শ্রীময়ী হেসে বললেন, বুঝে দ্যাখ সীমা, তোর মায়ের জোর কতখানি। একটা পনেরো-ষোল বছরের ছেলেকে বাড়ি থেকে ছিটকে ফেলে দিলাম এক থাপ্পড়ে!
সীমা হাসল না, মায়ের দিকে দৃকপাত না করে কাজলকে বলল, কোথায় পালালে? এতদিন কোথায় ছিলে? সব বলতে হবে।
কাজল চুপ করে রইল। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শ্রীময়ীর পায়ের দিকে।
শ্রীময়ী বললেন, আগের ব্যাপারটা জানা থাকলেও গৃহত্যাগের পরবর্তী অধ্যায়টা আমারও জানা নেই। বল না হতভাগা, বাড়ি ছেড়ে কোথায় গেলি?
কয়েকদিন আগে একটা সার্কাস দেখে এসেছিলাম। সার্কাসে বাঘের খেলা দারুণ ভালো লেগেছিল। আরো ভালো লেগেছিল সেই লোকটাকে, যে বাঘের খেলা দেখাচ্ছিল। তাকে গিয়ে ধরলাম, বললাম, সার্কাসে বাঘের খেলা শিখতে চাই। লোকটা তো প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দিল। আমি না-ছোড়বান্দা। বললাম, বাপ-মা নেই। পিসি আর পিসেমশাইয়ের কাছে থাকি। তারা খেতে দেয় না, অত্যাচার করে–
দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে শ্রীময়ী বললেন, এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলতে আটকাল না?
কাজল হেসে ফেলল, কই আর আটকাল? তাছাড়া আত্মরক্ষার জন্য মিছে কথা বললে দোষ হয় না। যাইহোক, অনেকক্ষণ কাকুতি-মিনতি করবার পর লোকটার মন গলল। বলল, যদি পুলিশের হাঙ্গামা হয় তাহলে কী হবে? জোর দিয়ে বললাম হাঙ্গামার সম্ভাবনা নেই, আমি চলে গেলে পিসি আর পিসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। লোকটা আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। বুক আর হাতের পেশি টিপে বলল, না-খেয়ে এমন চেহারা বাগানো যায় না। বললাম, একটা আখড়ায় বক্সিং লড়ি আর ব্যায়াম করি– আখড়ার শিক্ষক ভালোবাসে, তাই নিজের পয়সায় খাওয়ায়। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। জানকীবাবু ছিলেন বক্সিং-এর গুরু, সত্যিই খুব ভালোবাসতেন আমাকে–~ তবে খাওয়ানোর কথাটা যে মিথ্যে, তা তো বুঝতেই পারছ। লোকটাকে শেষ পর্যন্ত জমিয়ে ফেললাম, তারপর আর বাড়ি ছাড়তে কতক্ষণ? সার্কাস পার্টির সঙ্গে প্রথমেই গেলাম মাদ্রাজে যাওয়ার আগে অবশ্য বালিশের নীচে বাবাকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলাম—
একটু থেমে শ্রীময়ীর দিকে তাকাল কাজল, চিঠিটা নিশ্চয়ই পেয়েছিলে তোমরা?
শ্রীময়ী ঘাড় নাড়লেন। পেয়েছিলেন। তবে খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। মহাদেবই বারণ করেছিলেন। যে-ছেলে এমনভাবে মা-বাপকে ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে, তাকে ফিরিয়ে আনতে চাননি তিনি। শ্রীময়ীর আবেদন আর অনুনয়ও ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর কাছে।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কাজল। সীমা হঠাৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল, তারপর কি হল? তুমি কি সেই সার্কাস পার্টির সঙ্গে এই বিশ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছ? এর আগে একবারও কলকাতায় আসোনি? একবারও মনে পড়েনি আমাদের কথা?
কাজল সস্নেহে বলল, না, বোনটি, তোমার কথা মনে পড়েনি। তোমার অস্তিত্বই তো জানতাম না তখন। তবে বাবা আর মায়ের কথা মনে পড়েছে বার বার। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দেখা করব কেমন করে? আমি তো এখানে অর্থাৎ ভারতবর্ষে ছিলাম না।
–তবে কোথায় ছিলে?
–ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সার্কাস দলের সঙ্গে ঘুরেছি। একবার জাপানেও গিয়েছিলাম।
–জাপানেও গেছ? ওই সার্কাস পার্টির সঙ্গে?
