হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে ধমক দিয়ে বলেছেন— তোমার কাজ হলো অন্য বই থেকে সুন্দর করে কপি করা। কপি করবে, পাণ্ডুলিপি জমা দিবে, ক্যাশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। প্রচ্ছদ কী হবে, বই-এর নাম কী হবে, লেখকের কোন নাম যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ক্লিয়ার?
আলাউদ্দিন বিনীত ভঙ্গিতে বলেছেন, ক্লিয়ার।
হাজী একরামুল্লাহর বয়স আলাউদ্দিনের চেয়ে খুব বেশি না। তবে তিনি আলাউদ্দিনকে তুমি করেই বলেন। আলাউদ্দিন তাতে কিছু মনে করেন না।
রান্নার বইটাতে লেখক হিসেবে নাম ছাপা হয়েছে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর। বই-এর ফ্ল্যাপে লেখিকার ছবি এবং জীবনবৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। লেখিকা পৃথিবীর নানান দেশ ভ্রমণ করেছেন। মালয়েশিয়ার পেনাং-এ একটি আন্তর্জাতিক রন্ধন প্রতিযোগিতায় সিনিয়র গ্রুপে স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় বইটির নাম ছোটদের হাদিসের কথা। বই-এর প্রচ্ছদে খেজুর গাছের ছবি। খেজুর গাছের নিচে একটা উট। অনেক দুরে মসজিদের মিনার। বইটিতে লেখকের নাম ছাপা হয়েছে- মৌলানা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান খান।
আলাউদ্দিন বর্তমানে লিখছেন হাত দেখার বই। বইটার নাম সহজ হস্তরেখা বিদ্যা এবং তিল তথ্য। হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে বলে দিয়েছেন এই বইটার ভাষা হবে খটমটা। এসেছি, গিয়েছি টাইপ ভাষা না। সাধু ভাষা। কারণ। বইটির লেখক হিসেবে নাম যাচ্ছে স্বামী অভেদানন্দের। স্বামী অভেদানন্দ জটিল ভাষায় লিখবেন এটাই স্বাভাবিক।
এইসব বই-এর পাশাপাশি পাঠ্য বই-এর নোটও তিনি লেখেন। সেখানে নাম যায়—কে, এন, লাল, এক্স প্রিন্সিপ্যাল এন্ড কালি নারায়ণ স্কলার।
খাটের ওপর একটা টুলবক্স। আলাউদ্দিন খাটে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন। চিন্তা শেষ করে এ4 কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখছেন। লেখায় কাটাকুটি তার অপছন্দ। লেখা যা পছন্দ হচ্ছে না তা তিনি ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলছেন। টুলবক্সের ওপর তিনটা পেনসিল সাজানো। পেনসিলের পাশে ইরেজার। যে সব বই দেখে দেখে তিনি লিখছেন সেই বইগুলি খাটে ছড়ানো।
আজ সন্ধ্যা থেকেই শিররেখার চ্যাপ্টারটা লিখছেন। লেখা যত দ্রুত হওয়া উচিত তত দ্রুত হচ্ছে না। লিখে আরাম পাচ্ছেন না। কখনো মনে হচ্ছে ভাষা বেশি খটমটে হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো মনে হচ্ছে বেশি সহজ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সাইফুদ্দিন সাহেবের বাসা থেকে অল্প বয়স্ক একটা মেয়ের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এই মেয়ের হাসি অত্যন্ত তীক্ষ। শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে চট করে মগজে ঢুকে যায়। মগজ রিনরিন করে কাঁপতে থাকে। লেখার কনসানট্রেশন থাকে না। আলাউদ্দিন তারপরেও লিখে যাচ্ছেন, শুধু মেয়েটা যখন হাসছে তখন লেখা খেমে যাচ্ছে। আলাউদ্দিন লিখছেন—
মানুষের পরিচয় মন ও মস্তিষ্কে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ মন ও মস্তিষ্কের সোনালি ফসল। মন নিয়ন্ত্রণ করে মানবিক আবেগ, যথা প্রেম ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে মেধা। হস্তরেখা বিজ্ঞানে শিররেখা মস্তিষ্কের পরিচায়ক। হৃদয়রেখা মনের পরিচায়ক। মন এবং মস্তিষ্ক যেমন সমান্তরাল চলে, হৃদয়রেখা এবং মস্তিষ্করেখারও হাতের তালুতে সমান্তরাল অবস্থান। এ যেন সেই চিরন্তন কথা— রেল লাইন বহে সমান্তরাল।
