তবে একথাও ঠিক অতীতকে আমি ডাক দিয়ে আনি নি—সে দরজা ভেঙে আমার বর্তমানে প্রবেশ করে বর্তমানের সঙ্গে মিশে গেছে। যার কথা চল্লিশ বছর শুনি নি, এই কমাস ধরে ক্রমাগত শুনছি। আমি শুনেছি ওর স্ত্রী আছেন কিন্তু কোনো সন্তান নেই। ওরা দুটি প্রাণী এক বাড়িতে থাকে, ও দিনরাত্রি নিজের লাইব্রেরীতে বইয়ে মুখ খুঁজে পড়ে থাকে। তার জীবনে বই পড়া ও লেখা ছাড়া আর কিছু নেই। কথাটা আমায় ভয় দেখাচ্ছে, তাহলে যে মানুষকে আমি দেখতে যাচ্ছি সে একটা পুরো মানুষই নয়। যার বুকের উপর, পায়ে নূপুর, চোখে কাজল, হাতে নাড়, বালগোপাল নৃত্য করে নি সে কি করে সম্পূর্ণতা পাবে? শুনছি তার স্ত্রী খুব পাহারাদার, কেউ কেউ বলছে, আমার কোনো চিঠি সে পায় নি। কিন্তু একথা আমার বিশ্বাস হয় না। আমার চিঠিতে এমন কিছু ছিল না যে সেজন্য সেটা দেওয়া হবে না। আমাকে সে ঈর্ষা করবেই বা কেন, আমি তো অতীতের একটা স্বপ্নমাত্র। সেই যে আঠারই সেপ্টেম্বর উনিশ শ’ ত্রিশ সালের দুপুরবেলা মির্চা আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল তারপর তার একটি চিঠি বা অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন আমি পাই নি। সেই দুঃখেই তো আমার বুকের একটা পাশ জ্বলে গিয়েছে, ধিকি ধিকি জ্বলছে—অবিশ্বাসের বিষাক্ত ধোয়ায় আমার ভালোবাসার শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। আর আজ এতদিন পরে শুনলাম সে কারু কাছে বলেছে-“আমি তাকে একটা ছবি পাঠিয়েছিলাম স্বর্গদ্বার থেকে, আমি তো তাকে লিখতে পারতাম না, তাই খোকার মাধ্যমে পাঠাতাম—ঐ ছবিতে আমার মুখে দাড়ি দেখে সে খোকাকে বলেছিল, ‘পাশ থেকে হেঁটে ফেলে যেন।”
আমি ভাবছি, তাই কি? এরকম ছবি কি আমি দেখেছি? কখন দেখলাম, কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম? আজকাল আমার কাছে উনিশ শ’ ত্রিশ সালের ঘটনাগুলো ছবির মত ভেসে উঠছে, আমি দেখতে পাই বাবা যখন বলছেন, “একমুখ দাড়ি রেখেছে”, তখন বাবা কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন, আমি কোথায় ছিলাম। কিন্তু খোকা যখন আমায় এ ছবি দেখাল, তখন আমিই বা কোথায় ছিলাম, সে-ই বা কোথায়! এ দৃশ্য তো মনে পড়ছে না। তাছাড়া আমি ওর ওরকম ছবি দেখলে শুধু বলব—দাড়িটা পাশ থেকে হেঁটে ফেলে যেন, আর কিছু না, তাই কি হতে পারে? পারে না, পারে না, আমি নিশ্চয় কেঁদে কেঁদে বলব, “ও খোকা আমাকে একটু দেখা করিয়ে দাও ভাই।” এ সব তো কিছু মনে পড়ছে না। আমি ভাবছিই, ভাবছিই, ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছে ছবিটাই শুধু পাঠাল আমাকে, তাহলে চিঠিও কি পাঠিয়েছে? নিশ্চয় চিঠি লিখেছে, কারণ আমাকে ছবিটা দেখাতে লিখেছে—তাহলে সে চিঠি তো আমি দেখি নি।