না। তবে সব কথা খুলেই বলি। ইউরোপ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল ভাগ্যের কৃপায়। মাদ্রাজে থাকতে আমার বুনো জানোয়ারের খেলা দেখে এক সাহেব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ওই সাহেব ছিলেন আমেরিকার বাসিন্দা। তার ভাই-এর সার্কাস পার্টি ছিল। এখানে নয়, ইউরোপে। সেই সাহেবই চিঠিপত্র লিখে ভাই-এর ওখানে আমার একটা চাকরির বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং আরও অনেক ঝঞ্জাট সামলে তিনি আমায় সাগরপাড়ে পাঠিয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানিতে তখনকার এক ভ্রাম্যমাণ সার্কাস-দলে আমি কাজ পেয়ে গেলাম। তারপর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি, ওই সার্কাস ছেড়ে অন্য সার্কাসে যোগ দিয়েছি। পরপর তিনবার বিভিন্ন সার্কাসে দল বদল করলাম। চতুর্থবার মোটা টাকার বিনিময়ে যোগ দিলাম আর একটি নতুন সার্কাস দলে। তাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলাম ইতালিতে। সেখানে একটা ছোটো শহরে এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হল।…
সেদিন সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরিয়েছি। নতুন দেশ দেখার কৌতূহল ছিল। কয়েকদিন পরে খেলা শুরু হবে, এখন ছুটি–মনটাও ছিল বেশ খুশিখুশি। হঠাৎ খেয়াল হল বেশ রাত হয়েছে, আশেপাশে দোকানগুলো অধিকাংশই বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে, সেগুলোতে বন্ধ করার তোড়-জোড় চলছে। ফিরে আসার জন্য পিছন ফিরলাম। সঙ্গেসঙ্গে কোথা থেকে চারমূর্তি এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াল। তাদের ভাষা না বুঝলেও ইঙ্গিতটা বুঝলাম; হাতের ঘড়ি আর পকেটের টাকা তাদের হাতে সমর্পণ না করলে পরিত্রাণ নেই। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। সামনের লোকটা চোয়ালে ঘুসি খেয়ে সটান শুয়ে পড়ল মাটির উপর।
এমন ব্যবহার বোধহয় আমার মতো লোকের কাছে গুণ্ডারা আশা করেনি। তারা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই আবার আঘাত করলাম– আরও একজন পেট চেপে ধরে বসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে তাদের দুই সঙ্গীর হাতে ঝক ঝক করে উঠল ধারাল ছুরি। আমি একটু পিছিয়ে প্রস্তুত হলাম আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য। সেদিন বোধহয় আমার মৃত্যই হত, কিন্তু রাখে হরি মারে কে? হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল আর একটি লোক। তারপরে ব্যাপারটা কি হল ঠিক বুঝতে পারলাম না, শুধু দেখলাম একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল গুণ্ডা দুটোর উপর এবং কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই আমার দুই আততায়ী লম্বমান হল রাজপথে। আগন্তুক আমার হাত ধরে ছুট দিল। গলির পর গলির গোলকধাঁধার ভিতর দিয়ে অনেকদুর এসে আমরা যখন আবার বড়ো রাস্তার উপর এসে পড়লাম, তখন আমার রক্ষাকর্তা হাত ছেড়ে দিল। এতক্ষণে আমার রক্ষাকর্তার মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম। মঙ্গোলীয় চেহারা। ইংরাজিতে ধন্যবাদ জানালাম। আমার সৌভাগ্য, লোকটি ইংরেজি ভাষাটা জানত। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচয় জমে উঠল। লোকটি জাপানি, মার্শাল আর্টে সুদক্ষ। প্রাচ্যদেশীয় পদ্ধতিতে ওই লড়াইয়ের কথা আগে শুনেছিলাম, এইবার চাক্ষুষ করলাম। সেদিনের পরিচয় পরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। আমাকে ঘেরাও হতে দেখেছিল সে, তাই ছুটে এসেছিল আমাকে বাঁচাতে। মার্শাল আর্টের কৌশল দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। ঝোঁক চাপল যেমন করেই হোক প্রাচ্যদেশীয় পদ্ধতিতে লড়াই-এর ওই কৌশল আমায় আয়ত্ত করতেই হবে।