“না, তুমি যদি ওরকম কর তাহলে একেবারে কথা বলব না, তোমারই বা বলবার দরকার কি—আমি তো আর ভালো নই।”
“আমি তোমাকে খারাপ বলেছি?”
“নিষ্ঠুর হৃদয়হীন, একেবারে ভদ্রতা পর্যন্ত জানি না, এ যদি খারাপ নয় তবে কি?”
“তুমি কাল অমন করলে কেন?”
“কি করলাম?”
“অ’র সঙ্গে মীলু আর তুমি বেশ গলা জড়াজড়ি করে চলে গেলে, আর আমি তোমার একটু কাছে সঁড়াতেই তুমি সরে যাও।”
“কী আশ্চর্য, ও যে আমাদের আত্মীয়, তুমি তো আত্মীয় নও।”
আমার মার উপদেশ মনে পড়ছে, আমি যখন বেশ ছোট অর্থাৎ বার বছর বয়স হবে তখনও ফ্রক পরি। আমাদের বাড়ি মায়ের এক আত্মীয় আসতেন। মার চেয়ে অনেক বড় তিনি। তার বয়স কত জানি না, অত ছোটরা বড়দের বয়স বুঝতে পারে না। তবে তিনি অনেকের উপকার করতেন, সকলেই তাকে পছন্দ করত। বাড়ি এলে খুব হৈচৈ করে জমিয়ে তুলতেন আর আমাকে হাঁটুর উপর বসাতেন। আমি তো ফ্রক পরা একটা ছোট মেয়ে, কেউ কিছু মনে করত না—কিন্তু তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার শুরু করতেন–। হঠাৎ হঠাৎ আমার সদ্যোদ্ভিন্ন বক্ষ স্পর্শ করতেন। প্রথম দিন বুঝতে পারি নি। দ্বিতীয় দিনে মাকে বলে দিলাম। মা তো শুনে মাথায় হাত দিয়েছেন, “হা কপাল! বিয়ে করেও ওর স্বভাব শোধরাল না, হারামজাদাকে আর এমুখো হতে দিচ্ছি না।” মা কখনো এত অশ্লীল কথা বলেন না, আমাদের বাড়িতে মার জন্যই কেউ কোনো বিশ্রী কথা বলে না। অন্যদের বাড়িতে শুনেছি ‘হারামজাদা’, ‘শালা’, ইত্যাদি যথেচ্ছ ব্যবহার হয়, আমাদের বাড়িতে হয় না। আমাদের কানে গেলেও অসহ্য লাগে। মাকে প্রথম এই রকম একটা ভয়ানক কথা ব্যবহার করতে শুনলাম। এত রেগে গিয়েছিলেন যে, কোন সভ্য গাল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর মা আমায় বললেন, “রু, এরকম যদি আর কেউ কখনো করে, তখুনি এসে বলে দেবে। কখনো কোনো অনাত্মীয় পুরুষকে ছোঁবে না, ছুঁতে দেবে না। তাতে ফল খুব খারাপ হতে পারে। শরীর তো খারাপ হবেই, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।”
কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি, “মৃত্যু কি করে হবে?”
