হাজী সাহেব বললেন, বিয়ে ভেঙে দেবার আগে তোক কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে ভুল হয়েছে।
পুরোপুরি নিশ্চিত কীভাবে হব?
পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে তার নিজের বাড়িতে গিয়ে আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে হবে। তাকে কাছাকাছি থেকে কিছুদিন দেখতে হবে। তোদের দুজনকে যে এক ঘরেই বাস করতে হবে তা তো না। তুই একটা ঘরে থাকবি। আলাউদ্দিন অন্য একটা ঘরে থাকবে। আলাউদ্দিন অবুঝ না। তাকে বললেই সে বুঝবে। আমি তোকে বেশি দিন থাকতে বলছি না। এক সপ্তাহ থাকলেই হবে।
এক সপ্তাহ?
হ্যাঁ এক সপ্তাহ। মা রাজি হয়ে যা। আমি বুড়ো মানুষ, আমি তোর কাছে হাতজোড় করছি।
হামিদা বিরক্ত হয়ে বলল, যাত্রা থিয়েটার করবে না মামা। হাতজোড় করা। আবার কী? ঠিক আছে আমি থাকব এক সপ্তাহ।
তাহলে একটা তারিখ ঠিক করে ফেলি। কবে যাবি সেই তারিখ।
ঠিক কর।
বুধবার, নয় তারিখ। ঠিক আছে? বুধবার নয় তারিখ সকালে তোকে আমি ঐ বাড়িতে রেখে আসব।
বুধবার কেন? বুধবার কি বিশেষ কোনো দিন?
একটা দিন ঠিক করতে হয় এই জন্যে ঠিক করা।
হামিদা ছোট্র নিঃশ্বাস ফেলে বলল–আমার ধারণা কী জানো মামা? আমার ধারণা তুমি আলাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আগেই আলাপ করে এই দিনটা ঠিক করে এসেছ। তার সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে এসেছ আমার কাছে। আমি কি ভুল বললাম?
হাজী সাহেব জবাব দিলেন না।
হামিদা বলল, মামা আমার বুদ্ধি কেমন?
হাজী সাহেব বললেন, তোর বুদ্ধি ভালো। মাশাল্লাহ।
হামিদা বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথাব্যথার ওষুধে এই যন্ত্রণা যাবে না। মাথার ভোতা যন্ত্রণা বিয়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে। বাড়ছে কমছে, পুরোপুরি কখনো যাচ্ছে না। হামিদা এখন প্রায় নিশ্চিত এই যন্ত্রণা কখনো যাবে না। কোনো কিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকলে যন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়। ব্যস্ত রাখার মতো কিছু হামিদা খুঁজে পাচ্ছে না।
দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। হামিদ বিরক্ত গলায় বলল, কে?
হাজী সাহেবের কাজের মেয়ে বলল, ভাত খাইতে আসেন।
হামিদা বলল, আমি রাতে কিছু খাব না। তুমি মামিকে গিয়ে বলবে খাওয়া নিয়ে একটু পরে পরে আমাকে যেন বিরক্ত না করে। আমার ঘরেও যেন খাবার না পাঠায়। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জি।
এখন যাও। খবরদার আবার ফিরে আসবে না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আবার যদি তুমি ফিরে আস, কিংবা অন্য কেউ ভাত খাওয়া খাওয়ির জন্যে সাধাসাধি করতে আসে তাহলে আমি কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।
হামিদা বিছানা থেকে উঠে দরজার ছিটকিনি লাগাল। কাগজ কলম নিয়ে। মেয়েদের চিঠি লিখতে বসল। এখানে কী ঘটছে মেয়েদের জানানো প্রয়োজন। তার বিয়ের পর মেয়েদের সঙ্গে টেলিফোনে দুতিন মিনিট করে কথা বেশ কয়েকবার হয়েছে। তাতে তাদেরকে তেমন কিছুই বলা হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ভালো মতো উজানাতে হবে। চিঠি লিখতে হবে সাবধানে, কারণ মেয়েরা এই চিঠি শুধু যে নিজেরা পড়বে তা না— তাদের স্বামীদেরও পড়াবে। বিবাহিত মেয়েদের কাছে একান্তই ব্যক্তিগত কোনো চিঠি পাঠানো যায় না। তারা আহ্লাদ দেখানোর জনেঃ ব্যক্তিগত সবকিছুই স্বামীকে দেখায়। চিঠি একটা লিখে ফটোকপি করে দু মেয়েকে পাঠালে হবে না। দুজনকে আলাদা করে লিখতে হবে।
হামিদার মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। আরো বাড়ার আগেই চিঠি শেষ করা দরকার। মেয়েদেরকে চিঠিতে অনেক আহাদ আহ্লাদী কথা লিখতে হয়। মাথার যন্ত্রণা বেড়ে গেলে আহ্লাদী কথাগুলি আসবে না।
আমার প্রিয় মা ‘রু’,
কেমন আছ গো মা মণি? কেমন চলছে তোমার সংসার? জামাই কেমন আছে? তার পায়ের পাতায় কোড়া হয়েছিল বলেছিলে। সেটার অবস্থা কী? মা গো তুমি মোজা নিয়মিত ধুয়ে দাও তো? তোমার ওয়াশিং মেশিন আছে। কাপড় ধোয়া সমস্যা হবার কথা না। আল্ডার গার্মেন্টস প্রতিদিন ধোয়া প্রয়োজন। সুজির হালুয়ার রং শাদা হয়ে যাচ্ছে কেন জানতে চেয়েছিলে। সুজি সামান্য ভেজে নিতে পার। অনেকে আবার জাফরান দিয়েও রং করে। হলুদ দিয়ে রং করতে যেও না। হলুদের তিতা একটা স্বাদ আছে। মিষ্টি জাতীয় খাবারে হলুদ দেয়া যায় না। কাচা হলুদের রস একি ফোঁটা দিল সুন্দর রঙ হয়। তোমাদের দেশে কাচা হলুদ আছে কি-না, তা তো জানি না।
এখন নিজের প্রসঙ্গে আসি। কিছু কিছু কাজ আছে, মানুষ জানে কাজটা ভুল, তারপরেও কাজটা করে। কাজটা করার পর ভুলটা যে কত বড় তা ধরতে পারে। তখন আর ভুল শোধরানোর উপায় থাকে না। আমি এ ধরনের একটা ভুল করে ফেলেছি। এখন আমার মাথা আউলা হয়ে আছে। মাথা আউলা শব্দটা তোমার বাবা ব্যবহার করতেন। মানুষটা নেই কিন্তু সে তার অনেক কথাবার্তা ছড়িয়ে রেখে গেছে। ঐ যে বিখ্যাত লাইন— পাখি উড়ে চলে গেলেও পাখির পালক পড়ে থাকে।
আমি আমার নিজের ভুলের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখার জন্যে তোমাকে চিঠি লিখতে বসি নি। তোমার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করছি না। সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাটা আমার কাছে সব সময় খুব অরুচিকর মনে হয়েছে। তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাদেরকে নিয়ে আমি যখন গভীর জলে পড়ে গেলাম তখন অনেকেই সহানুভূতি দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন। রাগে আমার এখন গা জ্বলতো। এখনো জ্বলে। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই করব। তার জন্যে তোমাদের কাছে কখনো মাল না। এবং আমি আশা করব যে আমি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এই ভেবে তোমরা আমাকে সহানুভূতি দেখতে আসবে না।