–সায়েব! সে কী রে!
-হ্যাঁ গো, মা। যাও না দেখে এস। কী সব কইছে, আমি বুঝতে নারি।
মালতির মায়ের মুখে হঠাৎ এক সাহেবের আগমন-সংবাদ শুনে শ্রীময়ী অবাক হয়ে গেলেন।
এখানে মালতির মা নামক আধবয়সী দাসীটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। মালতির মা ঠিকা কাজ করে বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়িতে। শ্রীময়ীর বাড়িতেও কাজ করে সে। সকাল-সন্ধ্যা এসে শ্রীময়ীর সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে দেয়, দুপুরে বা রাত্রে থাকে না। মালতি নামে কন্যাটির কথা আরও অনেকের মতো শ্রীময়ীও শুনেছেন, কিন্তু স্বচক্ষে তাকে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। শুধু তিনি নন, কোনোদিন কেউ মালতির মায়ের মেয়েটিকে চাক্ষুষ করেছে বলে শোনা যায় না। মেয়েটি নাকি তার মাসির বাড়িতে থাকে। তবে মেয়েটিকে না দেখলেও কন্যার নামেই বিখ্যাত হয়ে গেছে মালতির মা। অনেকের ধারণা মালতি নামে কোনো মেয়ের অস্তিত্ব নেই— মেয়ের অসুখের নাম করে সময়-অসময়ে টাকা চাওয়ার জন্য আর কাজ কামাই করার ছুতো হিসাবেই ওই মেয়েটিকে সৃষ্টি করেছে মালতির মা। শ্রীময়ীর সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যার পর সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে মালতির মা ভাবছিল মেয়ের অসুখের নাম করে এ সময়ে দশটা টাকা চাইবে। মেয়ের অসুখের কথা শুনেও দশটা টাকা দেবেন না এমন কঠিন-হৃদয় মহিলা নন শ্রীময়ী, কিন্তু সম্প্রতি তিনি মালতির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উ লে মনে হয় পর পর কামাই করার জন্য বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন বহুদিন– অতএব টাকাটা পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে মালতির মায়ের সন্দেহ ছিল যথেষ্ট। তবু কথা বলতে বলতে মনিবের মন বুঝে দশটা টাকার কথা পাড়বে বলে স্থির করেছিল মালতির মা, হঠাৎ দরজার কড়া সশব্দে নড়ে উঠতেই সে দরজা খুলতে ছুটল। ফিরে এসে সে যা বলল, তা আগেই বলা হয়েছে, পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
শ্রীময়ী এবার নিজেই অগ্রসর হলেন। শার্টপ্যান্ট আজকাল সবাই পরে, তাদের সায়েব বলে ঘোষণা করে না মালতির মা। বলে, একজন বাবু ডাকতিছে। নয়তো বলে, প্যাণ্টেলুন পরা বাবু বা ছেলে। হঠাৎ তার মুখে সায়েব শুনে একটু অবাকই হয়েছিলেন শ্রীময়ী।
অপরিচিত আগন্তুককে ভিতরে বসতে বলেনি মালতির মা, সে বাইরে অপেক্ষা করছিল।
দরজা খুলে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে লোকটিকে দেখলেন শ্রীময়ী। লম্বা চেহারা, পরনে নিখুঁত ইউরোপীয় পরিচ্ছদ, টুপির তলায় মুখের উপরিভাগ ছায়ার অন্ধকারে প্রায় অদৃশ্য শুধু ধারালো নাক আর সরু গোঁফের নিচে একটা ক্ষীণ হাসির আভাস চোখে পড়ে।
শ্রীময়ী কোনো প্রশ্ন করার আগেই নত হয়ে অভিবাদন জানাল আগন্তুক, আমি নিশ্চয়ই মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছি?
লোকটির গায়ের রং আর চেহারা দেখে তাকে বাঙালি বলে মনে হয় না, কিন্তু তার বাংলা উচ্চারণে বিন্দুমাত্র জড়তা নেই।
বিস্ময় চাপা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, হ্যাঁ, আমি মিসেস চৌধুরী। আমার কাছে আপনার কী দরকার? আপনাকে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
আগন্তুকের ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা বিস্তৃত হল, না, আমরা কেউ কাউকে আগে দেখিনি।
একটু ইতস্তত করে শ্রীময়ী বললেন, আপনি ভিতরে আসুন।
প্রয়োজন নেই, আগন্তুক বলল, আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত। কথাটা বলেই চলে যাব।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন শ্রীময়ী।
একটা অনুরোধ করছি, আগন্তুক একটু থামল, বোধহয় বক্তব্য বিষয় মনে মনে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, আপনি কাজল চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিন দেখা করার চেষ্টা করবেন না সে এখানে এলেও তাকে এড়িয়ে যাবেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে আপনার ক্ষতি হতে পারে।
শ্রীময়ী চমকে উঠলেন। তাঁর কান এবং মাথার ভিতর দিয়ে রক্ত চলাচল করতে লাগল দ্রুতবেগে। অপরিসীম বিস্ময় ও ক্রোধ সংবরণ করতে একটু সময় নিলেন তিনি, তারপর অনুচ্চ কঠিন স্বরে বললেন, আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আপনি কথা বলছেন কেন? দেখুন, মিঃ–
জোসেফ। আপনি আমায় জোসেফ নামেই সম্বোধন করতে পারেন।
–মিঃ জোসেফ, আপনার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আপনি কথা বলছেন কোন অধিকারে? আমি কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, আর কার সঙ্গে রাখব না, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
–আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত করে, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে আপনার ব্যাপারেও নাক গলাতে হবে। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি- কাজল চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না।
কারণটা কী? একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল জোসেফের পিছন থেকে, কাজল চৌধুরী মানুষটা কী খুব খারাপ? খুনে-গুণ্ডা বা ডাকাত গোছের কিছু?
সচমকে পিছন ফিরেই দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল আগন্তুক, বিনীত হাস্যে অভিবাদন জানিয়ে নবাগতাকে বলল, আসুন, সীমা দেবী। ভালোই হল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিস্মিত কণ্ঠে সীমা বলল, আপনি দেখছি আমায় চেনেন। আমি কিন্তু আপনাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
–ঠিকই বলেছেন সীমা দেবী। আমাকে আপনি কখনো দেখেননি।
—আপনি আমায় চিনলেন কেমন করে? কে আপনি? মায়ের মতো আপনিও অঞ্জনকেই কাজল বলছিলেন বোধহয়। উপরন্তু তার ঘোষ পদবিটাও বদলে চৌধুরী বানিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা কি বলুন তো।