“অত সব তোমায় এখন বলতে পারছি না, কিন্তু যা বলছি শোনো, খুব সাবধানে থাকতে হয় মেয়েদের।”
একথা ঠিকই যে অনেক লোকই অতি অদ্ভুত ব্যবহার করে। যত দিন যাচ্ছে আমি অনেক বড় বড় লোকের চোখেও লোলুপ দৃষ্টি দেখেছি। গা ঘিন্ ঘিন্ করে, বিশ্রী লাগে। এই যেমন কমলবাবু অত শিক্ষিত, যাকে কালচার্ড বলা হয়ে থাকে, এলিটও, রীতিমত রবীন্দ্রভক্ত, বহু কবিতা ওর মুখস্থ, এলেই আমায় বিরক্ত করবে। সেদিন আমি বসবার ঘরে কোমরে কাপড় জড়িয়ে ঝুল ঝাড়ছি, এমন সময় তিনি এসে উপস্থিত। আমায় ঐ অবস্থায় দেখে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছে-“রাজমহিমারে যে করপরশে তব পার করিবারে দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে ধুলি ঝট দাও তুমি আপনার ঘরে—” কবিতা শুনলেই আমার ভালো লাগে তাই আমিও আবৃত্তি করছি—হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে পিছন। থেকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হল যেন সাপ ছোবল মারতে উদ্যত, আমি কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে পালালাম। মা শুনে বললেন, “বাহারে পাঞ্জাবী আর নাগরাই পরলেই ভদ্র হয় না।” মার কথা এখন আমি বুঝতে পারি। আমি জানি এ সবের পিছনে অদৃশ্য একটা গোপন জগৎ আছে, সেখানকার সবটা খবর আমি জানি না। মার কথা শুনে শুনে আমার খুব পাপবোধ জন্মাচ্ছে। ঠিকই কথা। অ’কেও আমার গলা জড়াতে দেওয়া ঠিক হয় নি। হলই বা দাদার মতো। আমার মনে মনে দ্রুত নানা কথা চলে যাচ্ছে—হঠাৎ দেখি মির্চা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে—
“ক্ষমা কর”–এই বলে দুহাত দিয়ে সে আমার দুহাত ধরে করপল্লব চুম্বন করলে।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি চিত্রার্পিত। ও আমার হাত ছাড়ছে না। আমার হাতের পাতা দুটো ওর হাতের মধ্যে নিপীড়িত। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। ও তার উপর মুখ রাখছে—অনন্ত সময় চলে যাচ্ছে। কতক্ষণ কে জানে, ও ছাড়ছে না, আমি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছি, পারছি না—আমি ঊর্ধ্বমুখে প্রার্থনা করবার চেষ্টা করছি। নিজের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করছি, কারণ আমি তো এখন ছুটে পালাতে চাইছি না চাইছি ও ভুবন্ধন। কিন্তু ও আমাকে আর একটুও কাছে টানে নি, আমাদের মধ্যে অনেক ব্যবধান, ও জানে আমি বাধা দিচ্ছি—“ছাড় ছাড় মির্চা, তুমি আমার হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছ, একেবারে মেরে ফেলেছ আমায়।”
মির্চা মুখ তুলল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি, আমার একটুও সরে যেতে ইচ্ছে করছে না। শরীরের মধ্যে ঘুঙুর বাজছে—একে কখনো শরীর খারাপ হওয়া বলে না। আমার দুধারে যেন প্রজাপতি পাখা মেলেছে—আমি উড়ে যেতে পারি। আমার হাতের উপর মির্চা আবার তার মুখ রাখছে—আকাশ নেমে এসেছে, রৌদ্রতপ্ত নীলাকাশ যেন মাটির উপর পড়ে গিয়েছে। ‘নীল অম্বর চুম্বন নত হয়ে স্থির হয়ে আছে আমার হাতের উপর।
সেদিন রাত্রিটা একটা আশ্চর্য রাত্রি। চারিদিক জ্যোৎস্না আলোছায়া মেলে কলকাতার ঐ রাস্তাটাকে ইন্দ্রপুরী করে তুলেছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—ঘড়িতে বাজছে একটা, দুটো, ঢং ঢং—চাঁদ এদিক থেকে উঠে ওদিকে চলেছে—চলেছে কালপুরুষ— আমি দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায় একা, আমার চুল বাধা হয়নি, চুল উড়ছে, আমার ছায়া পড়েছে পাশের দেওয়ালে—আমি নার্সিসাসের মতো নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে আছি, ‘পূর্ণ চাদের মায়া জড়ানো আমার ঐ তম্বী দেহ-ছায়া আমাকে আশ্চর্য করে দিচ্ছে। ঐ শরীরে যে মন বাস করে সে কেমন? আমি তার সন্ধানে আছি—মির্চা আমার আত্মাকে দেখতে চায়—শঙ্কর বলেছেন আত্মা ছাড়া জগৎ মিথ্যা—সবই ঐ ছায়াটার মতন। কিন্তু ঐ ছায়াটাও তো মিথ্যা নয়—ওর পাশে ঐ যে মাধবীলতাটা দুলছে ওটাও সত্য, জ্যোতির্ময় সত্য।