দরজা খুলে দিল হামিদা। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার বই-এর ম্যাপে যে মহিলার ছবি বাস্তবের মহিলা তার চেয়েও রুপবতী। দেখে মনে হচ্ছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে। মহিলার দুটি মেয়ে আছে এবং দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে— এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। হাজী সাহেব বললেন, হামিদা কেমন আছিস রে মা?
হামিদা খুশি খুশি গলায় বলল, খুব ভালো আছি। মামা তুমি এতদিন পরে কী মনে করে?
তোর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর এখানে এক কাপ চা! খেয়ে যাই। চায়ের পিপাসা হয়েছে।
তুমি আর দুই মিনিট পরে এলে আমাকে পেতে না। আমি বের হচ্ছিলাম, বেবিটেক্সি ডেকে এনেছি। বাসার সামনে বেবিটেক্সি দেখ নি?
যাচ্ছিস কোথায়?
ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে।
বেবিটেক্সি ফেরত পাঠিয়ে দে। আমি তোকে নামিয়ে দেব। আমি একজন লেখককে নিয়ে এসেছি। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার লেখক। প্রাইভেট কলেজে ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। এখন হয়েছেন রান্নার বই-এর লেখক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
হামিদা আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দেখে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। বই লিখেছেন আপনি, ছবি ছাপা হয়েছে অমির। মামা যে আমার ছবি নিয়ে এই কাজ করবেন আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন না।
আলাউদ্দিন কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলছে? এত সুন্দর করে বলল আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন। না। সেই কথার উত্তরে তারও সুন্দর করে কিছু বলা উচিত। মুখে কোনো কথাই আসছে না।
হাজী সাহেব বললেন, ক্ষমা করার কিছু নাই। আলাউদ্দিন বই লেখে নাই। অন্যের বই থেকে কপি করেছে। আলাউদ্দিন যদি সত্যি সত্যি বই-এর লেখক হতো তাহলে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসত।
আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে বসার ঘর দেখছেন। কী সুন্দর ছিমছাম। ঘরে অনেক আসবাবপত্র। তারপরেও কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে। দেয়ালে অতি রূপবতী দুই তরুণীর ছবি। এরা যে হামিদা বানুর মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবিকল মায়ের মতো চেহারী।
মেয়ে দুটির ছবির উপরে একজন যুবকের ছবি। সানগ্লাস পুরা যুবক। সে বেলুন ফুলাচ্ছে। এই যুবকের সঙ্গে মেয়ে দুটির চেহারার মিল নেই। তারপরেও বলে দেয়া যায় এই যুবক মেয়ে দুটির বাবা।
হামিদা চা নিয়ে এসেছে। চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে সে লজ্জিত গলায় বলল, চায়ের সঙ্গে যে দেব এমন কিছু নেই। অন্যদিন বাসি চানাচুর হলেও থাকে আজ তাও নেই।
হাজী সাহেব বললেন, কিছু লাগবে না। হামিদা বলল, মামা তোমার লাগবে না। কিন্তু তুমি মেহমান নিয়ে এসেছ।
হাজী সাহেব বললেন, আলাউদ্দিন মোহমান না! সে বলতে গেলে ঘরের মানুষ। তোর মেয়েরা কেমন আছে?
চিঠিতে তো সব সময় লেখে খুব ভালো। তবে যতটু! ভালো আছে বলে লেখে ততটা ভালো আছে বলে মনে হয় না। অসুখ বিসুখ যখন হয় আমি দুশ্চিন্তা করব বলে আমাকে কখনো জানায় না।
হাজী সাহেব বললেন, এটাই তো ভালো।
হামিদা বলল, এটা ভালো না। আমি সব সময় সত্যিটা জানতে চাই। মিথ্যা ভালো সংবাদের চেয়ে সত্যি খারাপ সংবাদ অনেক ভালো।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী? বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তুমি যে ঝিম ধরে বসে আছ। তোমার কিমা তো দেখি কাটছে না। কথা বলো।
আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, কী কথা বলব?
কিছু একটা বলো। কোনো কথাই যদি মনে না আসে হামিদাকে জিজ্ঞেস কর— আপনার দুই মেয়ের নাম কী?
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দুই মেয়ের নাম কী?
হামিদা হেসে ফেলল। তবে অতি দ্রুত হাসি থামিয়ে বলল, আমার এক মেয়ের নাম রু আরেক মেয়ের নাম নু। দুজনের মিলিত নাম রুনু।
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।
হামিদা বলল, মেয়েদের নাম এক অক্ষরের এটা শুনে আপনার অবাক লাগল?
আলাউদ্দিন বলল, সামান্য লেগেছে।
আপনার চেহারা দেখে সেটা বোঝা যায় নি। এক অক্ষরের নামের পেছনে সুন্দর। একটা গল্প আছে। গল্পটা বলি। এদের বাবার খুব শখ ছিল আমাদের প্রথম সন্তানটা মেয়ে হলে তার নাম হবে রুনু। মেয়ে হলো ঠিকই, জমজ মেয়ে হয়ে গেল। তার বাবা। রুনু নামটাকে ভেঙে একজনের নাম রাখল রু আরেকজনের নাম নু।
হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কই এই গল্প তো আমি জানি না!
হামিদ বলল, মামা তুমি আমার কোনো গল্পই জানো না। আমি শুধু যে দুঃখি মেয়ে তা-না, আমার জীবনের অনেক মজার মজার গল্প আছে।
হাজী সাহেব হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বললেন, দশ মিনিটের জন্যে আমি একটু ঘুরে আসি।
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাজী সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি যাচ্ছ কোথায়? তুমি বস, আমি দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসি। আমার একজন লেখক থাকে ১২১ নম্বর বাসায়। তাকে একটা তাগাদা দিয়ে আসি।
অলাউদ্দিন বললেন, আমিও সঙ্গে আসি।
হাজী সাহেব বললেন, তোমাকে নিয়ে যাব না। এক লেখক আরেক লেখককে পছন্দ করে না। তুমি হামিদার সঙ্গে গল্প কর। আরেক কাপ চা খাও। চা শেষ হতে হতে আমি চলে আসব।
হাজী সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বের হলেন। আলাউদ্দিক অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন। মেয়েদের সঙ্গে এমনিতেই তার কথা বলার অভ্যাস নেই। তার উপর যে মেয়েটি তার সামনে বসে আছে তার সঙ্গেই বিয়ের কথা হচ্ছে। ভালো ঝামেলায় পড়া গেল।
হামিদা বলল, আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?