কুটু শোন, বাড়িতে গিয়ে আমি যেন তোমাকে দেখতে না পাই। তোমার চাকরি অনেক দিন হয়েছে। এখন চাকরি শেষ। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জ্বি। তরকারিটা কি রাইখা যাব, না নিয়ে যাব?
হামিদা ক্লান্ত গলায় বলল, তরকারি যা ইচ্ছা কর। ঐ তরকারি আমি খাব না। এখন আমার সামনে থেকে বিদেয় হও। সাময়িক বিদায় না পুরোপুরি বিদায়। আমি আমার বাড়িতে যখন যাব তখন যেন তোমাকে না দেখি।
হাজী সাহেব বইয়ের দোকানে বসে আছেন। তাঁর চোখ মুখ শুকনা। মুখ হা করা। তিনি পান খাচ্ছিলেন। পান চিবানো বন্ধ হওয়ায় মুখে পানের রসের আস্তরণ জমে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার মুখের ভিতরে খয়েরি রং করে দিয়েছে। হাজী সাহেব দশ মিনিট আগে খবর পেয়েছেন ইয়াকুব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে। কুকুরের কামড়ে কেউ মারা গেছে এটা তিনি আগে শুনেন নি। কুকুর সুন্দরবনের বাঘ না। ঝেড়ে লাথি দিলে কুকুর পালাবার পথ পায় না। সেই কুকুর কামড়ে মানুষ মেরে ফেলেছে— এটা কেমন কথা!
ইয়াকুবের এক চাচাতো ভাই দোকানের সামনে এসে বিরাট হৈচৈ শুরু করেছে। তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। সে আকাশ ফাটিয়ে চিক্কার করছে— কুত্তা দিয়া আমার ভাইরে খাওয়াইছে। কী সর্বনাশ করছে গো! কুত্তা দিয়া আমার ভাইরে খাওয়াইছে। আফনেরা বিচার করেন। আমার আদরের ভাইরে কুত্তা খাইয়া সেলাইই।
হাজী সাহেব ম্যানেজারকে বললেন, টাকা দিয়ে যেন এর মুখ বন্ধ করা হয়। তারপর আড়ালে নিয়ে যেন শক্ত থাপ্পড় দেয়া হয়।
হাজী সাহেবের মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। তার সামনে নানান ঝামেলা। হাসপাতাল থেকে ডেডবড়ি আসবে। সেই ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে। সঙ্গে টাকা পয়সা দিতে হবে। পুলিশের ঝামেলা ও হবে। গন্ধে গন্ধে পুলিশ চলে আসবে। অস্বাভাবিক মৃত্যু মানেই পুলিশের মুখে হাসি। ওসি সাহেব তদন্তে আসবেন। গলা নিচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলবেন- ইয়াকুব হলো প্রেসের কর্মচারী। সে তো দারোয়ানের কাজ জানে না। তারপরেও তাকে আপনি দারোয়ানের কাজে কেন পাঠালেন?
যে কুকুরগুলি মানুষ মেরেছে তারা তো আপনার ভাগ্নির পোষা কুকুর। আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি কুকুরগুলি আপনাদের লোকের ইশারায় ঝাপিয়ে পড়েছে। ঘটনা কি সত্যি সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, আপনাকে আর আপনার ভাগ্নিকে একটু থানায় যেতে হবে।
পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্যে ম্যানেজারকে আগেভাগেই থানায় পাঠানো দরকার। হামিদার বাড়িতেও যাওয়া দরকার। আলাউদ্দিনকে সবকিছু বুঝিয়ে আসতে হবে। পুলিশ যদি তদন্তে আসে তাহলে যেন উল্টাপাল্টা কিছু না। বলে। তাকে বলতে হবে নকশন কুকুর কামড়েছে আমি কিছুই জানি না। আমার শরীর খারাপ ছিল। আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিলাম।
লাশের সুরতহাল হবে। সুরতহালের রিপোর্টে যেন কিছু না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সুরতহাল যে ডাক্তার করবে তাকে টাকা খাইয়ে রাখতে হবে। যেন সে ঠিকঠাক লেখে কুকুরের কামড়ে মৃত্যু। উল্টাপাল্টা কোনো লাইন লিখে ফেললে সাড়ে সর্বনাশ।
হাজী সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। সভাবে মরেও রক্ষা নাই। চারদিকে টাকা খাওয়াতে হচ্ছে। এরচে আফসোসের কারণ আর কী হতে পারে! ইয়াকুবের ভাইয়ের চিঙ্কার বন্ধ হয়েছে। তাকে সাতশ টাকা দেয়া হয়েছে। সে এখন বেশ খুশি মনেই দোকানের এক কোণায় বসে পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে মানুষের ভিড় কমছে না। বরং বাড়ছে।
হাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আজ আর দোকান খোলা রাখা যাবে না। বসতে হলে প্রেসে গিয়ে বসতে হবে। তারও আগে আলাউদ্দিনের কাছে যেতে হবে। হামিদাকে আজ কেন আনলেন সেটা তাকে বলা দরকার। সে নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। হয়তো দেখা যাবে হামিদার বাড়ির সামনে ও রাজ্যের ভিড়। টিভি ক্যামেরা চলে এসেছে। চ্যানেল গুলি চালু হওয়ায় আজকাল নতুন জিনিস শুরু হয়েছে। অন দা স্পট নিউজ। চেংড়া কোনো ছেলে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে হামিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করবে—
এই সেই ঘাতক বাড়ি। এই বাড়িরই দুটি কুকুরের আক্রমণ প্রাণ দিতে হলো নিরীহ ইয়াকুবকে। ঐ যে দেখা যাচ্ছে ঘাতক কুকুর দুটিকে। তাদের শান্ত চেহারা, আলস্যের লেজ নাড়া লেখে কে বলবে এরা দুই হন্তারক!
হাজী সাহেব হামিদার বাড়ির সামনে এসে খুবই অবাক হলেন। নিরিবিলি বাড়ি পড়ে আছে। চারপাশে কেউ নেই। হাজী সাহেব ভয়ে ভয়ে গেট খুললেন। তার মনে শঙ্কা কখন কুকুর দুটি ছুটে আসে। বাড়ির আশেপাশে কোনো কুকুরই নেই। দোতলায় উঠার সিড়ির গোড়ায় একটা কালো কুকুর দেখা গেল। সে হাজী। সাহেবকে দেখে কুঁই কুঁই করে উঠে চলে গেল। কুকুরটাকে মোটেই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। রাস্তার নেড়ি কুকুর কখনো ভয়ঙ্কর হয় না। এদের জীবন কাটে ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে খাবারের সন্ধানে। কুকুরসুলভ গুণাবলী এদের মধ্যে দেখা যায় না। হাজী সাহেব কুকুরটার দিকে তাকিয়ে যাহ বলতেই কুকুরটা যেভাবে চমকে লাফিয়ে উঠল এবং কুই কুই করতে করতে পালিয়ে গেল তা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় মানুষকে কামড়ানোর সাহস এই কুকুর কোনোদিনও সংগ্রহ করতে পারবে না।
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল কুটু। সে হাজী সাহেবকে দেখে বিয়ে। প্রায় নুয়ে গেল। হাজী সাহেব বললেন, কেমন আছ?
কুটু বলল, ভালো আছি জনাব।
আলাউদ্দিন বাসায় আছে?
জি আছেন। শুয়ে আছেন।
শুয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