আলাউদ্দিন বলেন, খুব ভালো।
হাজী সাহেব বললেন, যতটা ভালো মনে হচ্ছে তত ভালো না। হামিদা। পড়েছে মহাবিপদে। একা বাস করতে হয়, নিঃসঙ্গ জীবন। আজেবাজে দুষ্ট লোক তাকে নানানভাবে তাক্ত করে। বিয়ে করলে এই সমস্যা থেকে সে বাচবে। তাকে অনেক বুঝানোর পর এখন সে বিয়ে করার ব্যাপারে নিমরাজি হয়েছে। মেয়ে দুটি চাচ্ছে মা বিয়ে করে সুখী হোক। বাংলাদেশী মেয়ের বিধবা মায়ের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। এরা যে হয়েছে সেটা আল্লাহর রহমত বলতে হবে।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। হাজী সাহেব কিছু বললেন। বরং মুখ হাসি হাসি করে আলাউদ্দিনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। নিচু গলায় বললেন— হামিদা বানুকে তুমি বিয়ে কর না কেন?
আলাউদিদন থতমত খেয়ে বললেন, আমি?
হ্যাঁ, তুমি। আমার ধারণা হামিদার পাত্র হিসেবে তুমি খুবই উপযুক্ত। মেয়েটা ভালো। তরুণী বয়সে সে অপূর্ব রূপবতী ছিল। সেই রূপের খানিকটা এখনো আছে। তাকে দেখে মনেই হয় না তার বয়স পঁয়তাল্লিশ। তুমি তার ছবি দেখেছ। সুন্দরী কি তুমিই বলো।
আমি ছবি কখন দেখলাম?
তোমার রান্নার বইয়ের ফ্ল্যাপে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর ছবি আছে। এই হলো সেই হামিদা বানু।
উনি অধ্যাপিকা?
আরে না। বই চালাবার জন্যে লেখা। বিএ পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেল বলে আর পড়াশোনা হয় নি। এখন এজি অফিসে কাজ করে। জুনিয়ার অডিটর। মাসে সব মিলিয়ে ঝিলিয়ে ছয় সাত হাজার টাকার মতো বেতন পায়। তোমাদের দুজনের সংসার এই টাকায় চলে যাবার কথা। তোমার এই বিষয়ে মত কী?
আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, বিয়ের কথা কখনো ভাবি নি।
হাজী সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কখনো ভাব নি বলে যে কোনোদিন ভাববে না তা তো না; এখন ভাব।
এখন ভাবব?
তুমি এমন ভাব করছ যেন এই মুহূর্তেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে। তুমি হ্যাঁ বলাবে আর আমি কাজী ডেকে নিয়ে আসব। চিন্তা-ভাবনা কর। সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে আলাপ কর।
জি আচ্ছা।
তোমার বয়স কত?
এই নভেম্বরে ৫৩ হবে।
অনেক বয়স। বিয়ে করার বয়স না, কবরে চলে যাওয়ার বয়স। যাই হোক চিন্তা করে বলো।
জ্বি আচ্ছা।
মেয়েকে যদি দেখতে চাও, কথাবার্তা বলতে চাও, সেই ব্যবস্থাও করা যায়। একদিন বিকেলে বাসায় গিয়ে চা খেয়ে এলাম।
জি আচ্ছা।
কবে যাবে বলো?
আপনি যেদিন ঠিক করবেন সেদিনই যাব। আপনার বিবেচনা।
আমার বিবেচনা যদি হয় তাহলে আজই চল।
আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বলল, আজ যাব?
হাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কথা শুনে চিমশা মেরে গেলে কেন? আজ যাওয়াই তো ভালো। কোনো কিছু ঝুলিয়ে রেখে লাভ নাই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে, বিকালে কোনো খবর না দিয়ে চলে গেলাম। হামিদাকে বললাম, হামিদা আমার এক লেখককে নিয়ে এসেছি। ভালো করে চা খাওয়া। অসুবিধা আছে?
