বাদর না তো? পুরনো ঢাকায় প্রচুর বার আছে। জানালা খোলা থাকলে মাঝে মাঝে এৱা ঘরে ঢুকে পড়ে। নানানভাবে মানুষজনকে বিরক্ত করে। এই অঞ্চলেও হয়তো বাদ আছে— তিনি জানেন না।
আলাউদ্দিন কী করবেন ভেবে পেলেন না। একবার তাঁর মনে হলো এটা দুঃস্বপ্ন। রাতের খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। বদহজম হয়েছে। বদহজম থেকে দুঃস্বপ্ন। দেখছেন। তিনি থাকেন ছয়তলায়। দরজা বন্ধ করে শুয়েছেন। বাদর আসবে কোথেকে! না, একটু ভুল হয়েছে। তার ঘরের দরজা খোলাই ছিল। দরজা বন্ধ করার আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর ঘরের দরজা খোলা থাকলে ও বন্য কোনো পশু এসে ঘরে ঢুকবে না। তিনি তো সুন্দরবনের ভেতর কোনো ফরেস্টের বাংলোতে বাস করছেন। সমস্যাটা কোথায়? খাটের নিচ কাগজ ছেঁড়া এখনো চলছে।
অদ্ভুই একটা কথা আলাউদ্দিনের মাথায় এলো— তাঁর খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে নেই তো? হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। কাগজ ছিড়ছে। মাথা খারাপ মানুষদের পক্ষে এই কাজটা অস্বাভাবিক কিছুই না। সেতাবগঞ্জের এক পাগল ছিল হামাগুড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। পাগলের নাম সওদাগর। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, সওদাগর তুমি হট না কেন? সওদাগর বলত, হাঁটলে ব্যালেন্সের সমস্যা হয় ভাইজান। সওদাগর পাগলা অনেক ইংরেজি জানত। কথাবার্তা বলত খুবই স্বাভাবিকভাবে। শুধু হাঁটত চার পায়ে। কে জানে। কুটুও হয়তো সওদাগরের মতোই মানসিক রোগী। আলাউদ্দিন কাপা কাপা গলায় ডাকলেন, কুটু। খাটের নিচ থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিনের সারা শরীর হিম হয়ে গেল। এটা হতেই পারে না। খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে থাকবে কেন? তিনি আবারো ডাকলেন, কুটু। কুটু সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার। আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কী করছ?
কিছু করছি না স্যার।
খাটের নিচে বসে আছ কেন?
কুটু জবাব দিল না। ফোঁ-ফোল, ফোঁ-ফোস শব্দ করতে লাগল। আলাউদ্দিন ভয়ে জমে গেলেন। বন্যপশুর চেয়ে মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ অনেক ভয়ংকর। কুটুর। উপর অশুভ কোনো কিছুর ভর হয় নি তো?
আলাউদ্দিন আয়াতুল কুরসি সূরাটা পড়ার চেষ্টা করলেন। এই সূরাটা একবার ঠিকমতো পড়ে হাততালি দিলে খারাপ জিনিস দূরে চলে যায়। হাততালির শব্দ যতদূর যায় অশুভ জিনিসগুলি তত দূরেই যায়। আলাউদ্দিন সূরা পড়ে শেষ করেছেন কিন্তু হাততালি দিতে পারছেন না। হাততালি দেবার ক্ষমতা তার নেই। দুটি হাতই অসাড় হয়ে পড়ে আছে। যেন এই হাত দুটা নিজের না। অন্য কারোর হাত। এই দুই হাতের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আলাউদ্দিন চিৎকার করতে যাবেন তখনই খুট করে শব্দ হলো। ঘরের বাতি জ্বলে উঠল, ফ্যান ঘুরতে লাগল। আলাউদ্দিন ভাঙা গলায় ডাকলেন, কুটু মিয়া কুটু মিয়া।
থপথপ শব্দ করে কে যেন আসছে। কুটু মিয়াই অসিদ্রে। সে ছাড়া আর কে হবে! তার ঘরের দরজা ভেজানো। কেউ এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।
কুটু মিয়া।
জ্বি স্যার।
ভেতরে আস।
দরজা ঠেলে কুটু মিয়া ঢুকল। তার হাতে পানির গ্লাস। পানির গ্লাসে বরফ ভাসছে। পানির গ্লাস দেখে আলাউদ্দিনের মনে হলো তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গ্লাস পানিতে তার হবে না। এক কলসি পানি দরকার।
কুটুকে দেখে তার লজ্জা লাগছে। সহজ স্বাভাবিক একজন মানুষ। তিনি ডেকেছেন বলে বুদ্ধি করে পানির গ্লাস নিয়ে চলে এসেছে। অথচ তিনি তার সম্পর্কে কত কিছু ভেবেছেন। মস্তিষ্ক বিকৃত। ভূতের ভর হয়েছে। ছিঃ।
কুটু!
জি স্যার।
হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়েছিল। গরমে ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। পানি এনে ভালো করেছ। খুবই পানির পিপাসা হয়েছিল।
আলাউদ্দিন এক নিঃশ্বাসে পানির গ্লাস শেষ করে কুটুকে বললেন- কুটু দেশ তো আমার খাটের নিচে কিছু আছে কি না।
কুটু নিচু হয়ে খাটের নিচ দেখল। নিচু গলায় বলল, কিছু নাই স্যার।
আলাউদ্দিন বললেন, একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। কোনো একটা জতু আমার খাটের নিচে বসে আছে।
হাতে মুখে একটু পানি দেন। দিক, হাতে মুখে পানি দিব। তুমি আরেক গ্লাস ঠাপ্ত পানি আন।
কুটু মিয়া পা থপথপ করতে করতে চলে গেল। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামলেন। নিচু হয়ে খাটের নিচটায় উঁকি দিলেন। খাটের নিচে কেউ নেই তা ঠিক, তবে খাটের নিচে গাদা করে রাখা সমস্ত খবরের কাগজ কুচি কুচি করে ছেঁড়া। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন নি। কেউ একজন খাটের নিচে বসে সত্যি সত্যি কাগজ ছিঁড়েছে।
হাজী একরামুল্লাহ অবাক
হাজী একরামুল্লাহ অবাক হয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী?
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। একরামুল্লাহ সাহেব তাকে দেখে এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারলেন না। এক সপ্তাহ পরে এসেছেন— এই জন্যেই কি? তিনি মুক্তি প্রকাশনীর পোষা লেখক। তাই বলে প্রতিদিন আসতে হবে এমন তো কথা নেই।
হাজী সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি আগে প্রতিদিনই একবার বাংলাবাজার আসতে, এবারে ছয় দিন পরে আসলে। তাও আমি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছিলাম বলে আসা। ঘটনা কী?
কোনো ঘটনা না।
অসুখ বিসুখ হয় নি তো?
আলাউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন।
অসুখ বিসুখ যে হয় নি সেটা তো তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বরং ওজন বেড়েছে। তোমার শরীরে থলথলে ভাব চলে এসেছে। পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে ভুড়ি দেখা যাচ্ছে। ব্যাপার কী?
কোনো ব্যাপার না।
বিয়ে শাদি করেছ নাকি?
জ্বি না। এই বয়সে বিয়ে শাদি!
পুরুষ মানুষ যে-কোনো বয়সে বিয়ে করতে পারে। গোপনে বিয়ে করে থাকলে স্বীকার করতে অসুবিধা নাই।