গভীর পরিতাপে মাথা নীচু করল কাজল, পরিহাস করে বললেও কথাটা সত্যি–
–সে কী! কী অপরাধ করেছিলেন মা?
–মায়ের কোনো অপরাধ ছিল না। অপরাধ আমার।
–হেঁয়ালি ভালো লাগে না স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলল।
–স্পষ্ট করেই বলছি, শোনো। আমরা ভাই-বোন, কিন্তু তুমি আমার সহোদরা নও।
তার মানে?
মানে বুঝলি না? শ্রীময়ী হাসলেন, আমি ওর সম্রা, নিজের মা নই।
–বলো কী?
–ঠিকই বলছি রে সীমা। তোর বাবার প্রথম স্ত্রী যখন মারা গেলেন, কাজলের বয়স তখন দশ। আরও পাঁচ বছর পরে তোর বাবা আমায় ঘরে নিয়ে আসেন। আমি সেই বিয়েতে আপত্তি করিনি। সেটা আমার প্রথম অপরাধ। দ্বিতীয় অপরাধ যে, সতীনের ছেলেটার উপর দারুণ অত্যাচার চার্লিয়েছিলাম, তাই—
মা! কাজল উঠে দাঁড়াল, আমি জানি তুমি ঠাট্টার ছলে আমায় তিরস্কার করছ। কিন্তু তার দরকার আছে কি? আমি কি আমার অপরাধ স্বীকার করিনি? তোমার কথা সত্যি– বাবা দ্বিতীয়বার বিবাহ করায় আমি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। আত্মীয়-স্বজন, বিশেষ করে আমার এক বিধবা পিসি, প্রতিমুহূর্তে আমার মনে বিষ ঢেলেছে। তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি, তুমি আসায় অনেকেরই স্বার্থ বিপন্ন হয়েছিল। একটা নিঃসঙ্গ মানুষের যন্ত্রণা বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি, কুচক্রী আত্মীয় স্বজনের কথায় বাবার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। পরে সেই বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হয়েছিল। লজ্জার কথা কী বলব মা, তোমার সম্পর্কেও বিদ্বেষ পোষণ করতাম। অথচ তুমি আমার জন্য যথেষ্ট করেছ। নিজের ছেলের মতোই আমায় ভালোবেসেছিলে তুমি পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া, সিনেমা দেখা, সহ্য করোনি, শাসন করেছ নিজের ছেলের মতোই, আর তোমায় ভুল বুঝে বাবার উপর রাগ করে আমি ঘর ছাড়লাম।
তীব্র উত্তেজনায় ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘরে এসে হঠাৎ সীমার সামনে একটা মোডা টেনে নিয়ে বসে পড়ল কাজল, শোন সীমা, আমাদের মায়ের মতো মা হয় না। নিজের ছেলেকে তো সব মা-ই ভালোবাসে, পরের ছেলেকে নিজের বলে আপন করে নিতে পারে কয়জন? কিন্তু নতুন-মা ভস্মে ঘি ঢেলেছিলেন, তাঁর স্নেহের মর্যাদা আমি রাখতে পারিনি।
চেষ্টা সত্ত্বেও অবরুদ্ধ আবেগ দমন করতে পারল না কাজল, উত্তেজিত স্বরে বলতে লাগল, অল্প বয়সে মায়ের মৃত্যু দেখেছিলাম, কষ্টও পেয়েছিলাম খুব। পরে সেই কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম বাবার আদরে। তবে আমার দিকে বেশি মন দিতে পারেননি বাবা। তাঁর কাজকর্ম ছিল। সংসারের ভার পড়েছিল দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসির উপর। পিসি সংসার চালাত, বাবার টাকা পয়সা তার কাছেই থাকত। আমি চাইলে টাকা দিতে আপত্তি করত না পিসি। ছেলে যে আদর্শ ছাত্রের মতো জীবনযাপন করছে না সে-কথা বাবাও বুঝতেন না তা নয়, তবু মা-মরা ছেলেকে বোধহয় শাসন করতে পারতেন না। তার ফলে যা হয় তাই হল। কথায় বলে আদরে বাঁদর হয়। আমিও একদিকে বাবার ঔদাসীন্য আর অপরদিকে পিসির অবাধ প্রশ্রয়ে একটি আস্ত বাঁদর হয়ে উঠেছিলাম। নতুন-মা এসে সেই বাঁদরটাকে মানুষ করার চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলেন। আমার সেটা অসহ্য বোধ হত। আড়ালে মায়ের সম্পর্কে পিসির বিরূপ সমালোচনাও মনের উপর ক্রিয়া করত। ব্যাপারটা বোধহয় নতুন-মা বুঝতে পেরেছিলেন; কিছুদিন পরেই পিসিকে বিদায় নিতে হল। চোখের জলে ভেসে পিসি আমায় জানিয়ে গেল যে, নতুন মায়ের জন্যই তাকে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। তখন রাগ হলেও পরে বুঝেছিলাম আমার ভালোর জন্যই নতুন-মা পিসিকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। তবু একটা–
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, বহরমপুরে যেখানে তোর পিসি ছিল, সেখানে মাসে মাসে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ওই মহিলাটিকে এখানে রেখে তোমার পরকাল ঝরঝরে করতে পারিনি। ছেলের জন্য শক্ত হওয়ার দরকার ছিল।
একটু থেমে শ্রীময়ী আবার বললেন, বিয়ের পরেই উনি আমাকে বলেছিলেন ছেলেটা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, আমাকেই তাকে মানুষ করার ভার নিতে হবে। দ্বিতীয়বার বিবাহের সেটাই নাকি প্রধান কারণ। সেইজন্যই নির্বিকারভাবে তোকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করতে পারিনি, প্রয়োজনে শাসন করার চেষ্টাও করেছি– ফল হল উলটো।
শুধু কি শাসনই করেছ? কাজল শ্রীময়ীর দিকে তাকাল, আদরের কথাও আমার মনে আছে বৈকি। কত রাত্রে শোয়ার আগে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছ, উপদেশ দিয়েছ, কত সময়ে নিজে পড়াতে বসেছ সে-সব কথা কিছুই ভুলিনি, মা।
একটু থেমে আবার ফেলে-আসা কথার সূত্র ধরল অঞ্জন, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সীমা। মায়ের আদর মাঝে মাঝে ভালো লাগত, স্বীকার করতে লজ্জা নেই দুর্বল মুহূর্তে ভালো ভাবে চলার প্রতিশ্রুতিও দিতাম। তারপর আবার সব ভুলে যেতেও দেরি হত না। আসলে দীর্ঘকাল খুশিমতো চলার ফলে দস্তুর মতো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলাম, নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধন সহ্য করতে পারতাম না। একদিন লুকিয়ে সিনেমা দেখে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যার পর অঙ্ক করতে যেতাম, বন্ধুটি মেধাবী ছাত্র ছিল, অঙ্কে তার মাথা ছিল খুব পরিষ্কার। তাই বাবা কিংবা নতুন-মায়ের আপত্তি হয়নি। তারা জানতেন আমি সন্ধ্যার পর ওখানেই নিয়মিত অঙ্ক করি। কিন্তু মাঝে মাঝে সেখানে না গিয়ে ওই সময়টা যে আমি সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিতাম, সেটা কারো জানা ছিল না। দৈবক্রমে একদিন নতুন-মা আমার জামার পকেট হাতড়ে আগের দিনের পরিত্যক্ত সিনেমার টিকিট আবিষ্কার করলেন। নিতান্তই বুদ্ধির দোষ টিকিটটা ফেলে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। কে জানত যে, ভদ্রমহিলা হঠাৎ আমার জামার পকেট সার্চ করবেন! ধরা পড়তেই কৈফিয়ত তলব! আমি আজেবাজে কথা বলে ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতেই মুখের উপর একটা চড় পড়ল। বাবার কাছে কোনোদিন মার খাইনি, চড়টা পড়তেই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম, কিন্তু মনে মনে তখনই বাড়ি ছাড়ার সঙ্কল্প স্থির করে ফেলেছিলাম। পরের দিনই পালিয়ে গেলাম বাড়ি ছেড়ে।