জি না।
অসুবিধা থাকলে বলো। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি জোর করে তোময় বিয়ে দিচ্ছি। এখানে জোর করার কিছু নাই। হায়াত, মউত, রিজিক, ধনদৌলত এবং বিবাহ— এই পাঁচটা জিনি আল্লাহপাক নিজে দেখেন। আল্লাহপাক চাইলে বিবাহ হবে না।
জি, তা তো ঠিকই।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তবে তাঁর মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তায় যে মন খারাপ হয়েছে তা না। মন খারাপের প্রধান কারণ আজ দুপুরে মোরাগপোলাও খেতে হবে। হাজী সাহেব যে দোকান থেকে মোরগপোলাও আনান সেই দোকানের মোরণপোলাও অত্যন্ত ভালো। কিন্তু যত ভালোই হোক কুটু মিয়ার রান্নার পাশে কিছুই না। আজ দুপুরে কুটু মিয়া বিশেষ আয়োজন করেছে। ইলিশ মাছের ডিম রাধছে। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল, ইলিশ মাছের ডিমের ভাজা। এই দুই জিনিস আগেও একদিন খেয়েছেন। মনে হয়েছে বেহেশতি কোনো খানা। আজ সেই দুই আইটেম আবার রাঁধতে বলে এসেছেন। কুটু এই দুটা তো রাধবেই, তার সঙ্গে বাড়তি এমন কোনো আইটেম করবে যে সম্পর্কে তিনি কোনো চিন্তাই করেন নি। কবে যেন পাতার একটা বাড়া খেয়েছেন— আহা কী জিনিস! বেসনে ভুবিয়ে গরম গরম ভেজে পাতে দিয়েছে। খাওয়ার সময় মনে হয়েছে বিশাল কোনো বটগাছের সব পাতা যদি এরকম বেসনে ভেজে দিয়ে দেয় তিনি খেয়ে ফেলতে পারবেন।
আলাউদ্দিন।
জ্বি।
তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে?
জ্বি না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না।
তোমার মন না চাইলে থাকি যেতে হবে না। আমি আমার ভাগ্নিকে নিয়ে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। হামিদার পত্র হিসাবে তোমাকে আমার পছন্দ। এটাই আমার আগ্রহের কারণ।
আমি আপনার সঙ্গে বিকালে যাব।
তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। ভ্রামি নিশ্চিত আমার ভাগ্নির সঙ্গে কথা বলে তোমারও ভালো লাগবে। অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাদের দুইজনের মিলবেও ভালো। তোমার বুদ্ধি কিছু কম আছে। তোমার কম বুদ্ধি ঐ মেয়ে পুশিয়ে দিবে।
আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। হাজী সাহেব বললেন, তোমার বুদ্ধি কম বলেছি এতে রাগ কর নি তো?
জ্বি না।
তোমাকে অত্যধিক স্নেহ করি বলেই বলেছি। স্নেহ না করলে বলতাম না।
দুপুরে মোরগপালাও খুবই ভালো ছিল। আলাউদ্দিন তেমন মজা পেলেন না। তার মন পড়ে রইল ইলিশ মাছের ডিমে। দুপুরের খাওয়ার পর তিনি হাজী সাহেবের বই-এর দোকানে কিছুক্ষণ ঘুমালেন। বিকেলে গেলেন হাজী সাহেবের সঙ্গে তার ভাগ্নির বাসায় চা খেতে। এই ঘটনায় তিনি যে কোনো উত্তেজনা অনুভব করলেন তা না। দায়িত্ব পালনের মতো যাওয়া। একা একা বাস করে তিনি অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। বিয়ের মতো ঝামেলায় জড়ানো তার জন্যে বিরাট বোকামি হবে। জীবনে অনেক বোকামি তিনি করেছেন। হাজী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বোকামিটাও তিনি করে ফেলবেন বলে মনে হচ্ছে। তবে তা নিয়ে তিনি তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করলেন না।