কুকুর দুটা এখনো তাকিয়ে আছে। লেজ নাড়ছে, কিন্তু নড়ছে না। তিনি গেটের দিকে এগুচ্ছেন। কুকুর দুটা এখন তার পেছনে পেছনে আসছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হলো এরা তাঁকে কামড়াবে। অবশ্যই কামড়াবে। যে-কোনো মুহূর্তে দুজন দুদিক থেকে তাঁর গায়ে ঝাপিয়ে পড়বে। আতঙ্কে হাজী সাহেবের শরীর হিম হয়ে গেল। তিনি শুনেছেন মানুষ যদি ভয় পায় কুকুর সেই ভয় বুঝতে পেরে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ভয় পাওয়া যাবে না। কিন্তু তিনি ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। তার কপাল ঘামছে। প্রবল ইচ্ছা করছে দৌড় দিতে। তিনি গেটের কাছাকাছি চলে এসেছেন। কুকুর দুটার কিছু বোঝার আগেই তিনি দৌড়ে গেট পার হতে পারবেন। কিন্তু দৌড়ানো ঠিক হবে না। কুকুরের সামনে যারাই দৌড় দিয়েছে তারাই কুকুরের কামড় খেয়েছে। ইয়াকুব হঠাৎ ভয় পেয়ে দৌড় দিয়েছিল বলেই কামড় খেয়েছে।
হাজী সাহেব গেট পার হলেন। এখন তিনি রাস্তায়। রাস্তার পাশে গাছের নিচে একটা খালি রিকশা আছে। রিকশায় কোনোমতে উঠে পড়তে পারলে আর ভয় নেই। চলন্ত রিকশার কোনো যাত্রীকে কুকুর কামড়েছে বলে শোনা যায় না। এই কুকুর দুটা পাগলা কুকুরও না। পাগলা কুকুরের চালচলন আলাদা থাকে। এরা সারাক্ষণ মুখ হা করে থাকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে। পাগলা কুকুরের লেজ নামানো থাকে। এই কুকুর দুটির লেঞ্জ নামানো না। ভ্ৰাদের মুখ দিয়ে লালা ও পাড়ছে না।
হাজী সাহেব রিকশায় উঠলেন। রিকশাওয়ালাকে ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাংলাবাজার যাও। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাচ্ছে। কুকুর দুটা পেছনে পেছনে আসছে। আসুক, এখন আর কোনো সমস্যা নেই। হাজী সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর তখনই কুকুর দুটা দুদিক থেকে এসে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তিনি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। রিকশা উল্টে গেল। কুকুর দুটা পায়ের মাংসে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। রিকশা উল্টে যাবার পরও এরা পালিয়ে গেল না। দাত বসিয়ে রাখল।
তিনি দুই হাত দিয়ে কালো কুকুরটার মাথা সরাতে চেষ্টা করলেন। কালো কুকুরটা তার পা ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকাল। এবং তার মুখের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। তার কাছে মনে হলো কুকুরটা প্রকাণ্ড হা করেছে। কুকুরটা এখন তার পুরো মাথাটাই তার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নেবে।
তিনি চিৎকার করে বললেন, বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।
হাজী সাহেবকে যখন কুকুর কামড়ে ধরেছে তখন হামিদা বাথরুমে গোসল করছিল। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে শাওয়ারের নিচে মাথা দিয়েছে তখনই সে কুকুর দুটার গর্জন শুনল। সেই সঙ্গে স্পষ্ট শুনল— তার মামা চিৎকার করছেন, বাঁচাও আমাকে বাঁচাও।
বাথরুম থেকে আধভেজা হয়ে সে ছুটে বের হলো। সিড়ি দিয়ে সে ছুটে নামছিল এবং চিৎকার করছিল, মামাকে কুকুর মেরে ফেলছে। মামাকে কুকুর মেরে ফেলছে।
ঘরটা সুন্দর
ঘরটা সুন্দর।
ডাক্তারের চেম্বার বলে মনে হয় না। পরিষ্কার দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি। পেইন্টিং না, ফটোগ্রাফ। একটা ছবিতে আট ন বছরের একটি মেয়ে কাঁদছে। তার চোখের পাপড়িতে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রু জমা হয়ে আছে। হামিদা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার মেয়ের ছবি। আমার তোলা ছবি।
হামিদা বলল, অপূর্ব।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ছবিটা অপূর্ব ঠিকই। কিন্তু ছবিটার ভেতর ফাঁকি আছে। ফাঁকির কথাটা যেই আপনাকে বলব আপনার আর ছবিটা অপূর্ব মনে হবে না।
ফাঁকিটা কী?
আমার মেয়ে কাঁদছিল না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটা পানি তার চোখের পাপড়িতে দিয়ে ছবিটা তোলা। বাইরে থেকে চোখের পাপড়িতে আলো ফেলা হয়েছে যেন নকল অশ্রু বিন্দু ঝকমক করতে থাকে। এখন কি আপনার কাছে ছবিটা আগের মতো সুন্দর লাগছে?
হামিদা বলল, না। কিন্তু আপনি যে ফাঁকির ঘটনা স্বীকার করলেন এই জন্যে ভালো লাগছে। আমরা সবাই নানানভাবে ফাঁকি দেই কিন্তু কখনো স্বীকার করি না।
ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন ফাঁকির ঘটনা স্বীকার করাও অমাির একটা টেকনিক। যখন রোগীর কাছে ফার্কির ব্যাপারটা স্বীকার করি তখন তারা আমাকে একজন সৎ এবং ভালো মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে। আমার প্রতি তাদের এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়। রোগী ভরসা পায়। আমরা যারা মনোবিদ্যার চিকিৎসক তাদের জন্যে রোগীর কনফিডেন্সটা অসম্ভব দরকার।
হামিদা বলল, আপনার প্রতি আমার কনফিডেন্স তৈরি হয়েছে। আপনি যদি কিছু জানতে চান আমি বলব। আপনি আমার মাথার ভেতর থেকে কুকুরের ডাকটা দূর করে দিন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, চা খাবেন?
হামিদা বলল, আমার ঘনঘন চা খাবার অভ্যাস নেই।
ডাক্তার সাহেব বললেন, চায়ের একটা কাপ হাতে থাকা মানে এক ধরনের ভরসা। অসহায় বোধ করলে চায়ের পেয়ালা স্পর্শ করবেন। গরম কাপের স্পর্শে মনে হবে জীবন্ত কেউ আপনার কাছে আছে।
হামিদা বলল, চা দিন।
ডাক্তার সাহেব ফ্লাস্ক থেকে এক মগ চা ঢেলে হামিদার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন— মাঝে মাঝে আমাদের কানে বাস্তব কিছু সমস্যা হয়। ইনার ইয়ারে খুব সূক্ষ্ম একটা হাড় থাকে। হাড়টা থাকে তরল পদার্থে ডুবানো। এই তরলে যখন কোনো সমস্যা হয় ঘনত্বের সমস্যা, ভিসকোসিটির সমস্যা, ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা তখন মানুষ মাথার ভেতর নানা রকম শব্দ শুনে। কেউ শুনে ঝিঝির ডাক, কেউ শুনে ঘুণপোকার ডাক। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে, নাম ঘুণপোকা। সেই উপন্যাসের নায়কের মাথার ভিতর সব সময় ঘুণপোকা ডাকত। আপনি কি উপন্যাসটা পড়েছেন?