আমি এইসব জিনিস খাই না স্যার।
খাও না?
জ্বি না।
কোনোদিনই খাও নি?
জ্বি না।
আফসোস, একটা ভালো জিনিস থেকে বঞ্চিত থেকে গেলে। খুবই আফসোসের কথা। কুটু শোন, তোমার কি গরম লাগছে?
স্যার আইজ গরম ভালো পড়ছে।
এক কাজ কর— বাঘটাৰে পানি দাও। পানির মধ্যে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি।
এখন রাইত একটা বাজে। এত রাইতে বাথটাবে নামবেন?
কোনো অসুবিধা আছে?
জি না।
আমি ঠিক করেছি আজ বাথটাবেই ঘুমাব। কেন ঠিক করেছি বলতে পারবে?
গরম লাগছে এই জন্যে।
হয় নাই। দশে শূন্য পেয়েছ। আজ বাথটাবে গোসল করব, কারণ হলো— মানুষের যখন যা করতে ইচ্ছা হয় তা করা উচিত। মানুষ আর বাজে কত দিন! ঠিক না?
জ্বি।
একটা কচ্ছপ তিনশ বছর বাঁচে। আর মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখ। যাট হয়েছে কী শেষ। আমার হয়েছে তিপ্পান, আর মাত্র সাত বছর বাকি। কাজেই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে যা করতে ইচ্ছা করবে তাই করব? কে কী চিন্তা করছে
এইসব নিয়ে ভাবব না।
জি আচ্ছা।
বাথটাবে পানি লাগাও। গ্লাস শেষ হয়ে গেছে, এই জিনিস আরো দাও।
জি আচ্ছা।
আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে আসছে কুটু। বুধবার জামিল চলে আসবে।
তাই না?
জি।
চলে এলেও কিছু করার নেই, সব নিয়তি।
জ্বি স্যার নিয়তি।
কুকুরের ডাক মনে হয় একটু কমেছে।
জ্বি কমছে।
সর্বমোট কয়টা কুকুর?
এখন আছে পাঁচটা।
এরা কী করছে? বাড়ির চারদিকে চক্কর দিচ্ছে?
জ্বি স্যার।
খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। এদের কারণে বাইরের কেউ আমাদের কাছে আসতে পারছে না— এই একটা ভালো দিক। তুমি এখন থেকে এদের এক থালা করে খাবার দিও। জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিচ্ছে ঈশ্বর। কথাগুলি কে বলেছে ভুলে গেছি কিন্তু খুবই দামি কথা। রোজ এদের ভালোমন্দ খাওয়াবে।
জ্বি আচ্ছা।
বাথটাবে কি পানি দেওয়া হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলছি তো স্যার।
বাথরুমে যাই নাই।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বাথরুম থেকে কথা বলো। গ্লাসটা খালি। তাড়াতাড়ি তোমার জিনিস নিয়ে আস। টাইম ইজ শর্ট। অর্থাৎ সময় সীমিত। মাত্র আট বছরেই সব শেষ। আমার আছে মাত্র সাত বছর। বিরাট আফসোস।
রাত তিনটা। বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে আলাউদ্দিন শুয়ে আছেন। বাড়ির সমস্ত বাতি নেভানো। তবে বাথরুমে সামান্য আলো আছে। শোবার ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলাভ আলো বাথরুমে পর্যন্ত এসেছে। কুটু মিয়া বাথটাবের পাশে বসে আছে। আলাউদ্দিন চোখ মেলতে পারছেন না। তাঁর কথাও জড়িয়ে আসছে। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না— কষ্ট করে জেগে আছেন। তিনি খুবই আনন্দ। পাচ্ছেন। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সব আনন্দ শেষ। আনন্দ উপভোগ করতে হলে। জেগে থাকতে হয়।
কুটু?
