তারা কেন বলেননি, তাঁরাই জানেন, অঞ্জন বলল, বাবা নেই, এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন মা। তবে তাদের নীরবতার কারণটা অনুমান করতে পারি। খুব সম্ভব ছেলের উপর অভিমানেই তারা চুপ করে থেকেছেন, আমার অস্তিত্বের কথাটা পর্যন্ত তোমাকে জানানো দরকার মনে করেননি।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমি হয়তো হারিয়ে-যাওয়া দাদার কথা সীমাকে বলতাম, কিন্তু ওর বাবা নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন যে-ছেলে বাপকে এমন নিষ্ঠুরভাবে আঘাত দিয়ে চলে যেতে পারে, তার অস্তিত্ব আমি কোনেদিন স্বীকার করব না, বলতে বলতে শ্রীময়ীর গলার স্বর ভারি হয়ে উঠল, কাজল, পুরুষমানুষের চোখের জল ফেলতেও দেখেছি। তাঁর কষ্ট লাঘব করার ক্ষমতা আমার ছিল না, তাই ওঁর চোখের জল দেখেও না-দেখার ভান করেছি। এই ব্যাপারে নিজেকেও কিছুটা দায়ী করেছি। কাজটা তোর উচিত হয়নি কাজল।
হ্যাঁ মা, সেটা অনেক পরে বঝেছি, সেই জন্যই তো প্রায়শ্চিত্ত করতে ফিরে এলাম কাজল বলল, কিন্তু মা তুমি নিজেকে দায়ী মনে করবে কেন? গৃহত্যাগের জন্য তোমাকে বা বাবাকে দায়ী করা যায় না, সব দোষই আমার। সুবুদ্ধি যখন হল তখন দেরি হয়ে গেছে বাবাকে আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু মা তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে না?
শ্রীময়ী উত্তর দিলেন না। তার ক্লিষ্ট অধরে স্নিগ্ধ হাসির রেখাঁটি নীরবেই তার মনোভাব প্রকাশ করে দিল।
সীমা এতক্ষণ চুপ করে ছিল, সামনে উপবিষ্ট যুবকটি তার বড়ো ভাই জেনেও আনন্দ বা উল্লাসের চিহ্ন তার মুখে দেখা দেয়নি। বোধহয় অপ্রত্যাশিত সংবাদের বিস্ময়কর চমকটা সে তখনও পরিপাক করে উঠতে পারেনি।
এবার নিজেকে সামলে নিয়ে সে মুখ খুলল, বুঝলাম আপনি—
বাধা দিয়ে কাজল বলল, আপনি নয় সীমা তুমি।
সীমার মুখে কাষ্ঠহাসি ফুটল, বেশ, না হয় তুমিই হল। অনেকদিন আগে, বোধহয় আমার জন্মেরও আগে আমার বড়ো ভাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল বুঝতে পারছি। কিন্তু রাতারাতি ছোটো বোনের অধিকার জাহির করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সংসারের দায়িত্ব যদি মা তাঁর বড়ো ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দেন, আমি সেখানে আপত্তি করতে পারি না।
কাজল বলল,বেশ ভাববাচ্যে চার্লিয়ে গেলে দেখছি। মাকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়া আমার অন্যায় হয়েছিল সেকথা তো আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু মা যখন আমায় ক্ষমা করেছেন সেখানে ছোটো বোন হয়ে তুমি দূরে সরে থাকবে কেন সীমা?
সীমা মাথা নীচু করল, সকলের চরিত্র সমান হয় না। সম্পর্কটা সত্য কাজেই আমিও তা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্ত থেকেই ছোটো বোনের দাবি নিয়ে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জোর করে আর যাই হোক, ভালোবাসা আদায় করা যায় না কাজল বুঝি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল, তবে তোমাকে আমার প্রথম দিন থেকেই খুব ভালো লেগেছিল। একটা আকর্ষণ বোধ করেছিলাম। হয়তো সেটাই রক্তের টান। যাইহোক আমার কর্তব্য করতে যদি বাধা না দাও, তাহলেই আমি খুশি হব। এর বেশি চাওয়ার অধিকার বোধহয় আমার নেই।
কাজলের কথার মধ্যে এমন একটা বেদনার্ত করুণ সুর ছিল যে, সীমার মনও বিচলিত হয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাজলের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব অনুমান করার চেষ্টা করল সীমা। নতমুখ যুবকের মুখে ছায়া পড়ায় ভাবের কোনো অভিব্যক্তি সীমার চোখে ধরা পড়ল না, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে হতাশা ও বিষাদ ছিল অতিশয় স্পষ্ট।
একমুহূর্তেই সীমা মনস্থির করে নিল, এগিয়ে এসে কাজলের কাঁধে হাত রাখল সে, দাদা, তুমি যে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলে সেটা বুঝতে পারছি। কেন গিয়েছিলে? এতদিন ছিলেই বা কোথায়? এই প্রশ্নগুলো আমার মনে ভিড় করছে। সংক্ষেপে হলেও মোটামুটি সব কথা আমায় বলতে হবে। একটা কথা তো মানবে- মায়ের পক্ষে তোমায় গ্রহণ করা যত সহজ আমার পক্ষে সেটা তত সহজ নয়।
কাজলের একটা হাত সীমার হাতের উপর এসে পড়ল, প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই সরে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও সেই স্নেহের স্পর্শ বুঝতে সীমার ভুল হল না। একটু থেমে বোধহয় অন্তরের আবেগ সংহত করে নিয়ে কাজল বলল, আমার সব কথা শোনার অধিকার তোমাদের আছে। যদিও সময় বেশি নেই, তবু সংক্ষেপে সব কথা বলছি। এখন থেকে
বাধা দিয়ে সীমা বলল, সময় নেই বলছ কেন? এখানেই যা হোক কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়বে। কাল সকালে যা ভালো হয় করো।
না রে সীমা, কাজল হাসল, কাল তো নয়ই, আর কোনোদিনই সার্কাসে ফিরব না। তোদের আশ্রয়েই থেকে যাব। সার্কাসের মালিক হয়তো ঝঞ্জাট করতে চাইবে, তবে তাকে বোধহয় আমি অসুবিধার দিকটা বোঝাতে পারব। কিন্তু
-সত্যি! সত্যিই তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে দাদা?
-হ্যাঁ রে সত্যি। অবশ্য মা যদি আমায় তাড়িয়ে না দেন।
শ্রীময়ী কপট ক্রোধে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন, হ্যাঁ রে বেইমান ছেলে! মা-ই তো তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ বছর আগে।
বিশ বছর আগে! সীমা সবিস্ময়ে বলল, বিশ বছর আগে তুমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলে? কিন্তু কেন?
কেন আবার, মায়ের উপর রাগ করে, শ্রীময়ী বললেন, আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছিলাম, তাই আমায় শাস্তি দিতেই গৃহত্যাগ করেছিলেন গুণধর ছেলে।
যাঃ? কী যা-তা বলছ সীমা মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে দাদার দিকে তাকাল, বলো না দাদা, কেন পালিয়েছিলে বাড়ি থেকে?