জি।
হয়েছে কী–জ্বর?
জ্বর সামান্য আছে। শইলে পানি আইছে।
বলো কি? ডাক্তার দেখিয়েই?
জ্বি না। দেখি স্যার যদি রাজি হন তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাব।
আলাউদ্দিনকে দেখে হাজী সাহেব চমকে উঠলেন। এই কদিনে কী হয়েছে। মানুষটাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। মুখ এ ফুলেছ যে চোখই ঢাকা পড়ার অবস্থা। জায়গায় জায়গায় চুল উঠে যাচ্ছে। এখন তাঁর মাথায় খাবলা খাবলা চুল। শরীরে মনে হয় রক্ত নেই। মুখ সাদা, ঠোঁট সাদা। হাজী সাহেব কুটুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরে বিকটু পচা গন্ধ। গন্ধটা কোথেকে আসছে?
কুটু বলল, ইঁদুর মইরা পইচা গেছে। পচা ইঁদুরের গন্ধ। কোন চিপা চাপায় মরছে খুঁইজা পাইতেছি না।
দরজা জানালাও তো সব বন্ধ। দরজা জানালা খোল, পর্দা সরাও, ঘরে আলো বাতাস আসুক। দরজা জানালা খুলে রাখলে পচা গন্ধ কিছু কমবে। মেঝে ফিনাইল। দিয়ে ধুয়ে দাও।
কুটু মিয়া বলল, জ্বি আচ্ছা।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো?
আলাউদ্দিন ফিসফিস করে বললেন, আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাই।
হাজী সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ক্ষমা চাচ্ছ কেন? অপরাধটা কী করেছ?
বইটা লিখতে পারছি না। হস্তরেখা বিজ্ঞান।
তোমার শরীরের যে অবস্থা— এই অবস্থায় বই লেখা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি অতি দ্রুত কোনো হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি হও। আজ কালের মধ্যে ভর্তি হও।
আলাউদ্দিন বললেন, আমার শরীরটা দুর্বল, এছাড়া আর কোনো অসুখ বিসুখ নাই।
হাজী সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলছ অসুখ বিসুখ নাই! তোমার তো হাত পায়ের সব আঙুল নীল হয়ে আছে। আমার ধারণা তোমার সিরিয়াস কিছু হয়েছে। অবশ্যই তুমি আজ ডাক্তারের কাছে যাবে। আমি সন্ধ্যাবেলা গাড়ি নিয়ে আসব। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ডাক্তার বললে হাসপাতালে ভর্তি হবে।
আলাউদ্দিন বললেন, জি আচ্ছা।
তুমি তৈরি থাকবে। আমি ঠিক চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে চলে আসব। হামিদাকে আজ আর অনলাম না। তোমাকে ডাক্তার নিশ্চয়ই হাসপাতালে ভর্তি করবে। হামিদা খালি বাড়িতে এসে কী করবে! ও কয়েক দিন পরে আসুক। আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
জি আচ্ছা। আপনার অনেক মেহেরবানি।
মেহেরবানির কিছু না, এটা আমার কর্তব্য। তুমি তো বাইরের কেউ না। তুমি এখন আমার আত্মীয়। ভাগ্নিজামাই। তোমাকে তো আমি আসল কথাই বলতে ভুলে গিয়েছি। তোমার কাছে পুলিশ আসতে পারে। যদি আসে, বলবে আমি কিছুই জানি না। আমার শরীর খারাপ। রাত আটটার সময় দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছি।
আলাউদ্দিন বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমি কী জানি না?
ইয়াকুবকে কখন কুকুরে কামড়েছে আর কখন সে মারা গেছে কিছুই জানো। না।
আমি তো আসলেই কিছু জানি না। ইয়াকুব কে?
কিছু যদি না জানো তাহলে ইয়াকুব কে এটাও জানার দরকার নেই। এই জগতে যত কম জানা যায় ততই ভালো। আমি উঠলাম। বিকেলে আসব। হামিদাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি। তুমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাও।
আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। হাসপাতালে ভর্তি হতে বললে ভর্তি হব। যদি বলেন এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে আমি চলে যাব।
হাজী সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সেটা আমি জানি। তুমি নিতান্তই ভালো মানুষ। আফসোস, হামিদা এটা বুঝতে পারছে না। যাই হোক তোমার ঘরে আমি আর থাকতে পারছি না। পচা গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার বাবুর্চিকে বলে সে যেন খাট পালঙ্ক সরিয়ে মরা ইঁদুর খুঁজে বের করে। গন্ধেই তো। মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে।
আলাউদ্দিন বললেন, আমার বাবুর্চি বিষয়ে একটা কথা ছিল। হামিদা বলেছে বাবুর্চিকে বিদায় করে দিতে। আজকেই চলে যেতে বলেছে। তাকে কি বিদায় করে দেব।
হাজী সাহেব বললেন, আরে না ও থাকুক। যেতে হলে পরে যাবে। এখন। তাকে বলে— পচা ইঁদুরটা খুঁজে বের করতে।
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। পচা ইদরটা কোথায় তিনি জানেন। বুক। শেলফের পেছনে। কুটু মিয়াই এনে রেখেছে। কুটুর যুক্তি হলো— মদ যারা খায়। তাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হয়। ঘরে কোনো পচা ইঁদুর থাকলে সেই ইঁদুরের বিকট গন্ধে অন্য গন্ধ কেউ টের পাবে না। আলাউদ্দিন কুটুর বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। আসলেই তো ঘটনা সে-রকম। হাজী সাহেব কিছুই টের পান নি। পচা ইঁদুরের গন্ধে আলাউদ্দিনের নিজের অসুবিধা হচ্ছে না। পচা গন্ধটা নাকে সয়ে গেছে।
হাজী সাহেব দোতলার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়ির গোড়ায় কালো কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আরেকটা কুকুর যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় কুকুরটা ছোট। দুটা কুকুরই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চোখ চকচক করছে। শ্বাপদ প্রাণীদের চোখ রাতে জ্বলে, এদের দেখা যাচ্ছে দিনেই জ্বলছে। হাজী সাহেব উপর থেকে বললেন- এই যাহ!
দুটা কুকুর দুদিকে সরে গেল। তবে বেশি দূর গেল না। মাঝখানে জায়গা রেখে দুপাশে দাঁড়াল। এবং তাকিয়ে রইল হাজী সাহেবের দিকে। এক মুহূর্তের জানো ও দৃষ্টি সরালি না।
হাজী সাহেব একবার ভাবলেন কুটুকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। হাতে লাঠিসোঠা থাকবে। কুকুর দুটিকে দেখতে ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। রাস্তার নেড়ি কুকুর যেরকম থাকে সে-রকম। কিন্তু এরাই তো ইয়াকুবকে কামড়ে মেরে ফেলেছে। যদি তাকে তাড়া করে। তাছাড়া এদের চোখের দৃষ্টি ভালো না। হাজী সাহেব নিচে নেমে এলেন। তিনি ঠিক করে রেখেছেন যদি তাকে দেখে কুকুর দুটা কাছে এগিয়ে আসে তাহলেই দোতলায় উঠে কুটুকে নিয়ে আসবেন। কুকুব দুটা যে-রকম দাঁড়িয়ে ছিল সে-রকম দাঁড়িয়ে রইল। হাজী সাহেব উঠোনে নামলেন।