জ্বি স্যার।
বড় আনন্দ লাগছে কুট। শুধু চোখ মেলে রাখতে পারছি না— এইটাই সমস্যা।
চোখ বন্ধ কইরা রাখেন স্যার।
রাতে আর ভাত খাব না।
জ্বি আচ্ছা।
এখন থেকে একবেলা ভাত খাব। কুকুরদের যখন খেতে দিবে তখন আমাকেও দিও। ওরা যা খাবে আমিও তাই খাব। কুকুর বলে ওদের অবহেলা করা ঠিক হবে না। কবি বলেছেন— জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। কুকুর ও একটা জীব।
জ্বি।
পাইলট সাহেব কি কুকুর পছন্দ করতেন?
খুবই পছন্দ করতেন। উনার তিন জাতের কুকুর ছিল। এ্যালশেশিয়ান ছিল, জার্মান একটা কুকুর ছিল থাবরা নাকী, আর দুইটা কুকুর ছিল পর্তুগালের। মেয়ে কুকুর। উনি ঐগুলারে আদর কইরা ইকড়ি মিকড়ি নামে ডাকতেন।
উনার বিদেশী আর আমার দেশী নেড়ি কুত্তা। যাই হোক, আমার কাছে দেশী বিদেশী সবই সমান। গাহি সাম্যের গান। আমার চক্ষে দেশী বিদেশী কোনো ভেদাভেদ নাই… আচ্ছা কুটু শোন, প্রায়ই ভাবি একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করব। পরে আর মনে থাকে না। এখন মনে পড়েছে। জিজ্ঞেস করি?
জ্বি স্যার করেন।
পাইলট সাহেব ছাড়াও তো কুয়েতি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে তুমি কাজ করতে। তার কথা তো তুমি কিছু বলে না। উনি লোক কেমন ছিলেন?
অতি ভালো লোক ছিলেন স্যার। উনার তিন স্ত্রী ছিল। স্ত্রীদের সঙ্গে বনিবনা হইল না। আলাদা বাড়ি বানায়ে থাকা শুরু করলেন।
শুধু তুমি আর উনি?
জি।
উনার বাড়িতে কি বাথটাব ছিল?
উনি আশীর মানুষ, উনার বাড়িতে বাথটাব তো থাকবই। উনার বাথটাবের সব ফিটিংস ছিল সোনার।
বলো কী?
উনার বাথরুমে সোয়ানা ছিল, জুকুচি ছিল।
ঐগুলা কী?
সোয়ানা হইল পানির গরম ভাপ গোসলের ব্যবস্থা। আর জুকুচি বাথটাবের মতো পানির বুদবুদ হয়। শইলে পানি দিয়া আপনা আপনি ম্যাসাজ হয়।
উনার নাম কী?
শেখ আব্দাল রহমান। অত্যন্ত পরহেজগার আদমি ছিলেন স্যার। যখন উনার শরীরে গোটা গোটা ফোসকা উঠল, উনি বিছানা থেইকা উঠতে পারেন না–তখনো নামাজ কাজা করে নাই। শুইয়া শুইয়া আঙুলের ইশারায় নামাজ পড়ছেন।
আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, উনার শরীরেও ফোসকা উঠেছিল না কি?
কুটু বলল, জ্বি।
সালাউদ্দিন বললেন, ফোসকার ভেতরে পোকাও ছিল?
জ্বি।
এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা তোমার ভাগ্যে সব ফোসকাওয়ালা লোক পড়ে যাচ্ছে।
জ্বি। এইটা ভাই মনটা খারাপ।
আলাউদ্দিন কুটুকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, মন খারাপ করবে না। তাদের কপালে ছিল ফোসকা। তুমি আমি কী করব বলো। তোমার আমার কিছুই করার নাই…।
বাক্য শেষ করার আগেই আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। তিনি ভীত গলায় ডাকেন— কুটু।
কুটু তার ঘর থেকে সাড়া দেয়— জ্বি স্যার।