ডাল এক চামচ নেবেন কি-না আলাউদ্দিন বুঝতে পারছেন না। ডালটা দেখে খুব ভালো মনে হচ্ছে না। মুরগির ঝোলের স্বাদটা মুখে রেখে খাওয়াটা শেষ হওয়া দরকার। নেহায়েত কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে তিনি এক চামচ ডাল নিলেন। তখন মনে হলো বিরাট ভুল হয়েছে, ডাল দিয়েই খাওয়া শুরু করা দরকার ছিল। আলু ভাজি এবং মুরগির ঝোলের প্রয়োজন ছিল না, শুধু ডাল দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারেন।
কুটু মিয়া আশেপাশে নেই— এটাও একটা শান্তি। কেউ আশেপাশে থাকলে তিনি খেতে পারেন না। দীর্ঘদিন একা একা থেকে এই এক বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে। তার সমস্যা হয় না শুধু বিয়ে বাড়িতে। অনেকের সঙ্গে খেতে বসা যায়। তখন কেউ কারো দিকে তাকায় না।
আলাউদ্দিন খাওয়া শেষ করে ডাকলেন, কুটু মিয়া!
কুটু পাশে দাঁড়াল। আলাউদ্দিন বললেন, তোমার রান্না খারাপ না। চলবে।
কুটু বলল, শুকরিয়া।
আলাউদ্দিন ইচ্ছা করেই প্রশংসা চেপে রাখলেন। বাঙালি প্রশংসা নিতে পারে। প্রশংসা করলেই তারা মাথায় উঠে যায়। অদ্ভুত এক জাতি।
সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার সদাই করে আনবে।
জ্বি আচ্ছা।
ছোট মাছ, ভাজি ভুজি ভর্তা। এইসব। পোলাও-কোরমা-রোস্ট মুরগি মুসাল্লাম এইসবের প্রতি আমার লোভ নেই। গরিবের সন্তান, গরিবি খাদ্য খেয়ে অভ্যাস। বুঝতে পারছ?
জি।
তেল মশলা কম দিয়ে রাঁধবে। অনেকে মনে করে গাদাখানিক তেল মশলা হলেই তরকারি ভালো হয়। রান্নার পরে আমার লেখা একটা বই আছে— সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনীজ রান্না। সেই বই-এ এই ব্যাপারটা বিশদভাবে লিখেছি। বইটা পড়ে দেখতে পার। তোমার উপকার হবে। বই-এ খাদ্যের পুষ্টির উপর আলাদা একটা চ্যাপ্টার আছে।
আমি স্যার পড়তে জানি না।
সে কী! অ আ ক খ কিছুই না?
জ্বি না।
খুবই দুঃখের কথা। আমি নিজে শিক্ষক ছিলাম তো। বয়স্ক একজন কেউ যদি বলে লেখাপড়া জানি না তখন রাগ লাগে। যাই হোক, আমি বাংলাবাজার থেকে শিশু শিক্ষার একটা বই নিয়ে আসব। অবসরে পড়বে। শুধু রান্না জানলেই হবে না। লেখাপড়া জানতে হবে। ঠিক কিনা বল?
