হামিদার হাতের কাছেই সুইচ বোর্ড। সে ইচ্ছা করলে বাতি জ্বালাতে পারে। বাতি জ্বালাতে প্রচণ্ড ভয় লাগছে। যদি বাতি জ্বেলে দেখে কানের কাছে একটা ককর নিশ্বাস ফেলছে তাহলে কী হবে? এ রকম সম্ভাবনার কথা ডাক্তার সাহেব বলছেন।
হালকা শব্দ হলো ঘরের ভেতর। মেঝেতে কেউ একজন নড়ে উঠল। হামিদা নিশ্চিত অবশ্যই মেঝেতে বড়সড় একটা কুকুর। থাবা গেড়ে বসে আছে। এ রকম কিছু যদি হামিদা দেখে তাহলে ধরে নিতে হবে এই কুকুর সত্যি কুকুর না। এটা তার মনের কল্পনা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সত্যিকারের কুকুরের ঘরে। ঢোকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
হামিদা বাতি জ্বালাল। মেঝেতে দুটা কুকুর বসে আছে। একটা কালো একটা বাদামি রঙের। কালো কুকুরটা প্রকাণ্ড, বাদামিটা ছোট। ছোট কুকুরটা হা করে আছে। তার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। তারা এক দৃষ্টিতে হামিদার দিকে তাকিয়ে আছে। হামিদা মনে মনে বলল, আমি যা দেখছি তা ভুল। ভিসুয়াল হেলুসিনেশন হচ্ছে। আমাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। খুব ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমি কুকুর দুটার দিকে তাকাব না। আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে খাট থেকে নামব। কুকুর দুটাকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে যাব। দরজা খুলে ছাদে যাব। সিড়ি বেয়ে দোতলায় নেমে যাব। আসিয়াকে বলব— গরম এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। উষ্ণ চায়ের কাপ বন্ধুর মতো এ জাতীয় কী একটা কথা যেন ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন।
হামিদা খাট থেকে নামল। দরজা খুলে ছাদে চলে এলো। কুকুর দুটা নিঃশব্দে তার পিছনে পিছনে আসছে। হামিদা ছাদ থেকে নামার সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। সিড়ি-ঘরে সব সময় বাতি জ্বলে, আজ বাতি নেই। কুকুর দুটা ঘড়ঘড় শব্দ। করছে। হামিদা তাকালো কুকুর দুটির দিকে। আতঙ্কে ও বিস্ময়ে হামিদা জমে গেল— কারণ কুকুর দুটি এখন তার উপর ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই তো লাফ দিল! হামিদা প্রাণপণে দৌড়াল। ছাদের শেষ মাথায় এসে পড়েছে। ছাদের এই অংশে রেলিং নেই। ভালোই হয়েছে। রেলিং থাকলে সে আটকা পড়ে যেত। হামিদা দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল।
পিজি হাসপাতালের মনোবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ডা. আরেফিন চৌধুরী হামিদার জন্যে সকাল দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। হামিদা এলো না। আরেফিন চৌধুরী বিস্মিত হলেন না। তিনি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শতকরা ষাট ভাগ মানসিক রোগী প্রথম সেশনের পর দ্বিতীয় সেশনে ডাক্তারের কাছে আসে না। হয় আপনা আপনি তাদের রোগ সেরে যায়–কিংবা মনোরোগ চিকিৎসকের। কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না।
কতক্ষণ পানিতে আছি
কুটু আমি কতক্ষণ পানিতে আছি?
আটতিরিশ ঘণ্টা।
শুধু ঘণ্টার হিসাব দিলে হবে না, মিনিটের হিসাবও লাগবে। আটত্রিশ ঘণ্টা কত মিনিট?
আটতিরিশ ঘণ্টা সাত মিনিট।
তোমার কি মনে হয় আমি পানিতে বাস করার বিশ্ব রেকর্ড করতে পারব?
মানুষ চেষ্টা নিলে সব পারে।
ভুল বললে কুটু। মানুষ চেষ্টা নিলেও সব কিছু পারে না। আমি হাজার চেষ্টা করলেও গান গাইতে পারব না। আমার গানের গলা নাই। গান গাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। সম্ভব হলো না। আমি যখন একা থাকতাম তখন মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করতাম। এখন আমার সঙ্গে তুমি থাকি। লজ্জা লাগে বলে গাইতে পারি না।
কোন ধরনের গান করতেন।
বেশির ভাগ ইসলামি সঙ্গীত। তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে টাইপ।
আমি অন্য ঘরে যাই, আপনি গান করেন।
না তুমি থাক। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে গান গাওয়ার ইচ্ছা হলে তোমার সামনেই গাই। তুমি তো বাইরের কেউ না। তুমি হলে আপনা লোক। কুট, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি– অল্পদিনের মধ্যে তোমার মাথ্যার চুল। বড় হয়েছে, নখ বড় হয়েছে। তোমাকে দেখতে কিন্তু খারাপ লাগছে না।
শুকরিয়া।
হামিদার ধমক খেয়ে তুমি যে চুল কেটে বাবু হয়ে গিয়েছিলে। তোমাকে দেখতে তখন ভালো লাগছিল না। একেকজনকে একেকভাবে মানায়। কাউকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মানায়। কাউকে আবার নোংরা অবস্থায় মানায়। কুট তুমি কি গোসল বন্ধ করে দিয়েছ?
জ্বি স্যার। পানি আমার শইলে সহ্য হয় না।
সহ্য না হলে গোসল করার কোনো দরকার দেখি না। আমি চলব আমার মতো। পছন্দ না হলে আসবে না। কী বলো কুটু, সত্যি বলছি না?
জ্বি স্যার।
ভদকার সাপ্লাই আছে তো?
তিন বোতল আছে।
আরো আনিয়ে রাখ। হঠাৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে বিরাট বিপদে পড়ব। স্টক পাকা ভালো। টাকা সুটকেসে আছে। চাবি কোথায় আছে জানো?
আপনার বালিশের নিচে।
ভেরি গুড। যখন প্রয়োজন হবে টাকা নিয়ে খরচ করবে। আমি দরিদ্র হতে পারি কিন্তু আমার হার্ট অনেক বড়। হাট কী জানো?
না।
হার্ট হলো হৃদয়। হার্ট একটা ইংরেজি শব্দ। বানান হলো— HEART, গ্লাসে ঢেলে জিনিস দাও। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবে আমার গ্রাস যেন কখনো খালি থাকে।
আইজ বেশি খাইয়া ফেলছেন স্যার। আর খাইলে বমি করবেন।
আমার বমি আমি করব। যেখানে ইচ্ছা সেখানে করব। বুঝতে পারছ?
জ্বি স্যার।
রাত এখন কত?
একটা বাজে স্যার।
তুমি সব সময় ঘণ্টায় উত্তর দাও কেন? একটা বেজে কত মিনিট সেটা বলো।
একটা পাঁচ।
পাঁচ মিনিট সময় যে তুমি অগ্রাহ্য করলে এটা ঠিক করলে না। পাঁচ মিনিট। অনেক লম্বা সময়। পাঁচ মিনিট হলো তিনশ সেকেন্ড।
স্যার যাই, রান্না করতে হইব।
রান্না করতে হবে না। আজ আমি সলিড কিছু খাব না। লিকুইড জিনিস খাব। শুয়ে আছি লিকুইডের ভেতর। খাবও লিকুইড। লিকুইড হলো একটা ইংরেজি শব্দ। অর্থ হলো তরল। লিকুইড বানান শিখে রাখ— LIQUID. কুটু মিয়া–