলল, জাগুয়ার নিয়ে, বিশেষত কালো জাগুয়ার নিয়ে খেলা দেখানো খুব কঠিন। কিন্তু কঠিন কাজ সম্পন্ন করতেই আমার বেশি ভালো লাগে। সার্কাসের মালিককে বলে কয়ে ওই জানোয়ারটা কেনার ব্যবস্থা করলাম, তারপর বিমানযোগে সেই জ্যান্ত বিভীষিকাকে নিয়ে আমরা ফিরলাম ভরতবর্ষে।
-কিন্তু এর মধ্যে তোমার দুষ্কর্মের কোনো সন্ধান তো পাচ্ছি না।
সবটা শোন। জন্তুটার নাম দিয়েছিলাম শয়তান। এমন সার্থকনামা জীব আমি দেখিনি। আফ্রিকার সিংহ থেকে শুরু করে সাইবেরিয়ার দুর্দান্ত বাঘ পর্যন্ত অনেক রকম হিংস্র জন্তু জানোয়ার নিয়ে খেলা দেখিয়েছি, কিন্তু শয়তান নামে এই ব্ল্যাক জাগুয়ারকে কিছুতেই বাগ মানাতে পারলাম না। ওদিকে সার্কাসে খেলা শুরু হওয়ার দিন স্থির হয়ে গেছে, শহরে পোস্টার পড়েছে– আমি ভেবেই পাচ্ছি না কী করব- সীমা, আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিস?
পারছি দাদা। তবে এবার তোমাকে যখন পেয়েছি, আর সার্কাসের তাঁবুতে তোমায় ফিরতে দেব না। এসব ভয়ানক জন্তুকে নিয়ে খেলা দেখালে যেকোনো সময়ে বিপদ হতে পারে।
—তা তো পারেই। একবার একটা বাঘ আমার পাঁজরে থাবা বসিয়েছিল। সেই দাগও তোদের চোখে পড়েছিল। মনে পড়ে? নখের আঁচড়ে তিনটি সমান্তরাল ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছিল।
–তুমি কিন্তু মিছে কথা বলেছিলে। বলেছিলে একটা বনবেড়াল আঁচড়ে দিয়েছে।
-মোটেই মিছে কথা বলিনি। বাঘ হচ্ছে বিড়াল জাতীয় প্রাণী। ইংরেজিতে বাঘ-সিংহকে বিগ ক্যাট বলে।
চালাকি! ঘুরিয়ে মিছে কথা বলেছ।
-উঁহু। তোদর কাছে আমি একবারও মিছে কথা বলিনি। নিজের নাম বলেছিলাম অঞ্জন ঘোষ। অঞ্জন মানে যে কাজল তা তো জানিস। ওই নামটাই অবশ্য সর্বত্র চালু করেছিলাম, তোদেরও তাই বলেছি। তারপর পদবিটাও মিছে বলি নি। আমরা তো আসলে ঘোষ, উপাধি চৌধুরী। বাবা বলতেন ঘোষ চৌধুরী শুনতে ভালো নয়, তাই তিনি ঘোষ উড়িয়ে দিয়ে শুধু চৌধুরী বলতেন। আমি চৌধুরী উড়িয়ে দিয়ে ঘোষকেই প্রাধান্য দিয়েছি। মিথ্যেটা কোথায় বললাম?