আলাউদ্দিন সাহেবের ভয় কেটে যায়, তখন তার গল্প করতে ইচ্ছা করে।
তাঁর কাছে মনে হয় আহারে মানব জনম বড়ই মধুর। আল্লাহপাক মানুষ বানিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে বলেই না তিনি এত আনন্দ করতে পারছেন। মুরগি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে তো কুটু মিয়া জাতীয় কেউ একজন তাকে রান্না করে ফেলত। লোক খেয়ে বলত— মজা হয়েছে তবে ঝাল একটু বেশি। গরু বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে লোকজন তার শরীরের চামড়ায় জুতা বানিয়ে হাঁটাহাঁটি। করত। তার কত সৌভাগ্য মানুষ হয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। পাইলট স্যারের মতো ভাগ্যবান হতে পারেন নাই। জীবনে কখনো বিমানে চড়েন নাই পাইলট হওয়া তো দূরের কথা। পাইলট না হয়েও তিনি যা পেয়েছেন তাও তো কম না। এই পরম সৌভাগ্য নিয়ে কথা বলার জন্যে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এক সময় অস্থির হয়ে ডাকেন, কুটু কুটু কুটু।
কুটু সাড়া দেয় না। কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
কে দেখা করতে এসেছে
আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে? কে দেখা করতে এসেছে?
ঐ যে লোকটা শইল্যে বন ঘেরান।
কুটু মিয়া?
জ্বে কুটু মিয়া। আাগো আমার ডর লাগতাছে।
হামিদা বিছানায় শুয়ে ছিল, উঠে বসল। তার ইচ্ছা আসিয়াকে একটা কড়া। ধমক দেয়। আহ্লাদী ধরনের কথা অসহ্য লাগে। আমার ভয় লাগতাছে মানে কী? ভর লাগার কী হয়েছে? এইসব হচ্ছে মন রাখার কথা। আলিয়া বুঝতে পারছে কুটুকে তার আপা অপছন্দ করছে- কাজেই সে ডুর লাগার কথা বলছে। যদি এমন হতো সে কুটুকে পছন্দ করত তাহলে আসিয়া বলত— লোকটা এমুন ভালো। দেখলেই মনে শান্তি শান্তি লাগে।
হামিদা বলল, সে কী চায়?
আফনের সাথে কথা বলতে চায়। হাতে আইসক্রিমের বাটি। মনে হয় তরকারি আনছে। আফাগো হের তরকারি খাইয়েন না। হের শইল দিয়া ভুরভুর কইরা পচা গোবরের বাস আসতাছে।
হামিদা বলল, আসিয়া এত কথা বলার দরকার নেই। আমি ওর তরকারি খাব কি খাব না সেটা আমি ঠিক করব। আজ কি বার?
বুধবার।
আজ কি নয় তারিখ?
জানি না আফা।
আজ যে নয় তারিখ, বুধবার এই তথ্য হামিদার জানা আছে। তারপরেও অন্যের কাছে জানতে চাওয়ার অর্থ কি এই যে হামিদা চাচ্ছে না আজকের দিনটা বুধবার হোক? তার অবচেতন মন আসিয়ার কাছ থেকে অন্য কিছু শুনতে চাচ্ছে। হামিদা খাট থেকে নামল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের কোণার দিকে তাকাল। দুটা সুটকেস রেডি করা আছে। কুটুর হাতে স্যুটকেস দুটা দিয়ে সে এখনই চলে যেতে পারে। যেতেই মুম্বন হবে আগে যাওয়াই কি ভালো না? কিন্তু মন টুনিছে না। একেবারেই মন টানছে না।
হাজী সাহেবের বসার ঘরে কুটু দাঁড়িয়ে আছে। হামিদাকে দেখে সে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। হামিদা বলল, কী ব্যাপার কুটু?
কুটু জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কুটুর গা থেকে কোনো পচা গন্ধ আসছে না। লেবুর গন্ধের মতো গন্ধ আসছে। অতি হালকা ঘ্রাণ কিন্তু স্পষ্ট। লেবু বাগানে যখন লেবু ফুল ফুটে তখন বাগানের আশেপাশে এমন সৌরভ পাওয়া যায়। আসিয়া বলছিল পচা গোবরের গন্ধ। আসিয়ার কথা সত্যি না।
হামিদা দ্রুত চিন্তা করছে। কুটুর গা থেকে আগেও একবার লেবুর গন্ধ এসেছিল। আজ আসছে। এর পেছনে কোনো কারণ কি আছে? কুটু কি জানে লেবুর গন্ধ তার খুব পছন্দের?
কুটু বলল, আপনার জন্য তরকারি আনছি। কাইল রাইতে এই তরকারিটা খাইয়া স্যার খুব পছন্দ করছিলেন। স্যার বললেন, আপনার জন্য এক বাটি পাঠাইতে।
হামিদা বলল, তুমি কিসের তরকারি এনে আমি একটু আন্দাজ করি। দেখি আমার আন্দাজ ঠিক হয় কি-না। তুমি এনেছ শিং মাছের ডিমের তরকারি। আমার আন্দাজ কি ঠিক হয়েছে?
কুটু চাপা গলায় বলল, জ্বি আপা।
হামিদা বলল, আমার অনুমান করার শক্তি দেখে তুমি মুগ্ধ হও নি?
কুটু জবাব দিল না। হামিদা বলল, আমি নিজে কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি। অনুমান। কীভাবে করলাম জানো? শিং মাছের ডিমের কোল আমার খুব পছন্দের। দেশের বাড়িতে মা এই রান্নাটা রাধতেন। ভালো কোনো খাবারের কথা মনে হলেই আমার শিং মাছের ডিমের কথা মনে হয়। আমার পছন্দের জিনিসগুলি তুমি কীভাবে টের পাচ্ছ?
কুটু মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। যে আইসক্রিমের বাটিতে করে সে ডিম নিয়ে এসেছিল সেই বাটি সে এখন পিঠের দিকে সরিয়ে রেখেছে।
হামিদা বলল, তুমি কি মানুষের মনের কষ্মা বুঝতে পার? দাঁড়িয়ে থেক না। কথার উত্তর দাও।
কুটু না-সূচক মাথা নাড়ল।
হামিদা বলল, তুমি আমাকে চা বানিয়ে খাইয়েছিলে। দেখা গেল যে চা আমাকে খাইয়ে সেই মশলা চা অনেক দিন থেকেই আমার খাওয়ার শঙ্খ। আমার জন; তরকারি নিয়ে এসেছ। দেখা গেল যে তরকারি এনেছ সেই তরকারি অনেক দিন থেকে আমার খাওয়ার শখ। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
কুটু বিড়বিড় করে বলল, আমি নিজেও কিছু বুঝি না আপা।
হামিদা বলল, আজ আমি ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। সে-রকম কথা আছে। তুমি কি সেটা জানো?
জানি।
যদি জানো তাহলে তরকারি নিয়ে এলে কেন?
কুটু নিচু গলায় বলল, আপনারে বলতে আসছি যেন আপনি না যান।
আমার নিজের বাড়িতে আমি যাব না?
অবশ্যই যাইবেন আপা। কয়েকটা দিন পরে যাইবেন। কয়েকটা কুত্তা আইসা। জুটছে। কুত্তাগুলা খুবই উপদ্রব করতেছে। এর মধ্যে একটা কুত্তার হইছে জ্বলাতঙ্ক। পাগলা কুত্তা।
তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আমি আমার নিজের বাড়িতে যাব না— কুকুরের ভয়ে? আমি অবশই যাব। আজই যাব।
জ্বি আচ্ছা।