আমি এখন জানি খোকা ওর কাছে মাঝে মাঝে টাকা চাইত এবং সেই টাকা আদায়ের জন্যই সে ওর কাছে আমার উপর নির্যাতনের অদ্ভুত অদ্ভুত কাহিনী বলে ওকে বিপর্যস্ত করে ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। আমি স্থির করলাম খোকার কাছে যাব। এখন আর আমার লজ্জাই বা কি, সে তো কত যুগ আগের কথা।
একদিন সন্ধ্যাবেলা খোকার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। ওর দুরবস্থা কোনো দিন ঘুচল, ঘুচবে কি করে, ওর বারটি সন্তান। সবাই বড় হয়েছে অবশ্য, তবু ওদের তিন পুরুষের অক্ষয় দারিদ্র্য। বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি বাড়িটা অন্ধকার। কলকাতার একটা বিশিষ্ট পাড়াতেই ওরা থাকে, অনেক দিন আছে, চারদিক আলো ঝলমল, শুধু এই বাড়িটাই অন্ধকার। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর খোকা বেরিয়ে এল। বহু বছর পর ওকে দেখলাম। একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছে, ওর কুৎসিত চেহারা আরো কুৎসিত হয়েছে। বিরাট থ্যাবড়া নাক ও মুখের পাশে লোলচর্ম ঝুলে এসেছে, ও বললে, “কে? কে?”
“আমি, আমাকে চিনতে পারছ না?”
অন্ধকারে কিছুক্ষণ ঠাহর করে বললে, “ও রু! অনেক দিন পরে তোমায় দেখলাম, কি ব্যাপার?”
“আলো নেই কেন?”
“সে তো বোঝা শক্ত নয়, বিল দিতে পারি নি বলে কেটে দিয়েছে।” তারপর, “ভিতরে আসবে? একটা মোমবাতি নিয়ে আসি”।
মোমবাতি এনে খোকা আমায় দেখছে, “তুমি এখনও খুবই সুন্দর আছ রু। তোমার বয়সে এরকম ক’জন আছে? আজকালকার মেয়েদের যা ছিরি”
“তাই নাকি? খুব আনন্দ পেলাম শুনে, খোকা তোমার কাছে মির্চার যে চিঠিগুলো ছিল দাও তো!”
“মির্চার চিঠি! এতকাল পরে তাকে মনে পড়ল?”
“আমার জীবনী লিখব, তাতে ওর কথা তো লিখতেই হয় একটু, নয় কি?”
“যদি তোমার সাহস থাকে তাহলে নিশ্চয় লিখবে। আর জীবনীটা যদি শুধু সাধুতার বড়াই করবার জন্য লেখ তাহলে লিখবে না।”
“আমি ভেবেছি মির্চার কথা খুব ভালো করে লিখব।”
“খুব খুশি হলাম শুনে, সত্যি আনন্দ হচ্ছে, সবাই বলে তোমার খুব সাহস আছে। আমাদের ছেলেবেলাটা কি সুন্দর ছিল রু, কি মধুর সে দিনগুলো। আর কি চমৎকার ছেলেই ছিল মির্চা, খোকা স্মৃতি রোমন্থন করছে “অমন করে এক ঘণ্টার মধ্যে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া, মামার কোনো বিচার ছিল না, একটা ক্ষ্যাপাটে ছোট্ট মেয়ের কথা শুনে এমন কেউ করে…” ও বকেই চলেছে।
“খোকা চিঠিগুলো দাও তো। আমার তো কিছু মনেই পড়ছে না। চিঠিগুলো পড়লে হয়ত অনেক কথা মনে পড়বে। কটা চিঠি বল তো?” আমি মনে মনে আন্দাজ করছি দশ মাসে ক’টা লিখতে পারে, মাসে দুটো লিখেছে হয়ত।
“তা অনেক, কিন্তু সে সব চিঠি তো আমি ছিঁড়ে ফেলেছি!”
“ছিঁড়ে ফেললে কেন?”
“সাবধান হবার জন্য, কে কখন দেখে ফেলে।”
“খোকা ওর দাড়িওলা ছবিটা কই, সেটা তো হেঁড়বার দরকার ছিল না।”
“সেটা তো তোমায় দিয়েছি।”