- বইয়ের নামঃ রাত্রির সন্তান
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. অন্ধকারের অতিথি
জীবনের এক নিষ্ঠুর পাঠশালায় কঠিন শিক্ষার পাঠ নিয়েছে অঞ্জন চৌধুরী, দু-চারটে ছুরি-হাতে গুণ্ডাকে সে পরোয়া করে না কিন্তু এই অপরিচিত আগন্তুক তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে অঞ্জন প্রশ্ন করল, আপনার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে বলে তো মনে হয় না। আপনি আমার গুপ্তকথা জানলেন কেমন করে?
অন্ধকার আকাশের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে আগন্তুক বলল, ওখানে কী দেখছেন?
-ওখানে?… দেখছি, রাতের আকাশে জ্বলছে অসংখ্য তারা।
ওরা তারা নয়। অসংখ্য নক্ষত্রের অগ্নিময় চক্ষু মেলে মায়াবিনী রাত্রি তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে, পাহারা দিচ্ছে তার গোপন রহস্যের রত্নভাণ্ডার। সেই রত্নভাণ্ডারের রহস্য যার জানা আছে, পৃথিবীর কোনো বিষয় তার অজানা নয়। মায়াবিনী রাত্রি তার অসংখ্য নক্ষত্রের জ্বলন্ত চক্ষু মেলে যা দেখতে পায়, আমি মাত্র দুটি চক্ষুর সাহায্যেই তা দেখতে পাই। কারণ?… কারণ, আমি যে রাত্রির সন্তান!…
তারপরই শুরু হল ঘটনার পর ঘটনার আবর্ত… অঞ্জন একদিন সভয়ে দেখল যারা তার একান্ত আপন, তাদের দিকে থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে এক জীবন্ত বিভীষিকা!… সেই বিভীষিকার কবল থেকে অঞ্জন কি পারবে তার প্রিয়জনদের রক্ষা করতে?…
.
“আকাশের বুকে জ্বলছে অসংখ তারা… ওরা তারা নয়..অসংখ্য নক্ষত্রের অগ্নিময় চক্ষু মেলে মায়াবিনী রাত্রি তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে, পাহারা দিচ্ছে তার গোপন রহস্যের রত্নভাণ্ডার। পৃথিবীর মানুষ সেই রত্নভাণ্ডারের সন্ধান জানেনা।কিন্তু আমি জানি। কারণ?…আমি যে বাড়ির সন্তান!”
১৯৮২ সালে শুকতারা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় অলংকরণ সহ আধার গল্পটি। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালে একই গল্প নির্মল বুক এজেন্সি থেকে প্রকাশিত হয় রাত্রির সন্তান নাম দিয়ে। ওই বই-এর প্রচ্ছদচিত্রে ময়ুখ নিজের মুখের আদলে ছবি এঁকে ছিলেন। শিল্পীর ৫৫ বছর বয়েসে লিখিত আধার কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জন তথা কাজল (ঘোষ) চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তি ময়ুখ চৌধুরীর তথা (শক্তি)প্রসাদ রায়চৌধুরী-এর অনেক মিল পাওয়া যায়। উভয়েই দক্ষিণ কলকাতার দেবেন্দ্র রোডের বাসিন্দা, ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রবণতা, পশুপ্রেমী, মাঝারি চেহারার, দৃঢ় পেশীবদ্ধ নির্মেদ দেহের অধিকারী, কৈশোরে সিনেমাপ্রেমী, বক্সিং ও মার্শাল আর্টের প্রতি অনুরক্ত, স্ট্রিট ফাইট করেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। যদিও বইটিতে ময়ূখ লিখেছেন এই মৌলিক কাহিনির পশু ও মানুষের আত্মার বিনিময়ে আধার তত্ত্বের অংশটি বিদেশি কাহিনি থেকে বাংলা ভাষায় পরিবেশন করা হয়েছে। বাকি অংশটির সঙ্গে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের সার্কাস জীবনে মিল রয়েছে।
—প্রকাশক
“রাত্রির সন্তান ও অমানুষিক মানুষ দুটি আলাদা গল্প এবং প্রত্যেকটি গল্পই স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রথম কাহিনির সঙ্গে দ্বিতীয় কাহিনির গল্পের সূত্র ধরে যোগাযোগ না থাকলেও তত্ত্বের দিক থেকে সাদৃশ্য আছে। প্রথম গল্পটি মৌলিক, কিন্তু দ্বিতীয় কাহিনি অমানুষিক মানুষ বাস্তবে সংঘটিত ঘটনা, মনগড়া গল্প নয়। প্রথম ঘটনাটি যে-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লিখিত, সেটি যে নিতান্তই লেখকের কল্পনা-প্রসূত নয়, দ্বিতীয় কাহিনি তারই প্রমাণ। বলা বাহুল্য হলেও বলছি অমানুষিক মানুষ বিদেশির অভিজ্ঞতার কাহিনিকে বাংলা ভাষায় পরিবেশন করা হয়েছে।
–ভূমিকা, রাত্রির সন্তান
[অমানুষিক মানুষ গল্পটি আত্মা-দুরাত্মা নামে রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ডে অন্তর্গত।]
.
.
রাত্রির সন্তান (উপন্যাস)
০১. অন্ধকারের অতিথি
রাত খুব বেশি হয়নি, কিন্তু লোডশেডিং-এর কল্যাণে গলিটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে দেখা যায় একটি খালি রিকশার সামনে একটি তরুণীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মানুষ– চাপা গলায় বাদানুবাদ, নারীকণ্ঠের করুণ মিনতি আর পুরুষের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে পথ-চলতি পথিকের কানে।
কলকাতা শহরের বুদ্ধিমান মানুষ এইরকম দৃশ্য দেখলে দেখেও না দেখার ভান করে সরে পড়ে; কিন্তু যে-যুবকটি গলিপথে হেঁটে আসছিল, সে হয় নিতান্ত নির্বোধ আর নয়তো এই শহরে সে নবাগত- বর্তমান কলকাতার পরিস্থিতি সম্পর্কে সে আদৌ অবহিত নয়।
অতএব একটি লোক যখন তরুণীর হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তার পাশের লোকটি মেয়েটির করুণ প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে হাতঘড়িটা নেওয়ার উদ্দেশে তার হাত চেপে ধরেছে, ঠিক সেই সময়ে পথিকটি পাশ কাটিয়ে বুদ্ধিমানের মতো সরে না গিয়ে এগিয়ে এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করল আপনার ঘড়ির দরকার থাকলে কিনে নেবেন, দোকানে অনেক ঘড়ি পাওয়া যায়। দয়া করে ওঁর হাতটা ছেড়ে দিন।
গুণ্ডাটা চমকে উঠল, কিন্তু অনুরোধ রাখল মেয়েটির হাত ছেড়ে সে পিছিয়ে এল, সঙ্গেসঙ্গে তার ডান হাতে একটা ধারাল ছোরা অন্ধকারেও চকচক করে উঠল।
ছোরাটা উঁচিয়ে ধরে সে কর্কশ স্বরে বলল, তোমাকে দালালি করতে কে ডেকেছে? সোজা চলে যাও এখান থেকে।
পাশে দাঁড়ান দুই স্যাঙ্গাত জামার নিচে হাত দিল বোধহয় লুকানো অস্ত্র বার করার জন্য; কিন্তু তারা অস্ত্র বার করার আগেই ঘটল এক অভাবিত কাণ্ড–