জ্বি।
রান্না না জানাটা দোষের না, কিন্তু লেখাপড়া না জানাটা দোষের। বুঝাতে শার।
জ্বি।
রান্না যে জানে না তাকে কেউ গালি দেয় না। কিন্তু যে লেখাপড়া জানে না তাকে সবাই মূর্খ বলে গালি দেয়।
লেখাপড়ার ওপর বক্তৃতাটা দিয়ে আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে। একটু ক্লান্তি ও লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি কথা বলা হয়েছে। কারণ খাওয়াটা বেশি হয়ে। গেছে। শরীর হাঁসফাস লাগছে। একটা মিষ্টি পান খেতে পারলে ভালো হতো। তিনি এম্নিতে পান খান না তবে বিয়ে শাদির খাওয়ার পর মিষ্টি পানি খেতে ভালো লাগে। পানের সঙ্গে একটা সিগারেট পান হজমের সহায়ক। সিগারেট ও মনে হয় তাই।
কুটু মিয়া।
জ্বি।
দোকানে যাও, একটা মিষ্টি পান নিয়ে আসি। একটা সিগারেটও আনবে। ভালো কষ্মা, একটা মোমবাতি ও আনবে। কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকার ঘরে বসে। থাকতে হয়। রোজ ভারি মোমবাতি আনব, মনে থাকে না। আমি আবার অন্ধকার সহ্য করতে পারি না।
রাত বেশি হয় নি। এগারোটা চল্লিশ। আলাউদ্দিন রাত দুটা আড়াইটার আগে কখনো ঘুমাতে যান না। গভীর রাতেই তার লেখালেখি ভালো হয়। আজ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তার মুখে পান, হাতে সিগারেট। তার মনে হচ্ছে মুখ ভর্তি পান এবং হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তিনি খাটে আধশোয়া হয়েই ঘুমিয়ে। পড়বেন। হাত থেকে সিগারেটটা মেলতেও পারছেন না। আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় সিগারেটের ধোয়া টানতে তার খুবই ভালো লাগছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে জীবনটা সুখের।
আলাউদ্দিন আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন। গ ঘুম। ঘরের বাতি জ্বলছে, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। সেই বাতাসও আরামদায়ক শীতল। তার ঘুম ভালো হঠাৎ। ঘরে বাতি নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার ওপর ফান চলছে না। তার বুক ধক করে উঠল। চারদিকে এত অন্ধকার কলা ঘরের বাতি এখন শোনা কে এ মনা তা এত অন্ধকার ঘাকে না। এপার্টমেন্ট হাউসের আলো এসে ঘরে ঢুকে। রাস্তার আলো কে। অন্ধকারেও বোঝা যায় ঘরের কোথায় কী আছে। ঘুমের মধ্যে এমন কিছু কি হয়েছে যে তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন? তার এক দূর সম্পর্কের চাচার এ রকম। হয়েছিল। তিনি হাটে গরু নিয়ে গিয়েছিলেন বিক্রির জন্য। দরে বললো না বলে গরু বিক্রি হলো না। মেজাজ খারাপ করে তিনি গেলেন চা খেতে। চা খেয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। টোস্ট বিসর্কিট দিয়ে চা খেয়ে চায়ের নাম দিতে যাবেন, হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন— কী হইছে আন্ধাইর ক্যান? এই যে তার কাছে পৃখিবী হঠাৎ আন্ধাইর হলো— আলো আর ফিরল না।
তাঁর বেলায় এরকম কিছু কি হয়েছে? না-কি গোটা শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় শহরই অন্ধকার হয়ে গেছে? কোথাও আলো নেই। ঘটনা মনে হয় এ রকমই। ইলেকট্রিসিটি নেই বলেই ফ্যান ঘুরছে না। ফ্যান ঘুরলে ফ্যানের ক্যাট ক্যাট আওয়াজটা থাকত। কুটু মিয়া মোমবাতি এনে রেখেছিল— মোমবাতিটা কোথায় আলাউদ্দিনের মনে পড়ছে না। খাটের পাশের টেবিলে রাখার কথা। টেবিলটা কোথায়? গভীর অন্ধকার ও এক সময় চোখে সয়ে যায়। এই অন্ধকার চোখে সইছে না কেন? এ খাটের নিচে শব্দ হলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। আলাউদ্দিন চমকে উঠলেন। হঠাৎ তার মানে হলো জীবিত কোনো প্রাণী খাটের নিচে আছে। প্রকা কোনো প্রাণী চার পায়ে খাটের নিচে ঘুরছে। প্রাণীটার নিয়মিত নিঃশ্বাসের শব্দ এখন তিনি পাচ্ছেন। ফো-ফোস। ফো-ফোস। তার গায়ের বোটকা গন্ধ নাকে লাগছে। খাটের নিচে গাদা কর খবরের কাগজ। এই তো প্রাণীটা এখন কাগজ ছিড়ছে। গলার ভেতর অস্পষ্ট শব্দও করছে। রাগী শব্দ।