এখন কিছু অদ্ভুত ঘটনা তোমাকে বলি। ঘটনাগুলি কাকতালীয়। কিন্তু একের পর এক কয়েকটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটবে তাও আমি মানতে পারছি না। ব্যাপারটা কী শান— আগের কথামতো আলাউদ্দিন সাহেব এক সকালে তার বাবুর্চিকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো না। তিনি জিনিসপত্র নামিয়ে বাজারে চলে গেলেন, জরুরি কী সব কেনাকাটা না-কি বাকি আছে। তার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। তিনি জিলাপি এবং বেলি ফুল নিয়ে এসেছেন। কাকতালীয় ব্যাপারটা বুঝতে পার? বুঝতে পারা উচিত। তোমাদেরকে আমি অনেকবার বলেছি– জিলাপি এবং বেলি ফুল তোমার বাবার খুবই পছন্দের জিনিস। সে বাজারে গেলেই খুঁজে পেতে জিলাপি নিয়ে আসত। বেলি ফুলের সিজনে সে বেলি ফুল ছাড়া বাসায় এসেছে এরকম কখনো হয় নি। আলাউদ্দিন নামের মানুষটা বেছে বেছে প্রথম দিনেই জিলাপি এবং বেলি ফুল আনবে কেন? আচ্ছা ধরে নিলাম। কাকালীয়। আমাদের পৃথিবীতে বিস্মিত হবার মতো কাকতালীয় ব্যাপার যে ঘটে না তা-না। অবশ্যই ঘটে। পর পর ঘটে না।
দ্বিতীয় কাকতালীয় ব্যাপারটা সেদিনই ঘটল। আলাউদ্দিন সাহেব হঠাৎ এক সময় আমাকে জামিলা ডাকতে লাগলেন। তোমাদের আমি বলেছি যে তোমার বাবা ঠাট্টা করে আমাকে ডাকতেন— মিসেস ঝামিল। আমি শুধু ঝামেলা করি, এই জন্যেই আমার নাম মিসেস ঝামিলী। জামিলা এবং ঝামিলা এই দুটি নাম কী পরিমাণ কাছাকাছি তা কি বুঝতে পারছ? উনি যখন অবিকল তোমার বাবার মতো গলায় আমাকে জামিলা ডাকলেন আমি এতই মাক হলাম যে মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। উনি কেন আমাকে জামিলা ডাকলেন তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। আমার কাছে মনে হলো (এখনো মনে হচ্ছে) ব্যাখ্যার বাইরে অন্য কিছু আছে। সেই অন্য কিছুটা যে কী হ। ধরতে পারছি না।
আলাউদ্দিন সাহেব সঙ্গে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছেন। নাম কুটু মিয়া। অলিউদ্দিন সাহেবের আচার ব্যবহার এবং চলাফেরায় কোনো রহস্যময়তা নেই। তিনি আর দশটা মানুষের মতোই, কিন্তু কুটু মিয়া নামের মানুষটা অন্যরকম। প্রথম দেখাতেই আমি তাকে যতটা অপছন্দ করেছি আর কাউকে এর একশ ভাগের এক ভাগ অপছন্দও করি নি। তাকে দেখে প্রথম যে ধারণাটা হয় তা হলো এই লোক মানুষের সমাজে বাস করে না, এ বাস করে ম্যানহোলের। ভেতরের কোনো জগতে। সে আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াল। চায়ে মুখ দিয়েই মনে হলো কোথাও কোনো গগোল মাই। কারণ চা-টা ছিল মশলা চা। তোমাদের জন্ম হবার আগে তোমাদের বাবা একবার মামাকে নিয়ে চারদিনের জন্যে কাঠম গিয়েছিলেন। সেখানেই আমি প্রথম। মশলা চা খাই। সেই চায়ের স্বাদ আমার মুখে লেগে ছিল। কুটু মিয়া বেছে বেছে অবিকল সেই চা-ই কেন বানিয়ে দিল? ঘটনা কী?
ঘটনা অবশ্যই আছে। ঘটনার ব্যাখ্যাও আছে। আমার মাথা তোমার বাবার ভাষায় আউলা হয়ে আছে বলে ঘটনার ব্যাখ্যা বের করতে পারছি না। আমি নিশ্চিত একদিন পারব। তোমার মাথায় কোনো ব্যাখ্যা এলে আমাকে চিঠি লিখে জানি।
এখন আলাউদ্দিন সাহেব তাঁর বাবুর্চিকে নিয়ে আমার বালায় বাস করছেন। আমি চলে এসেছি বড় মামার বাড়িতে। এই অবস্থা কত দিন চলবে বুঝতে পারছি না।
এদিকে আবার আরেক সমস্যা আমার বাড়ির এক তলায় যে ভাড়াটে থাকতেন, ইঞ্জিনিয়ার শফিক সাহেব, উনি গতকাল সকালে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি প্রায় সাত বছর ছিলেন। তার মতো ভালো ভাড়াটে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম। বিপদে আপদে তার সাহায্য নিতাম। তিনি চলে যাওয়ায় আমি খানিকটা অসহায় বোধ করছি। তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটিও বিচিত্র। তিনি যা বললেন সেটা হচ্ছে— আলাউদ্দিন সাহেব কুটু মিয়াকে নিয়ে যেদিন ঐ বাড়িতে উঠলেন সেদিন সন্ধ্যায় রাস্তার একটা কালো কুকুর এসে বাড়ির বারান্দায় স্থায়ী হলো। সন্ধ্যার পর থেকে ঐ কুকুর বাড়ির চারদিকে চক্কর দেয় এবং মানুষের মতো করে কাঁদে। বাড়ির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে কুকুর বিড়ালের কান্না খুবই অশুভ বলে বিবেচনা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা অস্থির হয়ে গেলেন। কুকুরটাকে দূর করার চেষ্টা করা হলো— লাঠি দিয়ে তাড়া করলে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার চলে আসে।
পরদিন এই কালো কুকুরটার সঙ্গে আরো দুটা কুকুর যুক্ত হলো। দিনের বেলা এরা কিছু করে না। চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে। সন্ধ্যা মিলার পর থেকেই বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করে এবং কান্না শুরু করে। শফিক সাহেব মিউনিসিপালিটিকে খবর দিলেন। ওরা কুকুর ধরা গাড়ি নিয়ে এলো কিন্তু কুকুর ধরতে পারল না। শফিক সাহেব বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তাতে বিষ মিশিয়ে খেতে দিলেন। ওরা সেই মাংসে মুখ দিল না।
গত মঙ্গলবার থেকে কুকুরের সংখ্যা হয়েছে চার। এর মধ্যে একটা কুকুর শফিক সাহেবের মেজো মেয়ে এবং কাজের বুয়াকে কামড়েছে। উনার বাচ্চারা কুকুরের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারে না এমন অবস্থা। উনারা যে চলে গেছেন আমি তাদের দোষ ও দিতে পারছি না। আবার একের পর এক কুকুর এসে জুটছে এটাও মেনে নিতে পারছি না। আগে তো কখনো এই সমস্যা হয় নি। এখন কেন হচ্ছে?
বড় মামার সঙ্গে কথা বলেছি— উনি একজন দারোয়ানের ব্যবস্থা করেছেন। যার একমাত্র কাজ হলো কুকুর আটকানো। আজ সকালে খবর পেয়েছি দারোয়ানকে কুকুর কামড়েছে। একসঙ্গে দুটা কুকুর দুপায়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। নানান জায়গা থেকে খাবলে গোশত নিয়ে নিয়েছে। বড় মামা তাকে নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছেন। তাকে পেথিড্রিন ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে লাখা হয়েছে।