লেখাটা আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে না। স্বামী অভেদানন্দের লেখা বলে মনে হচ্ছে না। লেখার মাঝখানে হে বৎস জাতীয় কথা থাকা প্রয়োজন। গুরু জ্ঞান দিচ্ছেন ছাত্রকে। মানুষ না লিখে লেখা উচিত মানব। হাতের তালু না লিখে অন্য কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করা উচিত। হাতের তালু খুব কাছের কিছু মনে হচ্ছে। হাতের তালুর সংস্কৃত ক তিনি জানেন না। হাতের সংস্কৃত হস্ত। হস্ততালু নতে আবার তেমন ভালো লাগছে না।
এক বৈঠকে আলাউদ্দিন অনেকক্ষণ লিখতে পারেন। তেমন ক্লান্তি বোধ করেন না। লেখাটা দ্রুত শেষ করতে হবে। হাজী সাহেব নতুন একটা পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন। আলাউদ্দিনের দেরি হলে নতুনটা অন্য কেউ নিয়ে যাবে। তিনিই যে মুক্তি প্রকাশনীর একমাত্র ফরমায়েশি লেখক তা না। আরো লেখক আছে।
সার, খানা তৈরি।
আলাউদ্দিন রীতিমতো চমকে উঠলেন। ঘরে যে একজন বাবুর্চি আছে, সে রান্না করছে। এই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ছিল না। আলাউদ্দিন বলেন, রেঁধেছ কী?
কুটু মিয়া তার জবাবে হাসল। ম্যাজিসিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার সময় যে ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামতে নামতে বললেন, তোমার চোখে কি কোনো সমস্যা আছে? কীভাবে যেন তাকাচ্ছে।
কুটু বলল, একটা চোখে দেখি না।
সে কী! কোন চোখে।
বাম চোখে।
জন্ম থেকেই এরকম, না কোনো ব্যথা ট্যথা পেয়েছিলে?
কুটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন সাহেবের মনে হলো এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নি। চোখ নষ্ট হওয়া বিরাট দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে কষ্ট দেয়া ঠিক না। চোখ জন্ম থেকেই কষ্ট না পরে নষ্ট হয়েছে এই তথ্য জেনেও তো তার কোনো লাভ হচ্ছে না।
আলাউদ্দিন খেতে বসলেন। থালা বাসন ঝকঝক করছে। কাচের গ্লাস এত পরিষ্কার যে আলো জমকাচ্ছে। যে ছোট টেবিলটায় বসে তিনি খাওয়া দাওয়া করেন সেই টেবিল পরিষ্কার করা হয়েছে। টেবিলের ওপর ধবধবে সাদা টেবিল ক্লথ। তার যে টেবিল ক্লথ আছে এটাই তিনি জানতেন না।
খাবারের মেনু খুবই সাধারণ। আলু ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল, ডাল। এক পাশে পিরিচে লেবু, কাচা মরিচ। আলাউদ্দিন আলু ভাজি নিয়ে খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন— ব্যাপারটা কী, সামান্য আলু ভাজি তো এত স্বাদ হবে না। তার কাছে মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আলু ভাজি দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবেন। আলু ভাজি করেছেও কত সুন্দর। চুলের মতো সরু করে কাটা কাটা আলুর একটা টুকরা আর অন্যটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। সামান্য আলু ভাজিই খেতে এ রকম, মুরণির ঝোলটা না জানি কেমন! আলু ভাজি খাওয়া বন্ধ রেখে তিনি মুরগির ঝোল নিলেন। তিনি মনে মনে বললেন, কী আশ্চর্য! পাইলট সাহেব যে লিখেছেন— কুটুমিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলি জাদুকর। ঠিকই লিখেছেন, বরং একটু কম লিখেছেন। মুরগির ঝোল রান্নার কোনো কম্পিটিশনে এই মুরগির ঝোল পাঠিয়ে দিলে গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে আসবে। রান্নার বইটা তিনি না লিখে কুটু মিয়াকে দিয়ে লেখানো দরকার ছিল।