এই হচ্ছে অবস্থা। খুব যে ভালো অবস্থা না, তা তো বুঝতেই পারছ। তবে এইসব নিয়ে তোমরা মোটেই দুশ্চিন্তা করবে না। আমি নিশ্চিত প্রতিটি সমস্যারই আমি সমাধান করব। আমি যে খুব শক্ত মেয়ে তা আর কেউ জানুক বা না জানুক তোমরা দুই বোন জানোকাজেই দুশ্চিন্তা করবে না। আগামীকাল সকালে আমি আমার নিজের বাড়িতে যাব। কুকুরের সমস্যাটা কী নিজের চোখে দেখে আসব। অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। আগামীকাল ছুটি শেষ। অফিস করতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছে। আমার এক মাসের রিক্রিয়েশন লিভ পাওনা আছে। ভাবছি এ ছুটিটা নেব। এবং সব হলে তোমাদের দুবোনকে দেখে আসব। আমার মাথার আউলা ভাব দূর করার জন্যে এটা খুবই দরকার। মা। তোমরা ভালো থেকো। আল্লাহ পাকের দরবারে এই আমার প্রার্থনা।
হামিদা চিঠি শেষ করে উঠল। মাথার চাপা যন্ত্রণাটা এতক্ষণ ছিল না। এখন। আবার শুরু হয়েছে। ক্ষিধেও লেগেছে। নিচে গিয়ে কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। হামিদা বাথরুমে ঢুকে ভালো মতো হাতে মুখে পানি দিল। দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে। বিছানায় শুয়ে পড়ল। গত এক সপ্তাহ ধরেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেল সে তৃপ্তি মতো ঘুমুতে পারছে না। কে জানে হয়তো। এই জীবনে সে আর কোনোদিনও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমুতে পারবে না।
অনেক দূরে কোথায় যেন কুকুর ডাকছে। ভারী গলায় ডাকছে। শহরে কুকুরের ডাক শোনা অস্বাভাবিক কিছুই না। কিন্তু এই কুকুরটা কি অন্যরকম করে ডাকছে? হামিদা পাশ ফিরল। তার নিজের উপরই বিরক্তি লাগছে। সে এমন দুর্বল। হয়ে যাচ্ছে কেন? কুকুর যেভাবে ডাকে এই কুকুরটাও সেইভাবেই ডাকছে। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে ডাকটা অন্যরকম। মন দুর্বল হলে এ রকম হয়। স্বাভাবিককে মনে হয় অস্বাভাবিক। হামিদা মাথা থেকে কুকুরের ডাকটা সরাবার চেষ্টা করল। সরানো যাচ্ছে না। কুকুরটা ডেকেই যাচ্ছে। এই ডাক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হামিদা। ঘুমুতে পারবে না।
দরজায় টোকা পড়ল। হামিদা বলল, কে?
হামিদার কাজের মেয়ে আসিয়া ভীত গলায় বলল, আফা আমি।
হামিদা বলল, কী চাও এত রাতে?
আফনের খাওন আনছি।
আমি তো বলে দিয়েছি রাতে খাব না।
মামি পাঠাইছে। সাথে দুধ আনছি। কিছু না খাইলে দুধটা খান।
হামিদা দরজা খুলল। তার ভালোই ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু না খেলে ঘুম ও আসবে না। কুকুরটা ভালো যন্ত্রণা করছে। এখনো ডাকছে। মনে হয় তার গায়ে গরম মড়ি ফেলে দিয়েছে কেউ। ব্যথা না কমা পর্যন্ত সে ডাকতেই থাকবে। হামিদা বলল, লতিফঃ তুমি কি কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছ? বিশ্রী করে একটা কুকুর ডাকছে।
লতিফা বলল, কুত্তার ডাক তো শুনি না আফা।
অনেক দূরে একটা কুকুর ড্রাকছে, শুনতে পাচ্ছ না?
জি না।
হামিদা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। লতিফা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু কুকুর ঠিকই ডাকছে। একটা কুকুরের সঙ্গে আরো কয়েকটা কুকুর যুক্ত হয়েছে। আসলে ঘটছে কী?
হামিদা চোখ মুখ শক্ত করে বলল, ভাত দুধ কিছুই খাব না। নিয়ে যাও।
হামিদা চেয়ারে এসে বসল। আর তখনই সে বুঝতে পারল কুকুর দূরে কোথাও ডাকছে না। কুকুর ডাকছে তার মাথার ভেতর। এই লক্ষণ ভালো না। বিরাট অসুস্থতার লক্ষণ। হামিদার এখন উচিত অতি দ্রুত ভালো কোনো ডাক্তারকে দেখানো।
আলাউদ্দিন বললেন, কুটু কুকুরগুলি বড় যন্ত্রণা করছে।
কুটু বলল, জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন বলেন, রাত হলেই ঘেউ ঘেউ। তোমার বিরক্ত লাগে না?
কুটু বলল, কুকুরের কারণে কেউ এদিকে আসে না এইটা একটা ভালো দিক।
তা ঠিক। আমরা নিরিবিলি আছি, তাই না কুটু? কেউ আমাদের বিরক্ত করছে। হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির খোজে আমার কাছে আসবেন না।
জ্বি স্যার।
এদিকে জামিল আসছে না। এটাও খারাপ না।
জ্বি স্যার, এইটাও ভালো। আমার মনে হয় উনি আর এই বাড়িতে আসবেন না।
না এলে আমাদের তো কিছু করার নাই। আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি না আসতেই হবে। না এলে হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। তুমি আমার স্ত্রী। লিগ্যাল ওয়াইফ।
জ্বি না এরকম বলবেন কেন? আমরা কিন্তু আমাদের মতো। উনি থাকবেন উনার মতো।
আলাউদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, অবশ্যই।
কুটু বলল, না কি এখন খাইবেন না আরো পরে দিব?
আজকের খানা-টা কী? নতুন কিছু?
জি।
কী রান্না করেছ বলো দেখি।
গরুর মাংস।
ভেরি গুড। আজ সকাল থেকেই গরুর মাংস খেতে ইচ্ছা করছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। ঝাল ঝাল গরুর মাংস, সঙ্গে আলু। তুমি কি মাংসে আলু দিয়েছ?
জ্বি স্যার।
মাঝে মাঝে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় তুমি মনের কথা বুঝতে পার। সত্যি করে বলো তো, তুমি মনের কথা বুঝতে পার?
কুটু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, খানা খাইতে কি দেরি হইব স্যার?
আলাউদ্দিন বললেন, তাড়াহুড়া করার দরকার কী! ধীরে সুস্থে পাই। এখন যে জিনিসটা খাচ্ছি তার নাম কী?
এর নাম স্যার জিন।
অতি সুস্বাদু। পাইলট স্যার কি এই জিনিস খেতেন?
জ্বি খাইতেন। উনার পছন্দের জিনিস ছিল জিন এবং রাম।
রাম আবার কী?
মিষ্টি জাতীয়। খাইতে ভালো।
তোমার সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শিখলাম। রাম, লক্ষণ, সীতা… হা হা হা। রাম তো খাওয়া হয় নি। একদিন ব্যবস্থা করা।
জি আচ্ছা।
আমি একা একা এতসব ভালো জিনিস খাচ্ছি— আমার খারাপই লাগে। তুমি থাও না কেন? তুমিও খাও। কোনো অসুবিধা নেই। আমার কাছে সব মানুষ সমান। বাবুর্চিও যা খাদ্যমন্ত্রী ও তা। যাও, একটা গ্লাস নিয়ে এসো। খেতে খেতে দুজনে গল্প করি।